Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Safat Shoeb Bisshoy

৯ বছর আগে লিখেছেন

মৃত্যুর ডাক

লতিফ সাহেব পেশায় একজন ব্যবসায়ী মধ্যবয়স্ক, বয়স পঞ্চাশ ছুইছুই । নিউ মার্কেটে ব্যাগের দোকান তার। খুব বেশি না হলেও ব্যবসায়ে যা আয় করেন মোটামুটি চলে যায় তার একার সংসার । ঘুরতে বড্ড  ভালবাসেন ,একমাত্র ছেলে রাকিব আমেরিকাতে আন্ডার গ্রাজুয়েট পড়ছে, যোগাযোগ হয় না বললেই চলে।
তাই নেই কোন পিছুটানও । যখন ইচ্ছা , যেখানে ইচ্ছা ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। নেই কোন বাধা,নেই কোন বিপত্তি । নিজের এই স্বাধীন জীবনের একমাত্র সঙ্গী  তার একমাত্র বন্ধু  জামান। তারও ব্যাগের দোকান ছিল, ঠিক লতিফ সাহেবের পাশে।সেই সুত্রেই লতিফ সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয়।
তিনি ব্যবসায় মার খেয়ে বর্তমানে একটি কোম্পানির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে  চাকুরী করছেন । কোন কাজেই তিনি বেশি দিন থিতু হতে পারেন না ।হয় তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন, অথবা কোন কারনে বরখাস্ত হন। এই বিশেষ কারনে তিনি বিয়ে করেননি । এইভাবে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল দুই বন্ধুর জীবন।
এমনি একদিন জামান সাহেব আসলেন লতিফ সাহেবের দোকানে তার সাথে দেখা করতে ঃ
"কিরে জামান ? তুই?এতদিন পরে? নতুন চাকুরী পেয়েতো বন্ধুর কথা ভুলেই গেছিস!! "
"কি যে বলিস তুই! তোকে ভুলে যাবো? আসলে এই চাকুরীটা নিয়ে এত ব্যাস্ত থাকি যে তোর সাথে দেখা করতে আসতে পারিনা। তারপর বল বন্ধু, তোর কি খবর? " নিজের ব্রিফকেস রাখতে রাখতে ব্জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
"খবর বেশি ভাল না! দোকানে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি । কবের থেকে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না!"
"তা যা বলেছিস । সামনেই কোরবানির ঈদের ছুটি আছে। চল কোথাও ঘুরে আসি। " বলেই চোখ কুচকে উঠল তার।
"তা বল ।কোথায় যেতে চাস? "
"চল কুয়াকাটা থেকে ঘুরে আসি । সুখীনিলগঞ্জ  গ্রামে আমার এক চাচা থাকেন ।সেখান থেকে কুয়াকাটা খুবই কাছে ।আমরা প্রথমে সেখানে যাবো তারপর সেখান থেকে কুয়াকাটা ।কি বলিস? "
সুখীনিলগঞ্জের নামটা শুনেই কেমন জানি গা কাটা দিয়ে উঠল । তাই লতিফ গাইগুই করা শুরু করল। তার অবচেতন মন কেন যেন তাকে বারবার সেখানে যেতে নিষেধ করছে।তাকে সাবধান করছে এবং  বলছে সেখানে যেয়ো না, ওখানে বিপদ।
 "আসলে হয়েছে কি? আমার শরীরটা তেমন ভাল না। তাই জার্নি করে এতো দূর যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।" মিথ্যা বলে যাত্রা ভঙ্গ করতে চাইলেন তিনি।
"এখন  না বললি যে তুই যাবি? দোকানে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছিস?" অবাক দৃষ্টিতে জামানের প্রশ্ন।
লতিফ সাহেবের আকস্মিক মত পরিবর্তনে জামান সাহেম বিরক্ত হলেন খুব।
 "আসলে তখন শরীরের কথা মনে ছিল না।"
 "দেখ, এইসব আজিব ফাজলামি আমার সাথে করবি না, ঠিক আছে?তুই সামনের সপ্তাহে আমার সাথে যাচ্ছিস সুখীনিলগঞ্জে, ঠিক আছে?"
লতিফ সাহেব চুপ করে আছেন। কারন তিনি জানেন জামান যেহেতু একবার গো ধরেছে যে সুখীনিলগঞ্জ  তাকে নিয়ে যাবে সেহেতু সে যাবেই। তাকে না বলে লাভ হবে না। কেন যেন এই বন্ধুটির সাথে তিনি কক্ষনই পেরে উঠেন না। কিন্তু জামান তো জানেনা লতিফ সাহেব কেন যেতে চাচ্ছেন
না! সে জানে না  তার জীবনের কালো একটি অধ্যায় তিনি ফেলে এসেছেন সেখানে । যেই অধ্যায়ের সৃতিগুলো এখনও তাকে মনের ভিতর কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে , প্রতিটা মুহূর্তে , সবসময়।


