মোবাশ্বেরা খানম কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাঁর বউমার দিকে চেয়ে থাকলেন । তিনি যেন নিজের কানকে বিশ্বাসকরতে পারছেন না । তিনি ঠিক শুনেছেন তো ! বউমা তাঁর সাথে কখনো এভাবে কথা বলবে, এ যেন তাঁর ভাবনাতীত ।
কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে গেলেন বউমার কথা । সবটা ঠিকমতো তাঁর কানে গেল না । তাঁর ছেলের দিকেও তাকালেন, অকর্মার ঢেঁকিটা একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছে । কিচ্ছুটি বলছে না । এও কী সম্ভব ! এ-ই কী তাঁর সেই ছেলে, যে মায়ের এতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারত না বলে, ওইটুকুন বয়সে পাটায় ঘষে মরিচ-পিঁয়াজ পিষে দিত ! মা একটু রাগ করলেই কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলত ! এ-ই কী তাঁর সেই ছেলে ? নাকি অন্য কেউ ?
বিয়ের পর কি ছেলে আর মায়ের থাকে না ? বউয়ের হয়ে যায় !
২
অরুচির কারণে মুখে কিছু তুলতে পারছে না শুনে, দুপুরে মেজ মেয়ে আসার সময় বাপের জন্য মুরগী রান্না করে এনেছিল । মোবাশ্বেরা খানমই বলেছিলেন, যেন কিছু রান্না করে নিয়ে আসে । মাঝে মেজ মেয়ের বাসায় কিছুদিন ছিলেন তাঁরা । তখন বেশ আহ্লাদ করে মেয়ের রান্না খেতেন আহমদুল্লাহ মাষ্টার । তাই এই অরুচিতে যদি মানুষটা দুটো ভাত মুখে দিতে পারে, সে চিন্তা করেই মেজ মেয়েকে বলেছিলেন বাপের জন্য যেন কিছু রান্না করে নিয়ে আসে ।
মেজ মেয়ে রান্না করে এনেছিল, মুরগী-ভুনা । দুপুরে খাওয়ার সময় মেয়েকে সাথে নিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলেন আহমদুল্লাহ মাষ্টার । ডায়াবেটিসের কারণে রাতে বেশী খান না । যেটুকু খান সেটুকু যেন ভালমতো খেতে পারেন, তাই বউমা কে মোবাশ্বেরা খানম বলেছিলেন মুরগী দিতে ।
বউমা মুরগী দিয়েছিল । ওমা ! মুখে দিতেই বিরক্তিতে মুখ-চোখ কুঁচকে উঠে আহমদুল্লাহ মাষ্টারের । মুরগী পুরো পানসে হয়ে গেছে । ঘটনা কি জিজ্ঞেস করতেই বউমা বলে, ঝোল ছিল না বলে সে জল মিশিয়ে দিয়েছে সেখানে !
৩
কথাটা শুনেই মাথায় যেন বাজ পড়ল মোবাশ্বেরা খানমের । ‘কি করলা এটা তুমি ! তুমি জান যে, মানুষটা গত পনেরো দিন ধরে ভাত মুখে তুলতে পারছে না । এই মুরগী দিয়ে দুপুরে তিনি দুটো খেতে পেরেছিলেন । আর তুমি কি না... সেখানেই জল ঢেলে দিলে !’
‘অ্যাঁহ, এমন বেকুবের মতো কাজ কেউ করে !’
‘ডাল নেই তাই ঝোল করার জন্য...’
‘ডাল নেই বলে কেউ এভাবে ঝোল বানায় ? পানি দিছ, ভাল কথা । লবণ-টবণ... মরিচ দিয়ে খাওয়ার মতো করে দিবা না ? তুমি জান না, তোমার আব্বা কিছু খেতে পারছে না ?’
এই নিয়ে বেশ হট্টগোল চলল কিছুক্ষণ । মোবাশ্বেরা খানমের ছোট ছেলেও ভাবীর এই নির্বুদ্ধিতায় বেশ ক্ষেপে গেলেন । পুরো বাসা জুড়ে একটু চেঁচামেচি চলল । তারপর সব স্তিমিত হয়ে এল, সংসারে যেমন হয়ে থাকে । সবাই যে যার রুমে গিয়ে শোয়ার আয়োজন করতে লাগল ।
এই সময় হঠাৎ মোবাশ্বেরা খানম বউমার বাজখাঁই গলা শুনতে পেলেন । এবং একই রাতে দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেল ।
৪
‘আমার স্বামী ছাড়া কেউ আমাকে কিছু বললে অনেক অসুবিধা হবে । যা বলার আমার স্বামী বলবে । অন্য কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না । এই আমি বলে রাখলাম’ ।
বউমার এমন ঘোষণায় কয়েক মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন মোবাশ্বেরা খানম । ছিঃ, বউমার লজ্জা টজ্জা সব কোথায় গেল ! ঘরে শ্বশুর আছে, এভাবে কথা বলতে তার একটুও বাঁধল না ? রাতের বাজে একটা । এতবড় করে কথা বলছে, বিল্ডিংয়ের সব মানুষই তো মনে হয় জেগে যাবে ! তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসেন মোবাশ্বেরা । বলেন, ‘রাত-দুপুরে আবার কি শুরু করলা বউমা ?’
