সকালে যখন তমাল ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছিল, পাশের রুমে তার ছোট কাকী, কাকাকে বলছিল
- আমি কি দান ছত্র খুলে বসেছি নাকি হ্যাঁ? যত সব উটকো ঝামেলা আমার ঘাড়ে। তোমার ভাইপোকে বলে দিয়ো, আজকের ইন্টারভিউ দিয়ে যদি চাকরিটা না হয়, তবে আমার ঘরে তার আর জায়গা নেই। মানে মানে যেন কেটে পরে।
কথাগুলো যেন তমালের কান দিয়ে ঢুঁকে একেবারে হৃদপিণ্ডের গায়ে আঘাত করছিল। মাস্টার্স শেষ করার পর দু’ বছর হল সে তার ছোট কাকার বাসায় আছে। আগে হলেই থাকত। কিন্তু পাশ করার পর হল ছেড়ে দিতে হল। কাকা ডেকে বলেছিল
- তমাল, বাসায় তো একটা রুম ফাঁকাই পরে আছে। এখানেই চলে আয়। যত দিন চাকরি -বাকরি না হয় এখানেই থাকলি। মিশুকেও পড়াটা একটু দেখিয়ে দিবি।
তখন থেকেই তামাল ছোট কাকার বাসায় আছে। ক্লাস নাইনে পড়া কাকাতো বোন মিশুর হাউজ টিউটরের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি আরও দুটি টিউশনিও পেয়ে যায়। সাথে চলতে থাকে একটা চাকরির পাওয়ার প্রানান্তকর চেষ্টা। ছোট কাকী প্রথম দিকে তমালকে মেনে নিলেও, ইদানিং সে যেন তার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। সকালে কথাগুলো শোনার পর একেবারে মূষরে পরে তমাল।
মায়ের কটূক্তি মিশুর কানেও গিয়েছিল। নিজের বড় ভাই নাই তার, তমালকে সে আপন বড় ভাইএর মতই জানে। মন খারাপ নিয়ে সে তমালের রুমে আসে।
- আজ তোমার ইন্টারভিউ আছে দাদা?
- হ্যাঁ, কেন রে?
- না, দেখ তো, ইন্টারভিউ দিতে যাবার আগে মা তোমার মনটা কেমন খারাপ করে দিল।
- আরে ও কিছু নয়।
- দেখে নিও তোমার ইন্টারভিউ খুব ভাল হবে। আর চাকরিটা পেয়ে গেলে তোমাকে আর মা’র মুখ ঝামটা শুনতে হবেনা।
মলিন মুখে হাসে তমাল। আদর করে মিশুর মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে দেয়। তার পর রেডি হয়ে ফাইল পত্র নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে বেরিয়ে পরে।
এই নিয়ে ইন্টারভিউ তো আর কম হলনা। কিন্তু চাকরির শিকে এতদিন তার ভাগ্যে ছেঁড়েনি। কিন্তু এবার ছিঁড়ল। ধবধবে সাদা অফিসের প্যাডে কাল ছাপার অক্ষরে এপয়েন্টমেন্ট লেটারটি যখন হাতে পেল, তমাল যেন তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। মুহূর্তেই তার সব উৎকণ্ঠা কেটে গেল। মাথার ভিতরটা বেশ হাল্কা বোধ হতে লাগল। মনে হল মস্ত বড় একটা বোঝা তার মাথার উপর থেকে নেমে গেছে, যার ভর আর বয়ে নেবার ক্ষমতা তার ছিল না।
আজ মাসের বার তারিখ। তাকে পনের তারিখেই জয়েন করতে বলা হয়েছে। খুশিতে তার নাচতে ইচ্ছে করছে। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে গুলশানের ব্যাস্ত রাস্তার ধারে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে। অন্য দিন হলে পাঁচ মিনিটেই হাঁপিয়ে উঠত। অথচ আজ তার যেন ক্লান্তি নেই। আজ তার মন ভাল আছে। এতো ভাল বোধ হয় গত দু বছরের মধ্যে কখনও ছিলনা।