সুখীনিলগঞ্জ, নামের মতই খুব সুন্দর ও ছোট একটি গ্রাম  ঠিক যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। গ্রামের পরিবেশ ছিমছাম, বেশিরভাগই এখানে পেশায় কৃষক। গ্রামটি তেমন উন্নত না হলেও অজপারা গাও না।পাশাপাশি ঘর বাড়ি, সর্বদক্ষিণে বাঁশঝাড়  যা ঘেঁষে চলে গেছে এক বিল। সাঁকো দিয়ে বিল পাড়
হলেই একপাশে মসজিদ এবং মসজিদের পাশেই একটা দোচালা টিনের বাড়ি যেখানে মসজিদের ইমাম সাহেব থাকেন। অতিথি কেউ গ্রামে আসলে সাধারণত এই মসজিদেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়! খাবারদাবার সব আসে ইমাম সাহেবের বাড়ি থেকে। অবশ্য এর জন্য ইমাম সাহেবকে প্রতি
মাসে তার সম্মানির সাথে কিছু অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয় যাতে অতিথির কাছে গ্রামের  অপমান না হয়। এসবের ব্যবস্থা করেন এলাকার গণ্যমান্য সব ব্যক্তিরা।গ্রামের চেয়ারম্যান ইউনুস সাহেব এসব ব্যাপারে অনেক সচেতন। তার একটাই কথা "গ্রামের সম্মান আমাগো সব্বাইয়ের সম্মান।
তাই গেরামের অতিথি আমাগো সবাইয়ের অতিথি। তাই খেয়াল রাখতে হইব যাতে গেরামের অতিথির যেন কোন অসম্মান না হয়। দরকার পড়লে আমরা না খায়া মরমু তবুও লক্ষ্য রাখমু অথিতির কোন অসম্মান যেন না হয়।" তাই জামান সাহেব ও লতিফ সাহেবকে মসজিদেই উঠতে  হল।তাদের
 মসজিদে পৌছাতে বেলা হয়ে গেলো।
তাদের দেখভাল করছেন ইমাম আহসানুল করিম। ইমাম সাহেব স্বল্পভাষী। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলেন না বললেই চলে। জামান সাহেব খানিকটা এতে চমকে গেছেন, কেননা ইমামদের সবসময় বেশি কথা বলতে দেখা যায়। তারা নিজেদের ধর্মের শিক্ষার উপর দখল দেখিয়ে অন্যদের মুগ্ধ করতে
চায় যেন তারাও ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহী হয়। কিন্তু ইনি আলাদা। ইমাম সাহেবের বয়স ৩৫-৪০এর মাঝামাঝি। মুখভর্তি দাঁড়ি ,কুচকুচে কালো। সুদর্শন বলা যায়? হা বলা যাবে। তিনি খুব কমই হাসেন কিন্তু হাসলে তার চোখ দুটোও তার মত করে হাসে।তার হাসি সুন্দর। সম্ভবত খুব দামি সুগন্ধি দিয়েছেন।
কেননা তার গা থেকে ভুজভুজ করে ঘ্রান আসছে।
"ইমাম সাহেব,কেমন আছেন?" জামান সাহেব প্রশ্ন করলেন।
'আল্লাহর রহমতে ভাল জনাব।'
'আপনি কি জানেন আমরা এখানে কয়দিন থাকতে এসেছি?'
'জি জনাব,আমি জানি ।আমাকে ইউনুস সাহেব এ ব্যাপারে বলেছেন।'
'কেন থাকতে চাই সেটা জানতে চাচ্ছেন না?'
'না জনাব, কোন কাজই কারন ছাড়া হয়না!কিন্তু আমরা এর কয়টাই বা জানি। যদি জানা প্রয়োজন হয় তাহলে আল্লাহপাক নিজের থেকেই জানানোর ব্যবস্থা করবেন।'
লতিফ সাহেব লোকটার গোছানো কথায় চমকালেন। এই শহর থেকে দূরে একটা গ্রামের একজন ইমাম এতো গুছিয়ে কথা বলা দেখে তিনি অবাক হলে।
'আপনি এখানে কতদিন ধরে ইমামতি করছেন?'গলা ঠিক রেখে তিনি প্রশ্ন করলেন।
'প্রায় ১০ বছর।'
'আপনি কি প্রথম না এর আগেও এই মসজিদে কেউ ছিল?'
'না, আমার আগে আরেকজন ইমাম ছিলেন এখানে। তিনি দীর্ঘদিন এখানে ইমামতি করেন। নাম হাজী জাহিদুল ইসলাম।' নামটা শুনেই বুকের ভিতরে একটা মোচড় দিল লতিফ সাহেবের।
'হাজী সাহেবকি এখানে একাই থাকতেন?'
'না। তার ছেলে রাকিব এবং  একটা ভাগ্নি আসমা  থাকতো,এতিম।মা বাবা ছিল না নাকি মেয়েটার।'
'তারা এখন কোথায়?'
'জনাব আমি যতটুকু জানি, হঠাৎ একদিন তিনি গ্রাম থেকে পালিয়ে যান।তিনি নাকি পরিমল বাবুর কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন। সেই টাকা ফেরত দিতে না পেরে গ্রাম থেকে পলায়ন করেন। এমনকি নিজের সকল আসবাবপত্রও রেখে যান। এই ঘটনার পর পরিমল বাবুরও খোঁজ পাওয়া যায় না।'
'কেন?'
'লোকে বলে পরিমল বাবু নাকি মুসলিম হয়ে ওই মেয়েকে অর্থাৎ বিয়ে করে দেশান্তরি হয়েছেন। তিনি আগেই বিবাহিত ছিলেন কিনা!' শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন লতিফ সাহেব। 'আপনের যদি জানতে ইচ্ছা হয় তবে আপনে চেয়ারম্যান সাহেবকে জিজ্ঞেস করবেন।তিনি এই ব্যাপারে বিস্তারিত আপনাকে বলতে পারবেন।"
' তিনি কি আজ আসবেন?'
'হা, আসতে পারেন।'
'গ্রামে নতুন অতিথি আসলেই কি তিনি আসেন দেখা করতে?'
'জি জনাব। তিনি গ্রামের সম্মান নিয়ে অনেক চিন্তা করেন। জনাব এখন যদি অনুমতি দেন আপনেদের জন্য খানাখাদ্যের আয়োজন করি।'
'আপনি এখন রান্না করবেন?'
'জি না। আমার স্ত্রীকে  আপনেরা আসবেন শুনে রান্না চরিয়ে দিতে বলছিলাম।তেমন আহামরি কিছু না,সেগুলাই আপনাদের সামনে আনব।'
'আচ্ছা যান।'
ইমাম সাহেব খুব দ্রুত চলে গেলেন।
খাবারদাবারের আয়োজন খুব বেশি না হলেও তারা খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলেন।মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বিছনা, এরমধ্যে লতিফ সাহেব তার গল্পের বই হাতে নিলেন এবং জামান সাহেব বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। জামান সাহেবের একটু তন্দ্রামত এল কিন্তু হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেবের উপস্থিত এসেই বাজখাই গলায় সালাম দিলেন।
যাতে জামান সাহেবের তন্দ্রা কেটে গেলে এবং তিনি হুড়মুড় করে বসলেন।
'কেমন আছেন আপনেরা? আমি এই গ্রামের চেয়ারম্যান।নাম ইউনুস চৌধুরী, আশা করি চৌধুরী বংশের নাম আপনেরা শুনেছেন।'লোকটার কথা শুনে প্রথমেই যা পরিস্কার তা হল তিনি অহংকারী। নিজের নাম যশ খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে দিতেই তার এতো অতিথিপরায়ণতা।গ্রামের সম্মানের মূল্য
সেখানে শুধুই লোকদেখানো ব্যাপার। আরেকটা ব্যাপার বুঝা গেলো তিনি কথা বলতে ভালবাসেন।  কারনে অকারনে বিরতিহীনভাবে কথা বলতে পারেন।
"আপনাদের এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে নাতো?"
'জিনা, কোন সমস্যা হচ্ছে না।আপনি দয়া করে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।" চোখ ডলতে ডলতে জামান সাহেব জবাব দিলেন।
'ব্যস্ত হব না মানে? আপনারা গ্রামের অতিথি। শহর থেকে গ্রাম দেখতে এসেছেন ,গণ্যমান্য ব্যক্তি। আপনাদের যদি অসম্মান হয় তবে গ্রামের অসম্মান হবে।" বলেই মুখটা এমনভাবে চউখা করলেন যেন পেটে ব্যথা করছে। তার পাশে দাঁড়ানো টেটন ধরনের ছাতা ধরা মানুষটি পিকদান মুখের সামনে ব্যস্ত ভাবে
ধরায় তিনি পিচিক করে পানের পিক ফেললেন। ব্যাপারটা মজার, তার চউখা মুখ দেখে লোকটা বুঝতে পেরেছেন যে তিনি পিক ফেলবেন। অর্থাৎ তিনি বহুবছর ধরেই এই কাজ করছেন নাহলে মুখের ইশারায় বুঝতেন না তিনি কি বলতে চাচ্ছেন।
'আচ্ছা, আপনের ছাতা যে ধরে আছেন তিনি কয় বছর ধরে আপনের সাথে আছে?'
'কে? বদর? অনেক দিন। ১০-১২ বছর হইব।'
গল্পের বই থেকে মুখ তুলে লতিফ সাহেব প্রস্ন করলেন " আচ্ছা ইউনুস  সাহেব , জাহিদুল ইসলামের রহস্যটা কি?'
'ধুর, রহস্য নাকি ছাই! ওই ভণ্ড ইমাম পরিমল নামের এক বদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। কিন্তু টাকা ফিরত দিতে না পাইরা গ্রাম ছেড়ে পালায়। ওই বদ পরিমলের সাথে নাকি তার এতিম ভাগ্নি আসমার বিয়ে দেন। পরিমল বদও নিজের বউঝি ঘরে ফেলে ধর্মত্যাগ করে বেহায়ার মত তার সাথে যায়।'
হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হল। জমিদার সাহেব ব্যস্ত হয়ে পরলেন। 'আমি আসি জনাব, আপনারা বিশ্রাম করেন।' বলেই বড় বড় পায়ে তিনি বাসার দিকে রওয়ানা হলেন।


