ভালবাসার চাপা কষ্ট
মাহতাবউদ্দীন সাহেব বাসায় আছেন?
ডালিম মাথাটা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাচ্ছেন?
লোকটি পুনরায় গম্ভীর মুখ করে বলল, মাহতাবউদ্দীনকে চাচ্ছি।
ডালিম কিছুটা অবাক হল। মাহতাবউদ্দীন সাহেব বর্তমানে সরকারের একজন প্রভাবশালী এমপি। উনাকে এবারই মন্ত্রি করার কথা ছিল। কি কারণে যেন ফস্তে গেল। সবাই উনাকে স্যার বলে ডাকে। উনার নাম ধরে ডাকার সাহস এই বাড়িতে একজন ছাড়া আর কারো নেই। যে ডাকে সে হচ্ছে উনার ছেলে লিয়ন। এই লোকটি যেহেতু নাম ধরে ডাকছে তাহলে স্যারের চেয়েও আরও বড় কেউ হবে। নয়ত স্যারের আতœীয় কেউ হবে। স্যারের আতœীয় স্যারকে নাম ধরে ডাকে না। উনি কেন যে ডাকছেন? এত ভেবে লাভ নেই। দেখা যাক কি হয়।
ডালিম আগুন্তুককে ড্রয়িংয়ে বসাল।
মাহতাবউদ্দীন দেখতে নিগ্র“দের মত হলেও শক্তিতে, চেহারায় নিগ্রুদের থেকে জৌলস একশত পার্সেন্ট বেশি হবে। উনাকে অনেকেই নিগ্র“ এমপি ডাকেন। উনি কিছু মনে করেন না। উনি ভাবে জনগণ যেহেতু ডাকে এটা ভাল কিছুই হবে। এমপি মন্ত্রিদের ভালবেসে জনগণ অনেক নাম দেন। নামটা অসুন্দর হলেই ফেলে দিতে হবে এমন না। উনাকে সারা দেশের জনগণ নিগ্র“ এমপি ডাকে। এক নামে সবাই চিনে। এই পদবীর জন্যও উনি আলোচিত। উনি উনার তারণ্য ধরে রাখার জন্য চশমা পড়েন। চশমা তারণ্য ধরে রাখতে না চাইলেও তিনি ধরে রাখতে চাচ্ছেন। বাধ্যর্কের ছাপটা মাঝে মাঝে বেড়িয়ে আসলেও উনি এটা বুঝতে দেন না। তিনি ও মনে করেন না উনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।
অতিথী এসেছে শুনে মাহতাবউদ্দীন ড্রয়িং রুমে এলেন। অতিথী আসলে সবসময় ফোন করে আসেন। আজকে কেন আসল না উনার কাছে একটু কৌতুহল লাগল। এ ছাড়াও এ বাড়িতে অতিথী তেমন আসেন না। উনি আসতে দেন না। উনার সাথে কেউ দেখা করতে আসলে উনার অফিস থেকেই উনি বিদায় করে দেন। বাসায় আনেন না। বাসাটাকে উনি নিরিবিলি একটা স্থান মনে করেন। দর্শনার্থী এসে ভীর করলে বাসাকে উনার কাছে মনে হয় তীর্থস্থান।
মাহতাবউদ্দীন অপরিচিত লোকটার সাথে সৌজন্যবোধে কৌশল বিনিময় করলেন। উনি উনাকে চিনতে পারলেন না। উনি কেন এসেছেন সুকৌশলে দেখছেন। এত গভীর ভাবে ভাবার কিছু নাই। তবুও তিনি ভাবছেন।
লোকটি বলল, আমি আমেরিকা থেকে এসেছি কিছু দিন আগে।
মাহতাবউদ্দীন কিছুটা বিরক্ত হলে বললেন, আপনি বসেন। আমি বাসায় কারো সাথে কথা বলি না। আপনি যেহেতু বাসায় এসেই গেছেন, আমি কাউকে পাঠাই। ওর কাছে আপনার কথাগুলো বলবেন। আমি ওর কাছ থেকে শুনে নিব।
লোকটি শক্ত মুখে বলল, কাজটা আপনার কাছেই। আপনাকেই বসতে হবে। আপনি অনেক ব্যস্ত থাকেন। তারপরও একটু বসেন।
মাহতাবউদ্দীন চড়া মেজাজের মানুষ। অল্পতেই রেগে যান। আজ কেন জানি রাগলেন না। এরকম কথা কেউ যদি আগে বলত তাহলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন। তিনি হাসি মুখে বললেন, ঝটপট বলে ফেলুন। ভূমিকা করবেন না। আমি ভূমিকা পছন্দ করি না। সময় বেশি নিবেন না। মূল কথা বলবেন। ভাবসম্প্রসারণ বলবেন না। বেশির ভাগ মানুষ ভাবসম্প্রসারণের নেশায় মূল কথা ভূলে যায়।
আপনার ছেলে লিয়ন অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করছে। তাকে সাবধান করার দায়িত্ব আপনার। না হলে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।
এবার মাহতাবউদ্দীন মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেন না। রেগে গেলেন। আপনার এত বড় সাহস। আমার ছেলের নামে আমার কাছে অভিযোগ দিতে এসেছেন। আপনি কি আমার সম্পর্কে জেনে এসেছেন।
আমি আপনার সম্পর্কে জেনেই এসেছি। যারা জেনে আসে তারা শক্তি নিয়েই আসে। লোক মুখে একটা কথা শুনা যায়। আপনি মানুষটা যেমনই হোন, আপনি কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না।
আপনি বলেন, আমার ছেলে সম্পর্কে যা বলবেন যদি সত্য না হয় তাহলে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।
ঠিক আছে। আমি তাতে রাজি। আপনার ছেলে আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। আজকে তার গায়ে হলুদ ছিল। বিষয়টা আপনি বুঝতে পারছেন।
