০১
“দুররর! এইডা কিসু হইল?” খেঁকিয়ে উঠে মাহমুদ। “আমি এইসব পারমু না। অন্য কাওরে ধর।”
“তুই-ই পারবি দোস্ত,” উৎসাহ দেয় শিশির, “তুই না পারলে আর কেউ পারবো না।”
“এহ!” ভ্রু কোঁচকায় মাহমুদ। “এমনভাবে কইলি যেন আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হ্যাকার! শোন মামা, আমার চেয়ে বস বস হ্যাকার বাংলাদেশে পইড়া রইছে। কেউই কোন সময় এইগুলা নিয়া চিন্তাও করেনা। আর আমি তো এই রাস্তায় বাচ্চা। আমারে দিয়া এই কাম হইব না।”
“মাইর খাবি।” এবার চেতে উঠে শিশির। “গত তিন বছর ধইরা কি শিখলি তাইলে? ঘোড়ার আন্ডা?”
একথা শুনে মুখ বাঁকায় মাহমুদ। তবে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে আছে ও। সেটা বাইরে প্রকাশ হতে দিচ্ছে না।
ওরা বসে আছে একটা সাততলা বিল্ডিংয়ের ছাদে। টপ ফ্লোরে থাকে দুজন। রুমমেট ওরা। দুইজন একই ভার্সিটির ছাত্র। মাহমুদ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, শিশির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। গত তিন বছর ধরে একই রুমেই আছে দুজনে। দুজনের মধ্যে তাই বন্ধুত্বের টানটাও একটু বেশীই।
কথা হচ্ছিল একটা কাজ নিয়ে। শিশির একটা প্ল্যান করেছে। দেশের একটা বড় ব্যাংকের ওয়েবসাইট হ্যাক করতে চাচ্ছে ও। অন্যকোন কারনে নয়। শুধু সিষ্টেমে কতগুলো বাগ (প্রোগ্রামের ফাঁকফোকর) আছে এটা পরীক্ষা করার জন্য। সেইসাথে সিস্টেমের সিকিউরিটির ক্ষমতাও চেক করে দেখা। কাজটা যেমন কঠিন, তেমনই বিরক্তিকরও বটে। কিন্তু প্রোগ্রামারদের কাছে এসবই ডালভাত। আর ওরা দুজনই খুব ভাল প্রোগ্রামার।
প্রত্যেকটা বড় বড় কোম্পানী সবসময় চায় তাদের সিষ্টেম পারফেক্ট করতে। সেজন্য তারা দক্ষ প্রোগ্রামারদের খুঁজে বের করে এবং তাদের দ্বারা নিজেদের সিষ্টেমে শক্ত সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে। যাতে অবাঞ্ছিত কেউ তাদের সিষ্টেমকে গুড়িয়ে দিতে না পারে। তবুও যে তাদের সিষ্টেমের সিকিউরিটি সবসময় পারফেক্ট হয়, তা নয়। আসলে সব সিষ্টেমেই কিছু না কিছু খুঁত থাকে যেটাকে টেকনিক্যালি ভালনেরাবিলিটি (Vulnerability) বা সহজভাবে বাগ বলে। প্রফেশনাল সাইবার অপরাধীরা প্রায়ই এসব খুঁত খুঁজে বের করে সিষ্টেমের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে কেটে পড়ে। যার ফলে এসব কোম্পানীকে প্রায়ই লস গুনতে হয়।
এসব সাইবার অপরাধীকে ঠেকানোর জন্য প্রত্যেকটা কোম্পানীরই নিজস্ব কিছু প্রোগ্রামার থাকে। তাছাড়া আরো কিছু ফ্রিল্যান্সার প্রোগ্রামার তাদের সাহায্য করে তাদের সিষ্টেমকে যতটা সম্ভব নিখুঁত করতে। এসব ফ্রিল্যান্সার প্রোগ্রামারদের কাজ হচ্ছে প্রথমে এসব সিষ্টেমে চুরি করে ঢুকে পড়া, তারপর সিষ্টেমের যে খুঁতের জন্য তারা কাজটি করতে পেরেছে, তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্টানকে জানানো। এর বিনিময়ে তাদেরকে মোটা অংকের সম্মানী দেয়া হয়। শিশির এমনই একটা কাজের জন্য মাহমুদকে উদ্বুদ্ধ করছিল এতক্ষণ ধরে।
“কিন্তু মামা,” কিছুক্ষণ চিন্তার পর মুখ খুলে মাহমুদ, “কাজ শেষ করার আগে যদি ধরা খাই, তাইলে তো কাহিনী খতম। সাইবার ক্রাইম, পুরা চৌদ্দ বছরের লাইগা আটকাইয়া দিবো। লাইফ আর লাইফ থাকবো না কিন্তু।”
“আরে দুরর,” আবার উৎসাহ দেয় শিশির, “তুই হুদাই ভয় পাস মামা। কিচ্ছু হইবো না। দুইজনে মিলা সব সাইজ কইরা ফালামু। আমরা কি কারো চাইতে কম নাকি?”
