Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

স্মৃতিকথা-৩ : স্কুলে প্রথম দিন

এক বছরের মধ্যে ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত পড়া শেষে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলাম বাড়ির পাশে গুদিঘাটা প্রাইমারী স্কুলে। সে ১৯৬৮ সালের কথা। আমাদের বাড়ির পিছনে একটি খাল পাড় হয়ে বাগানের মধ্যে কিছুটা পথ হেঁটে এক চাচাদের বাড়ির উপর দিয়ে স্কুলে যেতে মিনিট কুড়ি সময় লেগে যায়। খালে যখন ভাটা থাকতো তখন হাঁটু পানি পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু জোয়ারের সময় গলা পানি ভেঙে স্কুলে যাওয়া ছিল খুবই কষ্টকর। এই পথটি ছাড়াও আরো দু’টি পথ ছিল। বাড়ির পূর্ব দিকে আমার চাচাতো ভাই তসলিমদের বাড়ির পাশ কাটিয়েয় প্রায় ৪০ মিনিট পথ হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। এটির চেয়ে একটি সহজ পথ ছিল- বাড়ির পশ্চিম দিকে জমিদারদের পোড়ো বাড়ির উপর দিয়ে। এই পথে কম করে হলেও ৩০ মিনিট সময় লেগে  যেতো।
জমিদারদের বাড়ির সামনে প্রকান্ড একটি বট গাছ ছিল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এতো বড় আর কোন বটগাছ আছে কিনা আমার জানা নেই। বট গাছের নীচে থাকতো হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি। এখানে দুর্গা পূজা, লক্ষ্মী ও কালি পূজা হতো। জমিদাররা ছিলেন ঘোষ বংশের। জনশ্রুতি রয়েছে জমিদার বংশের কোন এক ঘোষের টিকি স্থানীয় লোকজন কেটে দিলে এই গ্রামটির নামকরণ করা হয় ঘোষের টিকিকাটা। নামকরণ কতটা সত্য আমার জানা নেই। ছেলেবেলায় এ রকমই শুনে আসছি।
সাত চল্লিশের দেশ ভাগের পর ঘোষরা ভারতে চলে গেলে বাড়িটি পোড়ো বাড়ি হয়ে যায়। আমার দাদা আযহার উদ্দিন পঞ্চায়েতরা ছিলেন দুই ভাই। এরা জমিদারদের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। আমাদের জমাদার খেতাব ওই জমিদাররাই দিয়েছিলেন।  জমিদাররা ভারতে যাওয়ার সময় আমার দুই দাদাকে বসতভিটা মিলিয়ে প্রায় ৯শ’ কুড়া জমি দিয়ে যান। সাত চল্লিশের পর জমিদারদের কেউ আর নিজেদের বসত ভিটায় ফিরে আসেননি। একাত্তর সালে  বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জমিদারদের এক ভাই এসেছিলেন। তারা  আমাদের বাড়ির পাশে তসলিমদের বাড়ির বাগানে প্রকান্ড একটি পাকুর গাছের নীচে রাতে পূজা দিতে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির বাগানে পুকুর পাড়ে খালের ঠিক ওপাড়ে তসলিমদের বাড়ির বাগানে পাকুর গাছটি  আজো হয়তো আছে। ছেলেবেলায় এই গাছটিকেও আমি ভয় পেতাম। জমিদার বাড়ির প্রকান্ড বট গাছটির নীচেও তারা পূজা দিয়েছিলেন। তারপর আর তারা এ দেশে আসেননি।

