খুব ভোর ভোর শীতের কুয়াশা ঘন রাত্রি ফুরোলেও যেন সকালের ঘুম ভাঙতে দারুণ আলস্য থেকেই চারদিক কেমন আবছা মতন দৃশ্যমান হচ্ছিল রুবির চোখে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বুঝতে চেষ্টা করছিল। যদিও আশপাশের বেশ কয়েকজন যাত্রীর অস্থিরতা আর অনুসন্ধানের ফলে জানা হয়ে গিয়েছিল সামনের যে স্টেশনেই ট্রেন থামবে সেটাই জয়দেবপুর। মইনুদ্দিনের সঙ্গে এমন কথাই হয়েছিল ফোনে। আর তারা থাকে জয়দেবপুর সে কথা আরো আগে থেকেই জানা ছিল রুবির। মইনুদ্দিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাকে সঙ্গে করেই ফিরে যাবে ঘরে। এমন প্রতিশ্রুতির পরই আসতে সম্মত হয়েছিল সে। নয়তো সে সরাসরি আখাউড়া জংশনেই চলে যাওয়ার কথা। অচেনা এলাকা তার কোনোকালেই পছন্দ নয়। কিন্তু তার স্বামীর সমর্থন ছিল বলে এবং সে-ই তাকে নিশ্চিত করেছিল যে, মইনুদ্দিন স্টেশন থেকে নিতে আসবে তাকে। অথচ এত কথার পরও ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের কোথাও মইনুদ্দিনের দেখা না পেয়ে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে।
একে তো শীত তারপর কুয়াশার জন্যে খুব বেশি দূর দেখা যাচ্ছিল না। তার কোলে ছেলেটা খুব বড় একটি কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে এ মুহূর্তে। নাকি লোকটি তার আসার সংবাদ বউকে জানাতে সাহস পায়নি? যে কারণে অতটা ভোর ভোর ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে কোনো অজুহাত তৈরি করতে পারেনি। মইনুদ্দিনের ওপর রাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ে সমস্ত পুরুষ জাতির ওপর। যে কারণে স্টেশনের খোলা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয় যে, প্রতিটি পুরুষই আসলে ভণ্ড প্রকৃতির। ঘরের ভেতর বউয়ের সামনে যতক্ষণ থাকে তখন তার এক চেহারা আর যখন আশেপাশে বউটি না থাকে তখনই খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। মনে মনে বেশ কিছুটা রুষ্ট হয়েই সে যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট আসনগুলোর একটিতে বসতেই পশ্চাদ্দেশে অকস্মাৎ কঠিন বরফ শীতল স্পর্শে ইচ্ছে হয় দাঁড়িয়ে পড়তে। কিন্তু রাতভর ঠিকমতো বসতে না পারার কষ্ট এবং জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের শীতের তীব্রতায় আঁচলের আর চাদরের নিচে ছেলেটিকে বসিয়ে বেশ কিছুটা কুকরে ছিল সে। নয়তো দেখতে পেত দুটি উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে দিয়ে হালকা কুয়াশার ভেতর চাদর গায়ে নাকমুখ আর মাথার বেশ কিছু অংশ মাফলারে আবৃত করে পুরোটা প্লাটফরমে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি লোক।
