Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

জিয়াউল হক

১০ বছর আগে লিখেছেন

ক্ষুধার্ত সময়

আজ কালকের মানুষ গুলো যে কেমন ! মানুষের প্রতি মানুষের টান তো নেইই, তাই বলে একজন আত্মীয়ের প্রতি আরেক জন আত্মীয়ের টানও থাকবে না ? আদর যত্নটা যেন উঠে যেতেই বসেছে। যেটুক বা দেখায় ওটুকু না দেখালেই পারে ! বসতে বলার নাম নেই, খেতে বলার নাম নেই বাপরে বাপ বাড়ির খবর নিয়ে ব্যস্ত। আর ঐ পর্যন্তই !
    মধ্য বয়সী কুদ্দুস মিয়া তার বাড়ির অদূরে ফাঁকা রাস্তাটার মাঝখানে সটান্ দাঁড়িয়ে থাকা কড়ই গাছটার নীচে এসে থামতে থামতে ভাবে সে কথা। ভাবে যে ‘রক্তের রক্ত না হলেও একেবারে দূরেরও তো নয়। আপন খালাতো ভাইয়ের মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি। খালাতো ভাইয়ের মেয়ে মানে কি নিজের মেয়ের মতো নয় ? থাকতে না হয় নাই বললে, একটু জোর গলায় কি খেতে বলাও মানা ?’
    ভাবতে ভাবতে কুদ্দুস মিয়া কপালের ঘাম মোছে বাঁ হাতে। তবু যেন মুখমন্ডল ভিজেই থাকে তার। অবশেষে খানিকটা উবু হয়ে পরনের লুঙ্গির নীচের অংশটা তুলে একবার মুখখানা মুছে নেয়। তারপর মেরুদন্ড সোজা করে সটান্ দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘ হাফ ছেড়ে সামনের দিকে মুক্ত চোখে তাকায়। যেখানে গেলো আশ্বীনের অকাল বন্যায় বিধ্বস্ত দীর্ঘ বিস্তৃত মাঠভরা ধান ক্ষেত নিথর পড়ে আছে। কার্তিকের তীব্র রোদে তার পঁচনগন্ধ যেন দম আটকিয়ে দেয়। মূহুর্তে এক হলকা শীতল বাতাস এসে তার রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া তপ্ত শরীরটা ছুঁয়ে গেলে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যে বাতাসের জন্য একটু আগেই সে হাহাকার করে উঠেছিল মনে মনে। কার্তিক মাসের শুরুর দিকে রাতে একটু শীত শীত ভাব থাকে বলেই দিনের বেলা মেঘমুক্ত আকাশের নীচে বেশ রোদ পড়ে। তাতে ভর দুপুরে পথে বেরুলে ঘামতে হয় বটে। খুব বেশি দূরের পথ যে সে হেঁটে এসেছে তা নয়। কড়ই গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে এখনো বাড়িটা দেখাই যায়। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’বার আসা যাওয়াতেই এতোটা ঘেমে গেছে সে। যদি সে আত্মীয়ের বাড়িতে বসে খানিকটা জিরিয়ে নিতে পারতো তবে এতোটা ক্লেশ বোধ হতো না তার। কিন্তু আত্মীয় যদি জোর গলায় আত্মীয়তা না দেখায় তবে তার একার গলার জোরে তো আত্মীয়তা হয় না।
    অবশ্য সেখানে সে আত্মীয়তা করার ইচ্ছা নিয়েই গিয়েছিল। কারণ, এ সময়টায় গ্রামে মজুরের কাজ থাকে না। যেটুকু বা শবজি ক্ষেতের কাজ থাকে তা আবার গৃহস্থদের ঘনিষ্ট মজুররাই করে থাকে। বসে বসে গাঁটের পয়সা খরচ করে চাল ডাল কিনে খাওয়া আর দিন গোনা ছাড়া কোন কাজ নেই। আর সে গাঁটের পয়সাই বা কতদিন কুলায়। তাই সে আজ হঠাৎ করেই কি যেন ভেবে আত্মীয়তা করতে বেরিয়েছিল। ঐ খালাতো ভাইয়ের মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি ছাড়া নিকটবর্তী কোন আত্মীয়ের বাড়িও নেই তার। কিন্তু খালাতো ভাই হলেও সেও তো কম আপন নয়। তাছাড়া সে খালাতো ভাইয়ের সাথে তার মিল-মোহাব্বতও নেহাৎ কম ছিল না। সে খালাতো ভাই আজ বেঁচে না থাকলেও তার মেয়ের খোঁজ খবর রাখাটা তো তার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তাই সে গিয়েছিল। কিন্তু তারা খুব একটা কদর দেখালে না।
    বাড়ির উঠোনে পা দিতেই প্রথমে জামাইয়ের সাথেই দেখা হয়েছিল তার। জামাই সালাম দিয়ে বাড়ির সমাচারাদি জানতে চাইলে কুদ্দুস মিয়া সব ভাল বলে জামাইকে আশ্বস্ত করলো। তারপর ভাতিজীর কথা জিজ্ঞেস করতেই সেও বেরিয়ে এলো বাড়ির ভিতর থেকে। সেও জানতে চাইলো বাড়ির সমাচার। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই।