খুব দ্রুত তিনি দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলে জামান সাহেব লতিফকে প্রশ্ন করলেন " ঘটনা কি? হাজী সাহেবের বিষয় নিয়ে তোর আগ্রহের কারণটা কি বুঝতে পারলাম না।'
'কোন কারন নাই বন্ধু। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগায় প্রশ্ন করলাম, আর কিছুই না।' বলেই চোখ বন্ধ করলেন তিনি।তিনি  ভিতর ভিতর অস্থির বোধ করছেন। এর কারন তিনি একটা মিথ্যা বলেছেন ,তিনি বলেছেন যে তার আগ্রহের কোন কারন নেই কিন্তু কথাটা সত্যি না। হঠাৎ করে তার ১০ বছর আগের সব কথা
মনে পড়ে গেলো,
তিনি তখন এই মসজিদেই ইমামতি করতেন, তাকে গ্রামের মানুষ অনেক সম্মান করত। দেখলেই মাথা নিচু করে সব বয়সের মানুষ সালাম দিত। যেকোনো গ্রামের সালিশে তার ডাক পড়ত। সুখশান্তির কোন অভাব ছিল না। বাসায় তার একমাত্র ছেলে ছাড়াও ভাগ্নি আসমা ছিল। মেয়েটা সদ্য ১৬পাড় হয়েছে।
কিন্তু এখনও তার মুখ যেন শিশুর মত নিষ্পাপ। মেয়েটার চেহারায় লক্ষ্মী দেবীর মত পবিত্রতা। খোদা সবাইকে সবকিছু দেন না। যে সুন্দর হয়ত তার গলা সুন্দর না অথবা অতিরিক্ত চঞ্চল । কিন্তু আসমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খাটত না। সে অত্যন্ত শান্ত প্রকিতির, ধীর স্থির। গ্রামের কারো সাথেই তেমন খাতির নেই। একমাত্র
পরিমল নামের একজন শিক্ষক আছে যে তাকে অঙ্ক পড়ায় তার সাথেই তার ভাব।  তাছাড়া আসমার গলাও অসাধারন, প্রতি বছর হামদ ও নাত প্রতিযোগিতায় সে প্রথম পুরস্কার পায়। ভালোই যাচ্ছিলো দিন জাহিদুল সাহেবের। কিন্তু হঠাৎ একদিন আষাঢ়ে বিকালে ঘটল সেই বিভীষিকাময় ঘটনা।
বাড়িতে ছিলেন শুধু জাহিদুল সাহেব এবং তার ভাগ্নি। তার ভাগ্নি ছাদ থেকে ভিজা কাপড় এনে রাখতে রাখতে চুল শুকাচ্ছিলেন। ঠিক তখন এক নজর আসমার ভিজা শরীর  দেখে বিপত্নীক জাহিদুল সাহেব একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন।  তার সকল পুরুষত্ব তার উপর অতৃপ্ত আত্মার মত ভর করেছিল।
তিনি ধীর পায়ে আসমার পিছনে যেয়ে দাঁড়ালেন এবং মুখ চেপে ধরলেন। তার অবশ্য দরকার ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় আসমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না । এরপর কি হয়েছিল জাহিদুল সাহেব জানেন না। আসমার চিৎকার তার কানে পৌছায় না। বাইরের বৃষ্টি শব্দে ঘর থেকে সে শব্দ বাইরে যেতে দেয়না।
আসমা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু একসময় তার শক্তি নিঃশোষিত হয়। সে তার ভাগ্যের অভিশাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে।


