(তিন)
পাড়াময় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সশব্দে নয়; নিঃশব্দে। দেখলে মনে হবে কেউই কিছু জানে না। আসলে সবাই জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে মুখ ফুটিয়ে বলে না। বলে কানে কানে, চোখে চোখে। পাড়ার মেয়েরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে একজন আরেক জনের কাছে গিয়ে ফিস্ ফাস্ শব্দে ব্যাপারটা জেনে এসেও আবার জানতে চায়। আসল কথা তারা জানাতেই চায় যেন। তবু মনে হয় তারাও কিছু জানে না। পাড়াময় শুন্ শান্ নীরবতা। তবু ছাই চাপা আগুনের মতো ব্যাপারটা ক্রমাগত ছড়াতে থাকে নানা রঙে নানা ঢঙে। অবিলম্বে তাই এশার নামাজের পর রইচ কেরানির প্রশস্ত উঠোনে এক সালিশি বৈঠক বসে।
যেহেতু প্রেমিকা তার প্রেমের দাবী নিয়ে প্রেমিকের ঘরে জোরপূর্বক আশ্রয় নিয়েছে এবং তার দাবী না মানলে আত্মাহুতি দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে তাই এর একটা তাৎক্ষণিক বিহিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ায় সালিশির বিকল্পও ছিল না। অন্য কোন বিষয় হলে অথবা মেয়েটা যদি ছেলেটার ঘরে গিয়ে না উঠতো, তাহলে হয়তো এটা নিয়ে মারামারি থেকে শুরু করে খুনোখুনির পর্যায়ে গিয়ে এতক্ষণে থানা পুলিশে গড়াতো এবং আসল ব্যাপারটা তখন ঢাকাই পড়ে যেতো। অবশ্য রইচ কেরানির বড় ছেলেরা সেটাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েটার কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে সালিশির দ্বারস্থ হয়েছে।
বৈঠকের প্রধান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব। সঙ্গে দু’জন সদস্যও আছেন। এছাড়াও আছেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আর গ্রামের অসংখ্য কৌতুহলি মানুষ। যাকে বলে আমজনতা।
উঠোনের একধারে একটু উঁচুতে একটি হ্যাচাক লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একপাশে সারিবদ্ধ চেয়ার গুলিতে বসেছেনে বিচারক মন্ডলী। আর সামনে এবং দুই পাশে আমজনতা। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। একপাশে পুরুষদের পেছনে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কৌতুহলি কূলবধুরা আর তাদের কারো কারো শিশুরাও। গ্রাম্য সালিশিতে মেয়েরা অবশ্য পেছনেই থাকে। তাদেরকে সালিশি বিচারের অংশ হিসেবে এখনও ভাবা হয় না।
উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অন্যতম হাজী কালাচান সেখও আছেন। তিনি এদের মধ্যে সবচেয়ে মুরুব্বী। বসেছেন মধ্য বয়সী চেয়ারম্যান সাহেবের পাশেই। রইচ কেরানিও বসে আছেন তারই পাশে ‘ধরা পড়ে গেছেন’ এমন একটা ভাব নিয়ে। মান্যগণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মীর জাফর মন্ডল, জালাল মিয়া, মোকাররম হোসেন তারাও আছেন। তাছাড়াও সমাজের বিচারকদের সাথে ঘুরে ঘুরে যারা নিজেদেরকেও বিচারক ভাবতে ভালবাসেন এবং দু’চার জনের কাছে নিজেকে জাহির করতে চান অথবা প্রভাবিত করতে চান তারাও বিচারকের সারিতে বিচারকের গাম্ভীর্য নিয়ে বসে আছেন চুপচাপ। বিচার করে মূলত এরাই। চেয়ারম্যান নামে মাত্র উপস্থিত থাকেন। যদিও একালে বৈধ বিচারের ক্ষমতা মূলত চেয়ারম্যনেরই কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবরা বিচারের ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কারণ, যেহেতু বিচারে বাদী-বিবাদীর যেকোন এক পক্ষ নিশ্চিত ভাবে হেরে যান আর তখন তারা এক চরম ব্যক্তি স্বার্থের মুখোমুখি হন। তা হলো ভোটের সময় এলে হেরে যাওয়া পক্ষ তাকে আর ভোট দেবে কি ? সম্ভবত ভোট হারানোর ভয়েই চেয়ারম্যান সাহেবরা সত্যিকারের বিচারকের ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে তথাকথিত সমাজের প্রভাবশালী গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে সম্মান দেখানোর নামে বিচারের ভার তুলে দিয়ে নিজের আখের ঠিক রাখেন। আর এই সুযোগে প্রভাবশালীরা তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা সাধারন মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে সেকালের অত্যাচারী মাতুব্বরী প্রথাকে চলমান রাখেন। অবশ্য ভোট যারা করেন এই প্রভাবশালী গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাদের পৃষ্টপোষকও বটে।
কৌতুহলি আমজনতার মাঝে মৃদু গুঞ্জন চলছিল এমন সময় চেয়ারম্যান সাহেব গলা কাশি দিলে হঠাৎ গুঞ্জন থেমে যায়। যেন বন্দুকের গুলির শব্দে চমকিত হয়ে এক ঝাঁক পাখি হঠাৎ উড়ে চলে গেল। চেয়ারম্যান কিছু বলতে যাবেন এরই মধ্যে হাজী কালাচান শেখ তার কানে কানে কি যেন বলে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তারপর বার কয়েক দাড়িতে হাত বুলালেন আলতো করে। চেয়ারম্যান সাহেব দ্বিতীয়বার গলা কাশি দিয়ে কোন ভূমিকা ছাড়াই আদেশ করলেন ছেলে-মেয়ে উভয়কে তার সামনে হাজির করতে। মূহুর্তে অতি উৎসাহি কিছু লোকের মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল এবং তারা আবদ্ধ ঘর থেকে মেয়েটাকে বের করে আনতে গেল। হয়তো বা ছেলেটাকেও।
(চলবে..)
১ম পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
http://www.nokkhotro.com/me/show-post/138781-720152-b868f1-8a4216-.30038-664
২য় পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
http://www.nokkhotro.com/me/show-post/138788-404752-b96e0f-ce3cd5-.29939-206
Comments (6)
চলুক আলাপন।ভালো লাগছে।
ধন্যবাদ রোদেলা
মাঝে ৩/৪ দিন ব্লগে আসা হয় নি।
আড্ডার পর ব্লগে নক্ষত্রদের বেশ জেমেছে মনে হচ্ছে।
চমৎকার হয়েছে...পরবর্তী পর্ব পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ
শুভকামনা