মার্চ ০১।
‘নক্ষত্র আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবস লেখা প্রতিযোগিতা-২০১৪’ বিষয়ক আয়োজনে ফেসবুক গ্রুপ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। আমি ‘যাচ্ছি’ তে ক্লিক করেও ভাবছিলাম, আসলেই কি আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতন লেখা লিখতে পারবো? আমি চিত্রশিল্পী হিসেবেও বাস্তবধর্মী চিত্রশিল্পী; ছবির বিষয়বস্তু চাক্ষুস দেখে আমি নিখুঁত আঁকায় পারদর্শী। বিমূর্ত ছবি আমি আঁকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনা। তেমনি লেখার জগতেও বিমূর্ত অর্থাৎ কল্পনা করে লিখতে আমার কষ্ট হয়। আর তাইতো যেই মুক্তিযুদ্ধকে আমি সামনে থেকে চাক্ষুস হৃদয়ে অনুধাবন করিনি, তা নিয়ে আমি কি করে একটি সার্থক গল্প অথবা সাহিত্য রচনা করবো? আমার লেখায় যতটা আবেগ প্রয়োজন তা কি আমি ফুঁটিয়ে তুলতে পারবো?
প্রতিযোগিতার জন্য লেখা সাবমিট হতে শুরু করলো। সবাই লিখে যাচ্ছে। আমারও ভেতর থেকে তাড়না আসছে কিছু লিখতে হবে। কিন্তু আমি তো পারছি না। লেখার প্লট বাছাই করছি-লিখবো। কিন্তু শেষমেশ লিখে উঠতে পারছি না। কিন্তু প্রতিযোগিতায় আমাকে যে অংশগ্রহণ করতেই হবে। সবাই লিখছে, আমি পারছি না, কেমন কথা? নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছি।
অবশেষে প্রতিযোগিতার প্রথম ‘শেষসীমায়’, একটা গল্প লিখে জমা দিলাম। গল্পের শিরোনাম-‘চেতনা’। লেখা সাবমিট করে ফেলার পরে দেখলাম, সময় বাড়ানো হয়েছে। এর পরে সাহস বেড়ে গেলো কিছুটা। আরেকটা লিখতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সময় আর হয়ে উঠে না। আমি ফরমায়েশী সময়ের মধ্যে জোর করে কিছু লিখতে পারি না। তাই লেখার তাড়না থাকলেও বাস্তবিক লেখা হয়ে উঠলো না। ২৬ শে মার্চ রাত ১২টায় লেখা সাবমিট করার সর্বশেষ সময়। আমি রাত ১১টা পর্যন্ত টিভি দেখছি শুয়ে শুয়ে আর ভাবছি-একটা কবিতাও তো লিখলে লেখা যেতো। আমি সাড়ে এগারোটায় ল্যাপটপ চালু করলাম। ওয়ার্ড ফাইল খুলে লিখতে বসলাম। আমার হাতে আর মাত্র ৩০ মিনিট। এর মধ্যে আমাকে ভাবতে হবে। লাইন, অন্তমিল, ছন্দ যাই হোক সাজাতে হবে। উপমাও মনে আসছে না। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার মাথায় চিন্তার ঝড়। অবশেষে কোনরকম ছন্দের ধার না ধরে একটা গদ্য কবিতাই লিখলাম। কবিতার শিরোনাম কি দেবো তাও বুঝছি না। দিলাম তারেনারে করে একটা কিছু। এর মধ্যে নক্ষত্র ব্লগ ওপেন করেছি। ‘নতুন পোস্ট’ খুলে সাবমিট করতে যাবো, দেখি- সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। লেখার শিরোনামের পাশে ‘প্রতিযোগিতার জন্য’ কথাটি লিখতে খুবই সংকোচ হচ্ছিলো। আদৌ এটা কোন কবিতা বলে গুণিরা কি মেনে নেবে? আমি ‘প্রতিযোগিতার জন্য’ কথাটি জুড়ে দিতে খুবই লজ্জিত, কুন্ঠিত হচ্ছিলাম। তার উপরে যদি সাবমিট হতে হতে সময়সীমা পেরিয়ে যায়, তাহলেই হইছে! লজ্জার কোন সীমা পরিসীমা থাকবে না।
আমার সাবমিট করার পরে দেখি, ১২টা বাজতে আর ৩মিনিট বাকী।
সুপ্রিয় ঘাসফুল প্রতিযোগিতার জন্য জমা পরা সমস্ত লেখাকে একত্রিত করে একটি পোস্টে সাজিয়েছিলেন। সেখানের আপডেটে পরের দিন সকালে দেখি, আমার কবিতাটিও আছে। তবু নিশ্চিত হতে পারলাম না যে আসলেই এটি সিলেকশনে আসবে কিনা। যেমনই লিখি ছাতা মাথা, কাউয়ার ঠ্যাং, বগার ঠ্যাঙ; কিন্তু নিজেকে প্রতিযোগির আসনে এবং বিজয়ীর আসনে দেখতে কার না ভালো লাগে বা কার না আশা জাগে?