জমিদারদের বাড়ির প্রকা- এই বটগাছের নীচ দিয়ে স্কুলে যেতে আমার খুব ভয় করতো বলে এই পথটি আমার কাছে তিনটির মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দের ছিল। তা সত্ত্বেও খালে জোয়ার থাকলে এ পথেই স্কুলে যেতে হতো। জমিদারদের বাড়ির পার হয়ে উত্তর দিকে নাপিত বাড়ি পর্যন্ত প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটার পথের দু’ধারে নারকেল গাছের সারি ছিলো। আমার ছেলেবেলায় গাছগুলো মধ্যবয়সী ছিল। নারকেল গাছের সারির মধ্যদিয়ে রাস্তার মাথায় গিয়ে বাম দিকে ছিল নাপিত বাড়ি। বাড়ির চারদিকে বাউন্ডারী ওয়ালের মধ্যে একটি মঠ ও  প্রকা- একটি দালান চোখে পড়ার মতো। এগুলো সংস্কারের অভাবে জীর্ণ হয়ে পড়েছিল তখন থেকেই। পলেস্তরা খসে পড়ে ইট বের হয়ে পড়েছিল। অশ্বত্থ গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে দালানের ফাঁক-ফোকরের মধ্য দিয়ে। নাপিত বাড়ির লোকজন নাকি অলৌকিকভাবে  প্রচুর টাকা-পয়সা পেয়ে এসব স্থাপনা তৈরি করেছিল। আস্তে আস্তে তারা সব কিছু হারিয়ে আবার নিজেদের পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এই বংশের বলাই শীল গ্রামের পথে পথে হেঁটে পান বিক্রি করতো। আবার সুতারের কাজও করতো মাঝে-মধ্যে। এই বাড়ির একজন-নামটা মনে নেই, আমাদের বাড়িতে চুল কাটার কাজ করতো। মাসে একবার আমাদের বাড়ির দরজায় গিয়ে চুল কেটে আসতো। বছরের একবার অর্থৎ পৌষ মাসে এরা মজুরি হিসাবে ধান নিতো।
 একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় এই বাড়িতে যেতাম  রেডিও’র জন্য  বেটারী কিনে আনার জন্য। তখন দুই ধরনের বেটারী পাওয়া যেতো। কোহিনূর কোম্পানীর ছিল চান্দা বেটারী। আর হক কোম্পানীর ছিল হক ব্যাটারী। আমাদের রেডিও জন্য আমরা দামে একটু বেশি দিয়ে চান্দা বেটারী কিনে আনতাম। এক জোড়া বেটারীর দাম ছিল বারো আনা। তখন এক কেজি চালের দাম ছিল আট আনা।
রাস্তার ডান দিকে, নাপিত বাড়ির উল্টো দিকে ছিল আমাদের স্কুল। মূল রাস্তা থেকে ডান দিকে মোড় নিলেই একটি বকুল গাছের নীচ দিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে খালের ওপর ছোট্ট একটি সাঁকো পার হলেই আমাদের স্কুল ঘরটি। এটি পাকা দালাল ছিল। এখনো আছে।  টিকিকাটা ইউনিয়নের মধ্যে এটি প্রথম বিল্ডিং। এ  ছাড়া আরো একটি দালাল আছে, যেটি তহসিলদারদের অফিস, থানার পাশেই। আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল প্রকা- একটি তেঁতুল গাছ।

স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনটি আমার কাছে খুব স্মরণীয়  হয়ে আছে।  অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু বুকে সকালে ঘুম থেকে উঠে পান্তা ভাত খেয়ে জামা-কাপড় পরার জন্য যেই জামা গায়ে দিয়েছি, অমনি দেখা গেলো দুটি বোতাম নেই! কি আর করা! বড় বোন সেফটিপিন দিয়ে বোতামের কাজটি সেরে দিলেন। মাথা আচড়িয়ে দিয়ে হাতে কয়েকটা বই আর খাতা তুলে দিলেন তিনি।
প্রাথম দিন স্কুলে গেলাম মেঝো বোন দোদুলের সাথে। ও ক্লাস ফাইভে পড়তো। আমি আমার এক চাচাতো বোন বেনুকে পেলাম আমার ক্লাসমেট হিসাবে। খাল পাড়ি দিয়ে ওদের বাড়ির ওপর দিয়ে  স্কুলে যেতাম। ওদের বাড়িতে বড় বড় রাজহাঁসগুলো আমাদের দেখলেই কন কন ডাক দিয়ে তেড়ে আসতো। খুব ভয় পেতাম আমি। মেঝো বোনের হাত ধরে দুরু দুরু বুকে রাজহাঁসদের পাশ কাটাতাম।
স্কুলে স্যাররা এসে রোলকল করতেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। অন্যরা হেসে উঠতো। বেনু আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল ‘প্রেজেন্ট স্যার’ বলতে হয়। তাই বলতাম অর্থ না বুঝেই। বেনু আমার খুব প্রিয় ছিল। ওর ছিপছিপে শরীর, মিষ্টি হাসি ভালো লাগতো আমার। ও সে কথা জানতো না। জানানোরও প্রয়োজন মনে হয়নি কখনো।
স্কুলে আমি প্রথম দিন বেনুর পাশে বসেছিলাম। এর পরের দিন থেকে স্যাররা আমাকে ছেলেদের সাথে বসতে বাধ্য করেছিলেন। বেনুকে ছেড়ে অন্যদের সাথে বসতে খুব মন খারাপ লাগতো আমার। স্কুলে ছেলেমেয়েরা আলাদা আলাদা বসবে এটাই ছিল নিয়ম। বিস্ময়ের সাথে বিষয়টি মেনে নিতে হয়েছিল আমাকে।
একদিন স্কুল শেষে বেনুদের বাড়িতে ঢুকে দেখলাম ওর বাবা আনছার চাচা কি একটা যন্ত্র বাজাচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। দোদুল বলে দিলো ওটা হারমোনিয়াম। ওটা বাজিয়ে গান গাওয়া যায়। হারমোনিয়াম দেখে কয়েক দিন সময় লেগেছে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে। পরবর্তী জীবনে এই যন্ত্রটি আমার খুব কাছের হয়েছিল। খুব আনন্দ আর বুক ভাঙা কষ্ট গেছে এই হারমোনিয়ামকে কেন্দ্র করে। আপাতত সেসব কথা থাক।

