Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

স্মৃতিকথা-২ : তালপাতায় হাতেখড়ি

যে কোন স্মৃতিকথায় লেখকের স্বরূপ উন্মোচন করা সহজ হয়, যদি তিনি স্বাধীন চিন্তাচেতনাকে কাজে লাগিয়ে লেখাটি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন। এটি একটি কঠিন কাজ। স্মৃতিকথা লিখতে হলে লেখককে বিপ্লবী হতে হয়। স্মৃতিকথায় জীবনের আলোকোজ্জ্বল দিকটি যেমন তুলে ধরতে হয়, তেমনি অন্ধকারের দিকটিও পাঠকের সামনের নি:সঙ্কোচে তুলে ধরা চাই। না হলে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন।
আমি কোন বিখ্যাত লোক নই। তা সত্ত্বেও নিজেকে প্রকাশ করার যে যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি, তার থেকে উত্তরণের জন্য আমার এই প্রয়াস। এ প্রসঙ্গে আরো একটি কথা না বললেই নয়, একান্ত নিজের কথাগুলো বলার অবসর আজ হয়তো আছে, কাল নাও থাকতে পারে। মন-মানসিকতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সব সময় সত্য উন্মোচন কঠিন হয়ে পড়ে। আমি মনে করি, কোন কাজ শুরু করার এখনই সময়। এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এক ধরনের অলসতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি অলস, কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে এই দুর্নামটুকু আমি নিতে চাই না। পাঠকের কাছে একটি অনুরোধ এই লেখাটিকে আত্মপ্রচারণা মনে করবেন না।
স্মৃতিকথাগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে চাই। তবে এ ধারাবাহিকতা খুব বেশি বিচ্ছিন্ন। কোনটা আগের, কোনটা পরের। তা সত্ত্বেও প্রতিটি ঘটনাই জীবনমুখি এক একটি গল্প হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই।


আষাঢ় অথবা শ্রাবণ মাস। সন্ধ্যায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। বাইরে ঝড়ো হাওয়া। মাঝে-মধ্যে বজ্রপাতের শব্দ। উঠুনে ব্যাঙের ডাক। গ্রামবাংলায় বৃষ্টির এমন রূপ শহরে কল্পনা করাও যায় না। তার মধ্যে বারান্দায় এক কোণে বসে আমার বড় বোন নাছিমা খানম মুকুল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতাটি পড়ছিলেন, আর আমি তন্ময় হয়ে কবিতাটি শুনছিলাম। কবিতাটির শিরোনাম মনে পড়ে না। ক’টি লাইন খুব মনে পড়ে আজো।

‘বৃষ্টি পড়ে রিমঝিমিয়ে, রিমঝিমিয়ে
টিনের চালে, গাছের ডালে
বৃষ্টি পড়ে তালে তালে।

জুই চামেলী ফুলের বোটায়
বৃষ্টি পড়ে ফোটায় ফোটায়…’

