আজ ২৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক তেজস্ক্রিয় বিকীরণ সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণ। এর বিপদের মাত্রা ছিল সাতের মধ্যে সাত। ১৯৮৬ সালের এই দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে বিপজ্জনক দূর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপক তেজস্ক্রিয়তা ঘটে। চেরনোবিল দুর্ঘটনা হিরোশিমায় ফেলা আণবিক বোমার চেয়ে চারশ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়েছিল। এই দূর্ঘটনায় আজ পর্যন্ত দুই সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়। একে ধরে নেওয়া হয় স্মরনকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমানবিক দুর্ঘটনা। উত্তর মেরুর কাছাকাছি প্রায় সব কটি দেশেই পরমাণু বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা জানিয়েছে দূর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ৪ জন কর্মী মারা যান। পরবর্তীতে ২৩৭ জন মানুষ পারমাণবিক বিকিরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পরে এবং প্রথম তিন মাসে ৩১ জন মৃত্যুবরণ করে। আর ইউক্রেনের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ২৫ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী মারা যায়। সরকারি তথ্যমতে, দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে ছিল ছয় লক্ষ শিশু। এই দুর্ঘটনার ফলে ২০০বিলিয়ন ডলারের সমমান ক্ষতি হয়েছিল। বর্তমানে চেরনোবিল শহরটি পরিত্যক্ত এবং প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে বলতে গেলে কেউ বাস করে না এবং যেসব এলাকায় তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়েছে, সেসব জায়গায় আজও চাষাবাদ হয় না। আন্তর্জাতিক তেজস্ক্রিয় বিকীরণ সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় দিবসে চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে দূর্ঘটনায় নিহদের স্মরণে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল স্থানীয় সময় অনুযায়ী রাত ১টা ২৩ মিনিটে ইউক্রেন ও বেলারুশ সীমান্তে অবস্থিত পরমাণু কেন্দ্রটির চতুর্থ (বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট রিয়্যাক্টরের সংখ্যা ৪টি) রিয়্যাক্টর থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। দুর্ঘটনাটি মূলত ঘটেছিলো নিরাপদ শীতলীকরণের উপর একটি পরীক্ষা চালানীর সময়। রাতের শিফটে দায়িত্বরত কর্মীরা ভুল করে রিয়্যাক্টরটির টার্বাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতল পানি প্রবাহিত করে। ফলে সেখানে বাষ্প কম উৎপাদিত হয়। এতে করে রিয়্যাক্টরটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে প্রচন্ড বিস্ফোরন ঘটে। পরপর প্রায় একই সঙ্গে ঘটা দুটি বিস্ফোরণে বিদ্যৎ কেন্দ্রের চতুর্থ রিয়্যাক্টরের উপরের প্রায় এক হাজার টন ওজনের কংক্রীটের ঢাকনা সরে যায় এবং ছাদ ভেঙে যাওয়ার ফলে এক বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনার ২০ ঘন্টা পর বাইরের বাতাস ঢুকে রিয়্যাক্টরের দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে সেখানে বিরাট অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। এ আগুন ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে করে পারমানবিক বিক্রিয়ায় তৈরী পদার্থ পরিবেশে প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রচুর পারমানবিক ধুলো পরিবেশে দূষণ ছড়িয়েছিল।পরিবেশে পারমানবিক পদার্থ বেরিয়ে পড়েছিল প্রায় পাঁচশ টি ১৯৪৫ সালে হিরোসিমার উপর আমেরিকার ফেলা পারমানবিক বোমার সমান। পারমানবিক ভাবে সক্রিয় মেঘ এই দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত হয়ে ইউক্রেন, বেলোরাশিয়া, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে, গ্রেট ব্রিটেনে এমন কি পূর্ব আমেরিকার উপরেও গিয়েছিল।