শিশিরের কথায় উৎসাহিত হয় মাহমুদ। মুখে হাসি ফুটে উঠে ওর। তারপর বলে, “ঠিক আছে। আমি রাজি। কবে থেইকা শুরু করবি ভাবছোস?”
“উমম,” একটু ভেবে জবাব দেয় শিশির, “আগামী দশদিন তো কোন কাজ নাই। সেমিষ্টার ফাইনাল শেষ। চল, কালকে থেকেই ঘাটাঘাটি শুরু করি। কি বলিস?”
“হুম, ভাল হয়,” একমত হয় মাহমুদ, “কয়েকটা সাব-প্রোগ্রাম দরকার। ডাউনলোড দিতে হইবো, আর না পাইলে বানাইতে হইবো। একটা ব্রিচ লাগবো। বাগ খুইজা বাইর করতে হইবো আর, আর! উমম, ঠিক আছে মামা। ডান।”
খুশী হয়ে উঠে শিশির। পকেট থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেটটা বের করে তা থেকে নিজে একটা শলা ঠোঁটে ঝুলিয়ে আর একটা একটা এগিয়ে দেয় মাহমুদের দিকে। “আয় মামা, বিড়ি টানি।”
সানন্দে হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা গ্রহন করে মাহমুদ।
০২
কাজটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিল, তা মোটেও না। এসব কাজে একশ একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। তা ওরা ভাল করেই জানে। কিন্তু এটাতে যেন ঝামেলা আরো বেশী। গত দশদিন বলতে গেলে শুধু সিষ্টেমের বেসিক ইনফরমেশন জোগার করতে কেটে গেছে। মেজাজ যা খারাপ হবার, তা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে ওদের।
“ধ্যাত,” বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠে মাহমুদ। “এইডা কেমন সিষ্টেম বানাইছে শালারা! পুরাই গ্যাঞ্জাম দেখতেছি। এইভাবে তো দুই বছরেও কাজ শেষ হইবো না।”
একই জিনিস ভাবছে শিশির। সিষ্টেমটা আসলেই বেশী জটিল। অবশ্য একটা ব্যাঙ্কের সিষ্টেমের সিকিউরিটি বেশী হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও কেন যেন মানতে পারছে না ওরা।
গত দশদিনে পুরো সিষ্টেমের নাড়ী-নক্ষত্র মোটামুটি বের করে ফেলেছে ওরা। তিনজন মাত্র প্রোগ্রামার মিলে সিষ্টেমটা তৈরী করেছে। সিষ্টেমের সিকিউরিটির পুরো দায়িত্ব তাদের ঘাড়ে। পুরো সিষ্টেমের পাসওয়ার্ড তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না। এমন কি ব্যাঙ্কের মালিকও নয়। আর পাসওয়ার্ডও বেশ জটিল। আটাত্তর ডিজিটের। ইংরেজী বর্ণমালার ছাব্বিশটি বর্ণ আর দশটি নাম্বারের সমন্বয়ে তৈরী পাসওয়ার্ডটি ব্রেক করা সাধারন কোন কাজ নয়। কয়েক কোটি কম্বিনেশন হতে পারে। তাছাড়া আরো জটিল একটা সিকিউরিটি লেয়ার তৈরী করে রেখেছে তারা। যদি কেউ কখনো পাসওয়ার্ড ব্রেক করার চেষ্টা করে, তাহলে সাথে সাথে হ্যাং হয়ে যাবে তার কম্পিউটার। যার ফলে কাজটা আরো অনেক কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে।
“দোস্ত,” যতটা সম্ভব শান্ত রয়েছে শিশির, “সিষ্টেমের সাথে মানানসই কয়েকটা সাবপ্রোগ্রাম বানাইতে হবে রে।”
“যেমন?” ভ্রু কোঁচকে জিজ্ঞেস করে মাহবুব।
“দেখ,” বিষয়টা ব্যাখ্যা করে শিশির, “আমাদের প্রথম সমস্যা পাসওয়ার্ড। আটাত্তর ডিজিটের পাসওয়ার্ড ব্রেক করা অনেক কঠিন। আর তাছাড়া, পাসওয়ার্ড ব্রেক করতে গেলেই পিসি হ্যাং মারবো। তাহলে এমন একটা সাবপ্রোগ্রাম বানাইতে হবে, যেটা পাসওয়ার্ড ব্রেক করবে না, পাসওয়ার্ড আইডেন্টিফাইড করবে। আর, আরেকটা সাবপ্রোগ্রাম বানাতে হবে, যেটা ওদের সাবপ্রোগ্রামের মতো প্রায় একইরকম কাজ করবে। মানে, যখন আমরা ওদের সিষ্টেমে ঢুকবো, তখন অন্য কেউ যদি নতুন করে ঢোকার চেষ্টা করে, তবে ইরর দেখাবে অথবা দেখাবে পেইজ আন্ডারকন্সট্রাকশন। মানে বুঝলি?”
ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠে মাহমুদের মুখে। “মানে ওরা নিজেরাই হ্যাং হইয়া যাইবো?”
“হুম,” হেসে উঠে শিশিরও, “ঠিক। তাছাড়া আরো কয়েকটা বানাতে হবে। প্রথমেই কয়েকটা বড় বড় ব্রাঞ্চের ফাইল পুরোটা ডাউনলোড মারতে হবে। সেগুলো ইচ্ছেমতো এডিট করার মতো একটা আউটডোর বানাতে হবে। আর, নিজেদের আইপি এড্রেস লুকানোর জন্য লাগবে একটা প্রোগ্রাম। বুঝলি?”
“আইপি এড্রেস লুকানো কোন ব্যাপারই না,” হেসে জবাব দেয় মাহমুদ, “টর নাই তো কি হইছে? আরো কতগুলা সফটওয়ার আছে! হে হে হে।”
“তাহলে আর দেরী না করে চল লাইগা পড়ি।” আগের চেয়ে আরো খুশী দেখায় বলে শিশিরকে।
০৩
পুরো চারটা মাস লাগে ওদের কাঙ্ক্ষিত প্রোগ্রাম আর সাব-প্রোগ্রামগুলো তৈরী করতে। এতো দেরী হওয়ার কারনও আছে। ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি সিষ্টেম সম্পর্কে আরো জানতে হয়েছে ওদের। সেগুলো পর্যালোচনা করে সেইমাফিক সাব-প্রোগ্রামগুলো বানাতে হয়েছে। নতুন সাব-প্রোগ্রামগুলোর বাগ ঠিক করতে হয়েছে। সেগুলোর সিকিউরিটির জন্য আরো কিছু ব্যবস্থা গ্রহন করতে হয়েছে। সব শেষে ওরা আজ তৈরী।
কম্পিউটার টেবিলটার সামনে রাখা দুটো চেয়ারে বসে আছে দুই বন্ধু। বুকের ভেতর কেউ যেন ঢোল পেটাচ্ছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। আসলেই কি পারবে ওরা? নাকি ব্যর্থ হবে?
কাজ শুরু করলো ওরা। সামনে দুটো মনিটর রাখা। একটা ল্যাপটপও আছে। সবগুলো একসাথে কানেক্ট করেছে ওরা। মাহমুদ সাব-প্রোগ্রামগুলো একটা একটা করে ব্যাঙ্কের সিষ্টেমের সাথে জোড়া লাগাচ্ছে। একটু পরই ওদের আসল কাজ শুরু হবে।
সিষ্টেমের পাসওয়ার্ড পেতে দেরী হলো না। নিজেদের তৈরী সাব-প্রোগ্রামের সাহায্যে সহজেই পাসওয়ার্ড আইডেন্টিফাই করে ফেলল ওরা। তারপর পাসওয়ার্ড দিয়ে হাসতে হাসতে প্রোগ্রামের ভেতর প্রবেশ করলো। ব্যাংকটার নির্দিষ্ট কিছু ব্রাঞ্চ আগেই টার্গেট করে রেখেছিল ওরা। ঝটপট সেখান থেকে গ্রাহকদের একাউন্ট নাম্বার, তাদের একাউন্টে থাকা টাকার পরিমান ইত্যাদি তথ্য ডাউনলোড করতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঁচটা ব্রাঞ্চের তথ্যগুলো ডাউনলোড করা শেষ হয়ে গেলো। এজন্য অবশ্য শুধু মাহমুদকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারন ও সাব-প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে একটা বিশেষ কমান্ড যুক্ত করে দিয়েছিল। আর তা হলো, যাদের একাউন্টে পঞ্চাশ লাখের উপরে টাকা আছে, শুধু তাদের লিষ্ট আসবে।
কাজ আপাতত শেষ। তাই ওরা অফলাইন হয়ে যায় সাথে সাথে। লিষ্টটা প্রিন্ট করে খুলে নিয়ে বসে এককোণে। দুজনের মুখেই হাসি। মাহমুদ অবশ্য একটু বেশীই খুশি।
“দোস্ত”, মাহমুদ বলে উঠে, “সত্যিই কাজটা কইরা ফেললাম দেখি।”
“হুম, তবে” জবাব দেয় শিশির, “কাজ শেষ হয়নি এখনো। আরো কিছু কাজ বাকি আছে। এখন লিষ্টের মধ্যে থেকে গ্রাহকদের একজনের একাউন্টের টাকা আরেকজনের একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেখতে হবে কি হয়।”
