Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Mishu Milan ..

১০ বছর আগে

সাইকেল

রাস্তার বাঁকটা পেরিয়ে সাইকেলের চাকা মাঝারী গতিতে ঘুরছে। দশ-বারোটা বাচ্চা সহ একটা মুরগী রাস্তার ঢালে মাটিতে ঠোঁট ঠুকে, দু-পায়ে মাটি খুঁড়ে নিজের এবং বাচ্চাদের জন্য খাবার খুঁজছে। ছোট ছোট পোকামাকড়, কেঁচো, গুবরে পোকাগুলোকে খরশান ঠোঁটে আহত করে বাচ্চাদের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে মুরগীটি। বাচ্চাগুলো কিচির-মিচির করছে আর খাচ্ছে। খেতে খেতে কয়েকটা আবার রাস্তার মাঝখানে চলে গেছে। ঘূর্ণমান সাইকেলের চাকা কাছে আসতেই সেগুলো ট্যা ট্যা করে মায়ের দিকে ছুটলো। আতঙ্কিত মা হুঙ্কার ছেড়ে মুহূর্তের মধ্যে ডানা ঝাপটে ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে রণচন্ডীর মতো তেড়ে গেল সাইকেলের দিকে। খানিকটা গিয়ে আবার ফিরলো বাচ্চাদের কাছে। অস্থির চোখে চোখ বুলাতে লাগলো বাচ্চাদের ওপর।
আগের দিন বিকেলে বৃষ্টি হয়েছে, জল-কাঁদা এখনও ভাল মতো শুকোয়নি। গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি আর সাইকেলের চাকার গর্তে জল জমে আছে জায়গায় জায়গায়। এঁকেবেঁকে সাইকেল চালাতে হচ্ছে। আকাশে ঘন কালো মোষের মতো মেঘ! গজরাচ্ছে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো। বৃষ্টি নামতে শুরু করলে আর রা নেই। সাইকেল ঘাড়ে করে নিতে হবে। তাই সাইকেলের গতি কিছুটা বেড়েছে।
রাস্তায় সাইকেলের চাকার পুরনো গর্তে জমে থাকা জল-কাদার মধ্যে সামনের চাকা পড়তেই পুচ করে খানিকটা জল-কাদা গিয়ে লাগলো রাস্তার পাশে বাঁশের আড়ে শুকোতে দেওয়া নিতাই জ্যাঠার মায়ের সাদা থানে। বুড়ি দেখতে যতক্ষণ! তার পরই শুরু হবে বাপ-ঠাকুরদা তুলে শাপ-শাপান্ত। মায়ের গুষ্ঠিও বাদ যাবে না! চলবে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত।
দ্রুত ঘুরছে সাইকেলের চাকা। রাস্তার দু-পাশে এখন আর বাড়ি নেই। পাটক্ষেত, ধানক্ষেত। কোথাও পতিত জমি, সত্য নারায়নের আখক্ষেত। চাকার সামনে দিয়ে একটা ভেড়ার বাচ্চা ভ্যা ভ্যা করে দৌড়ে গেল। পাশের পতিত জমিতে বাধা মা ভেড়াটা মুখ তুলে ডেকে উঠলো। বাচ্চাটা কাছে যেতেই তাকে আদর করে চাটতে লাগলো। সাইকেলটা আরেকটু এগোতেই সুতোনলি সাপটা চাকার সামনে দিয়ে চলে গেল বড়ই গাছটার দিকে। চাকার নিচে পড়ে থেতলে গেল একটা কদম ফুল। কোন স্কুল পড়ুয়ার খাতার ফেলে দেওয়া ছেড়া পাতা গেঁথে গেল কাদায়।
