Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শুভ

১০ বছর আগে লিখেছেন

শুধু তোমারই জন্য

১.

শপিং মলে ঢুকলে আমি প্রথমে খাবারের দোকানের দিকে যাই। খাওয়ার ব্যাপারে আমি ছোটবেলা থেকেই একটু বিলাসী। আম্মু আমাকে রাক্ষস বলত কারন ভাল খাবার সামনে পেলে আমার নাকি হুঁশ থাকেনা। তবে সুখের কথা হল আমাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে আমি এতটা ভোজনবিলাসী।

রেস্টুরেন্টটা ভালই সাজানো গোছানো। একটা খালি টেবিলে বসে গেলাম। রেস্টুরেন্টটা ৪তলায়। টেবিলটাও জানালার কাছে। বাইরের দিকে তাকালাম। আকাশটা মেঘলা। যেকোনো সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। কফি আর পেস্ট্রির অর্ডার দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। পুরনো কথাগুলো আজ খুব বেশী মনে পরছে।

আমি রাহাত। বর্তমান বাংলাদেশের সবচে সফল ব্যবসায়িদের একজন। প্রায় শুন্য থেকে শুরু করেছিলাম আমি। ৭ বছরে আমার টোটাল এসেট প্রায় ১০০ কোটি টাকা। খুব একটা ভাল ছাত্র আমি কখনই ছিলাম না। গ্র্যাজুয়েশনের পর পারি জমাই ফ্রান্সে। ৭ বছরের কঠোর পরিশ্রম তারপর ভাল পরিমাণ টাকা জমিয়ে দেশে ফিরে আসি। এখানে এসে শুরু করি ব্যাবসা। বাকিটা কঠোর পরিশ্রম আর ভাগ্যের মিশেল। ছোট বোনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। ব্যবসা সব রিটায়ারমেন্টের পর থেকে বাবাই বেশী দেখেন। আমি এমনিতে ব্যবসার দিকে নজর দিলেও ঘোরাঘুরিই বেশী করি। এখানে আসা মূলত ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করতে। নতুন একটা প্রজেক্ট হাতে এসেছে। এটা কমপ্লিট হলে লম্বা একটা ছুটি নেবো আমি।

রিংটোনের শব্দে ভাবনায় ছেদ পরল আমার। মোবাইলটা বের করে sms চেক করলাম। বিল শোধ করে বেরিয়ে এলাম বাইরে। শপিংমলের দোতলায় অনেকগুলো কাপড় আর বাচ্চাদের খেলনার দোকান। তেমনি একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। বোনের বাসায় যাব আজ ভাগ্নিটার জন্য কিছু কিনতে হবে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বৃষ্টিটাও কমুক। একটা টেডিবিয়ার নিলাম সেলফ থেকে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাক দিল, "রাহাত! রাহাত না তুই?"

ঘুরে না দাঁড়ালেও আমি বুঝেছি কে ডাকছে। এই কণ্ঠ ভোলা আমার পক্ষে জন্ম জন্মান্তরেও সম্ভব নয়। ফিরে জবাব দিলাম, “কেমন আছিস মীরা?”

-“চিনতে পেরেছিস আমাকে? অবাক ব্যাপার তোকে অনেকদিন পর দেখলাম। আমি তো ভাবলাম চিনতেই পারবি না। কেমন আছিস?”

-“এইতো ভালই আছি।”

-“হ্যাঁ! তুই তো ভালই থাকবি। কোটিপতি হয়ে গেছিস।”

-“আমাকে দেখে কি কোটিপতি মনে হয়?”

-“না। তোর চেহারা গত পনের বছরে খুব একটা বদলায় নাই।”

মীরার পাশে হঠাৎ ফুটফুটে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল ন দশ বছর হবে বয়স। নাকোনাকো গলায় মীরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আম্মু এটা কে?”

মীরা হেসে জবাব দিল, “এটা তোমার আঙ্কেল হয় মামনি।”

আমি হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েটাকে কাছে টেনে নিলাম। “নাম কি তোমার মা?”

-“আমার নাম নিধি।”

-“নিধি মানে কি গো মা?”

-“জানিনাতো।” নিধি অসহায় চোখে তার মার দিকে তাকাল। মীরা হেসে ফেললো।

-“ওর বাবা নাম রেখেছে।”

-“হুম। চল কোথাও বসি।”
-“হ্যাঁ! চল।”

আগের রেস্টুরেন্টটাতেই আবার বসলাম আমরা। নিধির দিকে চোখ মটকালাম আমি, “কি খাবে গো মা?”

-“আইসক্রিম।”

“এক্সকিউজ মি!” একটু দূরে থাকা সাদা পোষাকের ওয়েটারে দৃষ্টিআকর্ষণ করলাম আমি, “ওয়েটার!”

নিধির জন্য আইসক্রিম আর আমাদের দুজনের জন্য কোল্ডকফির অর্ডার দিলাম। মীরা বলল, “তোর এখনো মনে আছে, কোল্ড কফি আমার পছন্দ?”

-“থাকবেনা কেন?”

-“না থাকারই তো কথা। এতদিন পর............”

-“মানুষ বদলায় না মীরা। তুই কি বদলেছিস? তারপর বল তোর কি খবর?”

-“ভালই আছি। সংসার নিয়ে আছি। হাসব্যান্ড ব্যস্ত মানুষ। টাকা প্রচুর ইনকাম করে বাট আমার আর নিধির জন্য সময় বের করতে পারে না। তাই অবসর সময়ে আমার একটা গাড়ি আছে ওটাতে করে নিধিকে নিয়ে ঢাকা শহর চষে বেড়াই। তোর কি খবর? বিয়ে তো করেছিস নিশ্চয়ই। বাচ্চা কাচ্চা কয়টা?”

