Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

sokal roy

৯ বছর আগে

☼ বিষাদে বিবর্ণ বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ☼

 

এক.

রবীন্দ্রনাথ কে? এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ, তিনি একজন কবি।
কিন্তু কবি জিনিসটা কি? উত্তরটা এখন খুব সহজেই বুঝতে পারলেও রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার যখন পরিচয় হয় তখন বুঝতে পারিনি আসলে কবি জিনিসটা কি?
রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ক্লাস ওয়ানে পড়বার সময়, আমি তখন সদ্য বর্ণমালা পড়ুয়া-নিতান্তই গোবেচারা টাইপের একজন ছাত্র।
স্কুলের রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তিতে নাম দিয়েছি, ‘বাড়ি বসে মা রোজ দু'বেলা করে রবীন্দ্রনাথের ছুটি কবিতাটি মুখস্ত করায়’। সেই প্রথম বেলাতেই প্রশ্ন ছিলো কবিতাটি লিখেছেন একজন কবি কিন্তু কবি কি? মা বলতেন যারা কবিতা লিখে তারাই কবি; আর যিনি এটা লিখেছেন তিনি বিশ্ব কবি
- মা-তারা কি মানুষ না?
বোকার ছাও বলে কি? কবিই মানুষ; মানুষই কবি তবে তারা আমাদের চেয়ে আলাদা।
সেই ভরা মঞ্চে পুরো কবিতা আবৃত্তি করা হয়ে উঠেনি সেদিন; গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছিলাম, দর্শক সারিদের সে কি হাসি! চোখে পানি এসে গিয়েছিলো! বাড়ি ফিরে বলেছিলাম মা- তোমার রবি কবি খুব পঁচা! আমি আর তার কবিতা পড়বো না।ছোটবেলায় তার কবিতা দেখে ভয় পেতাম আস্তে আস্তে সে ধারনা পাল্টেছে আমি খুব সম্ভবত তার বীরপুরুষ কবিতাটিই প্রথম পছন্দ করেছিলাম। ক্লাস ফাইভে গল্পগুচ্ছ পেয়ে গেলাম; পড়ার বইয়ের চেয়ে বাইরের বইকে বেশি ভালোবেসে ফেললাম। তখনকার সময়ে আমাদের বাজার লাইব্রেরীতে এই বই পাওয়া যেত না বই আনতে হতো দীজেন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরী থেকে। এরপর রবি বাবুকে ভালোবেসে ফেললাম। একে একে আমার হাতে উঠে এলো তার লেখা উপন্যাস গুলো; পড়লাম, ভাসলাম রবীন্দ্র সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় নিজেকে হারালাম। রবী বাবুর সমস্থ লেখাই যে ভালো লাগে তা নয়, তবে খারাপ লাগে এই সংখ্যাটা খুব কম।
এরপর রবী বাবুকে জানতে চাইলাম? কেমন ছিলেন তিনি? তার পুরো জীবনটাই আমার কাছে অন্যরকম মনে হলো। আমার কাছে ভালো লাগলো তার সাংসারিক জীবন আর বেদনাদায়ক লাগলো কবির কষ্ট মাখা জীবনের কথা জেনে। বিশ্বকবির অন্তরেও কষ্ট ছিলো, দুঃখ ছিলো, ভাগ্যের পরিহাস ছিলো তবুও তিনি লিখেছেন থামেন নি আর সেটা ভেবেই অবাক লেগেছে। অনেকেই ভাবেন জমিদার পুত্র রবীন্দ্রনাথের কোন ভাবনা ছিলনা তাই অবিরত লিখে ছিলেন কিন্তু মনে হয় এটা পুরোপুরি ঠিক না। তিনি কষ্ট পেয়েই হয়ত কিছু অসামান্য রচনা করতে পেরেছিলেন।






দুই.

“ এই করেছ ভালো, নিঠুর
এই করেছ ভালো।
এমনি করেই হৃদয়ে মোর
তীব্র দহন জ্বালো।

আমার এ ধুপ না পোড়ালে
গন্ধ কিছুই নাহি ঢালো
আমার এ-দ্বীপ না জ্বালালে
দেয়না কিছুই আলো।”

(গীতাঞ্জলি)