হ্যাঁ। একটা মেয়ের জন্য অবশ্যই দু:সংবাদ। আমি এই মাত্রই জানলাম। আপনি সরাসরি আমার কাছে এসেছেন কেন? থানা আছে, আইনশৃংখলা বাহিনী আছে।
থানা, আইনশৃংখলা বাহিনী কিছুই করতে পারবে না। আপনি সরকারি দলের লোক। সরকার আপনার নিয়ন্ত্রণে। আমি অন্য ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তবে আপনি শুনেছি আপনি ভাল রাজনীতিবিদ। স্বচ্ছ রাজনীতি করেন। অবৈধ ভাবে কিছু করতে চান না। যারা রাজনীতিতে স্বচ্ছ আমি মনে করি ব্যক্তিজীবনেও সে স্বচ্ছ।
আপনি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। যাকে সোজা বাংলায় বলে পাম দেওয়া। আমি আমার সামনে বেশি প্রশংসা সহ্য করতে পারি না। আমি বিষয়টা দেখছি। আপনার ঠিকানা আমার কাছে দিয়ে যান। আমি দেখি বিষয়টা কি ভাবে মিমাংসা করা যায়।
মাহতাবউদ্দীন চিন্তায় পড়ে গেলেন। উনার এক ছেলে। এক মেয়ে। সবচেয়ে মেধাবী, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন, চরিত্রবান এবং শান্তশিষ্ট ছেলে ছিল লিয়ন। ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই পাল্টাতে থাকে। রাতারাতি এত দ্রুত পাল্টাতে থাকে যা বলার মত না। উনি অনেক চেষ্টা করেছেন। চেষ্টাতে কোন ফল আসে নি। ছেলেকে নষ্টের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অনেক অনেক কিছু করছেন। কোনটাই রেজাল্টের মুখ দেখেনি। উনি এখনও বুঝতে পারছেন না লিয়ন কি আসলেই নষ্ট হয়ে গেছে। নাকি এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। অন্যের মেয়েকে নিয়ে পালানো দুষের কিছু না। পছন্দ হয়েছে তাই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। মেয়ে ছেলে রাজি থাকলে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে এটা তেমন বড় বিষয় না। যদি মেয়েটা রাজি না থাকে। বলপ্রয়োগ করে মেয়েটাকে তুলে নিলে এটা অবশ্যই নষ্ট হওয়ার লক্ষণ। মেয়েটাকে যেহেতু গায়ে হলুদ এর আসর থেকে তুলে আনা হয়েছে তাহলে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা রাজি ছিল না। এমনও হতে পারে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। মাহতাবউদ্দীন অনেক কিছু ভাবলেন। কিছুই পেলেন না।
লিয়নের মা মারা যাওয়ার পর থেকেই ছেলেটা রগচটা অন্য রকম হয়ে গেছে। লিয়নের মা মারা গেছে পনের ষোল বছর হবে। যারা যাওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই মারা গেছেন। বেশির ভাগ মানুষ বলে, মাহতাবউদ্দীন দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণেই মারা যায়। লিয়ন সবার ধারণাকেই সত্য বলে মনে করে। এছাড়াও সে ওর মা মারা যাওয়ার পিছনে মাহতাবউদ্দীনকে দুষি করেন।
লিয়নের যে বিষয়টি চোখে লেগে আছে তা হল হাসনাবানু যেদিন মারা যান তার আগের রাতে লিয়নকে কুলে নিয়ে অঝর ধারায় কাঁদছিলেন। ছোট্ট লিয়ন ওর মার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল বারবার মুছে দিচ্ছিল। লিয়ন তখন ওর মার কান্না সহ্য করতে না পেরে মাহতাবউদ্দীনের কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, বাবা তুমি নতুন বউ কেন এনেছ। মা কাঁদছে। নতুন বউ তুমি ফেরত দিয়ে আস। আমাদের নতুন বউ লাগবে না। নতুন বউকে বের করে দেব। লিয়ন নতুন বউয়ের ঘরে ও গিয়েছিল। নতুন বউকে বের করার চেষ্টাও করেছিল।
লিয়নের এখনও মনে আছে হাসনাবানু বারবার বলছিল আমার কপাল খারাপ। কপাল খারাপ না হলে এরকম হয়। এক বউ থাকতে কেউ কি আবার বউ বিয়ে করে আনে। আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই। আমি সতীনের সংসার করতে পারব না। আমি মরব। আমি মরে প্রমাণ করব আমি কতটা মূল্যবান।
পরের দিনই লিয়নের মা মারা গেল। কিভাবে মারা গেল তা কেউ বলতে পারবে না। লিয়নের তখন বারবার রাতের কথাগুলো মনে হচ্ছিল। কানে বাজছিল।
এরপর থেকেই লিয়নের মনে গেঁথে যায় হাসনাবানু মারা যাওয়ার পিছনে মাহতাবউদ্দীন দায়ী। শ্রাদ্ধের দিন লিয়ন অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট লিয়ন প্রতিবাদী হয়ে গিয়েছিল। মাহতাবউদ্দীনকে লাশের কাছেই ভীরতে দিচ্ছিল না। যারাই আসছিল সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিল এই লোকটা আমার মার খুনি। ওকে আমার মার সামনে ঘেষতে দিও না। সবাই নিশ্চুপ ছিল। কেউ একটা কথাও বলেনি। ছোট্ট লিয়নের জন্য অনেকেই সেদিন জল ফেলছিল। অনেকেই ছোট্ট লিয়নের কথা বিশ্বাস করেছিল। কারো বলার সাহস ছিল না। কানাগোষা সবাই করত। সামনা সামনি কেউ বলত না।