ঘোর যখন কেটে গেলো তখন জাহিদুল সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এ তিনি কি করলেন! যাকে গ্রামের মানুষ এতো সম্মান করেন তিনিই কিনা এমন এক অপরাধ করলেন যা পৃথিবীতে সবচেয় ঘৃণিত কয়েকটা ঘটনার একটা। না না, এ ঘটনা কাউকে জানতে দেয়া যাবে না, তাহলে তিনি চাকুরী তো হারাবেনই
সাথে  সাথে তাকে গ্রামত্যাগ করতে হবে। এই দুর্মূল্যের বাজারে চাকুরী যেন সোনার হরিণ। তিনি কোনোভাবেই এটা কাউকে জানতে দিবেন না। দরকার পড়লে আসমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাবেন। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি আসমার ঘরে গেলেন। তাকে দেখে আসমা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো,
'আসমা কি খবর?'
'আপনে কি চান?' কাঁপা কাঁপা গলায় আসমা বলল।
'আমি কিছুই চাই না। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসছি।'
'ক্ষমা? ক্ষমা তোর মার কাছে গিয়া চা। বদমাইশ , আমি তোরে বাপের নজরে দেখতাম। আর তুই কিনা আমার লগেই কুকীর্তি করলি। ছিঃ !'
'দেখ আসমা ,আমি জানি আমার ভুল এখানে, কিন্তু তোমার কাছে আমার  অনুরোধ তুমি এই কথা কাউকে বল না। তাহলে আমাদের চাকুরী ছেড়ে এই গ্রাম থেকে পালাতে হবে।আমরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ব, থাকা খাওয়ার কোন জায়গাই থাকবে না।'
'থু দেই তোর থাকা খাওয়াতে। কিন্তু তুই ভয়  পাইস না, আমি কাউরে কিছু কমু না। কারন আমি চাই না, তোর লেইগা তোর নিরীহ পোলাটা শাস্তি পাক, ওর ভবিষ্যৎ খারাপ হোক। তাছাড়া তোর মত জানোয়ারের শাস্তি এই পৃথিবীতে নাই। তোর শাস্তি করবেন তিনি যে সর্বশক্তিমান...'
হঠাৎ তখন আসমার দরজার কাছে চৌকাঠে শব্দ হল। আসমা এবং জাহিদুল ফ্যাকাশে মুখে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। 'কে? কে ওখানে?' চেচিয়ে উঠলেন । জাহিদুল সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলে তিনি দেখেন যে পরিমল বাবু। তার  কলিজা শুকিয়ে গেলো দেখে।
 'পরিমলদা আমাকে মাফ করে দেন। আমার ভুল হইসে।'
পরিমল বাবুর মুখে এক সুক্ষ হাসির রেখা ফুটে উঠল। ' আমি যদি কাউকে না বলি, তাহলে??'
কথাটা শুনে জাহিদুল একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন।
"তুমি কি বলতে চাও?" পরিমলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকান জাহিদুল সাহেব।
"আপনার তো টাকার কোন কমতি নেই। ইমামতি করে ভালোই আয়রোজগার করেন। তার কিছু পরিমান যদি আমাকে মাসে মাসে দেন তবে তো আর আপনার সম্মানও রইল এবং আমার দিন ভাল কাটল।" জোরে হেসে দিলেন পরিমল যেন খুব উচু দরের রসিকতা করেছেন।
"ওহ, বুঝেছি। তোমার টাকা পৌঁছে যাবে। কিন্তু সাবধান এই কথা যেন কোনোভাবেই জানাজানি না হয়।"
"আপনি কোন চিন্তা করবেন না জনাব। আমার আমৃত্যু এই কথা কেউ জানবে না,শুধু আপনি আমার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন।"
পরিমলের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন জাহিদুল সাহেব।  যাক, বড় বাচা বেচে গেলেন এই যাত্রায়। কোনভাবে যদি অন্যকেউ জেনে যেত তাহলে কি বড় কেলেঙ্কারিটাই না হত। টাকা পয়সা আজ আছে কাল নেই, তাছাড়া এলাকার একমাত্র ইমাম বলে আয়রোজগার এখন ভালোই হচ্ছে।
লোকে জানাজানি হলে তো চাকুরীটাই  থাকতো না, তার থেকে পরিমলকে অল্প কিছু টাকা দিয়ে দেওয়াই ভাল।