বাস এল আরও মিনিট পাঁচেক পরে। স্বভাবতই দারুন একটা হুড়োহুড়ি পরে গেল। কার আগে কে উঠবে। ফাইলটা এক হাতে ভাল করে ধরে নিয়ে অনেকটা যুদ্ধ করেই বাসে উঠে একেবারে জানালার ধারে একটা সিট পেয়ে বসে পরে তমাল। মুহূর্তেই মানুষে মানুষে গাদাগাদি করে ভরে যায় বাস। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে এক সময়। কিছুক্ষন পরেই ঘাড় ফেরাতেই গা গুলিয়ে ওঠে তমালের। তার পাশের ভদ্রলোক (!?) বেশ কসরত করে পরম আগ্রহে তার নাক থেকে কিছু একটা টেনে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মোটেই সহ্য হলনা তার। অন্য কোন সিট ফাঁকা থাকলে সে তখনই উঠে যেত। আপাতত সে সুযোগ নেই।
জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখে সে। নোংরা দৃশ্যটি ভোলার জন্য ভাল কিছু ভাবতে চেষ্টা করতেই ভেসে ওঠে রিন্তির মুখ। মনে মনে ছক কাটে তমাল। এই বাসে করে ফার্ম গেটে নামবে। তারপর ওখান থেকে সোজা রিন্তির হোস্টেল। চাকরির খবরটা তমাল অবশ্য রিন্তিকে মোবাইল ফোনে জানাতে পারত। কিন্তু ফোনে তো আর মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না। সামনাসামনি জানানোর মজাই আলাদা। দারুন একটা সারপ্রাইজ দেবে রিন্তিকে আজ। চাকরির খবরটা রিন্তিকে দিয়ে চলে যাবে কাকার বাসায়। তার পর ... তার পর ... ভাবতে ভাবতে পবনকে ফোন করে সে। পবন তার ক্লাশ মেট। অনার্স আর মাস্টার্স এক সাথেই পড়েছে তারা। পবন থাকে আজিমপুরের একটা মেসে। চাকরি পায়নি এখনো। তাই দু’ চারটে টিউশনিই সম্বল। পবনকে চাকরি পাবার খবরটা জানায় তমাল। পবনের সাথে আরও কি দু’ একটা কথা বলে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তমাল।
দেখতে দেখতে বাস চলে আসে ফার্ম গেটে। দ্রুত নেমে পরে তমাল। ওভার ব্রিজ পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছায় রিন্তির হোস্টেলের সামনে। রিন্তিকে ফোন দেয় সে।
– হ্যালো রিন্তি, একটু গেটের সামনে আসবা?
- তুমি হঠাৎ আমার এখানে! তুমি যে আসবা আমাকে তো জানাওনি। অবাক হয় রিন্তি।
- আহা জানাইনি, এখন জানালাম। এখন কথা না বাড়িয়ে ঝটপট চলে আস তো।
- আচ্ছা, তুমি দাঁড়াও, আমি কিছুক্ষনের মধ্যেই আসছি। বলে ফোন রাখে রিন্তি।
রিন্তির সাথে তমালের পরিচয় দেড় বছর হল। বাংলায় অনার্স পড়ছে। ঢাকায় থাকার মত তেমন কেউ নেই তার। তাই এই হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করছে। যথেষ্ট ভাল বোঝাপড়া আছে দুজনের মধ্যে। নিজেদের জীবনের ছক মোটামুটি সাজিয়ে নিয়েছে তারা। বাকি ছিল তমালের একটা চাকরি। সেটাও আজ পেয়ে গেছে তমাল। কিছুদিনের মধ্যেই বাকি সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলবে তারা।
হোস্টেলের ছোট পকেট গেট ঠেলে বাইয়ে মুখ বের করে উঁকি দেয় রিন্তি। তমালকে দেখে মুচকি হেসে বেরিয়ে আসে।
- তার পর কি মনে করে জনাবের আগমন?
- চোখ বন্ধ কর।
- কেন, চোখ বন্ধ করব কেন? মুখে খানিকটা অনিচ্ছার অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে তুলে হাসি হাসি মুখে চোখ বন্ধ করে রিন্তি। কিছু একটা সামনে বাড়িয়ে ধরে তমাল বলল
- বেছে নাও।
চোখ খুলে রিন্তি বিস্মিত হয়। তমালের এক হাতে একটি খাম অন্য হাতে দুটি গোলাপ।
- বেছে নাও মানে? গোলাপ তো নেবই, কিন্তু খামের ভিতরে কি?
- দুটোই তোমার জন্য ম্যাডাম, বলে হাত বাড়িয়ে দেয় তমাল। মুখে তার খুশির ঝিলিক।
তমালের হাত থেকে গোলাপ আর খামটা নিয়ে নেয় রিন্তি। দ্রুত হাতে খামটা খুলে খুশিতে চিৎকার করে ওঠে রিন্তি।
- এপয়েন্টমেন্ট লেটার! তোমার চাকরি হয়েছে! !