মাহতাবউদ্দীন লিয়নের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন লোকটি যা বলেছে তা ঠিক বলেছেন। লোকটার নাম জানা দরকার ছিল। লোকটার মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়েছে। মেয়েটার একটা ডাক্তারের সাথে বিয়ের হচ্ছিল।
মাহতাবউদ্দীনের মনে পড়ল লোকটাকে ঠিকানা দিতে বলেছিলেন। উনি নিশ্চই ঠিকানা দিয়ে গেছেন। ঠিকানা মত লোকটাকে ফোন করলেন। কয়েকবার রিং হওয়ার পরই অন্য পাশ থেকে লোকটা ধরল। উনার হ্যালো শব্দ শুনতে পেরেই মাহতাবউদ্দীন বুুঝতে পারলেন। সবাই বলে উনার স্মরণশক্তি নাকি অনেক ভাল। রাজনৈতিক বক্তিতা দিতে গিয়ে অনেকেই বক্তৃতা দেওয়ার সময় অনেক কিছু ভূলে যায়। মাহতাবউদ্দীন কিছু ভূলেন না। দশ বার বছরের আগের ঘটনাও এখনও বলে দিতে পারেন। উনার জনপ্রিয়তার বড় একটি কারণ হচ্ছে উনি কিছু করতে পারেন আর নাই পারেন। ভাল বক্তৃতা দিতে পারেন। শ্রোতা মন্ডলী উনার বক্তৃতা শুনে ঠাসকি খেয়ে যায়। বিরোধী দল উনার বক্তৃতাকে প্রচন্ড ভয় পান। বিরোধী দলের সব বক্তব্য, কর্মকান্ড মেমরি কার্ডের মত মাথায় নিয়ে সব সময় ঘুরেন। টিভির টকশোতেও উনার অনেক দাম। সরকারী দলের হয়ে টকশোতে গিয়ে টকশো কাঁপিয়ে দেন। উনার বিপক্ষের লোককে একটু নাস্তানাবোধ হতে হয়।
আমি মাহতাবউদ্দীন। আপনার মেয়েটিকে খোঁজে পাওয়া গেছে। আমার ছেলের সাথেই আপনার মেয়ে আছে। আমার ছেলে যেহেতু আপনার মেয়েকে তুলে এনেছে। আমি চাচ্ছি আমার ছেলের সাথেই আপনার মেয়ের বিয়ে হোক। আপনার কোন আপত্তি আছে।
অবশ্যই আছে। যে ছেলে বিয়ের আসর থেকে কোন মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় সে কতটা ভাল হবে তা বুঝার অপেক্ষা রাখে না। সন্ত্রাস ছেলের কাছে আমার মেয়ে বিয়ে দিতে পারি না। টাকা, ক্ষমতা থাকলেই সব হয় না। শান্তিটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিষ। আমি আপনার ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছি না।
আপনি কি চাচ্ছেন, আপনার মেয়েকে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে।
হ্যাঁ চাচ্ছি।
তাহলে ঠিক আছে। আপনার মেয়েকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
আমার মেয়ের যে কলঙ্ক করলেন তার কি হবে?
কলঙ্ক মুছনের ব্যবস্থা করেছিলাম। আপনি রাজি না। এখন আপনি বলেন কি করলে আপনার কলঙ্ক মুছন হবে।
উনি টেলিফোনেই ভাবতে লাগলেন। নিশ্চুপ হয়ে রইলেন।
মাহতাবউদ্দীন বললেন, আপনি ভেবে পাচ্ছেন না। আপনাকে বলি, আপনি ওদের বিয়েটা মেনে নেন। আমার ছেলে যদি সন্ত্রাসও হয় তাহলে আপনার মেয়ের কোন সমস্যা হবে না। সে সুখেই থাকবে। টাকার সুখ হচ্ছে বড় সুখ। টাকার কোন অভাব হবে না।
আমি টাকার সুখটাকে বড় সুখ মনে করি না। আমি মনের সুখটাকে বড় মনে করি।
ওরা যদি পছন্দ করে বিয়ে করে তাহলে মনের সুখ হবেই।
পছন্দ করে বিয়ে করলে আমার কোন সমস্যা ছিল না। সন্ত্রাস নাকি অন্য কিছু ভাবতাম না। সমস্যা হচ্ছে আমার মেয়ে আপনার ছেলেকে চিনেই না। পছন্দ করবে কিভাবে। আমি জানি, আমার মেয়ের সাথে কারো সম্পর্ক নেই।
আপনার জানার মধ্যে ভুল থাকতে পারে। আপনার ভাগ্য ভাল আমার মত মানুষের পাল্লায় পড়েছেন। নইলে আপনি রাজি হবেন কি? ছেলে পক্ষই রাজি হত না। এই দেশের যে কোন মেয়েকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই এক পায়ে খাড়া আছে। যদি মুখ থেকে বললাম, আমার ছেলেকে বিয়ে করাব তাহলে মেয়েদের লক্ষ লক্ষ লাইন পড়ে যেত।
আমি বুঝতে পারছি। আপনি যা বুঝেন করেন। আমি আপনার সাথে একমত।
মেয়েকে নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। ওরা যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। নিরিবিলি হানিমুন সেরে ফেলুক। টিকটিকি পাঠিয়ে ওদের হানিমুনটা নষ্ট করে লাভ নেই। টিকটিকি পাঠালাম না। ওদের আশে পাশেই টিকটিকি আছে। যে কোন সময় ইচ্ছা করলেই ওদের ধরা যাবে।
টিকটিকি কি?