কিছুদিন পরঃ
"আরেহ পরিমল তুমি, কি খবর? তোমার টাকা তো পাঠিয়ে দিয়েছি।" জাহিদুল সাহেব বলে উঠলেন।
"হেহে, আসলে আপনার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা  ছিল। তাই আরকি দেখা করতে আসলাম।" পরিমল  মুখটা যত সম্ভব তেলতেলে রাখা সম্ভব ততটুক রেখে বললেন।
"কি জরুরী কথা?"
" আসলে বয়স তো আর কম হল না। আমার জায়গাজমি করাতো কিছুই হল না। ছেলেদের জন্য কিছুতো করা দরকার ,তাই না?"
"হ্যা, তাতো অবশ্যই। কিছু করা উচিত ।তো, কিছু ভাবলেন?"
"ভাবলাম বটে। ঐযে রহিম আছে না?"
"কোন রহিম? রহিম মুন্সি?"
"হ্যাঁ, রহিম মুন্সি ঠিক করেছেন তার ভিটাবাড়ি বিক্রি করে দিবেন।ভাবলাম, ওইটাই কিনি।"
"হ্যাঁ কিনো। তো আমার কাছে কি?"
" না আজ্ঞে......আমি বলছিলাম কি...... মানে আপনি যদি বাড়ির অর্ধেক টাকা দিতেন......"
"মানে? আমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?" রাগে ও বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে গেলেন জাহিদুল।
"জি আপনি। এতো চিৎকার করছেন কেন?"
"আজব তো । চিৎকার করবো না?তুমি জানো  তুমিকি বলছ?"
"আলবৎ জানি। আপনি হয়ত একটা জিনিস ভুলে গেছেন।"
"কি ভুলে গেছি? তুমি কি বলতে চাও?। বেরিয়ে যাও ,  এক্ষণই বেরিয়ে যাও এখান থেকে। "
"আস্তে আস্তে!! রাগের মাথায় এমন কিছু করেন না যাতে আমি কষ্ট পাই।হয়ত তাহলে আমি এমন কিছু করতে বাধ্য যা আমি করতে চাই না। হাহাহা, আমি কাল যাচ্ছি জমি দেখতে। আপনিও চলেন। কাল বেলা ৩টা। আমি আসি এখন।"
পরিমল চলে গেলে রাগে কাপতে থাকেন জাহিদুল সাহেব।তিনি এখন কি করবেন?
পরিমলের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। কিছু করতে হবে! এমন কিছু যাতে চিরদিনের জন্য পরিমলের মুখ বন্ধ হয়ে যায়...
না, জামান সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তিনি আজ রাতেই যা করার করবেন। এবং তাকে সাহায্য করবে ইউনুস সাহেবের বিশ্বস্ত লোক বদর। বদর শক্তসামর্থ্য এবং মোটামুটি অনুভূতিশূন্য মানুষ। কিছুটা রোবটের মত। তাছাড়া তার সাথে জাহিদুল সাহেবের ভালোই খাতির। তাই জাহিদুল ইসলাম সাহেব যদি
টাকার লোভ দেখিয়ে  তাকে সব ঘটনা খুলে  বললে এবং তার সাহায্য চাইলে সে নির্দ্বিধায় সাহায্য করবে। তাছাড়া বদরের গ্রামে তেমন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধব নেই। তাই বদরকে সবকিছু বলা মোটামুটি নিরাপদ।