আমিও সামান্য আশায় বুক বাঁধলাম। প্রাথমিক সিলেকশনে দেখি-গল্প ও কবিতা দুটোই স্থান পেয়েছে। পরে দেখি, কবিতাই সবাই পছন্দ করছে। অনেকে ফেসবুক এর ইনবক্সে এসে জানিয়ে গেলো-কবিতাটি নাকি দারুন লিখেছি। আমি জানি না কিছু। আমি শুধু জানি আমি আমার নিজের মনের অনুভূতিটাই তুলে ধরেছি।
এর পরে আহবান এলো-আমাকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হবে;গান, নাচ, আবৃত্তি কিছু একটা করতে হবে। আমি তো স্টেজ পারফরমেন্স জানি না। নাচ পারিনা। গান গাই গুনগুনিয়ে, তা শুধু নিজের কানেই শোনা যায়। আর আবৃত্তি সুললিত কণ্ঠে যেভাবে পাঠ করতে হয় সেটা আমার আয়ত্বে নেই। তাহলে আমি কিসে অংশ নেবো? উপস্থাপনা? নাহ সেটাও আমি জানি না।
কিন্তু মাসুম বাদল ভাইয়ের অদম্য উৎসাহে আমি নিজের একটা আবৃত্তি অডিও করে ফেললাম, সাউন্ড ক্লাউডে আপলোড দিয়ে ফেসবুকে শেয়ার দিলাম। অনেকেই ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিলো। আমি যতটা এগোই, তার ৩ গুন পেছাই। আবৃত্তি ভালো না হলে শেষে সমালোচনা পেলে কেমন লাগবে!
দশ তারিখ সন্ধ্যাতেও নক্ষত্র অফিসে বসে আমি আমার আবৃত্তি বাতিল করতে চেয়েছি। কিন্তু মাসুম বাদল ভাই আমার কবিতাটি একবার আবৃত্তি করে দিলেন, আমি সেটা রেকর্ড করে নিলাম। আমি তো ভাইয়ার পাঠের ধারে কাছে ও না; আমার আরও লজ্জা করতে লাগলো। কিন্তু মাসুম বাদল ভাই তো বটেই তাহমিদ ভাইয়া পর্যন্ত আমাকে নানান কথা বলে উৎসাহ দিলেন। ওনাদের ভাষায়- “কবি নিজের কবিতা ভালোভাবে আবৃত্তি করতে পারে না। আপনি (আমি) আপনার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করবেন, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবেন, এটাই অনেক। আবৃত্তি কেমন হলো সেটা বিবেচ্য বিষয় না!” সেই কথায় আমি সাহস ফিরে পেলাম।
বাসায় ফিরে সকালে শুধু ২-৩ বার মাসুম বাদল ভাইয়ার আবৃত্তিটাই শুনেছি। নিজে একবারও আওড়াইনি। বাসায় বসে আওড়াতে কেমন যেন লজ্জামাখা সংকোচ থাকে।
১১ এপ্রিল বিকেলে, অনুষ্ঠানে যেতে সময়ে শুধু কবিতার ডায়রীটা সাথে করে গেলাম। আবৃত্তির অনুশীলন বা পাঠ যেটাই হোক, সেটা সরাসরি স্টেজেই করবো।
আমাকে অনুষ্ঠানে, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বিকেল ৩টায় উপস্থিত থাকতে বলা ছিলো। আমি সেখানে তিনটার আগেই পৌঁছে গেলাম। তারপরে একে একে ব্লগার ও অতিথিবৃন্দের মুখর পদচারণায় আমাদের অনুষ্ঠানের মঞ্চ ভরে উঠতে শুরু করলো।
ঠিক চারটার কিছু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হলো। এর মধ্যে অনেকেই এসে পরিচিত হলো।
সুপ্রিয় লুতফর রহমান পাশা ভাই উপস্থাপনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। সাথে সুন্দর উপস্থাপনা দ্বারা অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে চললেন সুপ্রিয়া রোদেলা নীলা।
বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ ও ছবি পর্ব চলতে থাকলো। নিজের পুরস্কার গ্রহণ সমাপ্ত হলে আমি অন্যদের ছবি তুলতে শুরু করলাম। অনুষ্ঠানের মাঝপথে এসে আমিও ফটোগ্রাফারের অংশে কাজ শুরু করলাম। ভালোই লাগছিলো।
যেকোন মিলন মেলা’রই একটা ইতিবাচক দিক থাকে। বিভিন্ন মন মানসিকতা ও বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষের একত্রিত অবস্থান মতো বিনিময় এবং নতুন কিছু দৃষ্টিভংগি শেখাতে সাহায্য করে।
আমি কালকের অনুষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে যে উপকারিতা পেলাম তা শেয়ার করছি—
