Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

সোশালিস্ট রিয়ালিস্ট ধারার সাহিত্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত রুশ সাহিত্যক মাক্সিম গোর্কির ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি


বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও রাজনৈতিক লেখক আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। যিনি মাক্সিম গোর্কি নামে সমধিক পরিচিত। এটি তার ছদ্ম নাম। তিনি নিজেই তার সাহিত্যক ছদ্মনাম হেসেবে বেছে নেন 'গোর্কি' নামকে। গোর্কি শব্দের অর্থ তিক্ত বা তিতো। আক্ষরিক অর্থে তিনি তা-ই ছিলেন। তার লেখায় সবসময় ফুটে উঠেছে তিক্ত সত্য। রাশিয়ার জনজীবনের নিঠুর বাস্তবতাকে তিনি কলমের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। অকুতোভয় বীরের মতো জার সম্রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে। তাকে সোশালিস্ট রিয়ালিস্ট ধারার সাহিত্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। তার অনেক বিখ্যাত রচনার মধ্যে মা একটি কালজয়ী উপন্যাস। বিখ্যাত এই ঔপন্যাসিক। বিশ্বখ্যাত এই লেখক ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ৭৮তম মৃত্যুৃবার্ষিকী। বিখ্যাত রুশ সাহিত্যক মাক্সিম গোর্কির মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(দাদীর সাথে মাক্সিম গোর্কি)
১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ার নিজনি নভগরোদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন ঔপন্যাসিক মাক্সিম গোর্কি। তার বাবা-মার দেওয়া নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবা-মার মৃত্যুর পর ১৮৮০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার দাদীমাকে খুঁজতে গৃহ ত্যাগ করেন। এর পর তিনি দাদীর কাছে বেড়ে উঠতে থাকেন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রথমে কাজ করেন জুতার দোকানে। এর পর কাজ নেন কয়েদি জাহাজে। সেখানে কর্মচারীদের বাসন ধোয়ার কাজ করতেন ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে মনের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেন তিনি। এক পর্যায়ে ১৮৮৭ সালে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন। প্রকৃতির রূপ, রস যার হৃদয়ে আসন পেতে বসে ছিল, তাকে কি এই কষ্ট হার মানতে পারে? কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাই তিনি দু'চোখ ভরে দেখতেন নদীর অপরূপ দৃশ্য। পরবর্তীতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমন করেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বেড়ে উঠতে লাগলেন গোর্কি। পাশাপাশি নিজের মধ্যে গড়ে তুললেন বই পড়ার অভ্যাস। ১৮৮৭ সালের পর কিছু আঞ্চলিক পত্রিকায় লেখালেখি করেন। স্থানীয় এক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তার গল্প-কবিতা। এ সময় পরিচিত হন তরুণ লেখক ভ্লাদিমির করোলেঙ্কার সঙ্গে। জীবন যেন অন্যদিকে মোড় নিল গোর্কির। প্রথাগত রচনার ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হলো তার নতুন পথের যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র প্রকাশ পেতে থাকে তার রচনায়। বিষয়গুলো পত্রিকায় ছাপার পর সবাই মুগ্ধ হয়ে তা পড়তেন। তখনও ঠিক অতটা খ্যাতি পাননি গোর্কি। এ সময় গোর্কি জারের শোষণ আর অত্যচারের বিরুদ্ধে যুক্ত হন বিপ্লবী দলের সঙ্গে।

১৮৯২ সাল নাগাদ গোর্কি ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তার প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে তার প্রথম সংকলন 'এসেজ অ্যান্ড স্টোরিস' প্রকাশ পায়। বইটি ভালোই পাঠক সমাদর পায়। এটি প্রকাশের পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সে সময়ের রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক চেখভ, তলস্তয়ের সঙ্গে গোর্কির নামও উচ্চারিত হতে থাকে সবার মুখে মুখে। ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'ফোমা গর্দেয়ভ'। এ উপন্যাসে তিনি নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের মর্মবেদনার কথা তুলে ধরলেন, যা এর আগে কেউ এমনভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। এ উপন্যাস রুশ শাসকদের বিচলিত করে তোলে। ফলে বন্দি হন তিনি। অবশ্য খুব শিগগিরই তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় রুশ সরকার।