আমেরিকান, টিকটিকি হচ্ছে পুলিশ। দেশীয় ভাষায় অনেকেই বলে। আমিও বললাম। সস্তা রসিকতা ধরত পারেন।
কয়েকিদিনের মাথায়ই লিয়ন বাড়িতে এসে উপস্থিত। লিয়ন একা এসেছে। মেয়েটা সাথে নেই। মাহতাবউদ্দীন অভাব। মেয়েটা কোথায় গেল। জিজ্ঞেস করা যায়। জিজ্ঞেস করলে যদি রেগে যায়। সবাই মাহতাবউদ্দীনকে ভয় পায়। মাহতাবউদ্দীন ছেলেকে ভয় পান। বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পান। তিনি ছেলের আশে পাশে ঘুরেন কোন তথ্য পান না। ছেলের মোবাইলে কান পেতে থাকেন কিছু বলে কিনা। উনি তথ্য উদঘাটতে ব্যর্থ হয়ে পিএস ডালিমকে তলব করেন।
ডালিম শুরু থেকেই মাহতাবউদ্দীনের বিশ্বস্ত কর্মচারী। লিয়নের সাথে মাহতাবউদ্দীনের কোন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ছেলে বাবার সাথে কথা বলে না। মাহতাবউদ্দীন চান ছেলে যেন কথা বলে। উনি চেষ্টাও করতেন। সলিট কথা ছাড়া লিয়ন আর কোন কথাই বলে না। সলিট কথা বেশিক্ষণ চালিয়ে নেওয়া যায় না। পিএস ডালিম কাজের লোক। যেকোন কাজ তাকে দিলে খুব সুন্দর ভাবে করতে পারে। কাজের মধ্যে কোন ফাঁক রাখে না। যে কোন কাজ এমনভাবে করবে যাতে কোন প্রশ্ন না থাকে। সব প্রশ্নের উত্তর যেন একসাথেই পাওয়া যায় সে সেইভাবেই কাজ করে। ডালিমকে নিয়োগ করলেন লিয়নের বিয়ে এবং বিয়ের পরবর্তী মেয়েটার অবস্থান জানার জন্য। অন্যভাবে তিনি কাজটা করতে পারতেন। মিডিয়া আছে, খবরের কাগজ আছে। ওরা তিলকে তাল করবে। তালকে অদৃশ্য করবে। ওরা হয়ত রিপোর্ট করে বসবে বাচ্চা পেটে মেয়েকে নিয়ে সনামধন্য এমপি পুত্রের কান্ড।
লিয়ন মাহতাবউদ্দীনকে হাসনাবানু মারা যাওয়ার পর কখনো বাবা বলে ডাকে নি। এই নিয়ে মাহতাবউদ্দীনের মনে অনেক কষ্ট। ছেলে বাবা ডাকবে না এটা কি করে হয়। জন্ম দিয়েছে। বছরের পর বছর একই ছাদের নিচে থেকে যদি ছেলে বাবাকে বাবা না ডাকে তাহলে সব বাবারই কষ্ট থাকে। মাহতাবউদ্দীনও ছেলেকে লিয়ন বলে ডাকে না। বদমাইশটা কই? এরকম ভাবেই ডাকেন। এই হচ্ছে বাবা ছেলের সম্পর্ক।
ডালিম ভয়ে ভয়ে লিয়নকে জিজ্ঞেস করল, লিয়ন ভাই, ভাবীকে আনলেন না।
লিয়ন এমন ভাব করল যে, সে কিছুই জানে না। তোমার ভাবী আসবে কোথায় থেকে। ভাবী কি আসার কথা ছিল নাকি। উনি কি আমার জন্য বউ ও ঠিক করে রেখেছেন। বাসায় এসে উপস্থিত হল। কাজী ডেকে সরাসরি বিয়ে।
না মানে। না মানে।
আমতা আমতা করতে হবে না। যা বলবা সরাসরি বলবা। ঘুরিয়ে পেঁছিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না।
আপনি একটা মেয়েকে নিয়ে ভাগিয়ে বিয়ে করেছেন। সেই মেয়েটাকে কোথায় রেখেছেন। ভাবীর বাবা এখানে এসেছিল। আপনার বাবা আপনার বিয়েকে বৈধতা দান করেছেন। ভাবীর বাবাও মনে হয় মেনে নিয়েছেন।
লিয়ন হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। লিয়ন বলল, আমি ওকে কবে বিয়ে করলাম। আমি বিয়ে করেনি। ও আমাকে নিয়ে পালিয়েছে। ওর বাবা ডাক্তার নাকি কোন ছেলেকে ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ঠিক করেছে। ওর ডাক্তার ছেলেকে পছন্দ না। ছেলেটা নাইট ক্লাবে যায়। গাঁজা, মদ খায়। এটাও ওর সমস্যা ছিল না। ওর বিরাট একটা সমস্যা আছে। মেয়ে ঘটিত সমস্যা। নিয়মিত পতিতালয়ে যায়। যে সব সুন্দরী রোগী উনার কাছে আসে ভিজিট ছাড়া রোগী দেখে। রোগীর সাথে ফস্টিনষ্টি করতেও রুচিতে বাঁধে না। মেয়েদের সাথে ফ্ল্যাট করে। একেকদিন একেকজনের সাথে প্রেম করে। শুতে যায়। মেয়েটাকে করায়ত্ত করতে পারলেই তাকে ছেড়ে অন্যকে ধরে।
আপনার সমস্যা কি? আপনি মেয়েকে পছন্দ করেন না। এরকম ঝুঁকি নিতে আপনি গেলেন কেন? আপনার কলঙ্ক লেগে গেল না। মানুষ আপনার কথা বিশ্বাস করতে চাইব না। মেয়েটার কি আর কারো সাথে সম্পর্ক আছে।
হ্যাঁ আছে। এই জন্যই আমার সাথে পালিয়েছে। আমি শুধু ওকে পালাতে সাহায্য করেছি। আর কিছুই না।