যদিও রুবি শীতের তীব্রতায় কুকরে-মুকরে বসে না থাকত, তাহলে নাক-মুখ মাফলারে আবৃত মইনুদ্দিনকে দেখতে পেলেও চিনতে পারত কিনা তাতে ঢের সন্দেহ আছে। মইনুদ্দিন একবার থেমে বসে থাকা এবং দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি যাত্রীর বা অপেক্ষমাণ নারী-পুরুষের চেহারা অবলোকন করতে করতে পকেট থেকে সেল ফোন বের করে একটি নির্দিষ্ট নাম্বারে কল করলে যান্ত্রিক বয়ানে জানতে পারে যে, রুবির ফোনটি এ মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে। এমন একটি নাজুক সময়ে ফোন বন্ধ রাখার মতো বোকামিগুলো কেন যে করে মানুষ! বেশ কিছুটা বিরক্ত, উদ্বিগ্ন আর হতাশাগ্রস্ত মইনুদ্দিন পুনরায় সেলফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে ভাবে যে, হতে পারে ব্যাটারির শক্তি কমতে কমতে আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গেছে ফোন। রুবি কি নিজে এমন একটি পরিস্থিতিতে ইচ্ছে করে ফোন বন্ধ রাখার মতো বোকামিটা করবে, নাকি করা উচিত? যেখানে সে জানতে পারছে যে, মইনুদ্দিন ছাড়া আর কাউকে চেনে না এ অঞ্চলে। চেনে না এলাকার রাস্তাঘাট বা চলাচলের পথ। এমন কি তার বাড়িতে যে সে কদিন বেড়ানোর উদ্দেশ্যে এসেছে সেই বাড়িটাই সে চেনে না। বলতে পারবে না কোন এলাকায় তা। যে কারণে একা একা রিকশা চড়ে নিজ বুদ্ধিতে সে যেতে পারবে না মইনুদ্দিনের বাড়িও। চিন্তা-ভাবনা করে এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই মইনুদ্দিনের ভেতরকার রুবি সংক্রান্ত উদ্বেগ দ্বিগুণ হয়ে যায়। হিঠাৎ স্টেশনের প্রায় বিপরীত প্রান্তে দূরের একটি কংক্রিটের বেঞ্চিতে শীতের প্রকোপে কিছুটা কুকরে গিয়ে চাদর মুড়ে বসে থাকা একটি নারী কাঠামোর দিকে দৃষ্টি পড়তেই সে প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় যে, এ নারী রুবি না হয়ে যায় না। যেহেতু দূর থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছে পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা ব্যাগের পাশে ঝুলে থাকা আরো এক জোড়া ছোট্ট পায়ের অবস্থান, তখনই বেশ কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে তার দেহ-মনে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে নারীটির পেছন দিক থেকে সে নিশ্চিত হতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুরোপুরি সন্দেহ মুক্ত হতে না পেরে সে আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। আর তখনই কোনো কারণে রুবি মুখ তুলে তাকাতেই মইনুদ্দিনের সঙ্গে চোখাচোখি হলে অকস্মাৎ সে খুশি হবে না রাগ প্রকাশ করবে তা নিয়েই হয়তো খানিকটা ইতস্তত করে। সেই অবসরে মুখ থেকে মাফলারের আড়াল সরিয়ে হেসে উঠে বলে মইনুদ্দিন, তুমি এইখানে বইসা আছ আর আমি পুরা ইস্টিশনে দৌড় পারলাম।
পুরোপুরি না রাগলেও বেশ খানিকটা বিরাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠে রুবি, আপনে না আমার আগে আগে ইস্টিশনে আসনের কথা! কই আছিলেন এতক্ষণ?
রুবির কথা শুনে বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে মইনুদ্দিন ফের কলকণ্ঠে জানায়,আমি তো ফজরের আগেই ইস্টিশনে আইসা বইসা রইছি। তুমি কোনখান দিয়া নামলা দেখতেই পাইলাম না!
-দেখবেন কেমনে? চোখ তো আর আমার দিকে আছিল না। বলতে বলতে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে মইনুদ্দিনের কোলের দিকে ঠেলে দিয়ে আবার তেমনই অপ্রসন্ন কণ্ঠে রুবি বলে, পোলাটারে কোলে লন! আমার হাত দুইটা মনে হয় লগে নাই!
