Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

এনামুল রেজা

১০ বছর আগে লিখেছেন

অপরিপক্ক

গ্রামের এ প্রান্তটা বেশ নির্জন।
চারপাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে চলে গেছে অবিশ্রান্ত, সেটির একদম তীরবর্তী বলেই হয়তো। পাশাপাশি চার-পাঁচটা বাড়ী। তারপর বিশাল ধানক্ষেত, বিল। সেসব পার হয়ে আবার দাঁড়িয়ে থাকা চার-পাঁচটা ঘর। যেন গ্রামের মাঝে আরও ছোট ছোট গ্রাম।
নির্জন বলেই হয়তো এদিকটা গ্রামের অঘোষিত প্রণয় ক্ষেত্র। সন্ধ্যার পর এদিকটায় সাধারণত কেউ আসেনা। তবে তখন নদীর পাড় ধরে নিরুদ্দেশের মত হাঁটতে থাকলে হঠাত হঠাত থমকে দাঁড়াতে হয়। হয়তো কোন ঝোপের ভিতর থেকে নড়া-চড়া, অস্ফুট শব্দ আসতে থাকে! চমকে উঠে ঘুরে চলে যাওয়া ছাড়া আগন্তুকের অন্য কিছু মাথায় আসেনা। কি ভৌতিক ব্যপার!

মূল গ্রাম এই যায়গাটা থেকে আরও অনেকটা ভিতরে। ছোট্ট কিন্তু জম-জমাট বাজার, লোকালয় সমস্ত কিছুতে মেশা। তবে ওই যে ঘনবসতি বলতে যা বুঝায়, তেমন কিছু ব্যপার এখানে নেই। সবাই সবাই কে চেনে, নাম জানে। মাঝে মাঝে দু-পাঁচ জন যারা অনিয়মিত আসা যাওয়া রাখে, এরাও প্রায় সবারই মুখচেনা।

তাই যখন ভ্যানচালক হামিদ গত রাতে নদীর পাড়ে বড়ো বিসর্জনের কাজ করতে গিয়ে দেখেছিল- ঝোপের মধ্যে অদ্ভূত কিছুর নড়াচড়া, সেটা তার কাছে মোটেও সহজ ব্যপার ছিলনা।  বিধায় তা হামিদের মুখ হয়ে দশ কান, দশ কান হয়ে ত্রিশ কান এভাবে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো।
হামিদের কণ্ঠেই ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি রসমন্ডিত হয়ে ওঠে- বুইসেন মিয়া ভাই, আমার তেন্নে হেব্বি হাগা লাগিসে। বদনা নিয়ে পাইখানাই গিসি, শালা দেহি আমার আগেও আর কেউ তার ভিতর ঢুইকে রইসে! শাউয়ো ভড় ভড় আওয়াজে পাইখানা কাঁপায় দেসসে একদম…
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজনের মাঝে হাঁসির তুফান ওঠে। চা’র দোকানের মালিক বজলু বলে- হামিদ শাউয়ো তুই কতাও কতি পারিস! এত্ত কতা না কইয়ে আসল ঘটোনা ক দিন!
হামিদ আসল কথা বলে। বদনা হাতে নদীর পাড়ে গিসি। হাইগে টাইগে ভাবলাম, এট্টূ ঘুইরে বেড়াই নদীর পাড় ধইরে। ওরে বাতাস দিসে মিয়া ভাই, কি আর কব! চান্দের আলোয় আলোয় ফকফকা চারপাইশ। চান্দের আলোয় আর সাপের ভয় কি?
হাঁটতিসি। হাঁটতি হাঁটতি দেহি আমার থে এট্টু সামনে ডানদিকির এক ঝোপের ভিতর কি যেন নড়তিসে। আর কেমন যেন পিরায় শুনা যায়না এমন শব্দ! ভয় পাইয়ে এমন দৌড় দেলাম, বুইসেন নাই……
হামিদের গল্প শেষে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে সবার। কারণ গর্ধব হামিদ কিছু বুঝতে পারুক না পারুক, সবাই বোঝে ঝোপের ভিতর কিসের নড়াচড়া। অস্পষ্ট আওয়াজটাই বা কিসের!