রাস্তার ঢালে দাঁড়িয়ে বই বগলে রেখে পশ্চিমের জমিতে নোনাজল ঢালছে দুই কিশোর। পথের ঢালের বাবলা গাছ থেকে একটা চড়ুই পাখি তড়িৎ চোখে ওদের দেখে সুরুৎ করে উড়ে গেল। অনিল বাদিকে দিকে ঘুরে তাকিয়ে আসাদের নোনাজলের উৎসস্থল দেখার চেষ্টা করতেই আসাদও একটু বামে কাত হলো লুকোনোর চেষ্টায়। অনিল মুচকি হাসলো। যেন প্রতিযোগিতায় সে জিতে যাচ্ছে। কে কতদূরে নোনাজল ঢালতে পারে তার প্রতিযোগিতা! কিন্তু অনিলের সাথে পেরে ওঠে না আসাদ। দুজন একই ক্লাসে পড়লেও অনিল আসাদের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। দুজনই ক্লাস এইটে। অনিল শুধু আসাদের চেয়ে বয়সেই বড় নয়। দুজনের শারীরিক ব্যবধানও অনেক। অনিল বেশ লম্বা-চওড়া। মুখে কালচে দাড়ি-গোঁফ উঠেছে। ফুল প্যান্ট পড়ে স্কুলে যায় সে। অনিলের চোখে মুখে ফুঁটে উঠেছে রুক্ষতা
আসাদের মুখখানা মায়ায় ভরা। ছোট-খাটো। ফর্সা চিকন সুন্দর মুখ। কৈশোরের রুক্ষ প্রান্তরে পা দিলেও বাল্যকালের কমলতায় ভরা সবুজ তৃণভূমি তাকে পুরোপুরি বিতারিত করে দেয়নি।
‘কিরে দুইজনে মিলে মেশিন স্টার দিছিস? মাঠ যে ভাসে গেল।’
সাইকেলের গতি মোড়ের কাছটায় এসে কমে গেছে। এখানটায় একটু বেশি কাদা। তাই রসিকতা করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হরিপদ ডাক্তার। ডাক্তারের বয়স পুরোপুরি দাদু শব্দটার স্বপক্ষে না গেলেও গ্রামবাসী সম্পর্কে তিনি দুজনেরই দাদু হন। ঠাট্টার সম্পর্ক। ঠাট্টা করতে বাঁধা নেই!
‘তোমার যদি ওষুধ লাগে তো নিয়ে যাও। এক ডোজেই রোগ সারে যাবেনে।’ বললো অনিল।
‘শালার শালা ড্যামনা। কতায় পারা যায় না।’
হাসতে হাসতে সাইকেলের গতি চড়ালেন হরিপদ ডাক্তার। তিনি হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। এলাকার মানুষের অসুখ-বিসুখের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। জ্বর, সর্দি-কাশি, হাঁপানী, গ্যাস্ট্রিক, আমাশয়, স্বপ্নদোষ যার যাই হোক না কেন সবই ছুটে যায় তার কাছে। সেও ভেবেছিল মানুষের সেবা করেই জীবনটা কাঁটাবে। বিয়ে করে সংসারের কারেন্ট জালে আর জড়াবে না। কিন্তু ভাইবোনদের চাপাচাপিতে এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে তাকে এসে বিয়ে করতে হয়েছে মাস ছয়েক আগে। সাইকেলটা শ্বশুরবাড়ি থেকেই পাওয়া।
নোনাজলের উৎসস্থলে ডানহাত রেখে হরিপদ ডাক্তারের সাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছে আসাদ। তার খুব ইচ্ছা সাইকেল চালানোর। সাইকেল দেখলেই সে হ্যাঙলার মতো তাকিয়ে থাকে। এই গ্রামে তিনটি সাইকেল। হরিপদ ডাক্তারের, কাশিরাম মাষ্টারের আর দিলীপের বাবার। দিলীপের বাবা বাজারে ব্যবসা করে। দিলীপ যখন তার সামনে হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালায় সে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। কতদিন দিলীপের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেছে একটু সাইকেল চালানোর জন্য। দিলীপ বড়জোড় পিছন থেকে সাইকেল ঠ্যালার অনুমতি দিয়েছে তাকে। অনিল সাইকেল চালাতে পারে। মামা বাড়ি গিয়ে শিখে এসেছে। অনিলের দুই মামার দুইটা সাইকেল।