১। কিছু কিছু লেখক/কবি বন্ধুর ভাষায় আমি কবিতা লিখতে জানি না। কিন্তু কালকের কবিতা বিষয়ের সম্মাননা আমাকে কবিতা লিখতে উৎসাহী করেছে।
২। মঞ্চে আমার পারফরমেন্স সম্পর্কে আমার নেতিবাচক ধারণাকে পালটে দিয়েছে। এর পরে আমি পারবো এবং নিয়মিত অংশ নেবার আশা রাখছি।
৩। কবিতা আবৃত্তিতে আমি সম্পূর্ণ সফল না হলেও ‘অর্ধেক ভালো’ পেরেছি বোধহয়; কাল কিছু প্রশংসামূলক বাক্য জুটেছে। আগামীতেও অংশ নেবো।
৪। বাংলাদেশ রাইটার গিল্ডস প্রতিষ্ঠাতা পারভেজ রানা’র সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেলাম। আমাদের মতন নতুন লেখকদের পাশে তিনি আছেন জেনে ভালো লেগেছে।
৫। প্রথম আলো’র আলপিন সম্পাদক সুমন্ত আসলাম বলেছেন-‘ ব্লগেই শুধু না লিখে আমরা যেন পত্রিকাতেও আমাদের লেখা ছড়িয়ে দেই।’
প্রতিযোগিতায় লেখা সাবমিট করার সময় ভেবেছি-পুরস্কার বড় বিষয় নয়, শুধু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণই বড় বিষয়। সত্যি কথা-পুরস্কার বা সম্মাননার প্রাপ্তি অনেক বড় বিষয়। নিজেকে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের কাছে আলাদা একটা সম্মান এনে দেয়। এখন নিজের শোকেসে নিজের অর্জনের ক্রেস্ট সাজাতে ভালোই লাগে। পর পর দু মাস-ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে দু দুটো লেখার সনদ মিলে যাওয়া অবশ্যই ভাগ্যের ব্যাপার। যেখানে আমি ‘প্রতিযোগিতার জন্য’ কথাটি যুক্ত করতেই লজ্জিত ও কুন্ঠিত ছিলাম, সেখানে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা অনেক বড় প্রাপ্তি।
লেখার জগতের বড় বড় গুণী মানুষ যাদেরকে আমরা অধিকাংশ সময় টিভিতে দেখি, অথবা পত্রিকার পাতায় যাদের নাম ছবি হয়ে ভাসে, তাদের সাথে এক প্লাটফর্মে মুখোমুখি দাঁড়ানো, দাঁড়িয়ে কথা বলা, তাদের হাত থেকে নিজের যোগ্যতার সনদ হাতে নেয়া এবং সামনে থেকে এক মঞ্চে উপবেশন করে তাদের শুভেচ্ছাবাণী গ্রহণ এগুলো কোনভাবেই আমি ছোট করে দেখি না।
যে সব সহ ব্লগার অথবা সাহিত্যিকদের সাথে আমরা একই ব্লগে লিখি তাদেরকেও সামনে থেকে চর্মচক্ষু দিয়ে অনুভব করা, পরিচিত হওয়া, ভাবের আদান-প্রদান এবং যোগাযোগের নতুন দ্বার উম্মোচন হওয়া এইরকম মিলনমেলার মাধ্যমেই সম্ভব হয়। এই কারণে আমি নক্ষত্রের মতন এরকম সাহিত্য আড্ডাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
যেই আমি মুক্তিযুদ্ধ নামক একটা বিমূর্ত বিষয় যাকে আমি চর্মচক্ষে অনুভব করিনি তা নিয়ে লেখাকে ভয় পেয়েছি, সেই বিষয়ে লেখার আহবান করে নক্ষত্র আমাকে দিয়ে মোট ৪টি লেখা তৈরী করিয়েছে, যার মধ্যে একটি গল্প(চেতনা) ও কবিতা(ফিরিয়ে দিতে চাই ওদের স্বপ্নের স্বাধীনতাকে) আমি নক্ষত্রে প্রকাশ করেছি; একটি কবিতা (স্বাধীনতার মানে) প্রকাশ পেয়েছে সুনামকণ্ঠ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় এবং অপর একটি কবিতা ‘আমি পারিনা’ বন্ধুব্লগের পাতায়।
এরকম চারটি সার্থক লেখা তৈরী করার পেছনে যে অবদান তা আমি নক্ষত্রকেই দিতে চাই। আমি নক্ষত্র হয়ে উঠবো কিনা জানি না। কিন্তু নক্ষত্র আমার আলস্য কাটিয়ে আমাকে দিয়ে নতুন নতুন সফল লেখা তৈরি করিয়ে নিচ্ছে এটাই আমার উপকার ও লাভ।
নক্ষত্র এ ধরনের আয়োজনে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাক, সেই শুভকামনা করে আজকের এই লেখা এখানেই সমাপ্ত করছি।
সবাইকে আসন্ন বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
(সমাপ্ত)
Comments (36)
লেখাটা পড়লাম। একমত পোষণ করলাম।
অতি সহমত ।