আপনি ভয়াবহ ভুল করেছেন। এতে স্যারের সম্মান নষ্ট হবে। স্যারের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ক্যারিয়ারে সমস্যা হবে। আপনি যদি মেয়েটাকে বাঁচাইতেই চাইতেন তাহলে আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। আপনার বাবা ক্ষমতাশালী। এতে সাপও মরত লাঠিও ভাঙ্গত। এরকম উপকার যে কেন করতে যান। মিডিয়ার লোক যদি ব্যাপারটা জানে তাহলে স্যারের অবস্থা খারাপ হবে। বিরোধী দল একটা ইস্যু পেয়ে যাবে। বাবার পক্ষ হয়ে রাজনৈতিক মাঠে নামবেন তা না। ছোট খাট বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন। মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়ের দিকে না যাওয়াই ভাল। মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়ের দিকে গেলেই জনগণ ভাবে কি যেন কি করে ফেলেছে। আমি আপনাকে চিনি। আপনি কখনো খারাপ কাজ করতে পারেন না। আপনি এরকম একটা ভুল করলেন।
তুমি তোমার স্যারের কাছে বুদ্ধিমান। আমার কাছে বোকা। তুমি বিষয়টা বুঝতে পারছ না। তুমি রাজনৈতিক মেধা ভাল। কূটনৈতিক বুদ্ধি ভয়াবহ রকমের খারাপ। কূটনৈতিক বুদ্ধি থাকলে তুমি তোমার স্যার থেকেও উপরে উঠতে পারতা।
কি বলেন লিয়ন ভাই? আমাকে একটু ব্যাখ্যা করেন।
আমি জানি, আমি ইচ্ছা করলে পুলিশ পাটিয়ে এমনিতেই ওর বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে পারতাম। আমি নিজে ঝুঁকি নিয়েছি। এর কারণ হচ্ছে উনাকে ব্যস্ত রাখা। উনি যেন টেনশনে পড়েন। উনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে যেন আঁচর লাগে। উনার ক্ষতি হয় এরকম কাজ অনেকদিন ধরেই চাচ্ছিলাম। পারছিলাম না। বেশি খারাপ হতে পারছি না। বিবেকে বাধা দেয়। হাতের কাছে সুযোগ পেয়ে সুযোগ কাজে লাগালাম। উনার বিরোধীরা উনার বিরোদ্ধে কথা বলার জন্য কিছু পাবে। একটা মানুষকে এতটা স্বচ্ছ থাকতে দেওয়া যায় না। আমি জানি উনি কতটা স্বচ্ছ। সারা দেশের মানুষদের উনার মুখোশটা উন্মোচন করার দরকার আছে।
ছি ছি ছি। লিয়ন ভাই। বাবার সম্মান কেউ এভাবে ভাঙ্গে।
লিয়ন এবার চোখ তুলে ভয়ংঙ্করভাবে ডালিমের দিকে তাকালেন। তুমি আমাদের পারিবারিক পটভূমি সব জান। তোমাকে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমার মা উনার কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। উনাকে যখন আমি ভাল থাকতে দেখি তখন আমার ভাল লাগে না। উনাকে কষ্টে রাখতে ইচ্ছে করে। উনি কষ্টে থাকলে আমার মায়ের আত্মা শান্তি পায়। আমিও সান্ত্বনা খোঁজে পাই। মানুষ একটা অন্যায়ের লাইন পেয়ে গেলে সে শাখা প্রশাখা খুলে। আমিও খুলব। দেখবে অশান্তিতে এই পরিবার জ্বলে যাবে। আমি উনাকে শান্তিতে থাকতে দেব না। ভাল মানুষের মত চেহারায় জনগণের সামনে দাঁড়াতে দেব না। উনার মুখোশ আমি উন্মোচন করব। আমি উনাকে হেয় করব। এই হল শুরু। আমি রাস্তা পেয়ে গেছি। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। তুমি যাও। কারো উপস্থিতি ভাল লাগছে না। আমি এখন ঘুমাব।
মাহতাবউদ্দীন খোঁজ নিয়ে জানলেন, ছেলে যা বলেছে তাই ঠিক। সে বিয়ে করেনি। সে একটা মেয়েকে সাহায্য করেছে। মাহতাবউদ্দীন বুঝতে পারছেন ছেলে এইসব করছে উনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই। উনি এমনিতেই অনেক কষ্টে আছেন। নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। উনার পিএস ডালিম এর মাধ্যমে লিয়নকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছেন ওর মার মৃত্যুর জন্য উনি দায়ী নন। উনি দুটি বিয়ে করেছেন ঠিক। বিয়ের আগে হাসনাবানুর মত নিয়েছিলেন। হাসনাবানু মত না দিলে উনি বিয়ে করতেন না। বিয়ে করার পর বউ নিয়ে এ বাড়িতে উঠার পর হাসনাবানু কষ্ট পেয়েছে এটাও ঠিক। তখন কিছু করার ছিল না। রাজনৈতিক চাপের কারণে বিয়েটা করতে হয়েছে। হাসনাবানুর এতে পূর্ণ সায় ছিল। তাহলে উনার দুষটা কোথায়।
লিয়ন এত কিছু বুঝে না। বুঝতে চায় ও না। মৃত্যুর আগের রাতের কান্নাগুলো চোখে ভাসে। এখনও মাঝে মাঝে ঐ রাতের কান্নাগুলো ভেসে আসে।
লিয়নের বিষয়টা মিডিয়ায় চলে গেছে। মিডিয়া এ ধরণের বিষয় বেশি করে প্রকাশ করে। জনগণ এগুলো খুব দ্রুত লুফে নেয়। বিরোধীরা বসে নেই। তারা মাহতাবউদ্দীনের নামে বিভিন্ন রূপকথার প্রচলন করতে লাগলেন। জনগণের কাছে মাহতাবউদ্দীনকে কিছুটা অসস্তি অবস্থায় পড়তে হল।
এদিকে লিয়ন এর অস্বাভাবিকতা ক্রমে ক্রমেই বাড়ছে। গভীর রাত করে বাসায় আসে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। সারাদিন তাস, জুয়া খেলে। কোন কোন দিন মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। ঘর বাড়ি চেঁচিয়ে মাথায় তুলে।