বেলা ৩টা। রহিম মুন্সির বাড়ি কাছেই।  ৫মিনিটের হাঁটাপথ। কিন্তু কিছুদিন আগেই পরিমল  জাহিদুল সাহেবের টাকায় নতুন মোটরসাইকেলে চড়ে এসেছেন।
"আরেহ ইমাম সাহেব, আপনি দেখি একদম  নতুন পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়ে আছেন, হাহাহা......"
'হ্যাঁ , একটা শুভ কাজ করতে যাচ্ছিতো , তাই আরকি!'
'ওহ, আচ্ছা আচ্ছা। চলেন যাই।"  বলেই মোটরসাইকেল চালু করলেন পরিমল।
দক্ষিন দিকে বিলের পাশ দিয়ে তীর ঘেঁষে চলছে পরিমলের মোটরসাইকেল । সো সো বাতাস কানের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। যার কারনে চুল এলোমেলো হয়ে গেছে পরিমল বাবুর। জাহিদুল সাহেবের মাথায় টুপি থাকায় তার চুল পর্যন্ত বাতাস পৌছাতে পারছে না। মোটরসাইকেল চলছে নিজস্ব গতিতে।
কিন্তু হঠাৎ কর্কশ ব্রেক চেপে ধরে থামাতে হল যন্ত্রটাকে ।ব্যাপারটায় একটু বিরক্তই হল পরিমল, ভ্রু কুঁচকে পরিমল বাবু জিজ্ঞেস করলেন, "কি ব্যাপার? হঠাৎ এই নির্জন এলাকায় গাড়ি থামাতে বললেন যে!"
"আরেহ দাড়াও দাড়াও, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে আসি।"
" সাড়া দিবেন ভাল কথা, তাই বলে এই নির্জন এলাকায়!"
'হাহা, আরেহ এই ডাক কি জায়গা দেখে আসে নাকি? কখন কার ডাক আসে কেউ জানে না। ঠিক যেন মৃত্যুর ডাকের মত!'
"আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, যান। যা করার তাড়াতাড়ি করেন, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
'হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়ি করবো। আমার হাতেও সময় যে খুব কম।'
বলেই দ্রুত পায়ে জঙ্গলের দিকে হাটতে লাগলেন।  কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি মিলিয়ে গেলে পরিমল মোটরসাইকেলে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে বিড়ি ফুকতে ফুকতে গান গাইতে শুরু করলে সেই গান সেই নিঃশব্দ প্রকৃতির সাথে দারুনভাবে মানিয়ে গেলো। সে নিজের গানে এতো মশগুল ছিল,বিল দেখায় এতই ব্যস্ত ছিল যে সে টের
পেল না যে কেউ একজন ধীর পায়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু যখন টের পেল তখন করার কিছু ছিল না। কারন ভারি কিছু একটার আঘাতে তার মাথা থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন এবং দেখতে পেলেন তার হন্তারক আর কেউ না, তার গ্রামের বদর। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না কি
হচ্ছে।তার প্রশ্ন করার মতও বিন্দু মাত্র শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। ঠিক তখনি জাহিদুল সাহেবকে ধীর জঙ্গল থেকে বের হতে  দেখলেন। তার মুখে ক্রুর হাসি দেখে সব বুঝতে পেরে তার চোখের কোনে একটি ছোট্ট অশ্রু কনা জমল। ঠিক তখনি ইমাম সাহেবের হাতে ধারালো চাকু দেখে তার মেরুদণ্ডে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা রক্ত
প্রবাহিত হল যেন! এই চাকু তো তিনি চিনেন, মাওলানা সাহেব কুরবানি ঈদে এই চাকু ব্যবহার করেন। তিনি বুঝতে পারলেন এখন কি ঘটতে যাচ্ছে।  বদর তার হাতপা চেপে ধরল, ইমাম সাহেব তার ধারালো চাকু সর্বশক্তি দিয়ে গলার কণ্ঠনালী বরাবর ঘষতে লাগলেন। মুহূর্তে ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে মাওলানা সাহেবের সাদা পাঞ্জাবি
কে লাল করে ফেলল।  শেষ কয়েকবার কুরবানির পশুরমতো শরীর ঝাঁকি দিয়ে তিনি চিরকালের মতো স্থির হয়ে গেলেন।
'বদর, আমি ভাবতেও পারিনাই এতো সহজ হবে কাজটা'কপালেন ঘাম মুছে ইমাম সাহেব বললেন।
'হ, এখন আপনে খালি পাঞ্জাবি পালটাইয়া নেন। হেরপর এসবকিছু পাত্থরসহ  বস্তায় ভইরা বিলে ভাসাইয়া দিমু। জিন্দেগিতেও কেউ উদিস পাইব না।'
'ঠিক বলেছ। তবে তার আগে আমার জন্য একটু পানি নিয়ে আসো। তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। 'বদর দৌড়ে ইমাম সাহেবের জন্য পানি আনতে গেল।
বদর মিলিয়ে যেতে না যেতেই হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনা গেলো। বিলের দিক থেকে কে  যেন আসছে। জাহিদুল সাহেব বুঝতে পারলেন না তিনি কি করবেন! তিনি কিছু ভাবার আগেই পদধ্বনি খুব কাছে এসে গেলো। আগন্তুক আর কেউ না, ইমাম সাহেবের পরিবারেরই আসমা। মাটিতে পরিমল বাবুর  রক্তাক্ত লাশ, ইমাম সাহেবের
পাঞ্জাবির লাল দাগ এবং ছুরিতে লাগানো লাল লাল ছোপ রক্ত দেখে আসমার বুঝতে অসুবিধা হল না ঘটনা কি! তিনি চিৎকার করে কেদে উঠলেন। সমস্বরে ইমাম সাহেবকে গালি দিতে দিতে বলতে লাগলেন,
"শালা ডাকাইত, তুই মানুষ না। তুই কেমনে পারলি?"
"শোনো আসমা,তুমি বুঝার চেষ্টা করো। ওর চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলছিল। আমার কিছুই করার ছিল না।"
"তাই বইলা তুই একটা মানুষরে খুন করবি।'
"আসমা,আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।প্লিজ তুমি কাউকে বোল না।"
"আমি কখনই এতো বড় একটা অপরাধ কইরা তোরে পাড় পাইতে দিমু না। তুইতো আমার সর্বনাশ করসিলি, তখন কিছু কই না।এখন আর চুপ থাক্মু না। আমি সবাইরে তোর কুকীর্তির কথা কমু। তুই যে খুনি সেটা কমু। তোর নামে মামলা করমু।"
আসমার কথা শুনে ইমাম সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি আর কিছুই ভাবতে পারলেন না। আসমা যদি সবাইকে সত্যি সব বলে দেয় তাহলে কি হবে! তার মধ্যের পশু তখন আবার জেগে উঠল। হঠাৎ করে দুহাতে আসমার গলা চেপে ধরলেন। কিছুক্ষন জোরাজুরি করে আসমা ইমাম সাহেবের সাথে পেরে উঠলেন না। সে ক্লান্ত হয়ে পড়লে
ধিরে ধিরে তার মুখ রক্তবর্ণ ধারন করল। এরপর সেও শেষ কয়েক ঝাঁকি দিয়ে একবারের জন্য শান্ত হয়ে গেলেন।
এরপর কিছু ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো। বদর খুব ভালোভাবে লাশগুলো সৎকার করে ফেলল, এমন ভাবে যেন কেউই জানতে পারল না। ইমাম সাহেব নাম পরিচয় পরিবর্তন করে তার ছেলেকে নিয়ে গ্রামত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে বদরকে পরিমলের ধর্ম পরিবর্তন এবং  আসমার বিয়ের ব্যপারে মিথ্যাটা গ্রামে ছড়িয়ে দিতে বললেন। এতে গ্রামের মানুষ
তাদের এতটাই ঘৃণা করতে শুরু করেন যে ঘটনা সত্যি না মিথ্যা কেউ খোঁজ নিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। এসব দেখে ইমাম সাহেব আর ওই বিভীষিকাময় দিনের পরে আর কখনো এমুখো হননি।তিনি ভেবেছিলেন কেউ না কেউ তাকে চিনে ফেলবে, কিন্তু না !কেউই তাকে চিনতে পারল না, কারন তার মুখে এখন গোঁফদাড়ির লেশ মাত্র নেই। চুল সাদা
হওয়ায় এতে মেহেদী দিয়ে লাল করেছেন, তাছাড়া চামড়াও একটু ভাজ পড়েছে। কিন্তু তিনি এইটা ভাবেননি যে এই পরিবর্তনে গ্রামের লোকতো দূরে থাক নিজের লোক বদরও চিনতে পারবে না। ব্যপারটা খেয়াল করে আপন মনেই হেসে উঠলেন মানুষরুপি শয়তান লতিফ ওরফে জাহিদুল সাহেব।


