Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মোঃ জাকারিয়া জামান

১০ বছর আগে লিখেছেন

জলবায়ু সম্মেলন ২০১৩ ও বাস্তবতা।

জলবায়ু সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণের পর আবহাওয়াবিদেরা এই বলে একমত হয়েছেন যে গেল বছর অর্থাৎ ২০১২ সাল ছিল গত কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ। ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা IPCC’র বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, আজ পৃথিবী যে পরিমানে উষ্ণ হয়ে উঠেছে তাতে মানব সৃষ্ট কারণগুলি ৯৬% দায়ী। ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত পরিবেশের উপর আমরা যে অবিচার করেছি তার প্রতিদান হিসাবে প্রকৃতি আমাদের জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, সাইক্লোন, অতি বৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির মত তিক্ত উপাদান উপহার দিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু সম্মেলনটি এমন সময় আয়োজিত হচ্ছে যখন ফিলিপাইন “হায়ান” নামের এক ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের কারনে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

এমন একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে পোল্যান্ড’র রাজধানী ওয়ারশ’তে ইউনাইটেড নেশন্স ফ্রেইমওয়ার্ক কনভেনসন্স অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ বা UNFCCC’র কনফারেন্স অফ পার্টিজের ১৯তম অধিবেশন বা COP19 এর সম্মেলন শুরু হয়েছে এবং সেই সাথে কিয়াটো প্রটোকল সম্পর্কিত CMP9’র সম্মেলনও আরম্ভ হল। দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনটি ঘিরে শত কোটি মানুষের অনেক আশা আকাংখা রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দেশ ফিলিপাইনের প্রতিনিধি উদ্ভোধনী দিনে ভাষণ দিতে গিয়ে জানান এই সম্মেলন থেকে ভালো কোন কিছু না শোনা পর্যন্ত তিনি অনাহারে কাটাবেন। তার মত শত কোটি মানুষ এই সম্মেলন থেকে ভালো কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে।      

২০০৯’এ ডেনমার্ক, কোপেনহেগেন’র COP15’র সম্মেলনে ধনী দেশগুলির ভিতর একটা গা ছাড়া ভাব ছিল। কার্বন নিঃসরণ রোধের ব্যপারে তাদের কোন কার্যকরী ভূমিকা চোখে পড়েনি। কিন্তু আস্তে আস্তে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে যা আশা জাগানিয়া। বিশ্বের বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি তার দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করতে এক নির্বাহী আদেশ প্রদান করেন। এই পদক্ষেপ অন্যান্য ধনী দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে। এতে ঝুঁকিতে থাকা গরিব দেশসমূহ তথা পুরো পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হবে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড(GCF) নামে যে তহবিল গঠন করা হয়েছে তা বড় একটা সাফল্য বলা চলে। ২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এই তিন বছরে দক্ষিন কোরিয়াতে স্থাপিত কার্যালয়ে এই ফান্ডে ধনী দেশগুলি ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু এই অর্থের ব্যাবহারের ধরন নিয়ে মতানৈক্য রয়ে গেছে। এখন ঝুকি মোকাবেলায় COP19’এর সম্মেলনের অন্যতম প্রধান কাজ হবে ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করা। উন্নয়নশীল দেশগুলির অভিযোজন প্রক্রিয়া অনেকটা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’র উপর নির্ভরশীল, আর এই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত এবং স্থানীয় কলা-কৌশলের মধ্যে একটি যূগসুত্র স্থাপন করে গবেষণালব্ধ কাজকে মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এই সম্মেলনের আরেকটি লক্ষ্য।

এক দশকের ভিতর আমেরিকাতে ক্যাটরিনা ও স্যান্ডি নামক দুইটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ২০০৫ ও ২০১২ সালে আঘাত হানা এই দুইটিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মত। গত বেশ কবছর যাবৎ ইংল্যান্ড ব্যাপক বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারনে ইউরোপের বেশকিছু দেশের জীবন যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রায় প্রতিটি প্রদেশ অনাবৃষ্টির শিকার আবার হটাৎ করে অতি বৃষ্টির কারনে সেখানে বন্যাও দেখা দিচ্ছে, তীব্র দাবদাহের কারনে “বুশ ফায়ার” একটা নিত্য দিনের ঘটনায় পরিনত হয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলি এইধরনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম কিন্তু বাংলাদেশের মত গরিব দেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহায়।

২০৯৯ সাল অব্দি বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভিতর রাখতে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলি আশা করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তহবিল গঠন, জলবায়ু পরিবর্তন সহনীয় রাখতে টেকসই প্রযুক্তির আদান প্রদান ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সম্মেলনে অংশ নেয়া ধনী দেশের প্রতিনিধিরা আরো সক্রিয় হবেন।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুকি মোকাবেলা করতে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়মুখ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকায় আছে। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি “জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড”গঠন করেছে।এর পাশাপাশিউন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য “ক্লাইমেট চেঞ্জ রিজিলিয়েন্স ফান্ড”গঠন করে। ফান্ডে ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ডিএফআইডি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও ইউএসএইড ১৮৯ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে।এ ছাড়াও সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে গঠিত জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ইতিমধ্যে এক হাজার ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩৯টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলি আরো ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মত অর্থ এনেছে।কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে অনভিজ্ঞতা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে চরম সমন্নয়হীনতা, দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতি ও বাস্তবসম্মত কর্মপন্থার অভাবের কারনে ঝুকি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি একবারে নড়বড়ে।

বিশ্বব্যাংক এর মতে আমাদের প্রান প্রিয় দেশ দীর্ঘমেয়াদে নদীর নিষ্কাশন জনিত ত্রুটির কারনে বন্যা, নদী ভাঙ্গন, খাবার পানির স্বল্পতা, সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সম্মুখীন হবে। উল্লেখিত কারনসমুহের জন্য আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হবে। আজ আমরা সামাজিক বিভিন্ন সুচকে যে অগ্রগতি সাধন করেছি তা ধরে রাখতে ভবিষ্যতে মারাত্মক রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।  

দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির কারনে সুনামগঞ্জসহ হাওর অধ্যুষিত ৭টি জেলার কয়েক মিলিয়ন মানুষ এক চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হবে। আগামী দশকেই হাওর অঞ্ছলে ব্যাপক পানি স্বল্পতা দেখা দিবে, বনভূমি উজারসহ, জীব বৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আরো পিছিয়ে পড়বে।এমতাবস্থায়, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ব্যাপারে আমাদের সকলের সচেতন হওয়া জরুরি এবং সেই সাথে দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের মনে রাখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা কোন একক দেশের তৈরি নয় বিধায় এই সমস্যা সমাধানে সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। যদিও এটা একটা চ্যালেঞ্জ তারপরেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির ঝুকি মোকাবেলায় সবার যুগপৎ চেষ্টায় সফল হওয়া সম্ভব। ঝুকি মোকাবেলা করে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিভিন্ন সামাজিক সাফাল্য ধরে রাখতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন ফোরামে উপস্থিত থেকে আরো সোচ্চার ভূমিকা নিতে হবে। শিল্পোন্নতদেশগুলিরখেয়ালীআচরণেরশিকারআমরা। উন্নয়ন সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ধনী দেশগুলির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে কৌশলী হতে হবে। অর্থ ব্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নিজেদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারবে বলে আমি মনে করি।

Likes Comments
০ Share