মইনুদ্দিন কিছু বোঝার আগেই বুকের কাছে শিশুটির অস্তিত্ব অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে চাদর সমেত হাত দিয়েই ছেলেটাকে কোলে নিতে বাধ্য হয় সে।
ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছু সময় পর্যন্ত সব স্টেশনেই কিছু যাত্রীকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ দাঁড়িয়ে থাকে উদ্দেশ্যহীন। কেউ বা বসে বসে হিসেব কষে। আবার কাউকে দেখা যায় দেওয়াল কিংবা থামের গায়ে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে থাকতে। অচেনা মানুষ মইনুদ্দিনের কোলে রুবির ছেলেটা স্বস্তি বোধ করে না হয়তো। যে কারণে সে বারবার পা দুটো নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে হাত বাড়ায় মায়ের দিকে। রুবি ছেলের আকুতি দেখলেও তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। ছেলেটি ফের দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে কান্না শুরু করলে সে চোখ পাকিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে, পুরাটা রাইত আমারে জ্বালাইছ! জুত পাইয়া উঠতাছ না!
রুবি একবার চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে চাদরের নিচেই হাত রেখে ব্লাউজ বা আঁচল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে সঙ্গে খানিকটা নিস্তেজ কণ্ঠে মইনুদ্দিনের উদ্দেশ্যে বলে, এখানে বাইরে ঘরে যাওনের কোনো ব্যবস্থা নাই?
-আছে তো! বলেই মইনুদ্দিন চাদরের নিচ থেকে হাত বের করে আঙুল তুলে স্টেশনের টয়লেট দেখায়।
পুরুষ আর মহিলাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও ব্যবহারকারীদের অনেকেরই সে বোধটকু থাকে না বলে, মহিলা টয়লেট থেকে পুরুষও বের হয়ে আসতে দেখা যায়। দেখা যায় নারীদের কেউ কেউ গিয়ে প্রবেশ করছে পুরুষ টয়লেটেই। রুবি সেদিকে তাকিয়ে থেকেই মইনুদ্দিনের উদ্দেশ্যে বলল, আপনে এখানেই খাড়াইয়েন!
তারপর, ব্যাগটা রইল। খেয়াল রাইখেন! বলতে বলতে সে টয়লেটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে, মইনুদ্দিনের কোলে ছেলেটা কাত হয়ে ঝুকে পড়ে অকস্মাৎ বেশ শব্দ করেই কেঁদে ওঠে। কিন্তু সেই কান্নার শব্দ রুবির কানে প্রবেশ করে কিনা বোঝা যায় না। দেখা যায় না তাকে চকিতেও একবার পেছন পানে মুখ ফেরাতে।
খানিকটা ঝুঁকে পড়ে মইনুদ্দিন প্লাটফরমের ওপর রাখা রুবির ব্যাগটির দিকে তাকায়। আকৃতি দেখে অনুমান করতে চেষ্টা করে কী কী থাকতে পারে ব্যাগের ভেতর। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেতে একটি মানুষের কত কিছু সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে? একজনের ব্লাউজ-পেটিকোট আর শাড়ি কাপড়ে ব্যাগের পেট অতটা ফুলে ওঠার কথা না। এসব ভাবতে ভাবতে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সে দেখতে পায় থো থো শব্দ করে থুতু বা কফ ফেলে নাকে মুখে চাদর চেপে ধরে এগিয়ে আসতে আসতে কিছু একটা বলতে থাকে রুবি।
মইনুদ্দিন কিছু বুঝতে না পেরে নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলে রুবি নাক-মুখ থেকে চাদরের আচ্ছাদন সরিয়ে আরেকবার থুতু ফেলে কেমন বিকৃত কণ্ঠে বলে ওঠে, ছিহ! মানুষ এত পিছাশ! আমার মনে হইতাছিল নাড়ি-ভুড়ি সব বাইর হইয়া যাইব!
ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে মইনুদ্দিন জানতে চায়, কী এত বোচকা বাইন্ধা নিয়া আইলা?
-আপনের এত কিছু জাননের কাম নাই। আমার খিদা পাইছে অনেক!
-চল তাইলে নাস্তা করি আগে। বলতে বলতে মইনুদ্দিন ব্যাগের দিকে ঝুঁকে হাতলে ধরতে গেলে রুবি এক হাতে সে হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, আপনে আমার পোলারে সামলান। ব্যাগ আমিই নিতাছি!