 খুব সকাল সকাল জামান সাহেবের ডাকে উঠে বসলেন লতিফ সাহেব। "কিরে জামান ? এতো সকালে কি হয়েছে তোর?"
"কালকে যে জমিদার বাবু আমাদের সাথে দেখা করতে আসছিলেন সেই কথা মনে আছে?"
'হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? এই তো কালকের ঘটনা।"
'তার সাথে যে লোকটা আসছিল......'
' হ্যাঁ, বদর। ঐযে ছাতা ধরে রেখেছিল যে ওই লোকটা না?' জামান সাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মুখের কথা ছিনিয়ে নিলেন লতিফ সাহেব।
'হ্যাঁ, সেই লোকটা আজ খুন হয়েছে।'
'খুন হয়েছে? মানে কি!! কি বলিস এসব?'
'হ্যাঁ, কেউ নাকি নৃশংসভাবে মেরে নদীর পারে ফেলে রেখেছে।'
'কিন্তু কিভাবে? কেন?'
'আমিও বিস্তারিত জানি না। চল নদীর পারে দেখে আসি ব্যাপার কি!'
'দাঁড়া, আমি মুখ হাত দুয়ে আসছি। তারপর যাই। '
 পুলিশ এখনও এসে পৌছায়নি। বদরের লাশ উপুর হয়ে আছে, কেউ খুব জোরে ভারি কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে তার।রক্ত ওখানে শুকিয়ে জমাট বেধে কালো হয়ে আছে। তাছাড়া তার পিঠে, গলায়, ঘাড়ে ,পেটে আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন , কোন বন্যপ্রাণী যেন প্রবল আক্রোশে তার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। আঁচড়ে আঁচড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে তার শরীর।
একটা চোখ কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আছে ঠিক যেন কেউ জোর করে টেনে নিয়েছে। যথাসময় পুলিশ এসে পৌঁছাল।তারা আশেপাশে দেখার সময় ওসি সাহেবকে একা দাড়িয়ে থাকতে দেখে লতিফ সাহেব এগিয়ে গেলেন তার দিকে,
 "কি ব্যাপার দারোগা সাহেব? আপনার কি মনে হয়? কিসের কাজ এটা?"
 'জি ঠিক বুঝতে পারছি না। এই গ্রামে এরকম ঘটনা আমার দেখা এই প্রথম। কিন্তু মশায় আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!'
' আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। ঢাকা থেকে।"
'ওহ আচ্ছা। আমরা দুঃখিত যে ঢাকা থেকে ছুটি কাটাতে আমাদের গ্রামে এসে আপনার এরকম অভিজ্ঞতা হল।'
'আরেহ না না, ঠিক আছে। আচ্ছা আপনার কি ধারণা ? এটা কি খুন নাকি দুর্ঘটনা?"
"মনে তো হচ্ছে দুর্ঘটনা, অর্থাৎ কোন বন্যপ্রাণীর আক্রমণ। দেখেন না সারা শরীরে আঁচড়ের দাগ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই গ্রামে এতো হিংস্র প্রানি আসলো কোত্থেকে? আর যদি এসে থাকে তাহলে এখন সেটা কোঁথায়?"
'ঠিক, আচ্ছা সাহেব আমি যাই। দুপুর হয়ে এল বলে।এখনও সকালের নাস্তা করা হয়নি। কিছু জানতে পারলে দয়া করে আমাকে জানাবেন।'