-“হ্যাঁ! করেছি তো। তোকে।”

-“দেখ ফাজলামি ছাড়। ওটা তোর অল্প বয়সের ক্রাশ ছিল। তুই বলেছিলি ওটা একটা ফান ছিল। আর তুই আমাকে তখন হেট করতি। মনে নেই। এখন তোর বয়স কত?”

-“জানিনা ৩৬/৩৭ হবে।”

-“এখনো বিয়ে করিস নি কেন?”

-“ইচ্ছে হয়নি। আর এখন বয়সও নেই।”

-“হুম। চুলও তো পেকেছে অনেক দেখছি। এত বড় রেখেছিস কেন? দাড়ি এমন নেশাখোরদের মত খোচাখোচা কেন? কতদিন হয়েছে শেভ করিস না?”

-“এক দেড় মাস।”

-“থাকিস কিভাবে জংলী কোথাকার? আজই শেভ করবি। চুলও কাটাবি। আমার একটা ননদ আছে যা সুইট দেখতে! তুই একবার দেখলেই প্রেমে পরে যাবি। মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভাল জব করে। ওর সাথে তোর লাইন লাগিয়ে দেব।”

-“ধ্যাত! এই বয়সে আর বিয়ে করব না।”

-“হুম। বললেই হল। এই নে আমার নাম্বারটা রাখ।”

-“হুম।”

ওর নাম্বারটা আমার ফোনে সেভ করে রেখেওর দিকে তাকালাম আমি। ওর বোধহয় কোন মেসেজ এসেছে। একপলক হাতের মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে তারপর বলল, “শোন এখন যাই। বাসায় একটু কাজ আছে।”

-“ঠিক আছে যা তাহলে। বাই। বাই মা।”

-“আঙ্কেলকে বাই বল নিধি।”

নিধি আর মীরা হাত নাড়তে নাড়তে চলে যাচ্ছে। মীরা যদি আজ আমার হত তাহলে কি আমারও নিধির মত একটা মেয়ে থাকত? নাকি ছেলে? আচ্ছা মেয়ে হলে কি আমিও নাম রাখতাম নিধি? না মনে হয় আমার পছন্দের নাম মেঘ। মেয়ে হলে মেঘবতী ছেলে হলে মেঘনাদ। ডাক নাম দুটোতেই এক। মেঘ।

আমি আকাশের দিকে তাকালাম। বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা। মেঘ। জলভরা ঘনকাল মেঘ।

এখন যাওয়া যায়। অনেক দূর যেতে হবে। পকেটে হাত দিয়ে আমি গাড়ির চাবিটা স্পর্শ করলাম।


আমি মীরা

শপিংমলে ঢুকতেই নিধি বলে উঠল, “আম্মু, আমাকে কিন্তু আজকে একটা টেডী বিয়ার কিনে দিতেই হবে।”

“অবশ্যই দেব মা।” আমি স্নেহভরে বলে উঠলাম। “আমার মা একটা টেডী বিয়ার চায়, আর আমি কিনে দেব না? চল, এখনই কিনে দিচ্ছি।”

নিধি। আমার একমাত্র মেয়ে। আমার দুনিয়া। অনেক ভালবাসি ওকে আমি। ও যা চাইবে, তাই ওকে দিতে পারি আমি। ওকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুদুর পরেই পুতুলের দোকান।

শপিংমলে এলেই নিজেকে কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। মনে হয়, কলেজ জীবনে ফিরে গেছি আমি। সবসময়ই এটা হয়। দেখা গেছে প্রায়ই এমন হয় যে, অল্পকিছু কিনতে এসেছি, অথচ অনেককিছু কিনে ফিরে গেছি। আসলে শপিংয়ে এলে কেমন যেন বদলে যাই আমি। যা কিছু চোখের সামনে পড়ে, কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে।

শপিংমলের দোতলায় অনেকগুলো কাপড় আর বাচ্চাদের খেলনার দোকান। নিধিকে নিয়ে তেমনি একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। দোকানের সামনে আরো একজন দাঁড়িয়ে আছে। খুব চেনা চেনা লাগছে।

রাহাত না? হ্যা, রাহাতই তো। ও এখানে কি করছে?

“-রাহাত!” ডাকলাম আমি। “রাহাত না তুই?”

ঘুরে দাড়াল মানুষটা। বলল –“কেমন আছিস মীরা?”

আমি তো অবাক। এতোদিন পরও ও আমাকে ঠিকই চিনেছে! আশ্চর্য!

রাহাতের সাথে আমি আর নিধি একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। আগের চেয়ে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি ওর। এ কথায় ও কথায় বিভিন্ন কিছু জানা গেল ওর সম্পর্কে। ও এখনো বিয়েই করেনি! আমার একটা ননদ আছে, দেখতে খুব সুন্দরী, ওকে তার কথা বললাম।
আমার সেল নাম্বার দিলাম ওকে।

এমন সময় আমার সেলফোনটা একটু কেঁপে উঠল। একটা টেক্সট মেসেজ এসেছে। সেলফোনটার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, “শোন এখন যাই। বাসায় একটু কাজ আছে।”

-“ঠিক আছে যা তাহলে। বাই।” তারপর নিধির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাই মা।”

আমি নিধিকে বললাম, “আঙ্কেলকে বাই বল নিধি।”

নিধিকে নিয়ে চলে এলাম আমি। তাড়াতাড়ি ওকে একটা টেডী বিয়ার কিনে দিয়ে বেড়িয়ে এলাম মল থেকে। রাস্তার একপাশে পার্ক করা লাল রঙয়ের গাড়িতে উঠে পড়লাম। নিধিকে পাশের সিটে বসিয়ে স্টার্ট দিলাম গাড়ি।

কিছুক্ষন ড্রাইভ করার পর একটা খালি জায়গা দেখে পার্ক করলাম গাড়িটা। সেলফোনটা বের করে মেসেজ চেক করলাম। একটা মাত্র শব্দ লেখা ওতে। “Sent”.