হরিপদ ডাক্তারের সাইকেলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে প্যান্টের চেইন লাগাচ্ছে আসাদ। ‘আরে দাদু’ বলে চিৎকার করে হেসে উঠলো অনিল। গরুর দড়িতে বেঁধে কাদার মধ্যে পড়ে গেছে হরিপদ ডাক্তার। আসাদও না হেসে পারলো না।
আকাশে অন্ধকার। যখন তখন বৃষ্টি নামবে।
‘তাড়াতারি পা চালা। এহন বৃষ্টি নামলি ভিজে কাকের ছাও হয়ে যাবানে।’ তাড়া দিল অনিল।
ওরা এখন ফাঁকা মাঠের মধ্যে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো।
‘দৌড়ো।’ বলেই নিজেও দৌড়তে শুরু লাগলো অনিল। পিছে পিছে দৌড়তে লাগলো আসাদ। অল্পক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠলো সে। অনিল অনেকটা এগিয়ে গেছে।
আসাদ বললো, ‘আস্তে যা। হাঁফ বাধে গেছে।’
ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো আসাদের। বৃষ্টির নিঃশ্বাসও ঘন হলো। অনিল চিৎকার করে বললো, ‘থামিসনে, চল ঐ টোঙ ঘরে যায়ে উঠি।’
বলেই রাস্তা থেকে অল্প দূরে টোঙ ঘরের দিকে দৌড়তে লাগলো অনিল। টোঙ ঘরের কাছে গিয়ে বইগুলো টোঙের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বাঁদরের মতো ঝুলে টোঙের মধ্যে উঠে পড়লো সে। অল্পক্ষণ পরেই এলো আসাদ। তারপর আসাদের হাত থেকে বই নিয়ে টোঙের মধ্যে রেখে হাত ধরে টেনে তুললো আসাদকে।
টোঙ ঘরটা মাটি থেকে চার ফুঁট মতো উঁচুতে। টোঙঘরে একটা বালিশ কাঁথা দিয়ে জড়ানো। রাতে এখানে মানুষ থাকে। সরকারদের আখক্ষেত পাহাড়া দেয় তার বাড়ির রাখাল আলম। আলম এখন নেই। দিনের বেলা সারাক্ষণ আখক্ষেত পাহাড়া দিতে হয় না। তারপরও আলম দু-চার বার ঘুরে যায় আখক্ষেত। কারণ দুষ্টু ছেলেরা সুযোগ পেলেই রসাস্বাদন করে। আর রাতের বেলা অন্য গ্রামের চোরেরা আসে। তাদের আগমন বার্তা টের পেলেই চিৎকার শুরু করে আলম। আলমের চিৎকার শুনে পাড়ার লোকজন ছুটে আসে। চোরদের চেয়েও আখের বড় শত্রু শিয়াল। রাতের বেলা দল বেঁধে শিয়ালেরা আখক্ষেতে হানা দেয়। সেগুলো তাড়াতেই আলমের রাতের ঘুম হারাম হয়। টর্চ আর লাঠি হাতে জোড়ছে পাহাড়া দেয় সে। সকাল হলে কাঁথায় বালিশটা মুড়ে রেখে বাড়ি চলে যায়।
গা ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি সহজে থামবার কোন সম্ভাবনা নেই। আজ আর স্কুলে যেতে পারবে কিনা কে জানে। ক্লাস এতোক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। তা হোক। ভিজে গিয়ে ক্লাস করতে হবে এমন দায় পড়েনি! বালিশ থেকে কাঁথাখানা ছাড়ালো অনিল। তারপর কাঁথা দিয়ে মাথা-হাত মুছে ফেললো। নিজের মোছা হলে কাঁথা এগিয়ে দিল আসাদের দিকে।
‘নে মাথা মুছে ফ্যাল, ঠান্ডা লাগবেন না।’
ঘাড় নাড়লো আসাদ, ‘আমার মোছা লাগবেন না।’
ধমক দিল অনিল, ‘আরে ব্যাটা মোছ, মোছ। এমনিতেই তো বারমাস নাক দিয়ে বেলুন ফুলোস।
‘ময়লা ক্যাতা। ত্যালকাষ্টে গন্ধ। আমি মোছপো না।’
‘ই..শালা বাওনের বিধবে! শুচিবাই দেহাও।’