    এক সময় জামাই হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘তা চাচা মিয়া এদিকে কোত্থেকে এলেন ? না কি কোনখানে যাচ্ছেন ?’
    কুদ্দুস মিয়া লজ্জার মাথা খেয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো, ‘তোমার মেয়েকেই দেখতে এলাম বাপু।’
    চার পাঁচ বছরের মেয়েটা কুদ্দুস মিয়ার ভাতিজির কোলেই ছিল। কুদ্দুস মিয়ার উচিৎ ছিল বাচ্চা মেয়েটার জন্য সৌজন্য হিসেবে অন্তত একটা লজেন্স নিয়ে যাওয়া। কিন্তু তার পকেটে একটি পয়সাও ছিল না। এজন্য সে মনে মনে লজ্জাই পেলো। সে লজ্জা ঢেকে দিতে আগ বাড়িয়ে অনেক কথাই বললো। নাতনীকে কোলে নিয়ে আদর করলো। তারা যে তার বাড়িতে বেরাতে যায় না সে জন্য অনেক আক্ষেপও প্রকাশ করলো। ইতিমধ্যে তার ভাতিজির শ্বাশুড়ি এসে দু’এক কথা বলেই তাকে বসতে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুললে কুদ্দুস মিয়া আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘না না বসা লাগবে না।’
    জামাই বললো, ‘এসেই চলে যাবেন ?’
    কুদ্দুস মিয়া বলে, ‘হ বাবা যাই।’
    জামাই বলে, ‘এটা কেমন কথা। বসেন।’
    কুদ্দুস মিয়া এতেই রাজি হয়ে ভাতিজীর ঘরে গিয়ে বসে। তারপর আরও নানান রকম গল্প শুরু করে। কুদ্দুস মিয়া তার খালা-খালুর গল্প করে। খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার স্মৃতির গল্প করে। কিন্তু তাকে ওযু করার পানি কেউ দেয় না। দুপুর গড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। তার পেটের ক্ষুধা মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। কারণ, আজ সকালেও তার বাড়িতে চুলায় হাঁড়ি উঠেনি। ক্ষুধার্ত স্ত্রী আর ছেলে মেয়েরা তার এখনো অনাহারেই আছে। সেও ক্ষুধার্ত কিন্তু তার ক্ষুধার কথা কাকে বলে সে ? তার পানেই চেয়ে আছে আরও তিন চারটি মুখ। বর্তমানে মজুরের কোন কাজ নেই বলেই যে আত্মীয়তা করার ইচ্ছাটা তার হয়েছিল এ কথা সে হলফ করে বলতে পারবে না। আসলে অস্বস্তিকর ক্ষুধার্ত সময়টা পার হচ্ছিল না বলেই এক সময় তার মাথায় আসে বসে থাকার চেয়ে বরং বাড়ির নিকটবর্তী এই ভাতিজীটাকে একবার এসে দেখে যাবে সে।
    কুদ্দুস মিয়া গল্প করে আর ভিতরে ভিতরে ছটফট করে। থেকে থেকে পেটের মধ্যে যখন মোচড় দেয় তখন সে গল্পের খেই হারিয়ে ফেলে। ধৈয্যচ্যুতি হলে কুদ্দুস মিয়া এক সময় জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আজ তাহলে যাই বাবা।’
    যাওয়ার কথা শুনে শেষে জামাই বলে, ‘খাওয়া-দাওয়া করেন চাচা।’
    এবার কুদ্দুস মিয়া জোর গলায় বলে, ‘না বাবা আজ থাক।’
    ভাতিজী বলে, ‘চাচা না খেয়ে যাবে সেটা কেমন হয় ?’
    এই পর্যন্তই। পেটে যত ক্ষুধাই থাক প্রথম কথাতেই কারো বাড়িতে খেতে বসা যায় না। কুদ্দুস মিয়াও তাই প্রথমে ‘না না’ করে মৃদু আপত্তি জানায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার কেউ আর খেতে বলে না। বরং তারা যেন কুদ্দুস মিয়ার চলে যাওয়ার অপেক্ষাই করে মনে মনে।
    কিন্তু, বসতে বললেই বসা যায় না। খেতে বললে খাওয়াও যায় না। বলার মধ্যে জোর থাকতে হয়। জোর না পেলে তাই নিজের আগ্রহটাকে মাটিচাপা দিতেই হয়। কুদ্দুস মিয়াও সেই জোর খুঁজে না পেয়ে আত্মীয়তা করার ইচ্ছাটাকে মাটিচাপা দিয়ে এই ভর দুপুরে চলে এসেছে।
    পেটের অসহ্য ক্ষুধাটা এতক্ষণে মরে যাওয়ায় হালকা বাতাসে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু বউ বাচ্চারা যে এখনো না খেয়েই আছে সে কথা ভেবে তাকে অস্বস্তি আবার ঘিরে ধরে। ঘামে ভেজা জামার পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে সে আগুন ধরায়। তারপর সে ঘনঘন বিড়িতে টান দেয় আর নিজের ক্ষুধার্ত বাড়িটার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে।