- হু হু। চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি রিন্তি শুনছো। এখন আর কেউ আটকাতে পারবেনা। বলেই এক ঝলক হাসি দেয় তমাল।
- এই তোমার ইন্টারভিউ ছিল আমাকে জানাওনি তো।
- আরে জানানোর কি আছে। প্রতি বারই তো জানাই। তার পর সেই ইন্টারভিউ, সেই চাকরি না হওয়া, সেই হতাশা। তাই এবার ভাবলাম ভাল কিছু হলে তবেই তোমাকে জানাব।
বলতে বলতে সামনের ছোট রাস্তাটা পার হয়ে আসে দুজন। দোকান থেকে দুটি আইস্ক্রিম কিনে নেয় তমাল। খেতে খেতে রিন্তির চোখের দিকে তাকায় তমাল। কিছুটা বিরতি নেয়। তারপ তার পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা রিন্তিকে জানায়।
- তুমি কি বল? জিজ্ঞেস করে তমাল।
- দেখ, যা ভাল মনে কর। তবে যা করবে ভাল মত চিন্তা ভাবনা করে করবে।
- আরে অত ভেব না তো। দেখ, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবারো খানিক নিরবতা।
- আচ্ছা এবার যাব। বলতে বলতে রিন্তিকে নিয়ে হোস্টেলের গেট পর্যন্ত এগিয়ে যায় তমাল।
- ঠিক আছে। সাবধানে যেও। বলে গেটের ভিতরে ঢুকে পরে রিন্তি।
একটা টেম্পো ধরে কাকার বাসার উদেশ্যে রওনা দেয় তমাল। বাসায় যখন পৌঁছুল, ঘড়িতে প্রায় আড়াইটা বাজে। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় তমাল। কাকা অফিসে।ছোট কাকী আর মিশুর খাওয়া হয়ে গেছে। কাকী মিশুকে ডেকে বলল
- মিশু টেবিলে খাবার দেয়া আছে। তোর দাদাকে খেয়ে নিতে বল।
আজ তমালের খেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। এই দু’ বছরে অনেক কটু কথা শুনেছে সে, কিন্তু কখনই না খেয়ে থাকেনি। আজ সত্যিই তার খেতে মন চাইছে না। তবুও মিশুর ডাকে সে ধীর পায়ে উঠে টেবিলে যায়। মাথা গুজে টেবিলে রাখা খাওয়া সেরে রুমে গিয়ে বসে।
কিছু ক্ষন বিশ্রাম নিয়ে তমাল তার জামা কাপড়গুলো ছোট ব্যাগে গুছিয়ে নেয়। বেঁধে নেয় তার বইখাতা সহ প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র। মিশুকে ডাক দেয় তার রুমে।
- এই মিশু শোন। একবার আয় তো এখানে।
- কি দাদা, বল।
তমাল ছোট একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয় মিশুর দিকে।
- কি আছে এতে দাদা।
- খুলেই দেখনা।
- ওমা চকলেট! প্যাকেট খুলে খুশিতে হেসে ফেলে মিশু।
- হ্যাঁ তোর জন্য। খুশি হয়েছিস?
- হ্যাঁ, খুব। তোমার ইন্টারভিউ কেমন হল দাদা?
- শোন তোকে একটা কথা বলি, কাউকে বলবিনা কিন্তু। ঠিক আছে?
- কি কথা দাদা?
- মিশু আমার না একটা চাকরি হয়েছে।
- সত্যি! এতো অনেক খুশির খবর। কিন্তু কাউকে বলবনা কেন?
- না, বলবি না। আর শোন আমি আজ চলে যাচ্ছি।
- চলে যাচ্ছ! কোথায় যাবে?
- দেখি কোথাও একটা মেসে টেসে উঠে পরব।
এতক্ষন বেশ খুশি মনেই ছিল মিশু । কিন্তু যখন দেখল তমাল তার সব কিছু গোছগাছ করে নিয়েছে, মিশুর মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো গলায় সে বলল
- তুমি কি সত্যি সত্যি চলে যাবে দাদা? মা না হয় তোমাকে সহ্য করতে পারে না, কিন্তু বাবা আর আমি তো আছি। আমরা তো তোমাকে ভালবাসি। তুমি যেওনা দাদা।
মলিন মুখে হাসে তমাল।
- আরে পাগলি, সবাই কি সব সময় কাছে থাকে নাকি? এক সময় তো চলে যেতেই হয় তাই না? মন খারাপ করিস না। মাঝে মাঝে এসে তোকে দেখে যাব।
তমাল তার সবকিছু নিয়ে দরজার কাছে রেখে কাকীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে। কাকীর কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পরে। কিন্তু সেটা তিনি বুঝতে দেন না। মনে মনে বরং খুশিই হন। যাক বাবা, এতো দিনে তাহলে বেকার ঝামেলা বিদেয় হচ্ছে।
- তা যাবে কোথায়? অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করে তমালকে।
- দেখি একটা ব্যাবস্থা ঠিকই করে নেব। আপনাদের অনেক জ্বালাতন করেছি। পারলে ক্ষমা করে দিবেন। বলে বেরিয়ে পরে তমাল।
একটা রিকসা ডাকে। ছোট্ট বাহনে তুলে ফেলে তার ব্যাচেলর সংসার। উদ্দেশ্য পবনের মেস, আজিমপুর। রিন্তির সাথে গাঁটছড়া বাঁধার আগে কয়েকটা দিন ওখানেই কাটাতে চায় তমাল।
(২২/০২/২০১৪ইং)
Comments (19)
আপনার এই লেখায় আগের লিঙ্কের গানটি দিয়ে দেন। সবাই এখানে এসে আগের পোস্টে চলে যাচ্ছে তা কি ঠিক হলো?