আসাদের ঘাড় ধরে কাছে টেনে এনে নিজেই মাথা মুছিয়ে দিল অনিল। আসাদ ছটফট করতে করতে গালি দিতে লাগলো। অনিলের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে নাক কুঁচকে থু থু ফেলতে থাকলো। আর হাসতে লাগলো অনিল। আসাদের সাথে অনিলের সম্পর্কটা কখনও বন্ধুর মতো, আবার কখনও বড় ভাইয়ের মতো। ভালবাসে, আবার প্রয়োজনে শাসনও করে। স্কুলে কেউ আসাদকে কিছু বললে বা গায়ে হাত দিলে অনিল সোজা গিয়ে তাকে এলোপাথারি কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। এজন্য অনিলের ভয়ে এখন আর কেউ আসাদের সঙ্গে লাগে না। সবাই জানে অনিলের হাতের কিল-ঘুষির ওজন বড় বেশি। এ ভার সইতে তাদের বড় কষ্ট হয়।
একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে এক ছেলে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছিল আসাদকে। পড়ে গিয়ে আসাদের নাক দিয়ে রক্ত বেড়িয়েছিল। অনিল দেখেই দৌড়ে এসে সেই ছেলের নাকে কয়েক ঘা কষে দিয়েছিল। সেই ছেলের নাক দিয়ে বলির পাঠার মতো রক্ত পড়েছিল। পরে সেই ছেলে কানাই স্যারের কাছে নালিশ করলে কানাই স্যার খুব মেরেছিল অনিলকে। দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধুকে মার খেতে দেখে কেঁদেছিল আসাদ। অথচ অনিল এক ফোঁটাও কাঁদেনি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আসাদ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমার জন্যে তুই এতো মার খালি!’
অনিল ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘বাচ্চা ছুঁড়ির মতো প্যান প্যান করে কাঁদিস নে তো! ঐ মারে আমার কিচ্ছু হয় না। আমার গা’র চামড়া অনেক মোটা। শালা ভোলাটারে আর কয়ডা ঘুষি দিলি ভাল হতো। ও ইচ্ছে করে তোরে ল্যাঙ মারছে।’
বৃষ্টি আপন মনে নেমেই চলেছে। আসাদের ঝিমুনি এসে গেছে। অনিল খোঁচা দিল, ‘কিরে ঘুমাস ক্যা?’
সজাগ হলো আসাদ, ‘ইস! আজ আর স্কুলি যাওয়া হয় কিনা তার ঠিক নাই।’
‘আজ আর স্কুলি যাব না।’
‘এখন বৃষ্টি থামলি যাব।’
‘ধুর! আজ আর যাবই না।’
‘আমি যাব। তুই না যাস না গিলি। তোর খালি স্কুল ফাঁকি দিবার ধান্দা।’
‘আমি তো যাবই না। তোরও যাবার দেব না। চুপ মারে বসে থাক। আর শীত লাগলি ক্যাতা গা’য় দে।’
‘হ, ঐ ত্যালকাষ্টে শ্মশানের ছিঁড়া ক্যাতা তুই গা’য় দে।’
‘শালা, বাওনের বিধবে!’ বলে নিজেই কাঁথাখানা গায়ে জড়িয়ে নিল অনিল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো দুজনই। চারিদিকে শুধু বৃষ্টির শব্দ আর মেঘের চোখ রাঙানি। সারা আকাশ জুড়ে মেঘ। অন্ধকার নেমে এসেছে সন্ধ্যার মতো। একটু পর একটি গরু ডেকে উঠলো। টোঙ থেকে মুখ বাড়ালো অনিল। দূরে মাঠের মধ্যে কার যেন একটা গরু বাঁধা। ঘন বৃষ্টিতে ভাল মতো দেখাও যাচ্ছে না গরুটাকে। বৃষ্টির তোড়ে টিকতে না পেরে ডাকছে আর দড়ি টানছে। তবু খুঁটো উঠছে না।
অনিল গরুটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কোন শালার বিটার গরু কিডা জানে! বুষ্টির মধ্যে কষ্ট পাতেছে। যায়ে খুঁটোডা উঠোয়ে দিয়েই আসপো নাকি!’
অনিলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আসাদ, ‘যাসনে, তুই ভিজে যাবেনে।’
যেতে হলো না অনিলকে। গরুটা নিজেই খুঁটো উঠিয়ে ছুটতে লাগলো বাড়ির দিকে। খুশি হলো ওরা দুজনই। অনিল ভালমতো কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বসলো।
হঠাৎ অনিলের কিছু মনে পড়তেই বাম দিকে কাত হয়ে প্যান্টের ডান পকেটে হাত দিল। পকেট থেকে ভেজা ম্যাচ আর দুটো ন্যাতানো সিগারেট বের করলো।
‘শালা ভিজে গেল!’ অনিলের কন্ঠে আফসোস। তবু ম্যাচে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতে লাললো সে।
কপাল কুঁচকে, চোখ বড় বড় করে অনিলের দিকে তাকিয়ে আছে আসাদ। সেটা লক্ষ্য করে অনিল বললো, ‘কিরে, ভূত দেখার মতো তাকায়ে আছিস ক্যা? মনে অয় বাপের জন্মে এমন দৃশ্য দেখিস নাই!’
‘তুই বিড়ি খাবি!’ আসাদের কন্ঠে বিষ্ময়!
‘একদম প্রেস্টিজ মারে কথা কবি না। আমি বিড়ি খাব ক্যান? বিড়ি তো খায় চাষাভূষারা। কালিপদ দাদু, কানাই কাকা, আলিম চাচা, ওরা বিড়ি খায়। আমি স্টুডেন্ট। আমি খাব সিগারেট।’
‘ঐ হলো। তুই সিগারেট খাবি?’
‘খাব। আমি কি ঋষি নাকি যে সিগারেট খাওয়া যাবিনে! অবশ্য ঋষিরাও খায়, গাঁজা। কল্কের ভেতর গাঁজা ভরে বম্ বম্ ভোলানাথা বলে টান মারে। তিনদিনের আগে আর শালার বিটাগের হুশ আসে না।’
আগুন জ্বললো না। ম্যাচ আর সিগারেট দুটোই টোঙের বাইরে ছুঁড়ে দিল অনিল।
‘তুই সিগারেট কনে পালি?’ বললো আসাদ।
‘আমার কাকা শ্রীযুক্ত বাবু অখিল চন্দ্রের পকেট থেকে ঝেড়ে দিয়েছি বৎস।’
‘যদি ধরা পড়ে যাস?’
‘ধুর ব্যাটা! আমার কাকা মহুরী হবার পরে, তাই বলে অত চামার না যে সিগারেট গুনে পকেটে থুবি।’
একটু থেমে আবার বললো অনিল, ‘শালার বৃষ্টি! জীবনের প্রথম চুরি করা সিগারেট খাবার পারলাম না!’
‘সিগারেট খাওয়া ভাল না। তুই আসলেই খারাপ অয়ে যাতেছিস।’
‘প্রভু আপনি ধরাধামে এসেছেন, বেশ করেছেন। দয়া করে আমাকে জ্ঞান দেবেন না। তাহলে আমি আপনাকে টোঙের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। আপনি ভিজে কাকের ছাও হয়ে যাবেন। চুপ থাক শালা, গোপাল ঠাকুরের মতো জ্ঞান চুদাচ্ছে। তুই শালা বড় হয়ে মহাপুরুষ হোস, আমার দরকার নাই।’
এখান থেকে উত্তরের মাঠটা প্রায় মাইলখানেক লম্বা। তারপর আরেকটি গ্রাম-পাকালিয়া। তার ওপাশে শিবরামপুর। ভরা বর্ষার সময় পুরো মাঠটি জলে ভরে যায়। পাকালিয়া যাওয়ার রাস্তাটিও তলিয়ে যায়। তখন এ গ্রাম আর ঐ গ্রামের মানুষেরা আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে বেড়াতে যায় নৌকায় চড়ে। আর শুকনো মরসুমে যায় পায়ে হেঁটে। এখন বর্ষা সবে শুরু হয়েছে। আর দিন বিশেকের মধ্যে মাঠটা জলে ভরে যাবে। পাকালিয়ার পাশ ঘেঁষে চিকল সুতোনলি সাপের মতো চলে এসেছে অড়াই নদী। মাঠের ভেতর দিয়ে বেড়িয়ে গেছে মাশালিয়ার দিকে। বর্ষার সময় অড়াই নদী দিয়ে