সন্তুষ্ট হয়ে ফোনটা ব্যগে ঢুকিয়ে রাখলাম আমি। তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। মাঝখানে কোথাও আর থামলাম না। ড্রাইভ করে একেবারে বাসার সামনে এসে থামলাম। তারপর দ্রুত গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আমার ঘরে চলে এলাম।

কাপড় পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানার উপর বসে ল্যাপটপটা হাতে নিলাম। নিধি ওর নতুন টেডি বিয়ারটা নিয়ে খেলছে। ওকে বললাম, “মামনি, হাতমুখ ধুওনি এখনো? যাও, হাত মুখ ধুয়ে এসো।”

নিধি চুপচাপ খেলতেই লাগল ওর টেডি বিয়ারটা নিয়ে। আমি আর কিছু বললাম না।
ল্যাপটপটা অন হতেই টর ওপেন করলাম আমি। তারপর আমার সিকিউরড মেইলে ঢুকলাম। নতুন একটা মেইল এসেছে। মেইলটা চেক করা দরকার। এটার কথাই বলা হয়েছে মেসেজে। ওপেন করলাম মেইলটা। অনেক বড় মেইল। একজনের পুরো বায়োডাটা থাকার কথা এতে।
কিন্তু এ কি? এর বায়োডাটা এখানে কেন?

ও, তাহলে এই ব্যাপার? ভাল লাগল। খুবই ভাল লাগল।

এমন সময় নিধি বলল, “আম্মু, ক্ষুধা পেয়েছে।”

-“এখনই খাবার দিচ্ছি মামনি। তুমি আর একটু খেলা কর। আমি খাবার গরম করছি।”

উঠে বসলাম আমি। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করতে লাগলাম। এদিকে আমার মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।


আমি রাহাত

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার একহপ্তার মাথায় আমার মীরার সাথে বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্ব স্থায়ী হয়নি। ইচ্ছায় না অনিচ্ছায় জানিনা ও আমাকে একবার খুব মীন একটা কথা বলে। আমার আত্মসম্মানে ঘা লাগে আমি ওর সাথে সবরকম কথাবার্তা বন্ধ করে দেই। ও অনেকবার সরি বলে কিন্তু আমি আমার অবস্থানে অটল থাকি। বেশ কয়েকবার আমার কাছে অপমানিত হবার পর মীরা হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি আমি আসলে ওর প্রেমে পড়ে গেছি।

লাজলজ্জার মাথা খেয়ে নিজের আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়ে আমি ওকে বলে বসলাম আমি তোকে ভালোবাসি। ও আমাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর বছর না ঘুরতেই সেই ছেলেটাকে ও বিয়ে করে বসে যে বছর দুএক আগে ওকে ছেড়ে গিয়েছিল। ওর প্রাক্তন প্রেমিক। আমি তখনও কিছুই বলতে পারিনি। কিইবা আমার বলার ছিল। অনার্স শেষ হতেই আমি পারি জমাই ফ্রান্সে।
জীবনটাই আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। পনের ষোল বছর আগের কথা অথচ মনে হয় এইতো সেদিন।

ব্যাঙ্কের ভল্টটা খুলতে পাসওয়ার্ড লাগে। মোবাইলটা বের করে কাঙ্খিত sms টা পরলাম। কিছুই লেখা নেই ওতে। শুধু কয়েকটা সংখ্যা। আর একটা নম্বর ৩১৬। এটা ভল্টের নম্বর। সংখ্যাটা পাসওয়ার্ড। দ্রুত হাতে ভল্টটা খুললাম। ভেতরে একটা পার্সেল। ওটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ব্যাঙ্ক থেকে। নিজের audi a6 sedan টাতে বসে খুলে ফেললাম সেটা। উপুর করতেই বেশ কয়েকটা বান্ডিল পড়ল কোলের ওপর। সব এক হাজার টাকার নোট। পঞ্চাশ লাখ থাকার কথা। ওগুলো নিয়ে মাথা ঘামালাম না। পারসেলের ভেতর থেকে আরও দুটো কাগজ বেরিয়েছে। একটাতে টার্গেটের সব রকম ডিটেইলস অন্যটা টার্গেটের ছবি।

ছবিটা দেখে চমকে উঠলাম। এটা কি করে হয়? এদের সাথে বসেই তো একটু আগে কফি খেলাম! মীরা আর নিধি! এদের খুন করার জন্য কে আমাকে ভাড়া করেছে? কাগজটা আবার পড়লাম। এদের মৃত্যু এমন ভাবে ঘটাতে হবে যেন মনে হয় দুর্ঘটনা। এসব কি? আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।

হ্যাঁ আমার আরও একটি পরিচয় আছে। আমি একজন পেশাদার খুনি। টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করি। ফ্রান্স যাবার পর আমি ফ্রেঞ্চ ফরেইন লিজিয়নে যোগ দেই। লেফটেন্যান্ট হবার পর আমাকে ওরা একটা গোপন এলিট ইউনিটে নিয়ে নেয়। আমি ছিলাম ওদের বেস্ট শট। আমরা ছিলাম মূলত এলিট ব্ল্যাক অপ্স টীম। গোপন মিশন পরিচালনা, গোয়েন্দাগিরি, গুপ্তচরবৃত্তি, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক হত্যা, টীম রেকনাইস্যান্স, গেরিলা যুদ্ধ, কমান্ডো অপারেশনের ওপর আমাকে বিশেষ ভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়। ওরা আমাকে বলত fantome বা প্রেত। আমার কাজ খুব নিখুঁত ছিল।

