ইসলাম যে বিশ্বময় দ্রুত প্রসার ও ব্যপ্তি লাভ করেছে তার অন্যতম কারণ এর ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা। যদি বলা হয়, ইসলাম ক্ষমা ও উদারতার ধর্ম তাও অত্যুক্তি হবে না। ইসলামের ঔদার্যে মুগ্ধ ও প্রাণিত হয়ে পথহারা কত মানুষ যে এর সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় নিয়ে খুঁজে পেয়েছে চির শান্তির ঠিকানা তার ইয়ত্তা নেই। ইসলাম ক্ষমা ও উদারতার ঝান্ডা উড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে। মোয়ামালা তথা সামাজিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামে ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা দিয়েছে।
মোয়ামালা বা সামাজিক লেনদেন কী ?
মানুষের মাঝে জীবন ধারণের বিভিন্ন পর্যায়ে যে নানারকম বিনিময় ও লেনদেন হয় তাই মোয়ামালা। যেমন : পারস্পরিক কেনাবেচা, উঠাবসা ও সামাজিক সম্পর্ক প্রভৃতি। এসব লেনদেনের সময় মানুষের ভেতরে লোভ বা স্বার্থ-ভাবনা ক্রিয়াশীল হয়। তাই দেখা যায়, উভয় লেনদেনকারীর চেষ্টা থাকে কীভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা যায়। এজন্য সে অন্যকে ঠকাতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত হয় না। ফলে তার অন্তরে গজে ওঠে আত্মচিন্তা ও স্বার্থপরতা। তখন সে চেষ্টা নিয়োগ করে কেবল নিজেরটা পাওয়ার জন্য। অন্যের লাভ-ক্ষতি তার কাছে হয়ে দাঁড়ায় গৌন।
মানুষের এ প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা ধন-সম্পদকে অতিশয় ভালোবাস।’ (সুরা ফাজর, আয়াত : ২০)
অথচ সামাজিক জীব হিসেবে তার মাঝে সৌহার্দ্য ও পর হিতৈষণার মতো গুণ বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। তাছাড়া সামাজিক শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ কারণে ইসলাম মানুষকে স্বার্থবুদ্ধি ও আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বাঁচাতে ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা দিয়েছে। উদ্বুদ্ধ করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষমা, নম্রতা ও উদারতা অবলম্বনের প্রতি। উৎসাহিত করেছে লেনদেন ও গ্রহণে-বিতরণে সুকুমার বৃত্তির প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখতে।
যে এসব গুণে উদ্ভাসিত হবে তার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে জান্নাত। যা আসমান জমিনের চেয়েও বড়। আর তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা।
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.)ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তিকে দয়া করুন যে ক্রয়-বিক্রয় এবং চাহিদা ও প্রয়োজন মেটানোর সময় উদারতা দেখায়।’ (বুখারী)
হরযত উসমান বিন আফফান রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.)ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তিকে জান্নাতে অভিষিক্ত করেন যে ক্রয়ে-বিক্রয়ে এবং গ্রহণে-প্রদানে উদারতার পরিচয় দেয়।’ (নাসাঈ)
মানুষের লোভ ও কৃপণতা থেকে সৃষ্ট হিংসা ও দ্বেষ তাকে বাধ্য করে লেনদেনে কড়াকড়ি ও অনুদারতা প্রদর্শনে। এর ক্ষতিকারিতা থেকে বাঁচাতে ইসলাম তাই লেনদেনে ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা দিয়েছে। এতোদ্দেশ্যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ব্যবসায় বাণিজ্যে ‘খিয়ার’নামক সুবিধার। আর সেটা হলো- ক্রয় চুক্তির পর ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ যদি ভুল বুঝতে পারে এবং সে এ চুক্তি প্রত্যাহার করতে ইচ্ছা করে তাহলে তার জন্য ওই বৈঠক ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত তার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
রাসুল (সা.)ইরশাদ করেন, ‘যখন দুই ব্যক্তি কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তখন তাদের উভয়ের জন্য এ চুক্তি বাতিল করার অধিকার রয়েছে যাবৎ না সে মজলিস ত্যাগ করে।’
কিন্তু যদি চুক্তির বৈঠক ত্যাগ করার পর অনুশোচিত হয় এবং চুক্তি বাতিল করার ইচ্ছা তাহলে তা করতে পারবে না। তবে অপর পক্ষ ছাড় দিলে সেটা ভিন্ন কথা।
মহনবী (সা.)তবুও এ অসহায় প্রতারিত ব্যক্তির চুক্তি বাতিল করতে, তার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাদের উদ্দেশে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অনুশোচনাদগ্ধ লোকের চুক্তি বাতিল করবে আল্লাহ তাআলা তার ভুলগুলোও বাতিল অর্থাৎ ক্ষমা করে দিবেন।’
তেমনি সমস্যার জর্জরিত ব্যক্তি যে ঠেকায় পড়ে ঋণ নিয়েছে অথচ তা সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না- এমন ব্যক্তির সঙ্গেও ক্ষমা ও উদারতার আচরণ করতে আহ্বান জানিয়েছে। তাকে শাস্তি দিতে বা আটক করতে বারণ করেছে। বরং তার ওপর অতিশয় দয়া ও করুণা করেছে। সুতরাং তার ঋণ মাফ করে সেটা দান করে দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে হোক না তা আংশিক। যাতে তার বিপদ উদ্ধার হয়। দূর হয় তার দুশ্চিন্তা-টেনশন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর যদি সে অসচ্ছল হয়, তাহলে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে। আর সদাকা করে দেওয়া তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত : ২৮০)
হাদিসের কিতাবে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, একবার আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করতে পাঠান যে, তিনি তার মুশরিক জন্মদাত্রীকে তার বাসায় তার সাক্ষাতে আসতে দিবেন কি-না? রাসুল (সা.)উত্তর দেন, হ্যা আসতে দাও। ইসলামের উদারতার আর দৃষ্টান্ত হলো- অমুসলিমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সদাচার ও তাদেরকে উপহার ও উপঢৌকন দেওয়ার সুযোগ দেওয়া। কারণ এ উদারতা ও মহানুভবতা তাকে অনেক সময় ইসলামের প্রতি মুগ্ধ করে আর সে জানতে পারে মানুষ হিসেবে তার মূল্য।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়নয়দেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
রোম সম্রাট কায়সার এবং কিবতি সম্রাট মুকাওকিস রাসুল (সা.) এর কাছে উপহার পাঠালে তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন। তেমনি উমর রা. তার মানবকূল সূত্রের এক মুশরিক ভাইকে রেশমি কাপড় উপহার দেন। এর এসবই মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বার্তা বহন করে। অন্য লোক ও অন্য ধর্মের প্রতি উদারতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সাহাবিদের জীবনে।
তাই আমাদের সবার কর্তব্য লেনদেন ও সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে তাদের মতো উদারতার চর্চা করা।