আমাদের বাংলা ক্লাস করাতেন আমার বাবার এক বন্ধু আবদুর রশিদ সাহেব। সবাই ওনাকে গজ রশিদ বলে জানতেন। স্যার খুব ভালো ফুটবল খেলতেন আমার বাবার সাথে। আমার বাবাও ব্যাকে খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। রশিদ স্যারকে গজ রশিদ বলার মানে হলো উনি নাকি বল শট করার আগে বলে দিতে পারতেন কত গজ বলটি গিয়ে পড়বে। সে পরীক্ষা আমার জানা নেই । তবে তিনি আমাকে খুব ¯েœহ করতেন। একদিন গরুর রচনা লিখতে দিলেন আমাদের। আমি জানালা দিয়ে দেখলাম দূরে মাঠের মধ্যে কয়েকটি গরু ঘাস খাচ্ছে। কোনটি লাল, কোনটি কালো, কোনটি ধূসর। আমি গরু দেখে দেখে গরু রচনা লিখছি- গরুর দু’টি কান, দু’টি চোখ, একটি লেজ আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্যার খাতা দেখে হেসে গড়াগড়ি খেলেন। বললেন, কী লিখেছিস তুই!
কথা বললাম না।
তিনি বলেন, তোর লেখায় তো মোকতারী প্যাঁচ। বাকি জীবনে কী করবি।
আমি বুঝলাম না, মোক্তার কি, আর প্যাঁচ কি।

আমাদের অংক ক্লাস করতেন নগেন স্যার। উনি গণপতি হালদারের বাবা। আমার খুব শ্রদ্ধাভাজনদের একজন। গণপতি হালদার মঠবাড়িয়ার কৃতী সন্তান ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। একাত্তর সালে রাজাকাররা আরও কয়েকজনের সাথে গণপতি দা’কে ধরে নিয়ে যায়। একদিন গভীর রাতে ওয়াপদা বাঁধের পাশে খাল পাড়ে গণপতি দাসহ আরও সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে রাজাকাররা। এদের মধ্যে ছিলেন শহীদ জিয়াউজ্জামান, ছাত্রনেতা ফারুকউজ্জামানের বড় ভাই; আরও ছিলেন শহীদ মোস্তফা, তার নামে কেএম লতিফ ইন্সটিটিউশনের স্কুল মাঠের নামকরণ করা হয়েছে। ছিলেন শহীদ আবু ভাই। তার নামে শহীদ আবু সড়ক হয়েছে। যদিও এই নামকরণ অনেকেই মনে রাখেন না, ওই নামে স্থানগুলোকে ডাকেনও না। আবার অনেকে হয়তো এই নামগুলোর কী অবদান ছিলো সে কথাও অজানা।

চলবে

০ Likes ৩ Comments ০ Share ৭০২ Views

Comments (3)

  • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

    ভাল লাগল দাদা

    - গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা

    শুভ কামনা রইল।

    - ছাইফুল হুদা ছিদ্দিকী

    টাকা দিয়ে সব কিছু সব সময় হয় না।অশেষ ধন্যবাদ।ভাল থাকুন।

    • - গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা

      ধন্যবাদ ছাইফুল ভাই।

      টাকা দিয়ে সব কিছু সব সময় হয় না। সব কিছু সব সময়...... এটা ব্যাখ্যা করে বিস্তারিত ভাবে লিখতে গেলে কয়েক পর্বের উপন্যাস হবে বোধকরি।

      তবে এইটুকু বলতে পারি জীবনের অনেক কঠিনতম সময়ে অনেক কঠিনতম সমস্যার সমাধান টাকার মাধ্যমে করা সম্ভব।