৫ বছর পর আমি ক্যাপ্টেন হিসাবে লিজিয়ন ত্যাগ করি। তারপর আমি বিভিন্ন দেশের জন্য মার্সেনারি হিসেবে অসংখ্য কাজ করেছি। ভাল কাজ নোংরা কাজ এরপর দেশে এসে ব্যাবসা শুরু করি। ফ্রান্সে আমি এই ৭/৮ বছর কি করেছি কেউ জানেনা। এটা পুরোপুরি গোপন।

কিন্তু সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। এই কাজ গুলো যা এক সময় ছিল আমার পেশা সেটা আমার নেশা হয়ে গেছে। এটা একটা মানসিক রোগ। এর নাম পোস্ট ট্রমা স্ট্রেস সিন্ড্রোম।এই রোগ হলে অষ্টপ্রহর রক্তে যুদ্ধের দামামা বাজে। তখনকার সেই থ্রিল আমি মিস করতে থাকি। তাই আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর জন্য ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কাজ করতে শুরু করি। তবে খুব কম। বছরে দুতিনটের বেশী না। আর শুধু তাদের কেই মারি যাদের পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

আজেবাজে আর সহজ কেস হলে আমি নেই না। রিস্কি আর টাফ কেসই আমার পছন্দ। ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ করি সিকিউর চ্যাটরুম আর আনট্রেসেবল নম্বর দিয়ে। আমি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার তাই আমার কাছে এগুলো ডালভাত। আমাকে সবাই চেনে আজরাইল নামে। এই গোপন পরিচয়টুকু বাদ দিলে আমি পুরোপুরি একজন ব্যাবসাদার। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন মাফিয়া গডফাদার, ড্রাগলর্ড, সন্ত্রাসী আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকজন গুপ্তচর আমার হাতে নরকদর্শন করেছে। আইন সাধারনত যাদের ছুতে পারেনা তাদের আপোষে সরিয়ে দেওয়াটাই আমার কাজ। এটাকে আমি একধরনের সমাজ সেবাও বলতে পারি। এটা আমার পেশা নয় নেশা।

অফিসে ঢুকে আমি বাইরে লালবাতি জ্বেলে দিলাম। এর মানে কেউ এখন ভেতরে ঢুকতে পারবে না। আমার সেক্রেটারিকে বললাম এক কাপ কফি পাঠাতে। বাবার রুম আমার রুমের পাশেই। বাবা মনে হয় নেই। লাঞ্চে গেছে। কফি আসলে আমি পার্সেলটা আবারও খুললাম।

এক সপ্তাহের ভেতর কাজ সারতে হবে। আজ ধানমণ্ডি যাব ওখানে আমার একটা ফ্ল্যাট আছে। যোগাযোগের সব ব্যবস্থা, সব অস্ত্র ওই বাড়িতেই আমি লুকিয়ে রাখি।

এজেন্টের নাম war। এছাড়াও আমার অনেক কন্ট্রাক্ট এজেন্ট আছে সারা বিশ্বে। এরা সবাই কোন না কোন দেশের গোয়েন্দা বিভাগের সাথে জড়িত। মজার ব্যাপার হচ্ছে এরা কেউ আমার সম্পর্কে কিছুই জানেনা। আজ বাংলাদেশের এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করব। সেই আমাকে এই কন্ট্রাক্টটা দিয়েছে।

-“হাই গোষ্ট।”

-“হ্যালো।”

-“পার্সেলটা পেয়েছ?”

-“হুম, পেয়েছি।”

-“কাজ শুরু করে দাও।”

-“তোমাকে বলেছি যে আমি মেয়ে আর বাচ্চাদের মারি না। এসব আমাকে কেন করতে বলছ?”

-“শোনো। এই লোকের টাকার কোন অভাব নেই। এটুকু কাজের জন্য ৫০ লাখ পাচ্ছ খারাপ কি?”

-“ I want details.”

-“ তোমার এই ক্লায়েন্টের একটা পরকীয়া প্রেম আছে। সেই মেয়ে তো প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোককে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। বাট ওর এই বউ এটা কখনোই মেনে নেবে না।”

-“ডিভোর্স দিলেই হয়।”

-“এই মক্কেলের সব প্রপার্টি তার বউয়ের নামে। বউকে তালাক দিলে একে পথে বসতে হবে। আর ওই মেয়ে একে ব্ল্যাকমেইল করছে।”

-“হুম। ওই লোক সেই মেয়েকে ছাড়বে না?”

-“না। তা ছাড়বে না। আমি তোমাকে বলেছি যে কাজটা করার জন্য কোন জোরাজুরি নেই। তুমি না করলে বল আমি অন্য কাউকে কাজটা দেই।”

-“না আমিই করব।”

-“ thanks dude.”

আমার মাথা খালি হয়ে গেছে। কাহিনী যে এদিকে মোড় নেবে, আমি তা ভাবতেই পারিনি। এখন কি করতে পারি আমি? কি করা উচিৎ?