‘যা বলেছি বলেছি । কেউ আমাকে কিছু বললে অনেক অসুবিধা হবে কিন্তু !’
‘বউমা ! ঘরে তোমার শ্বশুর আছে । কি বলছ তুমি এসব ? ঘরের বউরা এভাবে কথা বলে ? আমার মেয়েদের এত বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে । কই, তারা কখনো এই ধরণের কথা মুখেও আনতে পেরেছে ? শুনেছ কখনো ?’
‘আপনার মেয়েরা ওল্ড মডেলের । আমরা আধুনিক যুগের মেয়ে । আমাদের সাথে ওদের তুলনা হয় না’ ।
সেই রাতে তৃতীয়বারের মতো মাথায় বাজ পড়ল যেন মোবাশ্বেরা খানমের । তিনি হাই প্রেশারের রোগী । দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে বেশ কষ্টের হয়ে গেল । কোনমতে একটা চেয়ার ধরে তিনি আসন্ন পতন থামানোর চেষ্টা করেন । বিমূঢ়ের মতো বউমার দিকে চেয়ে থাকেন ।
৫
খাটের একপাশ ধরে মূর্তির মতো বসে আছেন মোবাশ্বেরা খানম । বার-কয়েক ঢেকে জবাব না-পেয়ে, চুপ করে গেছেন আহমদুল্লাহ মাষ্টার । অন্ধকারে চোখ খোলা রেখে শুয়ে আছেন তিনি । তাঁর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল কি গড়িয়ে পড়ল ! অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই ।
আহমদুল্লাহ অনেক কিছু সহ্য করতে পারলেও স্ত্রীর অপমান মোটেই সহ্য করতে পারেন না । আজ তাঁরই সামনে তাঁর ছেলে-বউ তাঁর স্ত্রীর মুখের উপর কি সব বাজে কথা বলে গেল । অথচ তিনি টুঁ শব্দটিও করতে পারলেন না । বুড়ো হলে গায়ের জোর কমার সাথে সাথে কি মনের জোরও কমে যায় ?
তিনি কি পারতেন না, ঐ উদ্ধত, দাম্ভিক-মুখরা রমণীটির দু’গালে দুটো চপেটাঘাত করতে ? এক-দুই চপেটাঘাতে পরের কত ছেলেমেয়েই তো মানুষ করেছিলেন । ভদ্রতা-শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছিলেন । তাঁর কি উচিৎ ছিল না, অভব্য নারীটিকে একটু ভব্যতা-ভদ্রতা শিক্ষা দেয়ার ? অন্তত কঠিন হুংকারও কি দিতে পারতেন না তিনি ?
এমন কঠিন সময়েও কেন তিনি তাঁর স্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারলেন না ! এই লজ্জায়, গ্লানিতে বিছানার একপাশে আরো গুটিয়ে যান তিনি । জানালা দিয়ে দেখেন তাঁর স্ত্রী ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে । সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই টের পেলেন, চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে নামছে । বাঁধা দিলেন না । নামুক, লবণাক্ত জলেরা আজ নেমে আসুক সব । গা-টা একটু শিরশির করে উঠল তাঁর । নাকি কান্নার দমকে কেঁপে উঠলেন তিনি ?
৬
আকাশে আজ চাঁদের অস্তিত্ব নেই । থাকলে ভালো হতো । মোবাশ্বেরা খানম আগেও খেয়াল করেছেন, তাঁর অনন্ত দুঃখের দিনে চাঁদটাও কোথায় যেন লুকিয়ে যায় । কেউ তাঁর পাশে থাকে না, না-ছেলে না-মেয়ে । চাঁদও না ।
হুঁহ, আধুনিক ! আধুনিক হলে কি এমন নির্লজ্জের মতো রাত-দুপুরে চেঁচাতে হয় ? বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর মুখের উপর বাজে কথা বলতে হয় ? মায়ের মতন শ্বাশুড়ীও কি আধুনিকাকে কিছু বলতে পারে না ! আজকালকার রকম সকম অনেক কিছুই ঠিক বুঝতে পারেন না, মোবাশ্বেরা ।
ভাগ্যিস ! তিনি আধুনিক ছিলেন না । আল্লাহ তাকে বড় বাঁচা বাঁচিয়েছেন । আশির্ধ্বো শ্বশুর তাকে মায়ের মতো ভালবাসত । বলত, “তুই আমার মা, বুঝলি । তোর জামাইটা যেখানে খুশী চাকরি করুক, যেখানে যাবে যাক, বদলি যেখানে হবে হোক, তুই আমাকে ছেড়ে যাস না । কেমন মা !” তিনি কখনো শ্বশুর কে ছেড়ে যাননি । বাপের বাড়িতেও দুই দিনের বেশী থাকতেন না, বুড়ো মানুষটার কথা চিন্তা করে ।
আহা, তাঁর বৃদ্ধা শ্বাশুড়ী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সাথেই ঘুমাত । কত গল্প করত তাঁরা ! কাছে ডেকে পরম মমতায় কতবার মাথায় চুল বেঁধে দিতেন তিনি !