ওরা দুজনেই উলটো দিকের রেল লাইন পেরিয়ে স্টেশনের প্রধান গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একটি খাবারের দোকানের দিকে যায়। তারা যেতে যেতেই দেখতে পচ্ছিল যে, বাইরের দিকে বড় একটি তাওয়ায় পরাটা সেঁকা হচ্ছে। পাশাপাশি ভাজা হচ্ছে ডিমও।
মইনুদ্দিন ভেতরের দিকে একবার উঁকি দিয়ে বলল, এইটাতে বসনের জাগা নাই লাগে। চল অন্যটায় যাই।
তখনই পরাটা আর ডিম ভাজায় ব্যস্ত লোকটি বলে উঠল, ভিতরের দিকে খালি আছে, বসেন যাইয়া।
টিনের একচালার নিচে চারদিকে মূলি বাঁশের চটার বেড়া দেওয়া ঘরের ভেতর তিনটি টেবিল আর ছ’টি চেয়ার সাজিয়ে লোকজনের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে দেখে রুবি নিচু কণ্ঠে বলে, এমন সস্তার হোটেলে কি ভালা জিনিস পাওয়া যাইব?
সদ্য খালি হওয়া একটি টেবিলের দিকে রুবিকে আহ্বান করে মইনুদ্দিন বলল, সব জাগার পরাটা ভাজি একই রকম। আর কি খাইবা, খিচুরি? ভুনা খিচুরি আছে।
রুবি নাকমুখ কুঁচকে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরের দিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, নাহ, খিচুরি খামু না। পরাটা ভাজিই খাই।
মইনুদ্দিন রুবির পাশে তার ছেলেটিকে কোল থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলল, পরাটার লগে ডিম খাও, শীত কম লাগব!
তাদের কথার মাঝখানেই একজন মধ্য বয়স্ক লোক বলে ওঠে, নাস্তা কয়টা দিমু?
-দুইটা দেও। লগে ডিম দিও তিনটা।
কিছুক্ষণ পর লোকটি ডিম-পরাটা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে আবার বলে, মিনারেল পানি দিমু?
সে কথা শুনে রুবি সঙ্গে সঙ্গেই জানায়, ব্যাগে পানি আছে।
লোকটি ফিরে গেলে মইনুদ্দিন অবাক হয়ে রুবির চোখের দিকে তাকায়। বলে, এত দূর থাইক্যা পানির বোতল বইয়া আনার কী দরকার আছিল?
গরম পরাটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে রুবি নির্বিকার কণ্ঠে জানায়, বিশটা ট্যাকা নষ্ট করনের দরকার কি? আর এক বোতল পানি তো সবটা লাগে না একজনের!
হবে হয়তো। ট্রেনে চলাচল করবার মতো দীর্ঘ যাত্রাপথে কোথাও যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই মইনুদ্দিনের। এমন কি খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে দূরের পথে যেতে আগ্রহও বোধ করে না সে।
(চলবে...)
Comments (24)
দারুণ এঁকেছেন! কোন টা আসল? ধরতে পারছি না! ৮ অথবা ১১ এর একটি হতে পারে। না হলে শরম দিয়েন না।
ধুর! শরম দেবো কেন?? কোন ইফেক্টটা ভালো লাগছে?? অনেক ধন্যবাদ, সুন্দর একটা মন্তব্য ও প্রথম মন্তব্যের জন্য।
আমার ৬ নাম্বারটা ভাল লেগেছে। এগুলো কি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এঁকেছেন, না ফটোশপের কারসাজি? যেটাই হোক, আপনি কিন্তু আঁকেন ভাল !!! এত গুণ আপনার
ক্যানভাসের উপর একটা তৈল চিত্র করা। বাকি গুলো ইফেক্ট। ৬নম্বরটাও একটা ইফেক্ট।
ভালো লাগলো জেনে খুশি হোলাম, আপু।
বেশ লাগল,
মাঘের শরীর যেন আজ সর্ষেফুল শিশিরে ধোয়া!
বেশ লাগাতে ধন্য হোলাম।
অনেক ধন্যবাদ জানবেন।