মীরার সাথে দেখা করা দরকার। ও এম্নিতে দেখা করবে না। ওর ননদের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখানো যেতে পারে। আমি আমার মোবাইলটা তুলে নিলাম।


আমি মীরা

রাহাত আর আমি একইসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। কম্পিউটার সায়েন্সে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার একহপ্তার মাথায় রাহাতের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব স্থায়ী হয়নি। হঠাত করে ঠাট্টার ছলে ওকে আমি একবার খুব মীন একটা কথা বলি। বুঝতে পারি ওর আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে। তারপর ও আমার সাথে সবরকম কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়। আমি অনেকবার সরি বলেছি কিন্তু ও ওর অবস্থানে অটল থাকে। বেশ কয়েকবার ওর কাছে অপমানিত হবার পর আমি রাগ করে হাল ছেড়ে দেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি ও আসলে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। তারপর একদিন লাজলজ্জার মাথা খেয়ে নিজের আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়ে ও আমাকে বলে বসল “আমি তোকে ভালোবাসি।”

আমি ওকে সেদিন ফিরিয়ে দেই। কেন দেব না? আমি কি কম অপমানিত হয়েছি ওর কাছে? ওর উপর রাগ করে বছর না ঘুরতেই সেই ছেলেটাকে আমি বিয়ে করে বসি যে বছর দুএক আগে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। আমার প্রাক্তন প্রেমিক। ও তখনও কিছুই বলতে পারেনি।

কিই বা বলবে ও? কিন্তু কিছুদিন পরই আমি বুঝতে পারি, আমিও ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। কোন মুখে ওর সামনে গিয়ে দাড়াব আমি?

পাশ করার পরই ও দেশের বাইরে চলে গেল। তারপর এত বছরে আর দেখা হয়নি। অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলাম ওকে। নিজের কাজে ডুবে গেছিলাম আসলে। তারপর এতো বছর পর আবার দেখা হলো ওর সাথে। একইসঙ্গে এই মেইল। কিছুটা দৈবসংযোগ নাকি? হতে পারে।

খাবার গরম করা হয়ে গেছে। আমি নিধিকে ডেকে এনে একত্রে খেতে বসলাম ওর সাথে। আর ভাবতে লাগলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাহাতের সাথে আবার দেখা করা প্রয়োজন আমার।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। তখনই আমার সেলফোনটা বেজে ওঠল। রিসিভ করে বললাম, “হ্যালো। কে বলছেন?”

-“রাহাত।”

-“ও তুই। আমি তো ভেবেছিলাম আর যোগাযোগই করবি না।”

-“ইয়ে মানে... সেদিন তোর ননদের কথা বলছিলি।”

-“ও এই ব্যাপার! আমি ভাবলাম আমার সাথে কথা বলতেই বোধহয়।”

-“তোর সাথেই তো বলব। আম্মু খুব ঘ্যানঘ্যান করছে।”

-“বুড়ো ছেলে ঘরে বসে থাকবি কি করবে আর? তোকে তো পেটানো উচিত।”

-“হুম তাহলে কাল দেখা করি।”

-“ঠিক আছে। কাল ফোন দিস। বিকালে।”

-“নিধি কে নিয়ে আসিস।” ফোন কেটে দিল ও।

আমি ব্যালকনিতেই কিছুক্ষন বসে থাকলাম। ভাবছি। আজ কি সবই দৈবসংযোগ হচ্ছে নাকি? কিছুক্ষন পর ঘরে ফিরে এলাম। নিধিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবার ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম।


আমি রাহাত

লেকের পাশেই রেস্টুরেন্ট। খাবার কেমন হবে আল্লাহই জানে। মীরার ননদ মিথিলা মাঝেমধ্যে আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন এই সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতাম না। কিন্তু আজ মাথার ভেতর হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মীরা আসর জমানোর চেষ্টা করছে। আমি ওকেই প্রশ্ন করলাম।

-“এই তোর হাসব্যান্ড যেন কি করে?”

-“তোকে বলেছিলাম না গার্মেন্টস, বায়িং হাউস আর ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট।”

-“হুম মালদার পার্টি। তোর স্বামীর অফিস কোথায়?”

-“উত্তরাতে। কেন?”

-“এমনি। ব্যবসা করি যদি কখনো প্রয়োজন হয়।”

আরো বেশ কিছুক্ষন এটা-সেটা নিয়ে কথা বললাম আমরা। বেশ ভালই কাটল সময়। অনেকদিন পর প্রাণখুলে কারো সাথে কথা বললাম। আমি বারবার মীরার দিকে তাকাচ্ছিলাম, আর মায়া লাগছিল ওর প্রতি। আর বারবার মাথায় একটা কথা ঘুরছিল, “মীরাকে মারা কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে আমাকে”।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর মীরা আর নিধিকে বিদায় দিয়ে আমি বেড়িয়ে পড়লাম।

পরের দিনগুলো কাটল প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে। বেশ কয়েকটা মিটিং। তারপর আবার মীরার হাসব্যান্ডের ওপর নজরদারি। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ। মীরাকে মারার কন্ট্রাক্টটাও আছে। ওটা ধরে রাখতেই হবে। নইলে ফিল্ডে আর কেউ নামলে বিপদে পরে যাবো। আমার মত পেশায় যারা আছে তাদের অসংখ্য সোর্স থাকে। ওর স্বামীর অবৈধ সম্পর্কটা আছে পার্সোনাল সেক্রেটারির সাথে। প্রায় ৪ বছর ধরে সে এই খেলাটা খেলছে। অফিসের স্টাফরা কেউ তেমন কিছু জানেনা।

