Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

স্মৃতিকথা-১ : দাদা তো গরুর গোসত খান না!

 

যে কোন স্মৃতিকথায় লেখকের স্বরূপ উন্মোচন করা সহজ হয়, যদি তিনি স্বাধীন চিন্তাচেতনাকে কাজে লাগিয়ে লেখাটি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন। এটি একটি কঠিন কাজ। স্মৃতিকথা লিখতে হলে লেখককে বিপ্লবী হতে হয়। স্মৃতিকথায় জীবনের আলোকোজ্জ্বল দিকটি যেমন তুলে ধরতে হয়, তেমনি অন্ধকারের দিকটিও পাঠকের সামনের নি:সঙ্কোচে তুলে ধরা চাই। না হলে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন।
আমি কোন বিখ্যাত লোক নই। তা সত্ত্বেও নিজেকে প্রকাশ করার যে যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি, তার থেকে উত্তরণের জন্য আমার এই প্রয়াস। এ প্রসঙ্গে আরো একটি কথা না বললেই নয়, একান্ত নিজের কথাগুলো বলার অবসর আজ হয়তো আছে, কাল নাও থাকতে পারে। মন-মানসিকতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সব সময় সত্য উন্মোচন কঠিন হয়ে পড়ে। আমি মনে করি, কোন কাজ শুরু করার এখনই সময়। এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এক ধরনের অলসতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি অলস, কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে এই দুর্নামটুকু আমি নিতে চাই না। পাঠকের কাছে একটি অনুরোধ এই লেখাটিকে আত্মপ্রচারণা মনে করবেন না।
স্মৃতিকথাগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে চাই। তবে এ ধারাবাহিকতা খুব বেশি বিচ্ছিন্ন। কোনটা আগের, কোনটা পরের। তা সত্ত্বেও প্রতিটি ঘটনাই জীবনমুখি এক একটি গল্প হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই।