মাহতাবউদ্দীন পড়লেন গভীর সমস্যায়। এত বছর হাসনাবানুর বিষয়টা নিয়ে লিয়ন ঘৃণা করত তা তিনি জানতেন। লিয়নের মনে এরকম ভাবে ঘটনাটার দাগ বসে আছে তা তিনি কল্পনাই করতে পারেন না। মানুষ মারা গেলে দুই তিন দিনেই সব ভুলে যায়। ও এই ঘটনা এত বছর মনে রেখেছে। কি জঘণ্য ভাবেই মনে রেখেছে। মাহতাবউদ্দীন ভাবতেই পারছেন না। পুরান ঘটনা নতুন করে নাড়া দিয়ে উঠেছে। এতদিন সপ্ত অবস্থায় ছিল। এখন সক্রিয় হয়ে গেছে। মাহতাবউদ্দীন বিষয়টাকে এত ভয়াবহ ভাবে নেন নি। উনি ভেবেছিলেন, ছোট্ট ছেলে মা মারা গেছে এরকম করবেই। সে যে এই বিষয়টা মনের ভিতর গেঁথে নিয়ে এত বছর পরও তারা বাবাকে এতটা দুষি ভাববে তা তিনি কল্পনাই করতে পারছেন না। হাসনাবানুর জন্য উনারও কম খারাপ লাগে না। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সফল করার পিছনে হাসনাবানুর হাতই সবচেয়ে বেশি।
লিয়ন হাসনাবানু মারা যাওয়ার পরও স্বাভাবিক ছিল। বাবার সাথে কথা বলত না ঠিকই। অন্য সবার সাথে কথা বলত। স্কুলে যেত। সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হত। একটা বিষয় প্রচলিত আছে বড় ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেরা মেধাবী হয় না। এরা পড়ালেখা করতে চায় না। এরা ভাল রেজাল্ট করে না। লিয়নের ক্ষেত্রে এরকমটা ঘটে নি। ও ঘটতে দেয় নি। খেলাধুলাতেও লিয়ন ছিল বেশ পাকাপোক্ত। অনেকগুলো গোল্ড মেডেল সে জিতেছে। সবার সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্যও তার খ্যাতি আছে। একজন বড় রাজনীতিবিদের ছেলে হয়েও সবার সাথে মিশত। বাবার নাম দিয়ে কখনো কিছু করতে চাইত না।
মাহতাবউদ্দীন যখন বের হতেন তখন লিয়নের প্রশংসা শুনতেন। স্কুলে গেলে শিক্ষকরা লিয়নের প্রশংসা করত। উনার বুক ভরে যেত। সব বাবার মত উনারও আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হত। এই জন্যও ছেলের প্রতি মায়া বেড়ে গিয়েছিল। ছেলে যেহেতু ভাল কিছু করছে তাকে ঘেটে লাভ নেই। তাকে তার মত থাকতে দেওয়া উচিত। বাবাকে যতই ঘৃণা করুক। এখন উনার কাছে মনে হচ্ছে এভাবে থাকতে দেওয়া উচিত হয়নি। ওর সাথে মিশা উচিত ছিল। ওকে ওর মার বিষয়টা অন্তর থেকে ভাঙ্গানো উচিত ছিল। বাবা হিসেবে যা যা করার তা করা উচিত ছিল। এখন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
মাহতাবউদ্দীন ভাবলেন, বিয়ে করালেই লিয়নের রোগ সেরে যাবে। একটা বয়সে এসে ছেলেরা একটু পাগলামি করে। তাদের বিয়ে করালেই পাগলামি চলে যায়। কয়েকজনের সাথে পরামর্শও করেছেন। সবাই একই মত দিয়েছেন। বিয়ে করালেই রোগ সেরে যাবে। ছেলের মর্জি জানার জন্য পিএস ডালিমকে পাঠালেন।
লিয়ন বিয়ের কথা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে গেল। আমাকে বিয়ে করানোর চেষ্টা করলে উনার কপালে খারাপি আছে। আমার কারো দরকার নেই। আমি একা থাকতে চাই। উনাকে আমার কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি উনাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করি। উনি যদি আমার জন্য কিছু পছন্দ করেন তাহলে সারা জীবনেও ঐ জিনিষটা আমার ভাল লাগবে না। আমি ভাল লাগাতে পারব না। আমি মদ খেয়ে আমার দুঃখ নিবারণ করছি। আমার যত বয়স যাচ্ছে তত মার কথা মনে হচ্ছে। মা আমার কাছে মাঝে মাঝে আসে শান্তনা দিয়ে যায়। আমি শান্তনা পেতে চেষ্টা করি। মা যতক্ষণ আমার সাথে কথা বলে ততক্ষণ আমি শান্তনা পাই। মা চলে গেলেই আমি অশান্তিতে ডুবে যাই। উনি বলবে, আমাকে নিয়ে যেন উনি মাথা না ঘামান। আগে যে রকম ঘামাতেন না। এখনও ঘামানোর দরকার নেই। উনি আমাকে নিয়ে মাথা ঘামালে আমার মাথা ঠিক থাকে না। আমি কিছু করতে পারি না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
মাহতাবউদ্দীন ছেলের ইচ্ছার বিরোদ্ধেই বিয়ে ঠিক করেছেন। সারা বাড়ি আতœীয় স্বজনে ভর্তি। লিয়ন কয়েকবার বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই ধরা খেয়ে ঘরে বন্দি। এখন লিয়নকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মাহতাবউদ্দীন এতটা কট্টরের দিকে গেলেন না। পাহাড়ায় গার্ড বসানো হয়েছে। রাতটা রাখতে পারলেই হল। সকালেই বরযাত্রী রওয়ানা দিবে।
