মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই অন্ধ হয়ে যান কবীর সাহেব। তিনি এখন কেবল একটি মাত্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন, তার সংগ্রহে থাকা বইগুলোর কি হবে? চোখই যদি না থাকলো তাহলে আর বই দিয়ে কি হবে?
প্রায় দশ বারো বছর ধরে তিনি বই সংগ্রহ করে চলেছেন। বইয়ের নেশায় তিনি দিনের পর দিন না খেয়ে টাকা জমিয়েছেন, পুরনো বইয়ের দোকানে পড়ে থেকেছেন বেলা-অবেলায়। তবে এসব অনেক আগের কথা, তার ছাত্র জীবনের।
কবীর সাহেব ভেবেছিলেন বই নিয়ে তার এ পাগলামোটা হয়তো বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু যায়নি। সাড়ে চার বছর টিকে ছিলো তার বৈবাহিক জীবন। এর পেছনের কারনটাও ছিলো সেই বই। প্রেমের বিয়েটা ভেঙে যাবার পর থেকে তিনি একাকী জীবন যাপন করছিলেন।
কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় চোখ হারানোর পর থেকে কার্যত তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তখনই তিনি সব গুছিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ চলে আসেন একটা নিরিবিলি সাধারণ জীবনের আশায়। কিন্তু কে জানতো তার এ সাধারণ জীবন অসাধারণ যন্ত্রনায় ভরে উঠবে ! ঘুরেফিরেই বইয়ের তাকে সাজানো বইগুলো তিনি পরম মমতায় ছুয়ে দেখেন আর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তখন তার মনটা গাঢ় বিষাদে ছেয়ে যায়। সরকারি চাকরী থেকে হঠাৎ বাধ্যতামূলক অবসরে চলে যাওয়ায় পেনশনের টাকা দিয়ে হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব কিন্তু সেটা হবে এক যন্ত্রনাদায়ক জীবন।
আত্মহত্যার করার কথা তিনি যে ভাবেননি তা না, কিন্তু সেটা মন থেকে মুছেও ফেলেছেন। তার কোন উত্তরসূরিও নেই যার জন্য তিনি বইগুলো রেখে যাবেন, আগলে রাখবেন।
এখন কেইবা তার তিলতিল করে গড়ে তোলা প্রিয় জিনিসগুলো যত্ন করে রাখবে? কত জনইবা সেগুলোর কদর বুঝবে? যে বুঝতে পারতো সেইতো তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে অনেক আগেই।
কবীর সাহেব তার বইগুলো সংগ্রহ করে রাখার জন্য বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়ে বেড়িয়েছেন, অফিসের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে হাত পেতেছেন, মন্ত্রনালয়ে চিঠির পর চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি, শুরুতে সকলে তাকে আশ্বস্ত করলেও কেউ আর পরে সেটা গুরুত্ব দেয়নি। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিরও কোন জবাব মেলেনি কখনো।
এক জ্যোৎস্না রাতে তিনি নদীতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অন্ধ মাঝির নৌকা ছুটে চলে দিকহীন গন্তব্যের দিকে, এলোমেলো ভাবে। তখন নক্ষত্রে ছেয়ে গিয়েছে আকাশ, গাঢ় জ্যোৎস্নার আভায় চারিদিক হয়ে উঠেছে নীলাভ স্বর্গ। দূরে কোথাও থেকে দেখা যায় প্রকৃতির এমন খেয়ালে শান্ত জলরাশির মাঝে ভেসে চলেছে এক নিঃস্ব মাঝি যার নৌকায় উচু ঢিবির মত স্তূপ হয়ে রয়েছে বই আর বই। অদ্ভূত সে দৃশ্য!