দহন না হলে হৃদয়ের গভীরতা বোঝা যায়না। কতটুকু গভীর যে হৃদয় তার গভীরতা মাপতে গেলে দহন হতে হবেই। কবিগুরু তার জীবনে কি দহন সয়ে ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ অবশ্যই সয়েছিলেন তা, না হলে অমন সুন্দর সব কাব্য রচনা হতোই না।
খুলনার দক্ষিন ডিহি গ্রামের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীকে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেন। বিয়ের পর ভবতারিণী'র নাম পাল্টে তিনি মৃণালিনী রাখেন। কবি মৃণালিনী দেবীকে খুব ভালোবাসলেও তাকে অন্তরঙ্গ ভাবে খুব কমই পেয়েছেন তার সংসার জীবন খুব একটা সুখের ছিলনা।
কবিরা উদাসীন হয়, আপনভোলা হয়, আর সংসার জীবন তাদের কাছে অনেকটা নিয়ম পালনের মতোই। কবির পাঁচ সন্তানের সংসার জীবনে তিনি হয়তো কোন কারণে কিছুটা অতৃপ্তই ছিলেন। আর সেটার নমুনা পাই সংসার নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে।




কবি ছিলেন ভোজন বিলাসী। চিঁড়ের পুলি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই খেতে পছন্দ করতেন এছাড়া চিজ, বিস্কিট এগ অ্যান্ড বেকন, সারডিন, খই, মুড়ি পছন্দ করতেন। কবি সুগন্ধীযুক্ত আতপ চালের ভাত, আলু-কলা, পটল, ডালবাটা খেতে অভ্যস্ত ছিলেন তাছাড়া মৃণালিনী দেবীর নারকেল দিয়ে তৈয়ারী নারকেলের মিষ্টান্ন ছিল অধিক প্রিয়। মৃণালিনী দেবী রান্নায় ছিলেন অন্নপূর্ণা অনেকেই তার রান্নার প্রশংসা করতেন। একবার জগদীশ চন্দ্র বসু তার হাতে শাকের নানারকম তরকারি খেতে চেয়ে ছিলেন। মৃণালিনী দেবী শাক ভাজা, শাকের ঘন্ট, শাকের চচ্চরী, শাকের ঝোল সহ প্রায় বিশ রকমের শাকের তৈয়ারী তরকারি জগদীশ চন্দ্র বসুকে খাইয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের এই ভোজনবিলাসী রবীন্দ্রনাথ বহু বছর নিরামিষভোজী ছিলেন তার একমাত্র কারন ছিলো পত্নী বিয়োগ। ‘কবির জীবনেও ব্যর্থতা থাকে’-নতুন একটি কবিতা জন্ম দিতে না পারাই হয়তো কবির জীবনের ব্যর্থতা।
রবীন্দ্রনাথ মিতব্যয়ী ছিলেন তৎকালীন সময়ে সর্বসাকুল্যে তিনশত টাকা দিয়ে মাস পার করতেন। তিনি তার সন্তানদের কখনো প্রাচুর্য্যের মাঝে বড় করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ওরা মানুষ হবে সাধারণ ভাবে হয়তো প্রাচুর্যে মধ্যে থাকলে তা হবেনা।
সব পরিকল্পনা ছক মাপা থাকলেও কবি তার জীবনে কিছু কাজ করেছিলেন অপরিকল্পিত ভাবে যেমন- তিনি তার কন্যাদের বিয়ে দিয়েছিলেন অল্প বয়সেই, বেলার(মাধুরীলতা) বিয়ে দেন পনের বছর বয়সে, মীরারও বিয়ে দেন পনের বছর বয়সে আরো হতবাক হবার মতো ব্যপার যে, রানীর (রেনুকা) বিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়সে। মেয়েদের বিয়েতে কবির অনেক খরচা হয় এবং এক পর্যায়ে তিনি অর্থ সংকটে পরে যান। উপলব্ধি করেন অর্থ সংকট কাকে বলে? কবির জীবনেও অনেক লাঞ্ছনা,গঞ্জনা ছিলো উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ তার পুত্র রথীন্দ্রনাথকে বিধবা বিবাহ করিয়েছিলেন বলে তার আত্বীয়-স্বজনরা এটা মেনে নেয়নি। তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছিলো এ জন্য। তাই তার জীবনে পথে দেখতে পাই তার অনেক কষ্ট চাপা ছিলো। তার দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে কষ্টের কালি দিয়ে কবিতা আঁকা ছিলো আর তাই তিনি লিখেছিলেন

“চির জনমের বেদনা,
ওহে চির জনমের সাধনা
তোমার আগুন উঠুক হে জ্বেলে
কৃপা করিয়ো না দূর্বল ব’লে
যত তাপ পাই সহিবার চাই-
পুড়ে হোক ছাই বাসনা।”

(গীতাঞ্জলি)