“আরে,” একটু জোড়েই বলে উঠে মাহমুদ, “এইডা কোন ব্যাপারই না।” বলেই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসলো সে।
পরের দুদিন ওরা এসব কাজেই ব্যস্ত থাকে। লিষ্টের একজনের একাউন্ট থেকে কিছু পরিমান টাকা আরেকজনের একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেয়। এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট ওদের জন্য। একটা বিশেষ খেলা। আসলে এটা করে দেখতে চাইছে ব্যাঙ্কের ওরা ধরতে পারে কিনা। কিন্তু দুদিন পরেই ওরা আবিষ্কার করল, ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল কম্পিউটার বা এর প্রোগামাররা কিছুই ধরতে পারছে না। ওরা খুশিতে আত্নহারা হয়ে উঠল।
০৪
“দোস্ত, সেই একখান কাম করলাম, কি কস?” সমর্থনের আশায় শিশিরের দিকে তাকায় মাহমুদ।
“হুম,” জবাব দেয় শিশির, “শালারা ধরতেই পারে নাই। এবার দোস্ত আসল কাজ শুরু।”
“ঠিক কইছিস।” মাথা দোলায় মাহমুদ, “বিষয়টা ওগো জানাইতে হইবো। ওদের সিষ্টেমে একটা সমস্যা আছে, এইটা শুইনা তো ওরা টাসকি খাইবো। হে হে হে।।”
এবার মাথা দোলায় শিশির। তবে একারনে নয় যে ব্যাঙ্কের লোকেরা টাসকি খাবে। বরং একারনে যে ওর পরিকল্পনা সফল হয়েছে। হ্যাঁ, ঠিকঠাকমতো নিজের পরিকল্পনা সাজাতে পেরেছিল ও। যার ফলস্বরুপ সাব-প্রোগ্রামগুলো তৈরী হয়েছে। এটা আসলে ব্যাংককে তাদের বাগ ডিটেক্ট করার প্রজেক্ট ছিল না, ছিল মাহমুদের সাহায্যে সাব-প্রোগ্রামগুলো তৈরী করা এবং তা কেমন কাজ করে তা পরখ করে দেখা। ওদের কাজে ওরা শতভাগ সফল বলা চলে। এরপর থেকে শিশির শুরু করবে ক্র্যাকিং।
সাধারন ভাষায় হ্যাকিং বলতে আমরা বুঝি কোন সিষ্টেমে ঢুকে তার সব সিকিউরিটি চুরমার করে দিয়ে নিজের মনের মতো তথ্য চুরি করা। কিন্তু টেকনিক্যালি এটাকে ক্র্যাকিং বলে। মজার কথা হলো, টেকনিক্যালি হ্যাকিং বলতে যা বোঝায় তা চুরি করা নয়, বরং চোরের হাত থেকে সিষ্টেমকে রক্ষার জন্য সিকিউরিটি তৈরী করা এবং নিয়মিত তার উন্নতি সাধন করা। আর এই কাজগুলো যে বা যারা করে, তাদের বলা হয় হ্যাকার। হ্যাকাররা সত্যিকার অর্থে প্রোগ্রামের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকে। অন্যদিকে যেসব প্রোগ্রামার ক্র্যাকিং তথা চুরি করে, তাদেরকে টেকনিক্যালি বলা হয় ক্র্যাকার।
“দোস্ত,” আজকে প্রচন্ড খুশী মাহমুদ, “দোস্ত, আমার সেই লাগতেছে রে দোস্ত। কি কামডা করলাম! মনে হয় খুশীর চোটে ডান্স দেই। ঐ লুঙ্গি ডান্স লুঙ্গি ডান্স লুঙ্গি ডান্স।” বলেই লাফালাফি শুরু করে সে।
মাহমুদের কাজকারবার দেখে না হেসে পারে না শিশির। সত্যি, ছেলেটা এখনো যেন বাচ্চা রয়ে গেছে। মাথা নেড়ে সেও উৎসাহ দেয়া শুরু করে দেয়। একটু পর উৎসাহিত মাহমুদ তার “লুঙ্গি ডান্স” বাদ দিয়ে শিশিরের পাশে এসে বসে হাপাতে থাকে। ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে।
“দোস্ত,” মাহমুদ হাত বাড়ায় শিশিরের দিকে “ প্যাকেটটা এদিকে দে তো। একটা বিড়ি ধরাই।”
শিশির পাশ থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয় মাহমুদকে। মাহমুদ প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলে, “দুরর, একটাই আছে মাত্র!”