সকাল হওয়ার পর লিয়নের ঘরে গিয়ে দেখা গেল লিয়ন মেঝেতে পরে আছে। সারাবাড়ি গুজব ছড়ল লিয়ন বিষ খেয়েছে। বাড়ির সবাই লিয়নের জন্য বিলাপ করতে লাগল। লিয়নকে ঘর থেকে বাহির করা হল। ডাক্তার ডাকা হল। মাহতাবউদ্দীন চুপ করে বসেন। তিনি কিছু ভাবছেন কিনা বুঝা গেল না। ছেলের কাছে একবারও আসলেন না। উনি উনার জায়গায় বসে রইলেন।
ডাক্তার আসার পূর্বেই লিয়ন চোখ খুলল। চারদিকে তাকিয়ে সেও অবাক হয়ে গেল। এত মানুষ তার চারপাশে কেন? চারদিকে ছোটাছুটিই বা কেন করছে। সবাই বলছে, যাক বেঁচে আছে। বেঁচে আছে। লিয়ন ভাবল, সে কি মারা গিয়েছিল। কতদিন মারার মত পরেছিল। হাতের ঘড়িটা দেখতেই তার ঘোর ভাঙ্গল। এখন সকাল। তারিখও ঠিক আছে। তাকে নিয়ে একটা নাটক পাকানো হয়ে গেছে। নাটকের পরিচালক কিছু মহিলা। প্রযোজকের কোন দরকার ছিল না। অভিনেতা বাড়ির কর্মচারী। দর্শক মাহতাবউদ্দীন।
ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা করে বললেন, অতিরিক্ত ঘুমের কারণে এরকম হয়েছে। ঘুমের বড়ি মনে হয় খাওয়ানো হয়েছিল। ডোজ বেশি পড়ে গেছে। তাই এরকম হয়েছে। ভয়ের কোন কারণ নেই।
মাহতাবউদ্দীন দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেললেন। কেন ফেললেন বুঝা গেল না। ছেলে বেঁচে আছে এই জন্য নাকি গন্ডোগোল মিঠে গেছে এই জন্য।
লিয়নকে বরের পোশাক পড়িয়ে গাড়িতে উঠানো হল। জোর করে উঠানো হল। লিয়ন কোন ভাবেই চাচ্ছিল না। পাগলের মত আচরণ করছিল। লিয়নের মনে হচ্ছে আশে পাশে যা আছে সবই পাগল। শুধু সে ভাল। পাগল না হলে জোর করে কাউকে বিয়ে করায়। পাগলের রাজ্যে সে একাই মানুষ।
মাহতাবউদ্দীন বললেন, বিয়েটা আগে হোক। তারপর যা খুশি তা করুক। মেয়েটা বাড়িতে থাকলে মেয়েটার প্রতি যদি বিন্দুমাত্র ভালবাসা জন্মায় তাহলে সে ঠিক হয়ে যাবে। সে জন্মগত পাগল না। অভিনয়ের পাগল। পাগলামিটা তার ভিতর থেকে আসছে না। এটা সে অভিনয় করছে। অভিনয়টা ভালই করছে। মানুষজন হাসাহাসি করছে। মজা পাচ্ছে। সামনাসামনি কেউ কিছু করার সাহস পাচ্ছে না। মাহতাবউদ্দীনকে হাসির পাত্র বানাবে এটা আগেই জানার কথা। এ নিয়ে উনার মনে কোন দু:খ নেই। উনার মাথায় চিন্তা একটা বিয়ে করাতে পারলেই হল।
লিয়নের পাগলামি বেড়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা পরে করালেই ভাল হত। কি দরকার ছিল এত ঝামেলা করে বিয়ে করানোর। কথাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন না ও বলা যাবে না। মেয়ে পক্ষ পরিচিত। লিয়নকে চিনে। লিয়ন যদি ঐ খানে গিয়ে পাগলামি করে তাতেও সমস্যা তেমন থাকবে না। তবে আতœীয় স্বজন আছে। ওরা নিশ্চয়ই এরকম পাগলামি করা ছেলেদের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে না। বিয়েটা শুধুমাত্র বাবা মা, শশুর শাশুড়ীর না। পাঁচজন থাকে। তাদের কথাকেও গুরুত্ব দিতে হয়। পরিশেষে কি হয় কে জানে।
কনের বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই রাষ্ট্র হয়ে গেল জামাই পাগল। জামাইকে চার পাঁচজন ধরে নিয়ে আসতেছে।
এতে করে কনের পক্ষের লোকজন মারাতœক ঝামেলায় পরে গেল। এদের মধ্যে ও দু ভাগ হয়ে গেল। একভাগ মেয়ের বাবা মা। উনারা বলল, ছেলে পাগল না। বিয়ে করবে না। তাই পাগলামি করছে। আরেক ভাগ বলল, ছেলে পাগল। না হলে কেউ এরকম করে। আরেক ভাগ বলল, যত যাই হোক। ও যদি পাগল ও না হয় তাহলে যেহেতু বিয়ে করতে চাচ্ছে না সেহেতু বিয়ে দেওয়ার দরকার কি? মেয়ে জলে পরে যায় নি। কেউ কেউ বলল, সামনে উনি মন্ত্রি হবেন। মন্ত্রির ছেলে পাগল হলেও হাতির মত দাম।
লিয়নকে নিয়ে বরপক্ষ আসল। সবার মধ্যে কানাকানি বন্ধ হয়ে গেল। সবাই সার্কাস দেখার জন্য তৈরি হল। পাগলের সার্কাস। অন্ধরমহলে এখনও তুমূল তর্ক চলছে। তর্ক করার মত বিষয়ও বটে। উৎসুক সবাই পাগল জামাইকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পরতে লাগল। পাগল জামাই বলে কথা।
লিয়নকে তখনও দুইজন বলশালী লোক শক্ত করে ধরে আছে। লিয়ন বন্দি থেকেও বিভিন্ন ধরণের সার্কাস দেখাচ্ছে। লিয়ন ভাবছে, সে যা করছে তার সাথে বিষয়গুলো যাচ্ছে না। সে নিজেকে একটা হাসির খোরাকে পরিণত করছে। কি করবে বুঝে পাচ্ছে না।
মেয়েরা চিৎকার করে বলছে, পাগল জামাই। পাগল জামাই।