মীরার স্বামীর একটা ফ্ল্যাট আছে বনানীতে, ওটাই ওদের প্রেমকুঞ্জ। প্রায়ই ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে যায় লোকটা। সাথে থাকে সেই সেক্রেটারি। মেয়েটা প্রচণ্ড উচ্চাবিলাসি। সে প্রথম থেকেই জানত যে লোকটা বিবাহিত। তারপরও সে কাহিনী চালিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটার আর একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। দুজনে ইচ্ছে করেই এই কাজটা করছে মীরার স্বামী আশফাক সাহেবের সম্পত্তির লোভে। প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা ভুয়া। আশফাক সেটা জানেন না। উনি মেয়েটার শরীরের নেশায় মত্ত। লোভ জিনিষটা খুব খারাপ। কারও লোভ টাকার প্রতি কারো নারীর প্রতি। কিন্তু সবাই ভুলে যায় যে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। লোভের দাম তাদের দিতেই হবে। আর এই লোক আজ না হোক কাল মীরার বা নিধির ক্ষতি করার চেষ্টা করবেই। ওদেরও নিরাপদ রাখতে হবে।

প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে মীরার স্বামীর একটা রিভলবার আছে। ওটাই আমার ট্রাম্প কার্ড। আমার প্ল্যানও কমপ্লিট। লোকটা প্রতি মঙ্গল আর বুধবারে মেয়েটার বাড়ি যায়। ওখানেই ঘটনা ঘটবে। এটাকে আত্মহত্যা হিসাবে চালিয়ে দেওয়াটা কোন ব্যাপারই না। মেয়েটার প্রেমিকের ব্যাপারেও খোঁজ খবর করা শেষ। ছোড়াটানেশাখোর। ওয়ারীর দিকে থাকে। এখন শুধু মঙ্গলবারটার জন্য অপেক্ষা।

অপেক্ষার প্রহরগুলো এত দীর্ঘ হয় কেন?

রাত প্রায় বারোটা। গাড়ির জানালা খুলে দিলাম আমি। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক জায়গাটা লং ড্রাইভের জন্য আদর্শ। এবার ছুটিটা কক্সবাজারে কাটাব। অনেকদিন হয়ে গেছে সমুদ্র দেখিনা। একটা ফোন এসেছে। না দেখেই বুঝেছি আমার এজেন্ট কোডনেম ওয়ারের কল এটা,

-“কোথায় তুমি?”

-“কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছি।”

-“ধুর! এদিকের খবর কিছু রাখো?”

-“কি হয়েছে?”

-“তোমার মক্কেল তো খুন হয়ে গেছে।”

-“কিভাবে?” গলায় নিখাদবিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

-“ওই যে রিলেশন ছিল যে মেয়েটার সাথে সেই মেয়েটার নাকি একটা ড্রাগ এডিক্টেড বয়ফ্রেন্ড ছিল। সে সব জানতে পারে। ওদের প্রেম করার সময় ওই ফ্ল্যাটে হানা দেয়। দুজনকেই গুলি করে। তোমার মক্কেল শেষ মুহূর্তে নিজের রিভল্বার দিয়ে ছেলেটাকে গুলি করে। ব্যস তিনজনই শেষ। পুলিশে এলাকা ভর্তি। তোমার টার্গেট মানে মক্কেলের ওয়াইফের কাছে খবর গেছে। মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছে। সরি ম্যান, তোমার কন্ট্রাক্টটা বাতিল হয়ে গেছে।”

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম একটা। তারপর গম্ভীরগলায় বললাম, “ইটস ওকে, মাহবুব সাহেব।”

আমার কথা শুনে যেন আঁতকে উঠল লোকটা। তুতলাতে লাগল, “তুত-তু-তুমি। তুমি কি বললে? তুমি আমার নাম কিভাবে জানো?”

মৃদু হাসি আমি। তারপর আবার গম্ভীর গলায় বলি, “সেটা আসল কথা না আপনি কে? আপনার পেশা কি? আপনার ঠিকানা সবই আমি জানি। শুনুন আমি আর এই পেশায় থাকতে চাইছি না। আর ভাল লাগছে না আমার এসব করতে। আপনিও আর মৃত্যুর দালালি করবেন না। আপনাকে তাহলে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। কি বলছি তাতো আশা করি ভাল করেই বুঝতে পারছেন?”

-“হ...হ্যা। কক...কিন্তু...............”

-“কোন কিন্তু নয়। যা বলেছি সেটাই। আপনি এই কন্ট্রাক্টটার পুরো টাকাটাই পেয়ে যাবেন। পুরো পঞ্চাশ লাখ। আমাদের ডীল এখানেই শেষ। আপনার সাথে ব্যবসা করে আরাম পেয়েছি। বিদায়।”

ফোনের সিমটা খুলে কামড়ে ভাঙলাম আমি। ফোনটা ছুড়ে দিলাম বাইরের দিকে। ব্রিজের ওপর এখন আমি। ভাঙ্গা সিমটাও একই দিকে গেল। ড্যাশবোর্ড থেকে আরেকটা মোবাইল
বের করলাম।

হ্যাঁ খুনগুলো আমিই করেছি। পুরনো ঢাকা থেকে প্রথমে মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডকে তুলেছি। ভাল পরিমাণ ড্রাগ দিয়ে ছেলেটাকে অচেতন করে নিয়ে এসেছি মেয়েটার বাসায়। মেয়েটার বাসার দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে বদমাশটাকে ছ’তলায় তুলতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। অচেতন ছেলেটাকে লুকিয়ে রেখে নিজেও লুকিয়ে ছিলাম।

আশফাক সাহেব আর তার ফিয়াসে ঘরে ঢোকবার পর বেরিয়ে আসি আমি। আমাকে দেখে লোকটা সত্যিকার অর্থেই হাঁ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম গুলিটা মেয়েটার মাথায় লাগে। আশফাক সাহেব রিভলবার বের করে ফেলেছিলেন কিন্তু বুকে একটা ছোট ফুটো তাকে রিভলবারটা ব্যাবহার করারকোন সুযোগ দিলনা। অচেতন নেশাখোরটাকে এনে জায়গা মত দাড় করিয়ে দিলাম। বদমাশটা টলছে। আশফাক সাহেবের রিভলবারটা দিয়ে গুলি করলাম।