কি অদ্ভুত ভালবাসার সম্পর্ক ছিল তাদের ! আহা ! অজান্তেই চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে মোবাশ্বেরা খানমের ।
৭
বাতাসটা আজ খুব বেশী ঠান্ডা । একটা চাঁদরও জড়াননি মোবাশ্বেরা খানম । খুব শীত লাগছে তাঁর । আসলেই কি বাতাস এতটা ঠান্ডা ?
তাঁর এক নাতনি আছে । ডাক্তার । বছর কয়েক আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়েছে । নাতনি-জামাইয়ের রাগটা একটু বেশীই । অল্পতেই চটে যায় । মাঝে মধ্যেই সেই নাতনি তাকে ফোন দেয় । বলে ‘নানু, একটু দোয়া করবেন ! যেন মানুষটার রাগটা একটু কমে যায় !’ কখনো কখনো মোবাশ্বেরা খানমের হাসি পায় নাতনির কথায় ।
সেই নাতনির বিশাল পরিবার । শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, ননদ-দেবর নিয়ে এক মহাযজ্ঞ যেন সেখানে ! কত খুনসুটি, ছোট-খাট তর্ক-বিতর্ক, কথা কাটাকাটি... কত কিছু হয় । সাংসারিক কত ঝামেলার কথা তাকে বলে । কই, সে তো কখনো শ্বশুর-শ্বাশুড়ী ননদ-দেবরের কিছুতে অনুযোগ করে না । তবে সে কী আধুনিক নয় ? তাঁর মেয়েদের মতোই পুরনো ?
৮
মোবাশ্বেরা খানম বুকের কোথায় যেন একটা দলা পাকানো অনুভূতি টের পান । ভীষন কষ্ট লাগছে তাঁর । মেজ মেয়ের বাসায়, বইয়ের আলমারিতে একটা বইয়ে একটা কবিতা পড়েছিলেন । কার কবিতা ঠিক মনে নেই তাঁর ।
‘কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট’ ।
এতটুকুই মনে আছে, আর নেই । কবিতাটা এখন খুব পড়তে ইচ্ছে করছে তাঁর । কিন্তু কোথায় পাবেন সেটা ?
কত ধরণের কষ্টের কথা বলা হয় সেখানে । তাঁরও যে খুব কষ্ট হচ্ছে, ব্যাথা হচ্ছে । তীব্র অপমানের কষ্ট, লজ্জার কষ্ট, গ্লানির কষ্ট, ছেলের চুপ থাকার কষ্ট... কত রঙের, কত স্বাদের কষ্ট । ব্যক্ত কষ্ট, অব্যক্ত কষ্ট । এত কষ্ট কেন তাঁর ! এত কষ্ট রাখবেন কোথায় তিনি !
মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসার বিশাল এক সাম্রাজ্য আছে তাঁর । সেসব রাখার জায়গার অভাব পড়েনি কোনদিন । কেউ যেঁচে এসে নিয়ে গেছে, কাউকে বা তিনি যেঁচে দিয়েছেন ।
কিন্তু এখন এই এত কষ্ট কোথায় রাখবেন, কাকেই বা দেবেন ? এমন কেউ কি আছে, যে তাঁর থেকে কিছু কষ্ট নিয়ে যাবে ? ওফ, অসহ্য বেদনা হচ্ছে তাঁর । অপমান-লজ্জার যুগল যাতনা বড় কষ্টের । ভীষণ কষ্টের । তিনি যেন আর সইতে পারছেন না । কেউ কি নেবে তাঁর কষ্ট !
______
পুনশ্চ : কবিতার অংশটুকু কবি হেলাল হাফিজের 'ফেরিঅলা' কাব্য থেকে ধার করা । গল্পের শিরোনামটাও ।
Comments (0)
সুন্দর কবিতা , পড়ে ভাল লাগলো।