উনিশ’ একাশি সালের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হলের ২০০৭ নাম্বার রুমে থাকতাম। সন্ধ্যার পরই খবর পেলাম হল তল্লাশি হবে। হোক না, তাতে আমার কি! আমি নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বন্ধুদের দেখলাম যে যার মতো করে এদিক-সেদিক পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকেও টানাটানি শুরু করে দিলো। শেষটায় বাধ্য হলাম হল ত্যাগ করতে। রাতে হল তল্লাশি হলো। এটুকু না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু অপ্রীতিকর কোন একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেলে আমি নিরুপায় হয়ে পড়লাম। আমার বাড়িতে যাওয়ার যে লঞ্চভাড়া ১১ টাকা দরকার, সেটাও আমার পকেটে নেই! এ অবস্থায় দেখা হলো জগন্নাথ হলের কয়েকজন বড় ভাইয়ের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করার জন্য এদের সাথে আমার সখ্যতা ছিল খুব। তারা জিজ্ঞেস করলেন, কী করবো আমি, বাড়ি যাবো কিনা। আমার অসহায়ত্বের কথা বললাম তাদের। হো হো করে হেসে উঠলেন তারা। বললেন তাদের কাছে সদরঘাট যাওয়ার পয়সাও নেই! একটা কিছু হবে ধরে নিয়ে বিকাল পাঁচটার লঞ্চে চড়ে বসলাম আমরা সাত থেকে আটজন। কারো কাছে কোন টাকা-পয়সা নেই। দু’এক কাপ চা আর সিগারেট ছাড়া একটি বিস্কুট খাওয়ার সামর্থও নেই কারো।
ভিক্ষুক হলে কী হবে, পায়ে স্যান্ডেল থাকা চাই। আমাদের এলাকায় এক জমিদারের নাতি পায়ে স্যান্ডেল পরে ভিক্ষা করতেন। সে কথা পরে বলবো। আজ নিজেদের কথা বলি। সবাই মিলে ফার্স্টক্লাসের সেলুনে গিয়ে বসলাম। হৈ-হুল্লোড় করে তাস খেলছি সবাই। খাবার সময় হলো। পকেটে টাকা নেই। চা পানই ভরসা। এর মধ্যে দু’বার টিকিট কাটার জন্য লোক এসে ফিরে গেলো। তাস খেলা বন্ধ করে সবাই ভাবতে বসলাম কীভাবে টিকিটের ফয়সালা করা যায়।
বড় ভাইয়ের একটা কোর্ট ছিল আমার ব্যাগে। ঢাকায় ধোলাই করতে দিয়ে তিনি বাড়িতে গেছেন। আমাকে বলেছেন, যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। সেটাকে কাজে লাগালাম। হালকা শীত শীত পড়ছে বলে গায়ে জড়ালাম সেটিকে। এবার নিজেকে সাহেব সাহেব মনে হলো। সবাইকে বললাম আমি সুপারভাইজারের কাছে যাচ্ছি। অবাক হয়ে আমার যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো সবাই।
সুপারভাইজারকে বললাম, কষ্টের কথা। বললাম, রাতে খেতে পারিনি। হল বন্ধ হয়েছে হঠাৎ বাড়ি যাচ্ছি, টিকিট কাটবো কি দিয়ে!
সুপারভাইজার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন, ‘ঠিক আছে, সমস্যা হবে না।’
সমস্যা হয়নি সে যাত্রা।
সত্য বলার সুবিধা আছে। মানুষকে বিশ্বাস করানো যায়। একটি মিথ্যে কথাকে হাজারটা মিথ্যে দিয়েও সত্য বানানো যায় না। তাছাড়া সত্য প্রকাশের অহংকারও আছে!
বাড়িতে গিয়ে দেখলাম মা বাসায় নেই। নভেম্বর মাস। নতুন ধান উঠবে বলে ভাইবোন সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন তিনি। আমি ঘরে একা। মাঝে-মধ্যে নিজের হাতে রান্না করে খাই। এরই মধ্যে মায়ের কয়েকটি মুরগী বন্ধুদের নিয়ে সাবার করেছি। এখন আর ঘরে চাল ছাড়া আর কিছু নেই। বাজার থেকে কিছু কিনবো সে সামর্থ কোথায়! তবুও না খেয়ে থাকিনি কখনো। বন্ধুরা সাহায্য করেছে, এক একদিন পালা করে ওদের বাড়িতে খেয়েছি।
একদিনের ঘটনা খুব মনে পড়ে। সন্ধ্যায় উদীচী’র অনুষ্ঠান ছিল টিটিডিসি সেন্টারে। তখনকার দিকে অডিটোরিয়াম ছিল না থানা পর্যায়ে। সন্ধ্যা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হলো। শেষ হলো রাত এগারোটায়। খুব ক্ষিধে অনুভব করলাম। আমাদের সাথে ছোট ভাই ও বন্ধুদের বললাম আজ না হয় হোটেলে রাতের খাওয়াটা খাই। সবার পকেট হাতড়ে তিন কি সাড়ে তিন টাকা পেলাম। এতেই যা হোক কিছু একটা খাওয়া যাবে। সবচেয়ে নিম্নমানের একটি হোটেলে দেখলাম টিম টিম করে হেরিকানের আলো জ্বলছে। গিয়ে বসলাম চার-পাঁচজন। বেয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাত আছে?
: কয়জনে খাইবেন?
: আমি একলা।
: আছে। খাওয়াইতে পারমু। বয়েন।
বসলাম। ভাতের প্লেট নিয়ে এলো বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে। ওর নামটা ভুলে গেছি আজ। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘কি দিয়া ভাত খাইবেন?’
: আছে কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
: দাদা আপনি তো গরুর গোসত খাইবেন না!
মনে মনে বললাম, খাবো কি। পয়সা থাকলে তো!
: কেন, গরুও গোসত খাবো না কেন? ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম। ছেলেটি হাসলো। বললাম, আপনে কি মনে করছেন, মুই কি জানি না যে, আপনে গরুর গোসত খান না!
: আরে পাগল, বলতি তো কেন খাই না?
: আপনি তো দাদা, আপনারা যে গরুর গোসত খান না, হেইডা মুই বালো কইরা জানি।
ছেলেটি আমাকে হিন্দু মনে করেছে! মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম। যাক, এই যাত্রা তাহলে ভগবান তার একজন সনাতনী ভক্তকে উদ্ধার করবেন।
: আমি হিন্দু কীভাবে বুঝলি?
: ক্যান আপনে গান করেন। মুই চিনি তো আপনেরে? আপনার নাম কাবুল দা না? কি ঠিক কই নাই?
আমার সাথে ছিল শংকর সাওজাল আমাদের প্রিয় শংকার দা’র ছোট ভাই শিবু, পরিমল আর ছিল দ্বীজু মোহন গোলদার। ওরা সবাই হেসে গড়াগড়ি গেলো। ছেলেটি অবাক হয়ে দেখতে লাগলো আমাদের।
: দাদা, মুই কি কিছু অন্যায় কইছি?
মনে মনে বললাম, যাক বাঁচা গেলো। গরুও মাংস খাওয়ার পয়সা নেই। এ কথা ছেলেটিকে বলতে হলো না।
: না না ঠিকই বলেছো। এবার বল, কি দিয়ে ভাত খাওয়াবি।
: কেন, আন্ডা ভাইজা দিমু।
সেই রাতে ডিম ভাজা আর শুকনা মরিচ পোড়া দিয়ে যে ভাত খেয়েছিলাম, তার স্বাদ এই নাগরিক জীবনে এখনও মনে পরে।

চলবে

০ Likes ২ Comments ০ Share ৪৬৮ Views