সেই ছেলেবেলা থেকে জানি কবিতাটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা।
মা বলতেন কোন লেখাটি কার জেনে রাখা উচিত। না হলে লেখককে অশ্রদ্ধা করা হয়। এ কথার অর্থ সেই কিশোর জীবনে বুঝতে পারিনি। পরিণত বয়সে মনে হয়েছে, যা কিছু যিনি লিখেছেন, তা পড়ে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। তাকে মনে রাখা উচিত।
বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হওয়ার পর আমার বেশ কিছু গান ভুল নামে অর্থাৎ নাসির আহমেদ কাবুল নামের স্থলে নাসির আহমেদ বাবুল নামে প্রচারিত হয়েছে। এতে খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। এ নিয়ে অভিযোগও করেছি, খুব একটা কাজ হয়নি। নিজের নামের ভুল উচ্চারণ কেউ সহ্য করতে পারে না। নাম ভুলে যাওয়া বা কার সৃষ্টি সেটা স্মরণ না করা তো মারাত্মক অপরাধ!
এখনকার অনেক শিল্পী আছেন যারা গানটি গাওয়ার সময় গীতিকার ও সুরকারের নামটি বলেন। এটা তাদের বিশেষ একটি গুণ। আবার অনেকে আছেন যারা আদৌ মনে রাখেন না শ্রষ্টার কথা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন গীতিকার বা সুরকারকে ভুলে গিয়ে গানটি হয়ে যায় রুনা লায়লার গান, সাবিনা ইয়াসমিনের গান, বশির আহমেদের গান। সৃষ্টির কি মহা প্রাপ্তি! কি পুরস্কার! এসব কারণে গান লিখতে মন চায় না। ছেড়ে দেই অভিমানে। আবার শুরু করি। কী করা মনকে তো বাধা দেয়ার ক্ষমতা আয়ত্ব করতে পারিনি কিছুতেই। মনের সাথেই তো ভেসে চলেছি জন্মের পর থেকেই। এভাবে ভেসে ভেসে একদিন মুছে যাবো, সে সত্য মেনে নিয়েছি মনে মনে।
বড় বোনের কণ্ঠে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা শোনার পর থেকেই আমি কবিতার প্রেমে পড়ে যাই। আমারও খুব ইচ্ছে হতো অমন করে কবিতা পড়ার। এ কথা একদিন মা’কে বললাম। মা আমার কথা শুনে তো হতবাক। কী বলে ছেলে! এখনও যে ধারাপাত শুরু করেনি, সে পড়বে কবিতা!
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তার আগে তোকে অ, আ, ক, খ পড়তে হবে।’।
: তারপর কবিতা পড়তে পারবো তো?- ব্যাকুল হয়ে মায়ের চোখে তাকালাম।
: পারবে না কেন! অবশ্যই পারবে। মা অভয়বাণী শোনালেন।
মায়ের কথায় ভরসা পেলাম।
পরদিনই ধারাপাত বই এলো আমার জন্য। তখন আমার বয়স ছয় বছর। লেখাপড়া শুরু করার একটু বেশি বয়সই বটে। কবিতা পড়ার অস্থিরতায় পেয়ে বসলো আমাকে। সারাক্ষণ শুধু ধারাপাত পড়তে লাগলাম। পরবর্তী জীবনে মনে হয়েছে, মায়ের মতো শিক্ষা গুরু না পেলে এক বছরের মধ্যে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে।
আমার বাবা তালগাছের পাতায় ধারালো পেরেক দিয়ে অ, আ, ক, খ এঁকে দিলেন। ধারাপাত পড়ার পাশাপাশি কাঠ কয়লা দিয়ে তৈরি কালিতে বাঁশের কলম দিয়ে বাবার এঁকে দেয়া স্বর ও ব্যাঞ্জনবর্ণের ওপর মন দিয়ে কলম ঘুরাতাম। সপ্তাহখানেক পরে শ্লেট এলো। শ্লেটের জন্য এক ধরনের পেন্সিল ছিল বিশেষভাবে তৈরি। লিখতাম আবার মুছে দিতাম। আবার লিখতাম। কিন্তু সমস্যা হলো আমার শ্লেট কখনো পুরনো হতে পারতো না। বড় জোর পনের কি এক মাস। ভেঙ্গে ফেলতাম ঠিক নয়, ভেঙে যেতো। আবার নতুন শ্লেট আসতো। আবার নতুন উদ্যমে লেখাপড়া।
পরবর্তী জীবনে লেখাপড়ার উদ্যম হারিয়ে ফেলেছিলাম। এর কারণ অনেক। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচন, প্রলয়ংকরী ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য অনেকটা দায়ী। এরপর পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে রাজনীতি পেয়ে বসলো আমাকে। তখন আমি সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। হাইস্কুল জীবন থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে এই ধারাটি খুব গতি পেয়েছিল। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুজিববাদী ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল তৃতীয়। জাসদপন্থী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হতো সব বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন একটি ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। সেই নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না ভিপি ও আখতারুজ্জামান জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। মান্না ভাইয়ের সাথে তুমুল প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছিলেন কাজী আকরাম, তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মহামতি লেনিনকে লাল সালাম জানিয়ে ‘মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ নিপাত’, ‘মার্কিনীদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়েছি দুই হাত তুলে। মিছিলের পুরোভাগে থাকতাম সব সময়। কতবার যে পত্রিকার প্রথম পাতায় সেসব জঙ্গি মিছিলের ছবি উঠেছে তার হিসাব রাখিনি। পত্রিকার মধ্যে সংবাদ পত্রিকা ছাত্র ইউনিয়নের খবর বেশি ছাপতো। আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তারা এই পত্রিকাটির একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম। এখনও এই পত্রিকাটি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনের কাছে প্রিয়। এই পত্রিকাটিতে চোখ বুলাতে না পারলে সেদিন পত্রিকা পড়া অসমাপ্ত মনে হয় আমার কাছে।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্বর ও ব্যাঞ্জনবর্ণ আয়ত্ব হলো আমার। দু’মাসের মধ্যে মাকে বললাম, সব পড়া শেষ আমার। মা সেটা জানতেন। বাবাকে বলে ক্লাস টুয়ের বই এনে দিলেন। সেটাও দুই মাসের মধ্যে পড়া শেষ করলাম। আরও তিন মাসের মাথায় ক্লাস থ্রির সব বই পড়া শেষ করলাম। তখনও আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়নি। আমি জানতাম না যে, বছর শেষে পরীক্ষা দিয়ে ক্লাস পরিবর্তন করতে হয়। বাবা-মাও সে কথা বলেননি। আমাদের কাচারি ঘরে একজন মওলানার কাছে চাচাতো ভাইবোনেরা আরবী পড়তো। আমিও তার কাছে গোটা কয়েক সুরা পড়ার পর লেখাপড়া শুরু করলাম। মাওলানা সাহেবের নাম ছিল রব সাহেব। খুব পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি একজন মানুষ ছিলেন তিনি। আমাকে তিনি খুব আদর করতেন। মাওলানা সাহেব কিছুদিন পর আর আমাদের বাড়িতে থাকলেন না। এরপর আমাদের গ্রামের সুশীল স্যার এলেন। তিনি কাচারি ঘরের স্কুলে আমাদের পড়াতেন।
সুশীল স্যারের একটি বিষয় আজো আমি বুঝতে পারিনি। উনি যখন আমার হাতের লেখা বা অংক দেখতেন তখন আমি টেবিলি উঁকি দিয়ে উনি কী দেখছেন খেয়াল করতাম। এ সময় মাঝে মাঝে সুশীল স্যারের হাতে আমার নাকের শ্বাস-প্রশ্বাস লেগে গেলে বলতেন, ‘কী করেছিস, তাড়াতাড়ি ফুঁ দে।’ এতে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো আমার। আমি স্যারের হাতে বার বার ফুঁ দিতে থাকতাম। স্যারের হেসে বলতেন, ঠিক আছে, এবার থাম!

চলবে

১ Likes ২ Comments ০ Share ৫১৪ Views