চেরনোবিল পারমানবিক দূর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব কাটানোর জন্য দুর্ঘটনার আশপাশের এলাকার লোকজন সরিয়ে নেওয়া হয়। দুর্ঘটনার পর থেকেই জনসাধারণের জন্য চেরনোবিল পরামাণু কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পারমানবিক দূষণ থেকে পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে একটি বিশাল কংক্রীটের খোলসের মধ্যে দুর্ঘটনাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া চতুর্থ রিয়্যাক্টর কে ছয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে ঢেকে ফেলা হয়। ওই অস্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত পারমাণবিক কেন্দ্রটির ধ্বংসাবশেষকে আটকে রাখার জন্য নির্মিত একমাত্র স্থাপনা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চেরনোবিলের ধ্বংসাবশেষে থাকা গলিত প্রায় ২০০ টন পরমাণু জ্বালানি থেকে যে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে তা হাজার বছরেও সম্পূর্ণ দূর হবে না। তাই এ পরমাণু জ্বালানি বাইরের পরিবেশের আওতামুক্ত রাখতে নতুন একটি নিরাপত্তা স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। উচ্চাভিলাষী স্থাপনাটির নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১৬০ কোটি ইউরো বা ২২১ কোটি ডলার।
তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের কারণে পাশের এলাকা ও এর জীববৈচিত্র্যের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। শুৃধুৃ মানুষ নয় দুর্ঘটনাকবলিত চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় বসবাসরত পাখিদের উপরও পরেছে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া। চেরনোবিল গবেষণার সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে পাখিদের ওপর তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের প্রভাব জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অধ্যাপক মুসো ও ড. মলে চেরনোবিল দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার জীববৈচিত্র্যের ওপর গবেষণা করেছেন। গত বছর গবেষণার ফলাফলে তাঁরা জানান, পরমাণু কেন্দ্রের আশপাশের পরিত্যক্ত এলাকায় স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সঙ্গে কমে আসছে পতঙ্গের বিভিন্ন প্রজাতিও। পরিবেশের জটিল পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্য পাখির কোনো কোনো প্রত্যঙ্গে পরিবর্তনের ঘটনা আগেও দেখেছেন তাঁরা। কিন্তু মস্তিষ্কে পরিবর্তনের ঘটনা এই প্রথম নজরে এল গবেষকদের। মস্তিষ্ক ছোট হওয়া ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে এ কারণে পাখির ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায় বলে দাবি করেছেন তাঁরা। এখানকার পাখিদের মস্তিষ্কের আকার ৫ শতাংশ ছোট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। একই প্রজাতির তেজস্ক্রিয়তামুক্ত পাখির তুলনায় চেরনোবিলের পাখিদের মস্তিষ্ক প্রায় ৫ শতাংশ ছোট বলে জানিয়েছেন তাঁরা। দীর্ঘদিন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর কারণে এমনটা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চেরনোবিল পারমানবিক কেন্দ্রের দুর্ঘটনার জন্য কর্তব্যরত কর্মীদেরই দায়ী করা হয়ে থাকে। কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করা ছিলো এবং রিয়্যাক্টরটি অনুপযুক্ত অবস্থায় চালানো হচ্ছিলো, যার ফলে শক্তি নির্গমন অতিরিক্ত বেড়ে যায়। আবার, একটি গবেষণায় বলা হয় কর্মীদের রাতের শিফটে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বিক ব্যবস্থাপনাও দায়ী। এ কারনে ৩ জনকে ১০ বছরের শাস্তি দাওয়া হয়।
চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে বিপজ্জনক দূর্ঘটনা স্মরণে ২৬শে এপ্রিল আন্তর্জাতিক তেজস্ক্রিয় বিকীরণ সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় দিবস পালন করা হচ্ছে। তেজস্ক্রিয় দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় থেকে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আজ রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলোরাশিয়া বহু শহরে স্মরণ সভা করা হবে। আন্তর্জাতিক তেজস্ক্রিয় বিকীরণ সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় দিবসে চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে দূর্ঘটনায় নিহদের স্মরণে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
Comments (0)
সে ছোঁয় না আমায় কভু
তবুও তার ছোঁয়া লাগে,
স্পর্শ হাজার ভুলিয়ে দেয়া
সেই ছোঁয়াতেই স্বপ্ন জাগে।
কিচ্ছু নয় শুধু মনের ভাষাটা ফুটেছে চমৎকার
অনেক অনেক ধন্যবাদ কবি মাইদুল। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
''সে শোনে না আমার কথা
তবুও মনের কাব্য শোনে,
তার বিহনে কাব্য আমার
পরিতৃপ্তির প্রহর গোনে।''
চমৎকার করে মনের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
ভীষণ ভালোলাগা।
শুভকামনা প্রিয় কবি।
অসংখ্য ধন্যবাদ কবি নিষাদ। শুভ কামনা তোমাকেও।