জল এসে মাঠটা ভরে যায়। তখন অড়াইকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অড়াই নদীর দৈর্ঘ্য অনেক। এ গ্রামের পাশ ঘেষে, ঐ মাঠের বুক বেয়ে, অমুক বিলের কোমর ছুঁয়ে চলে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু প্রস্থ খুবই কম। এই অড়াই নদী আর চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে এই অঞ্চলে লোকগাঁথা চালু আছে। ঠাকুরমা, দিদিমা, পিসিমাদের মুখে মুখে ফেরে এখনও সেই লোকগাঁথা- একদা চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যে যাবে। সাতখানা বিশাল মযূরপঙ্খী বাণিজ্য তরী সাজানো হয়েছে। বাণিজ্য তরীগুলো বন্দরে অপেক্ষা করছে চাঁদ সওদাগরের জন্য। চাঁদ সওদাগর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে প্রণাম করলেন। মা তাঁকে আশির্বাদ করে বললেন, ‘বাবা সব নদী য্যান ত্যান, অড়াই নদী সাবধান।’
মায়ের কথা মনে রেখে চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য তরীতে পা রাখলেন। বাণিজ্য তরী ছাড়ার অনুমতি দিলেন। তীরে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ হাত নেড়ে, উলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি দিয়ে, ঢাক-কাঁসর বাজিয়ে চাঁদ সওদাগরকে বিদায় জানালেন।
অনেক বড় বড় নদী পেরিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্য শেষে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরী অবশেষে অড়াই নদীতে প্রবেশ করলো। অড়াই নদী দেখে চাঁদ সওদাগর প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেন-কপাল কুঁচকালেন। এরপর নাক সিটকালেন, ঠোঁটও উল্টালেন। এই অড়াই নদী! তিনি ভেবেছিলেন অড়াই নদী কত বড়! কি বিশাল তার জলরাশি, গোখরো ফণার মতো তার ঢেউ! অথচ এ যে ছোট খাল বৈ কিছু নয়! এরই জন্য মা তাকে সতর্ক করেছিলেন! মায়ের খেয়াল বৈকি! তার তরী লম্বা করে রাখলেই তো তার ওপর দিয়ে হেঁটে অড়াই পার হওয়া যায়!
অমনি এক পাকে চাঁদ সওদাগরের সাত সাতটি বাণিজ্য তরী বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললো অড়াই। স্রোতের তোড়ে সাতখানা বাণিজ্য তরীকে সাত জায়গায় নিয়ে রাখলো। সেই থেকেই নাকি লোকে এই ক্ষীণকায় অড়াইকে ভয় পায়, মান্য করে। এখন যারা বাবা, তাদের বাবা-জ্যাঠাদের ছেলেবেলায় নাকি চাঁদ সওদাগরের সেই ডুবে যাওয়া বাণিজ্যতরীর গলুই দেখা যেতো অড়াইয়ের বুকে কোথাও কোথাও! এখন আর দেখা যায় না। লোকের এমনই বিশ্বাস! এমন লোকগাঁথা ঠাকুরমার মুখে শুনেছে অনিল। শুধু অনিল নয়, তার মতো আরো অনেকেই শুনেছে ঠাকুরমা, দিদিমা, পিসিমাদের মুখে। তবে অনিল তুড়ি মেরে এক কথায় উড়িয়ে দেয়, ‘যত্তসব ফালতু কথা।!’