লিয়ন কনে বাড়ির অবস্থা দেখে নিজিকে ছোট করতে মন চাইল না। সে চুপ চাপ ভদ্র জামাইয়ের মত বসে রইল। যারা ভেবেছিল জামাইয়ের সার্কাস দেখবে তারা মনকষ্টিত হল। লাইফ সার্কাস দেখা হল না।
বিয়ে পরানোর সময় লিয়নের কোন ভূমিকা না নিয়েই বিয়ের কাজ সমাপ্ত করা হল। যতদ্রুত সম্ভব মাহতাবউদ্দীন কনের বাড়ি ত্যাগ করলেন।
মেয়ের বাবা মা ভারাকান্ত মন নিয়ে পাগল জামাইয়ের সাথে তাদের আদরের কন্যাটিকে সপে দিলেন। মন বার বার চাইছিল এই ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে। মেয়ের সুখের জন্যই যদি বিয়ে দেন তাহলে পাগল ছেলে কেন? ছেলে কি দেশে অভাব। এমন সুন্দর মেয়েকে সবাই পেতে চাইবে। কত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, চার্টাড এ্যাকউন্ট এর সাথে বিয়ে দিতে পারতেন। কেন গেলেন পাগল ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। সবাই বলছিল, এরকম ছেলের সাথে বিয়ে না দেওয়ার জন্য। ঠিক আছে ছেলে ভাল। তবুও পাগলামি করলে এই ছেলের সাথে কি বিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে। ছেলের পছন্দ না হলে যে কোন সময় যে কোন ঘটনা ঘটাতে পারে। মেয়ের নামে মাহতাবউদ্দীন অনেক সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন। তবুও টাকাই সুখ না।
লিয়নের গাড়িতে কনেকে তুলে দেওয়া হল। অতিরিক্ত নিশ্চয়তার জন্য দুজনকে দেওয়া হল। বরের গাড়িগুলো বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। লিয়ন গাড়ীতে চুপ করে বসে ছিল। ভদ্র ছেলের মতই আনমনে চারদিকে তাকাচ্ছিল। লিয়ন বলশালী শক্ত দুইজনকে বলল, ঠান্ডা পানি আনার জন্য। বলশালী লোকদুটো যেতে চাইল না। লিয়ন পানি আনার জন্য বের হতে চাইল। বলশালী লোকগুলো তখন রাজি হল। তারা পানি আনতে গেল। লিয়ন সুযোগ বুঝে ডাইভারকে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে চম্পট।
নতুন কনে ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কি করছেন?
লিয়ন পিছনের দিকে মুখটি বাড়িয়ে বলল, পাগল জামাই যা করে তাই করছি।
মেয়েটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমাকে নামিয়ে দিন। আমি নেমে যাই।
লিয়ন ভিলেনের মত হু হু করে হেসে উঠল। আজব ব্যাপার। স্বামীর সাথে স্ত্রী পালিয়ে যাচ্ছে তাও নাকি ভয়। তোমাকে রেখে যেতে পারি। তোমাকে নিয়ে আমার লাভ নেই। স্ত্রীর মর্যাদা কখনো পাবে না। সমস্যা হচ্ছে লোকে কি বলবে। এমনিতেই পাগল পাগল বলে খেপিয়ে তুলেছিল। নিজেকে এতটা ছোট করা ঠিক হয়নি।
আমি জানি আপনি পাগল না। আপনাকে কলেজে দেখেছিলাম। সবাই আপনার প্রশংসা করত। আমাকে নিয়ে পালিয়ে যান কোন সমস্যা নেই। বলেন কোথায় যাচ্ছেন। মাকে বলতে হবে। মা চিন্তা করবে।
চুপ করে বসে থাক। কোন কথা বলবে না। আমি পাগল। সত্যিকার অর্থেই পাগল। তুমি যখন আমাকে দেখেছিলে তখন ভাল ছিলাম। এখন পাগল হয়ে গেছি। আমার সাথে সংসার করতে পারবে না। আমার মনে হয়। তুমি আমার কাছ থেকে চলে যাও। যত টাকা চাইবে আমি তোমাকে দিব। অন্য ছেলেকে বিয়ে করে সুখি হও।
পাগল এরকম করে কথা বলতে পারে না। এত ভেবে চিন্তে কোন পাগলকে কথা বলতে দেখি নি। ভবের পাগলও এরকম হয় না।
তুমি বেশি বকবক করছ। আজকে তোমার বিয়ে হয়েছে। লজ্জা শরম একটু রাখ।
আপনি রাখছেন না। আমি রাখব কেন? আমি জানতে চাচ্ছি আপনি কোথায় যাচ্ছেন। এরকম না করলেও পারতেন। বুঝার চেষ্টা করেন।
বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমি চাচ্ছি চুপ থাক।
এখই স্বামীগিরি ফলাচ্ছেন।
হ্যাঁ। কোন সমস্যা। স্বামীগিরি ফলাচ্ছি না। আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করিনি।
Comments (2)
'গয়নার বাক্স' চলচ্চিত্রের দারুণ রিভিউ করেছেন। বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিভিউ যে করেছেন সেটা বুঝা যায় ছবিটির আলোচনা এবং সমালোচনা দুটোই করেছেন দেখে। অনেক ভালো লাগলো। সময় করে দেখে নেয়ার ইচ্ছা থাকেলও কোন উপায় দেখছি না। যদি অনলাইনে পাওয়া যায় তবে হয়তো দেখা হবে। ধন্যবাদ শেরিফ আল সায়ার।
আমার ভালোলাগছে জাতীয় সঙ্গীতটা
বাঙলাদেশের কোন ছবিতে অত সুন্দর কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত কখনো শুনিনি।
সুন্দর পোস্ট।