১৯০১ সালে বিপ্লবী অন্দোলন ক্রমেই বেড়ে চলছিল। ১৯০২ সালে লেনিনের সঙ্গে তার দেখা হয়। এরপর তারা ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হন। এ সময় তিনি প্রেসের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কথা বলেন তিনি। ওই বছর অনারারি একাডেমিশিয়ান অব লিটারেচার নির্বাচিত হন। কিন্তু জার নিকোলাস দুই তা রদ করেন। এর প্রতিবাদে আন্তন চেকভ ও ভ্লাদিমির করোলেঙ্কো একাডেমি ত্যাগ করেন। গোর্কি তখন সেন্ট পিটার্সবার্গে। কাজানের এক আন্দোলনে অনেক ছাত্র নিহত হলে তিনি লেখেন 'দ্য সং অব দ্য স্টর্মি পেত্রল' 'ঝড়ো পাখির গান' নামের বিখ্যাত কবিতা। তার এ কবিতা যেন বিপ্লবের মন্ত্র। ক্রমেই গোর্কি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন লেনিনের আদর্শে। এ সময় বহু বিপ্লবী নেতাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তিনি হয়ে উঠলেন জার কর্তৃপক্ষের এক নম্বর শত্রু। আন্দোলন তুঙ্গে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব নিয়ে লেখেন নাটক 'চিলড্রেন অব সান'। নাটকটির প্রেক্ষাপট ছিল ১৮৬২ সালের কলেরার মহামারী। কিন্তু প্রতীকি অর্থ বাদ দিলে এটি উঠে সে সময়ের রাশিয়ার চিত্র। একই বছর তিনি বিখ্যাত 'দ্য লোয়ার ডেপথ' নাটকটি লেখেন। এ ছাড়াও ম্যাক্সিম গোর্কির উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছেঃ মাকার চুদরা, অরপান পল, চেলকাশ, স্কেচস অ্যান্ড স্টোরিস (তিন খণ্ড), টুয়েন্টি সিক্স মেন অ্যান্ড এ গার্ল, মাই চাইল্ডহুড, ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ও মাই ইউনিভার্সিটিজ।

১৯০৬ সালে দেশে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। গোর্কিকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করা হলো। এ খবেরে বলশেভিকরা তাকে আইভান নরোদনির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে দলের তহবিল গঠনের জন্য পাঠান। তারা জার্মানি হয়ে ফ্রান্স ও অমেরিকায় যান। সেখানেই লিখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মাদার’। জারের ভয়ে এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদে। পৃথিবীজুড়ে এ উপন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিশ্বখ্যাত এই উপন্যাসটি পৃথিবীর বহু ভাষায় অ্নুদিত হয় যা বাংলা ভাষায় মা নামে প্রকাশিত হয়। মা উপন্যাস লিখে গোর্কি উঠে আসেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। নাম লেখান অমরত্বের খাতায়। এই উপন্যাসের কারণে পৃথিবীর শ্রেষ্ট কয়েকজন গদ্যশিল্পীর তালিকা করলে তার নাম থাকবে। মা ছাড়াও গোর্কি অসংখ্য জনপ্রিয় গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা ও আত্মজীবনী লিখে গেছেন। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত গোর্কি বাস করেন কাপ্রি দ্বীপে। এর কারণ কিছুটা্ স্বাস্থ্যগত ও কিছুটা রাশিয়ার বৈরি পরিবেশ। ১৯১৩ সালে রোমানভ রাজবংশের ৩০০ বছর পূর্তিতে দেশে ফেরার অনুমতি পান। কিন্তু ফিরে এসেও সমালোচনা থেমে থাকেনি। এ সময় তিনি সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন। রাজনীতি নিয়েও ব্যস্ত থাকেন। বিপ্লবীদের সঙ্গে কাজ করেন এ সময়। ১৯১৫ সাল থেকে তিনি রাজনীতিনির্ভর সাহিত্য পত্রিকা লিটোপিস প্রকাশ করেন। ১৯২১ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্য উদ্ধারে ইতালি যান। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে থাকেন। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা এখানেই লেখা। মাঝে মাঝে দেশে আসলেও ১৯৩২ সালে স্তালিনের আমন্ত্রণে পাকাপাকিভাবে ফেরেন । এরপর তিনি নানান ধরনের সম্মাননা ও উপঢৌকন লাভ করেন। স্তালিনের আমলে তিনি সম্মান পেলেও অচিরেই তার একনায়কতন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে। স্বভাবগত ভাবে গোর্কি এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে বলশেভিক নেতা সার্গেই কিরবের হত্যাকাণ্ডের পর গোর্কিও গৃহবন্দি হন।

১৯৩৬ সালের ১৮ জুন জীবনাবসান ঘটে এই মহান লেখকের। কিন্তু গোর্কি আজও তাঁর লেখনীর মাধ্যমে চির-অম্লান হয়ে আছেন মানুষের হূদয়ে। জগদ্বিখ্যাত এ সাহিত্যিকের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সোশালিস্ট রিয়ালিস্ট ধারার সাহিত্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ম্যক্সিম গোর্কির মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

০ Likes ০ Comments ০ Share ৪৫১ Views