আমার বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানো ছিল শব্দ হয়নি। কিন্তু রিভলবারের গুলি বন্ধ কামরায় বজ্রধ্বনি তুলল। এখনি লোকজন এসে পরবে। আমাকে দ্রুত বের হতে হবে এখান থেকে। আমার প্রতিটা শট অনেক হিসেব করা। কারো বেঁচে যাওয়ার সম্ভবনা নেই। হাতে গ্লাভস ছিল তাই ফিঙ্গারপ্রিন্টেরও ভয় নেই। আর আমার বন্দুকটা দেশে তৈরি। চোরাবাজার থেকে কেনা। কোন নম্বর নেই তাই ট্রেস করা সম্ভব না। মোট কথা ধরা পরার কোন ভয় নেই।

আমার পিস্তলটা নেশাখোরটার হাতে আগেই ধরিয়ে দিয়েছিলাম। দরজার নব টিপে টান দিতেই দরজা ভেতর থেকে আটকে গেল। সাবধানে বাসা থেকে বেড়িয়ে এলাম। পুরো এপার্টমেন্টে হইহল্লা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে। এই হইচইয়ের মধ্যে আমাকে কেউ লক্ষ করল না। ২ ব্লক দূরে গাড়িটা দাড় করিয়ে রেখেছি আমি।

মীরার জন্য নিধির জন্য খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু এটা আমাকে বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। এটা ওদের ভালর জন্যই করেছি আমি। মীরাকে আমি ১৬ বছর আগে যতটা ভালবাসতাম আজও ঠিক ততটাই ভালবাসি। আজীবন বাসব। কেউ যদি ওদের কোন ক্ষতি করার চিন্তাও করে তবে তাকে আগে আমার মুখোমুখি হতে হবে।

আজকের আকাশে চাঁদ নেই। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকালাম আমি। আমার জীবনটাও হয়ত অন্যরকম হতে পারত। অনেক সুন্দর হতে পারত। কিন্তু এই পথটা আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। জানিনা আরও কতদূর হাঁটতে হবে।


আমি মীরা

রাত্রি বারটা ছয় মিনিট। বসে আছি আমার বাসার ব্যালকনিতে। আমার স্বামীর লাশ এখনও মর্গে রয়েছে। পুলিশি তদন্তের জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই থানায় রয়েছে এখন। পুলিশদের সাথে আলোচনা করছে তারা। যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশটা এনে দাফন করা সম্ভব হয়।

হঠাতই আমার ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা যে করেছে, সে আমার কন্ট্রাক্ট এজেন্ট। কোডনেইম ওয়ার। ওপাশ থেকে একটা ভীত কন্ঠ শোনা গেল। “হ্যালো, হায়াবোসা?”

-“ইয়েস?”

-“সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

-“কি হয়েছে?”

-“ফ্যান্টম আমার আসল নাম জেনে গেছে।”

-“এতে এত অবাক হবার কি আছে? আপনার আসল নাম তো অনেকেই জানে।”

-“অ্যা? কি বলছেন এসব?”

-“ঠিকই বলছি মাহবুব সাহেব।”

-“আপনিও জানেন আমার আসল নাম?”

-“আপনি নিজের গলায় আপনার নামের সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখবেন, তাও যদি আপনার আসল নাম না জানি, তাহলে তো লোকে আমাকে হয় অন্ধ, না হয় অশিক্ষিত বলবে। তাই না?”

-“অ্যা?”

-“হ্যা। ঠিকই বলছি। যাইহোক। ফ্যান্টমকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। তার ব্যবস্থা আমি করেছি। আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবুন। ভাবুন যে, কিভাবে এখন লেজ তুলে পালানো যায়। রাখছি।”

এই কথা বলেই কলটা কেটে দিলাম আমি। ভেতর থেকে সিম বের করে বাথরুমে নিয়ে ফ্ল্যাশ করে দিলাম। তারপর সেলফোনটা আছড়িয়ে ভেঙ্গে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম।

নিধি ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। আমি ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এসে দাড়ালাম। বালিশের তলা থেকে যে সেলফোনটা সব সময় ব্যবহার করি, তা তুলে নিলাম। রাহাতের নাম্বারটা স্ক্রীনে নিয়ে এলাম। একবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত্রি বারটা বেজে সতের মিনিট। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।

আমি আসলে পেশায় একজন হ্যাকার। বলতে গেলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হ্যাকারদের একজন। কিন্তু সারা দুনিয়ার কেও তা জানতো না। সাইবার দুনিয়ায় আমার নাম হায়াবোসা। মানে বাজপাখি।

হঠাত করেই আমার স্বামী একদিন টের পেয়ে যায় আমার পরিচয়। তারপরই শুরু হয় আমার জীবনের যত যন্ত্রনা। ওর সব বিজনেস আমার নামে। আসলে আমার টাকাতেই হয়েছে সব। তার নামে সবকিছু লিখে দেইনি বলে আমার স্বামী প্রায় সময়ই আমার উপর নির্যাতন চালাত।