“তুই টান,” শিশির বলে উঠল, “আমি পরে বাইরে থেকে নিয়ে আসবো গিয়া।”
“দাড়া,” উঠে দাড়ায় মাহমুদ, “আমার ব্যাগে একটা থাকার কথা। দেখি আছে কি না। দুই বন্ধু একসাথে বিড়ি টানমু আজকে।”
উঠে ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে শিশিরের দিকে এগিয়ে দেয় মাহমুদ। তারপর আগুন জ্বালিয়ে নিজের সিগারেটটা মনের সুখে টানতে শুরু করে। কিন্তু পরক্ষনেই মুখ খানিকটা কালো করে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে ও, “মামা, এইডা কি? ভিতরে মাল ভরছোস নাকি?”
“এহহে,” জিব কাটে শিশির, “সরি দোস্ত, মনে ছিল না। দে আমারে, তুই এইটা টান।”
“আরে দুররররর,” হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভাব করে মাহমুদ। “আইজ সব চলবো।” এই বলে জোরসে টান দেয় সিগারেটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়ায় ভরে যায় রুম।
শিশিরও সিগারেট টেনে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ওর ভেতরে ঝড় চলছে। ওর বুঝতে বাকি নেই মাহমুদকে সিগারেটটা ধরেছে। বেশভাল মতোই ধরেছে। আর মাত্র কিছুক্ষণ। মাত্র কিছুক্ষণ!
হঠাত করেই চোখ মুখ লাল হয়ে যায় মাহমুদের। শিশিরের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় ও। অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে শব্দগুলো বের করে ও। “মামা, এইডা ক-কি?”
“সিগারেট!” শান্ত কন্ঠে জবাব দেয় শিশির। “তুই তো জানিসই, আপেলের বীচিতে একপ্রকার বিষ থাকে। সায়ানোজেনিক গ্লাইকোসাইড। একেকটা বীচিতে খুবই কম পরিমানে থাকে যদিও। তাই তোর হাতের সিগারেটের ভেতরে মাত্র আটত্রিশটা শুকনা বীচি গুড়া করে ভরে দিছি। বেশী সময় লাগবে না তোর মরতে। মাত্র দুই থেকে তিনঘন্টার মধ্যে টক্সিন পুরোপুরি মিলিয়ে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না কিভাবে মরলি তুই।”
এবার দৃষ্টিটা আরো বিস্ফোরিত হয়ে যায় মাহমুদের। কিছুক্ষণ পরই বিছানার উপর ওর শরীরটা এলিয়ে পড়ে।
এটা দেখে হেসে উঠে শিশির। মনের সুখে হাতের সিগারেটে জোড়ে টানতে থাকে। কয়েকটা টানেই শেষ হয়ে যায় সিগারেটটা। এবার মাহমুদের দিকে ভালভাবে তাকায় ও। মুখ বাঁকা করে বিছানার উপর পড়ে আছে ছেলেটা। কিছুটা মায়া লাগছে শিশিরের। কিন্তু এখন মায়া লাগলে চলবে না। মায়ার দিন শেষ। সামনে অনেক কাজ বাকি। লাশটাকে সরাতে হবে। বাইরে কোথায় নিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। উঠে দাঁড়ায় শিশির। হাতের কাজটা সমাপ্ত করতে হবে ওকে।
হঠাতই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে শিশিরের। কি হলো? একটু পরই অবর্ণনীয় কষ্টে মুখটা কুঁচকে যায় ওর। দ্রুত মাহমুদের দিকে তাকায় ও। মাহমুদের কষ্টে বাঁকানো মুখের মধ্যে কি একটু বিদ্রুপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।