সবাই হামিদ কে অপরিপক্ক ভাবে। আসলেই কি সে অপরিপক্ক? তার বয়স কত হবে? বাইশ থেকে চব্বিশ এর মধ্যে। অপুষ্ট ছোটোখাটো শরীর। মাথাটা খুবই ছোট। ছোট নাক আর বড়ো বড়ো চোখে সে যখন কারও দিকে তাকায়, হাবলুসের মতোই দেখতে লাগে তাকে। পড়া লেখার বালাই তার কোন কালেই ছিলনা। ভ্যান চালানোর কর্মটা তাদের তিন পুরুষের। দাদা রহিমজান চালাতো। বাবা গফুরজান চালাতো। সেই তিন চাকার ভ্যান এখন হামিদ চালায়। পরলোকগত রহিমজান কিংবা গফুর যদি হামিদ কে আজ দেখত! বাপ-দাদা ভ্যান চালাতো, কুস্তিগীরের মতো দেহ ছিল তবু দুজনারই। অথচ হামিদ হয়েছে যেন ধইঞ্চা বনের সবচেয়ে অপুষ্ট টি। নিয়তি!

হামিদের মা তারামন বিবি ইদানিং তার একমাত্র ছেলেটাকে নিয়ে বড়ো দুঃশ্চিন্তায় ভোগে। ছেলের বয়স বাড়ছে, কিন্তু ছেলে বড়ো হচ্ছেনা কেন? ত্রিকাল দেখা শাশুড়ি, গ্রামের অন্যান্য লোকেরাও তারামন কে পরামর্শ দেয়, সুয়ালডারে বিয়ে বসাতি হবে, বুইসিশ বউ। বিয়ে দিলি দেকপি দুদিনির মদ্যি কিরাম মরদ হইয়ে গিসে তোর সুয়াল! তারামন ভাবে, আসলেই তো…

অপরিপক্ক, অপুষ্ট ছেলে। পেশা যদিও মন্দ না।  তিন চাকার ভ্যান নিয়ে পুরো উপজেলা চক্কর মারে হামিদ। যৎসামান্য জমিজমা আছে। তার জন্য কন্যা তো জুটলোই, তাও আবার যৌতুক সহ। কন্যা দেখতে শুনতে ভাল। তার উপরে ক্লাস ফাইভ পাস করেছে!

বসন্ত আসলো সময়ের রথে চড়ে। আর সেই বসন্তের আলোয় ভরা কোন এক দিনে হামিদের বিয়ে হয়ে গেল পাশের গ্রামের আরিফার সাথে।  দেন-মোহর দশ হাজার এক টাকা। হামিদ যৌতুক হিসেবে পেল নগদ বিশ হাজার নারায়ণ আর ঝাঁ চকচকে একটা ইন্ডিয়ান ফনিক্স সাইকেল। তার আনন্দের সীমা রইলোনা!
মা তারামন বিবি নিশ্চিত জানত, তার ছেলে এবার বকশে যাবে। হামিদের বৃদ্ধ দাদি উপরে দুহাত তুলে প্রার্থনা করতে থাকলো, হা পরোয়ার দিগার! আমাইগের হামিদরে ইবারা তুমি মানুষ কইরে দেও।হামিদের আজকাল সময় এত মধুর কাটে! সারা দিনমান তার আর ইচ্ছা করেনা ভ্যান চালাতে। ঘর থেকে বেরুতে মন সরেনা। বুকের ভিতর ধুকপুক করে নতুন বউ এর দিকে তাকালে। কোন মেয়েও এত সুন্দর হয়?

সুন্দর এমন দিন গুলির মাঝেই একদিন ভৈরবের খরস্রোতা জলে ভেঁসে চলতে দেখা গেল হামিদের লাশটাকে। কোন নিরুদ্দেশের পানে, কে সে কথা বলবে? অথচ যারা দেখেছিল, কেওই তার চেনা ছিলনা। খুব দুরের, খুব দুরের কোন  এক অচেনা গাঁয়ের নদীর তীরে গিয়ে একদিন তার লাশটা ভিড়লো। ফুলে ওঠা একতাল বীভৎস কিছু তখন আমাদের অপরিপক্ক হামিদ। ততোদিনে জলের প্রাণী আর পাখিদের ঠোকরে ঠোকরে তাকে আর চেনার উপায় নেই। লোকজন জড়ো হয়ে অবাক হয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। জোয়ার এলে আবার ভাঁসতে শুরু করে হামিদ।