আরো শুনেছে, ঐ যে এখান থেকে দেখা যায় পাকালিয়া গ্রামের বটগাছ আর তার পাশে কার্তিক পুজার শিঙার মাথার মতো মঠের চূড়া। ওখানে নাকি ভূত থাকে! কোন এক অজানা পথিক নাকি এক রাতে ওখান দিয়ে আসছিল, ভূতেরা তার ঘাড় মটকে দিয়েছিল। আরো অনেক ভয়ংকর গল্প শুনেছে ঐ জায়গা নিয়ে। এখনও নাকি রাতে ওখান থেকে ভূতের আলো দেখতে পাওয়া যায়। অনিল এসব ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না। সে অনেকবার রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে এসে ঐ বটগাছের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কোন আলো দেখতে পায়নি। কিন্তু আসাদ এসব বিশ্বাস করে। আর এই প্রসঙ্গ উঠলেই সে ভয়ে কুকড়ে যায়। এখনও রাতে একা শুতে ভয় পায় আসাদ। আর একা বাইরে গিয়ে প্রসাব করার কথা তো সে ভাবতেও পারে না। এজন্যই অনিল তাকে কথায় কথায় বলে, ‘তুই তো শালা নাবালোক। নাক টিপলি দুধ বাইর অবেনে।’
এই টোঙ ঘর থেকে ঐ বট গাছ আর মঠের চূড়া দেখা যায়। কিন্তু এখন এই ঝুমবৃষ্টি আর অন্ধকারাচ্ছান্ন পরিবেশে মঠের চূড়া তো দেখাই যাচ্ছে না, বটগাছের অবয়বও বোঝা যাচ্ছে সামান্য। তবু আসাদের গা কেমন ছম ছম করছে এই পরিবেশে। এই নির্জনে তাদের মতো নাবালোক দুই কিশোরকে যদি ভূতে ধরে! যদিও এক মাইল পথ। কিন্তু ভূতেরা নাকি এই মাইল পথ এক সেকেন্ডেই পাড়ি দিতে পারে!
‘আমাগের যদি ভূতে ধরে।’ বট গাছ থেকে চোখ ফিরিয়ে অনিলের দিকে তাকিয়ে বললো আসাদ।
‘ভূত না। আমরা তো ছেলে মানুষ, আমাগের ধরলি পেত্নীতে ধরবেনে। তয় পেত্নীডা দীপালির মতো সুন্দর যেন অয়। পেত্নীরে আমি...’ বলেই চোখ টিপে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলো অনিল।
সব কিছুতেই তোর খালি বাজে কথা।’ বিজ্ঞের মতো বললো আসাদ।
কাঁথার মধ্যে একটু নড়ে চড়ে বসলো অনিল। সহসাই বৃষ্টি থামার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। হাই তুললো আসাদ।
‘দীপালি কেমন ডাগর অয়ে উঠছে দেখছিস? বুক দুডে হেভি খাড়া খাড়া!’
‘যা! তোর খালি বাজে চিন্তা!’
‘ই.....তোমার মনে অয় সাধ জাগে না! অ, তুমি তো আবার নাবালোক! এই তোর অইছে?'
'কি অইেছ?'
'কিছুই বোঝ না। দেহি তোর অইছে নাকি!
বলেই আসাদের হাফপ্যান্টের চেইনের দিকে হাত বাড়ালো অনিল। আসাদ অনিলের হাত সরিয়ে দিল। কিন্তু অনিলের রোখ চাপলে তো আর কথা শোনার পাত্র সে নয়। বা হাতে আসাদকে ধরে ডান হাতে আসাদের প্যান্টের চেইন খুলে ফেললো। আসাদ আছাড়ী-পিছাড়ী করতে লাগলো। তবু ছাড়লো না অনিল।
(চলবে)


০ Likes ১৬ Comments ০ Share ৫৪২ Views

Comments (16)

  • - কামাল উদ্দিন

    মজা পাইলাম মজা

    • - বাসুদেব খাস্তগীর

      আনন্দিত হইলাম ।

    - কামাল উদ্দিন

    • - বাসুদেব খাস্তগীর

    - ঘাস ফুল

    হা হা হা। মজা পেলাম বাসুদেব দা। এখন রাজনীতিতে নতুন তত্ত্ব যোগ হয়েছে। ক্যাশতত্ত্ব। প্রধান হুইপ রাজনীতিকে একবারে সুইপ করে দিয়েছে। 

    • - বাসুদেব খাস্তগীর

      ধন্যবাদ ঘাসফুল।

    Load more comments...