এর মধ্যেই আমি জানতে পারি যে, আমার স্বামীর আরো একজন ভাগীদার আছে। আমি যদি সব আমার স্বামীর নামে লিখে দেই, তবে তারপর থেকেই এই সংসারে আমি থাকতে পারবনা। তাই সবসময় তার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছি। যেদিন ও জানতে পারে, আমিই সে কুখ্যাত হ্যাকার, তারপর থেকেই আমার উপর নির্যাতনের পরিমান কয়েকগুন বেড়ে যায়। আমাকে ও হুমকি দেয়, যদি সব আমি ওর নামে লিখে না দেই, তবে আমার পরিচয় সারা দুনিয়ার সামনে ফাস করে দেবে ও। আমি বুঝতে পারি যে, সব লিখে দেওয়ার পরও ও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবে। হয়ত এমন সব কাজ করিয়ে নেবে, যাতে করে ও রাতারাতি অনেক বড় হতে পারে। কিন্তু আমার কপালে সুখ আসবে না।

ব্ল্যাকমেইলের হাত থেকে বাচতে আমাকে অনেক মাথা খাটিয়ে প্ল্যানটা বের করতে হয়েছে। আমি আমার নিজেকে খুন করার কন্ট্রাক্ট দিয়েছি রাহাতকে। যদিও আমি জানতাম না, কে পাবে এই কাজ। রাহাত হওয়াতে আমার সুবিধা হয়েছে। সব কিছু অনেক সহজ হয়ে গেছে আমার জন্য। প্রায় কিছুই করতে হয়নি আমাকে। ও নিজেই আমার স্বামী, তার প্রেমিকা, আর প্রেমিকার বয়ফ্রেন্ডকে হত্যা করেছে। যদিও এখনো পর্যন্ত রাহাত জানে না যে সবই আমি জানি।

আমার আরো একটা সেলফোন আছে। সেটা বের করে কল করলাম রাহাতকে।

-“হ্যালো?” রিসিভ করল রাহাত। “কে বলছেন?”

-“চিনতে পারছ রাহাত?”

-“মীরা? এত রাতে? কি হয়েছে?” ওর কন্ঠে নিখাদ বিস্ময়। মনে মনে হেসে ওঠলাম আমি। সত্যি, অভিনয় জানে বটে।

-“তুমি জান কি হয়েছে। আমার স্বামী, তার প্রেমিকা আর প্রেমিকার বয়ফ্রেন্ড খুন হয়েছে। খুনটা কে করেছে, তাও কি আমাকেই বলতে হবে?”

ওপাশে কিছুক্ষন নিরবতা। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম আমি। রাহাত আবার বলল, “হ্যা, তোমার ধারনা ঠিক। কিন্তু কিভাবে জানলে তুমি যে আমিই করেছি এগুলো?”

হেসে ওঠলাম আমি। বললাম, “তুমি প্রেত। আর আমি বাজ। তুমি অনেক কিছুই দেখতে পাও। আর আমি সব কিছুই দেখতে পাই।”

ও যেন চমকে ওঠল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “এর মানে তু-তুত-তুমি?”

-“হ্যা আমি। আমি খুবই দুঃখিত রাহাত। কিছুই করার নেই আমার। তুমি তো জানই, এই খেলার কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়ম সবসময় মেনে চলতে হয় আমাদেরকে। আর সেই নিয়ম অনুযায়ী সব কিছু করতে হচ্ছে আমাকে। তোমার কোন দোষ নেই।”

কিছুক্ষন নিরবতা। তারপর আবারো শোনা গেল রাহাতের গলা। “তার মানে কি, এখন আমিও?”

-"হ্যা। তুমিও। কিছু করার নেই। ইট’স নট পার্সোনাল। জাষ্ট বিজনেস। এই কাজটা আমাকে করতেই হত। তুমি ছাড়া অন্য কেউ হলেও করতে হত। দৈবক্রমে এখানে ঢুকে পড়েছ তুমি। যাই হোক। উইশ ইউ আ ভেরী হ্যাপি জার্নি।”

এ কথা বলার সাথে সাথে সংযোগ কেটে গেল। পাঁচ মিনিট শেষ। বুঝতে পারলাম, বিস্ফোরন ঘটেছে রাহাতের গাড়িটাতে। সেই সাথে শেষ হয়েছে রাহাতও। জীবনের জুয়া খেলায় জিতে গেছি আমি।

আমার আসলেই কিছুই করার ছিল না। কারন, আমি কোন কিছুরই সাক্ষী রাখতে রাজী নই। আজ বাদে কাল ও ঠিকই জেনে যেত সব। সেই ঝুঁকি আমি নিতে পারিনা।

এখন গভীর রাত। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সারা শহর নিশ্চুপ। যেন মারা গেছে সবাই। আমারও আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এখনই যদি মারা যেতে পারতাম।

কিন্তু না। বাচতে হবে আমাকে। নিজের জন্য নয়। নিধির জন্য।

নিধি, মামনি আমার। বাচব আমি। শুধু তোমারই জন্য বাচব আমি। আমাকে বেঁচে থাকতে হবেই।

(চলবে)

Likes Comments
০ Share

Comments (2)

  • - মোঃসরোয়ার জাহান

    valo laglo pore.....!কেমন আছেন ?মহান স্বাধীনতা দিবস লেখা প্রতিযোগিতা২০১৪ ক্যাটাগরি ১ এ আমার কবিতা “প্রিয় স্বদেশআছে,প্রতিযোগিতার জন্য।আপনাদের  কবিতাটি পড়তে আমন্ত্রণ রইল।যদি ভালো লাগে তবে আপনার মূল্যবান একটি ভোট চাই।ভালো থাকবেন শুভ কামনা রইল। http://www.nokkhotro.com/post/139582-212853-328e30-07c579-.52321-016

     

    • - মোঃ কামরুজ্জামান বাবু

      প্রিয় স্বদেশ কবিতাটি পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো । ধন্যবাদ ।

    - তৌফিক মাসুদ

    শুভকামনা রইল। 

    • - মোঃ কামরুজ্জামান বাবু

      আপনার জন্যেও ভাই ।