Likes Comments
০ Share

Comments (7)

  • - ঘাস ফুল

    ত্রিভুজ প্রেম কাহিনীই বলা যায়। রোহিত ভালোবাসতো একজনকে কিন্তু পায় নাই। আবার সিঁথি ভালোবাসে রোহিতকে। তাকেও হারায় রোহিত। 

    প্রথম ভালোবাসাটা রোহিতের বুকে অনেক খানি জায়গায় দখল করেছিল, তাই না পেয়েও সেটা ভুলে যেতে পারে নাই। তাই হয়তো সিঁথির এতো ভালোবাসাও তাকে প্রথম প্রথম সহজে ছুঁয়ে যেতে পারে নাই। যখন এক সময় ছোঁয়া শুরু করলো তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো রোহিতের পারিবারিক এবং আর্থিক অবস্থা। মা বাবা ভাই সবাইকে হারিয়ে এখন কোন কিছুতেই আর রোহিতের ভরসা হয় না। তাই হয়তো সিঁথিকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চায় নাই। জড়িয়ে কষ্ট দেয়ার চাইতে, না জড়ানোকেই তাই সে সঠিক বলে মনে করেছে। কিন্তু সিঁথি যে নিশিথ, চুমকির মতো ফাঁকি দিবে, সেটা রোহিত ধারণা করতে পারে নাই। শেষ পর্যন্ত সিঁথির দেহটা চলে গেলো কিন্তু মনটা আর ভালোবাসাটা ঠিকই রোহিতের বুকে রয়ে গেলো, যা কেউ কখনো আর সড়াতে পারবে না। 

    গল্পটা বেশ ভালো লাগলো। কিন্তু আপনার বিরাম চিহ্নের যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে আমি নিজেও যন্ত্রণা বোধ করেছি। কয়েক জায়গায় শব্দ এলোমেলো হয়ে গেছে। যেমন- কোথায় 'করে' হওয়ার কথা অথচ আপনি লিখেছেন 'করা'। এই টাইপের কিছু ভুল আছে, যা বাক্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। 

    ফিনিশিংটা ভালো দিয়েছেন। শেষ লাইনের 'ভাসাবে' শব্দটার পর একটা কমা হবে। সেটাও দিতে ভুলে গেছেন। অনেক জায়গায় বিরাম চিহ্নের ভুল আছে। এতোগুলো এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয় বলে ধরছি না। সময় করে ঠিক করে নিয়েন।  

    ধন্যবাদ সকাল দা। 

    • - সকাল রয়

       

      বিরাম চিহ্ন ঠিক করতে হবে। কিন্তু সময় কোথায়_____

      লিখার ই সময় পা ই না

       

      অনেক অনেক বিনীত চিত্তে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি দাদা

    - জাকিয়া জেসমিন যূথী

    অনেক সুন্দর একটা গল্প। এরকম আবেগী গল্প আমার মতো পাঠকদের জন্য; মুগ্ধতায় হাউ মাউ করে কেঁদেকেটে একাকার হয়ে যাব বলে!!! এর বেশি আর আর কিছু বললাম না!! 

    • - সকাল রয়

       

      আমি যখন লিখতে গেছিলাম তখন আমারো এমন হইছিল।

      অনেক অনেক ধন্যবাদ