আজকাল প্রায়ই রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙ্গে পড়তে থাকে তারমন বিবির কান্নায়। ও হামিদ রে… কই গেলি বাপধন আমার! ও বাপধন রে!… তার বুড়ি শাশুড়ী আজকাল কথাবার্তা বলেনা। চোখেও কি জানি সমস্যা! দিনমান অন্ধকার হয়ে থাকে চারপাশ।
হামিদের বউ আরিফা কে নিতে তার বাপজান এসেছিল। অথচ আরিফা গেলনা! রোগা-পাতলা, বেতাল, শীর্ণদেহি ছেলেটা কি এমন মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল তাকে? মুজিও কয়েকদিন এসে ফিরত গেছে। মুজির সাথে কিসব দিনই না গেছে এক সময়। কত গভীর প্রেমই না ছিল তাদের মাঝে। অথচ তাদের বিয়েটা হলনা কোনদিন! আজও কি হতে পারেনা? আরিফার নিজেকে আজকাল মূর্তির মতন মনে হয়। সমস্ত অনুভূতিগুলি যেন ছুটি নিয়েছে তার থেকে। বাবা হয়তো কদিন পর আবার নিতে আসবে তাকে।

সেদিনের বসন্তময় রজনীটা ছিল অনেক দিন আগের আরও এক রাতের মতন। মধ্যরাতে পেটে ভীষণ চাপ লেগেছিল হামিদের। পায়খানা ঘরের ভিতর সেদিনও কেউ ছিল। হামিদ ভেবেছিল- আরিফা ভিতরে। আহা মেয়ে মানুষ!
সে আর কিছু না ভেবে গিয়েছিল নদীর তীরে জংলায়। কাজ শেষে ভেবেছিল, একটু নদীড় পাড় ধরে হাঁটলে মন্দ হয়না। একেই কি নিয়তি বলে? অদূরেই পাশের একটা ঝোপের ওপাশে সে বুঝতে পারলো, কিসের যেন নড়াচড়া চলছে। আর সেই শোনা যায়না প্রায়, এমন আওয়াজ! সেদিন সে বুঝেছিল শব্দটা কিসের। নাহ! এবার সে ছাড়বেনা।
চাঁদের ফকফকা আলোয় ঝোপের কাছাকাছি গিয়ে সে যেন মূর্তি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের অপুষ্ট হামিদও অবাক হতে পারে! মোষের মত একটা কালো দেহের নিচে ধবধবে একটা নারিদেহ কাতরাচ্ছিল। সেই কাতরানি হঠাত থেমে গেল! আরিফার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ছেয়ে রইলো হামিদের কম্পমান অবয়বটার দিকে!

হামিদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। সে দেখলো মোষের মত বিশাল একটা কিছু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুজি!
সারা গ্রামে কোন কিছুই চাউর হলনা। রাতজাগা পাখিগুলো নদীতীরের প্রহরী জারুল গাছটার ডাল ছেড়ে অকারণ উড়াল দিয়েছিল সে মুহূর্তটায়। তারপর থেকে আর কোনদিন কোন কথা বলেনি আমাদের অপরিপক্ক হামিদ।

——————————

Likes ১১ Comments
০ Share

Comments (11)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    ছবিতে ভ্রমনটা ভালই হয়েছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

    • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

      আপনাকেও ধন্যবাদ অনেক অনেক

    - নীল সাধু

    আর কদিন এই মেঘ এই রোদ্দুর তারপর এই ব্লগে ছবি পোষ্ট দিতে কোন কষ্টই হবেনা। বেশ ভালোভাবে দিতে পারবেন। ভালো লাগা রইলো -

     

    আকাশ থেকে দেখা হল যেন সকল - নাইস।

    • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

      অপেক্ষায় থাকলাম । অনেক ছবি পোষ্ট বাকি আছে কিন্তু

       

      ধন্যবাদ নীল দা

    - প্রহরী

    খাবার গুলো দেখতে কি রকম লাগছে

    • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

      ঠিক । খেতেও মজা ছিল না

      ধন্যবাদ

    Load more comments...