এই জগৎ মাজারে অদব্য কিছুই নয়। মহাকাল, মহাকাশ, মহাপাতাল, সবই মূল্যময়। মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছার মহাকাশে স্মৃতিরা বাসা বাঁধে, স্মৃতিরা কষ্ট বুননে, কষ্ট জাগরণে মনে করিয়ে দেয় প্রিয়দের বিদায় কিংবা জন্মলগ্ন। কবির পত্নী দীর্ঘ রোগ-ভোগে মারা যান। ব্যথিত কবি তার জীবনে কষ্টের কারণ খুজে পাননি।
তার কন্যা বেলার (মাধুরীলতা) মৃত্যু হয়েছিলো ক্যান্সারে, রানীর (রেনুকা) মৃত্যু হয়েছিলো যক্ষায় আর পুত্র শমীর মৃত্যু হয়েছিলো কলেরায়। প্রত্যেকটা মৃত্যুই তাকে ভারাক্রান্ত করেছিলো; হয়তো প্রতিটা মানুষের চিন্তাধারাটা একটু সময়ের জন্য হলেও থমকে যায় যখন মৃত্যুর কথা মনে হয়। সকল আনন্দ যাতনা ভাগ করেই আমাদের বেঁচে থাকা এই বিশ্ব সংসারে। নিজেকে প্রতিনিয়ত ফেরী করে বেড়ানো কিংবা অভিনয়ের মাঝে নিজেকে তুলে ধরা এই নিয়েই আমাদের জীবন। তাই কবি মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন

“মরণ যেদিন দিনের শেষে
আসবে তোমার দুয়ারে
সেদিন তুমি কি ধন দিবে উহারে।

ভরা আমার পরান খানি
সম্মুখে তার দিব আনি,
শূন্য বিদায় করবা না তো উহারে-”

জীবনের শেষ দিনে কি দেব শুধু এই পিতৃদত্ত প্রাণটি ছাড়া। স্বজন মৃত্যু প্রতিটা মানুষের জীবনে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও কষ্ট দেয়। কবি পত্নীর হৃদয়া বিদারক মৃত্যুর কথা মনে হলে আমি নিজেও খানিকটা কষ্ট অনুভব করি। মীরা দেবীর স্মৃতি কথায় পাই ‘ঠাকুরবাড়িতে লালবাড়ির দোতলায় মৃণালিনী দেবীর শেষ শয্যা পাতা হয়’। ঘরে কোন আলো বাতাস খেলতো না, তখনকার দিনে বৈদ্যুতিক পাখা ছিলনা কবি তালপাখা দিয়ে দিনের পর দিন অবিরাম বাতাস করে গেছেন। সেই ঘরেই ১৩০৯ সালে ৭ই অঘ্রাণে মৃণালিনী মৃত্যুবরণ করেন। কবিকে বিবর্ণ করে দেয় সেই মৃত্যু। স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে কবি লিখেছিলেন

তখন নিশীথ রাত্রি,গেলে ঘর হতে
যে পথে চল নি কভু সে অজানা পথে।
যাবার বেলায় কেন বলিলে না কথা।
লইয়া গেলে না কারো বিদায়-বারতা।




প্রত্যেক মানুষের জীবনেই যেমন আলো আঁধারির খেলা আছে তেমনি কবির জীবনেও ছিলো তবে আঁধারটাই মনে হয় বেশি ছিলো অথচ বাহির থেকে কবিকে দেখে আমরা কি সুখি মানুষটাই না ভাবতাম। কবি চলে গেছেন সেই কবে কিন্তু আমার কাছে তার সে যাওয়াকে কখনোই মনে হয়না তাকে হারিয়েছি আমার এখনও মনে হয় তিনি রয়ে গেছেন আমার পাশে ঠিক সেই প্রথম বেলার মতো।





____________________________________________

গ্রন্থপঞ্জী

১। রবীন্দ্রনাথের সংসার জীবন, তিতাশ চৌধুরী, ভারত বিচিত্রা।
২। মৈত্রেয়ী দেবী, রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে, কলকাতা
৩। চিত্রাদেব, ঠাকুর বাড়ীর অন্দর মহল, কলকাতা বৈশাখ-১৪০০


সমাপ্ত

১ Likes ২ Comments ০ Share ৬০৯ Views

Comments (2)

  • - মাইদুল আলম সিদ্দিকী

    সত্য ও বাস্তব, লেখনী চলুক নিরন্তর

    মেয়েরাও এখন ছেলের চেয়ে পিছিয়ে নেই।