"লতিফ একটা জিনিস খেয়াল করেছিস, মাত্র বাজে ৮টা কিন্তু চারপাশ কি নিরব , কি নিঃশব্দ ...... ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দই নেই।" নিজের জায়গায়  শুতে শুতে লতিফ সাহেবকে বললেন জামান সাহেব।
'হ্যাঁ, গ্রামে সন্ধ্যারাতই গভীর রাত।এখানে তো আর ঘরে ঘরে টিভি নেই, তাই সবাই তাড়াতাড়ি  খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।' নিজের পড়া গল্পের বইয়ের পাতা উলটাতে উলটাতে বললেন লতিফ সাহেব।
'আচ্ছা, কাহিনি শুনেছিস? পুলিশ নাকি বদরের খুনকে বন্যপ্রাণীর আক্রমণ বলে ধরে নিয়েছে।'
'তাইতো করা উচিত! কেন? তুই তার শরীরে আঘাত দেখিসনি?"
'দেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয় না এটা বন্যপ্রাণীর আঘাত।"
"কেন?"
"প্রথমত এখানকার ঘনবসতি খুব বেশি না হলেও খুব কমও কিন্তু না, তাই এখানে একটা হিংস্র প্রানি ঘোরাঘুরি করবে আর কেউ তা দেখবে না এটা হতে পারে না। দ্বিতীয়ত বদরের মাথায় ভারি কিছুর একটা আঘাত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো যার কারনে মাথার পিছনে রক্ত জমাট বেধে ছিল। বন্যপ্রাণী নিশ্চয় আর যাই করুক মাথায় আঘাত করবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি
মানুষ তাকে খুন করে থাকে তাহলে শরীরের আঘাতগুলো কিসের! কারন মানুষের নখ দিয়ে এরকম আঘাত করা অসম্ভব।"
জামান সাহেবের কথা শুনে লতিফের শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের চোটে শীতল রক্ত প্রবাহিত হল। তবে কি অশরীরী কিছু?  এরসাথে তার কোন যোগসাজশ নেই তোঁ? নাহলে এতদিন ধরে কেন বদর এই গ্রামে থাকে কেন এতদিন তার কিছু হল না?লতিফ সাহেব আসার পরই কেন হল?তাছাড়া জামান
সাহেবও এতো গ্রাম থাকতে লতিফ সাহেবকে কেন সুখীনিলগঞ্জে নিয়ে আসলেন! না তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না... এটাই তার এই গ্রামে শেষ দিন। কাল সকালেই তিনি রওয়ানা দিবেন ঢাকার উদ্দেশ্যে । জামান সাহেব সাথে গেলে ভাল, না গেলে একাই রওয়ানা হবেন। ঢের হয়েছে আর না!
এই গ্রামে এটাই তার শেষ রাত এই কথা ভেবেই হয়তোবা নিজেকে খুব হালকা লাগতে লাগল লতিফ সাহেবের। তিনি নিজের গল্পর বইয়ে মনযোগ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জামান সাহেবের নাক ডাকার শব্দ তার কানে আসলো। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালে দেখেন ১টা বাজে রাত। বই পড়তে পড়তে সময়ের খেয়ালী
ছিল না। তিনি বই বন্ধ করে ঘুমাতে যাবেন ঠিক এমন সময় জানালার দিকে তার চোখ গেলো। দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু ভাল করে তাকানোর পর বুঝলেন ওইটা চোখ না, জোনাকিগুচ্ছ। ঠিক তখনি এক নাম না জানা নিশাচর পাখি কর্কশ গলায় ডেকে উঠল। হঠাৎ করে সমস্ত ঝিঝি পোকার ডাক থেমে গেলো।
আশ্চর্য এক নিরবতা। চারপাশ যেন বায়ুশূন্য হয়ে গেছে যেন! লতিফ সাহেব চোখ বন্ধ করে কান তীক্ষ্ণ রেখে শুয়ে আছেন। ঠিক তখনি থম্থমে গলায় এক নারীকণ্ঠ হেসে উঠল। লতিফ সাহেব শিউরে উঠলেন। তিনি কি ভুল শুনছেন! চুপচাপ তিনি শুয়ে রইলেন। "ইমাম ও ইমাম, আমারে দেখবা না?' এবার তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন যে আসমার গলা। তিনি  তার জানা
সকল দুয়াদুরুদ পড়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। দূরে আবছা অন্ধকারে মানুষের অবয়বের কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। কে ওখানে? এতো দূর থেকে বুঝাও যাচ্ছে না ছায়ামূর্তিটা কি নারী না পুরুষের। লতিফ সাহেব সাহস করে হারিকেন জ্বালালেন। এরপর ধীর পায়ে মূর্তির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।  তিনি হেটেই যাচ্ছেন ,হেটেই যাচ্ছেন  কিন্তু কিছুতেই  ছায়ামূর্তিটার
কাছে  যেতে পারছেন না। মধ্যের দূরত্ব যেন শেষ হবার নয়।তিনি হাটতে হাটতে চারপাশে এটাও খেয়াল করলেন না যে   তিনি সেই বিলের কাছে  এসে পড়েছেন। মূর্তিটা থেমে গেছে, তিনিও  খুব কাছে চলে এসেছেন। ঠিক তক্ষনি তিনি দেখলে নারীমূর্তিটা সেই একই শাড়ী পড়া যেইটা সেই অভিশপ্ত দিনে আসমা পড়েছিলো। কিন্তু একী! নারীমূর্তির চেহারার স্থানে শুধু মানুষের
চেহারার অবকাঠামো। সেই অবকাঠামোর কিছু কিছু জায়গা আবার শেওলা পড়ে সবুজ হয়ে গেছে। লতিফ সাহেবের ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেন, তিনি মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু কিছুতেই  মনে করতে পারলেন না। হাতের হারিকেনটার ওজন যেন একশগুণ বেড়ে
গেলো। তিনি অনেক চেষ্টা করেও হারিকেনটা হাতে ধরে রাখতে পারলেন না। মাটিতে আছড়ে পড়ে টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে  পুরা স্থানকে গভীর অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল। তৃষ্ণায় তার ছাতি ফেটে চৌচির হবার যোগাড়।পাগুলো যেন মাটির সাথে শিকড় গেড়ে বসেছে। কিছুতেই তোলা যাচ্ছে না।ঠিক তখনি নারীমূর্তিটা এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। লতিফ সাহেব বুঝতে পারলেন তার সাথে
কি হতে চলেছে। তিনি অপেক্ষা করছেন, প্রতিটা মুহূর্ত  যেন অনন্তকালের মতো লম্বা। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ধিরে ধিরে সেই নারীমূর্তির ঠাণ্ডা হাত তার গলা সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরল। তিনি কোন বাধাই দিতে পারলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন তার ডাক এসেছে, মৃত্যুর ডাক।

স্টেশনের বেঞ্চে জামান সাহেব বসে আছেন। ঢাকার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। গত দুইদিন তার উপর অনেক ধকল গেছে। লতিফ সাহেবের লাশ বিলে ভেসে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি দুর্ঘটনা কিন্তু এতো রাতে লতিফ সাহেব বিলের ওইদিকে কি করছিলেন সে প্রশ্ন সকলেরই অজানা। রাকিবকে জানানো হলেও সে এতো জরুরী ভিত্তিতে ছুটি নিয়ে দেশে আসতে
পারেনি। তাই সেই বিলের ধারেই লতিফ সাহেবের কবর হয়। ঠিক একই জায়গায় যেখানে মারা গিয়েছিল আসমা ও পরিমল। মৃত্যুর ডাক যেন তাদের একই সমান্তরালে, শুধু আসলো ভিন্নভাবে। যেরকমই হোক, মৃত্যুর ডাক কি আদৌ এড়ানো যায়?
Likes Comments
০ Share

Comments (1)

  • - রব্বানী চৌধুরী

    " আজ তাদের ভালোবাসার তিন বর্ষপূর্তি " 

    আমাদের অনেক শুভেচ্ছা রইলো ওদের জন্য আর ভালো লাগলো গল্প। শুভেচ্ছা জানবেন ভালো থাকবেন।

     

    • - টোকাই

      ধন্যবাদ রব্বানী ভাই । emoticons

    - তাহমিদুর রহমান

    খুব ভাল লাগল।

    তিন বছর আগে তারা ঠিক করেছিল তাদের পছন্দের ঋতুর একটি দিনকে এই বিশেষ দিন হিসেবে বেছে নিবে  । দুজনেরই খুব পছন্দ বর্ষাকাল । নৌকায় ঘুরোঘুরি, কদম ফুল ছোঁড়াছুঁড়ি আর জমে থাকা পানিতে রাস্তায় লাফালাফি করে বেড়ানোয় যারপরনাই আনন্দ পায় তারা । আর দুজনেই বর্ষার কোনো একটি দিনে ভিজে একাকার হয়ে যায় ।

    emoticonsemoticons

    - সুলতানা সাদিয়া

    বাহ কবির গল্পের হাতও দেখছি বেশ! শুরুটাতো মিষ্টি। শেষটা পড়ে আসি।

    • - টোকাই

      ধন্যবাদ  সাদিয়া   আপু । emoticons