রানা তিনদিন ধরে অসুস্থ বলে অফিস যাওয়া বন্ধ রেখেছে। এই মৌসুমে ভাইরাস জ্বর স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পড়ে তবে তা শরীরকে অনেক দূর্বল করে দেয়। রানার মুখের স্বাদ চলে গিয়েছে, পানি খেতে তার তিতা তিতা লাগে বলে কিছু সিভিট কিনে এনেছে। কিছুক্ষন পর পর সেটাই মুখে পুড়ে চিবুচ্ছে। যতক্ষন জ্বর ছিল ততক্ষন তা নিয়েই ব্যস্ত ছিল কিন্তু এখন জ্বর নেই বলে ক্লান্তি অনুভব করছে। কয়েকদিন আগে জহির রায়হানের গল্প সমগ্র কিনেছিল, রানা সেটাই খুলে বসে। সূচিপত্র খুলে গল্পের নামগুলো পড়তে থাকে। “পোস্টার” নামটা পছন্দ হয় তার, পৃষ্ঠা নাম্বার দেখে ৮৫ নম্বর পৃষ্ঠা খোলার চেষ্টা করতে থাকে।
“দূর থেকেই দেখলেন আমজাদ সাহেব। লাল কালো হরফে লেখা অক্ষরগুলো সকালের সোনালি রোদে কেমন চিকচিক করছে। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।”
গল্পের আমজাদ সাহেব তার সদ্য রঙ করা দেয়ালে এইরূপ পোস্টার দেখে রেগে উঠেন এবং রানাও রেগে যায়। ঠিকই তো শুধু শুধু হতচ্ছাড়া কিছু ছেলে দেয়ালগুলো নষ্ট করছে। রানা জোরালোভাবে আমজাদ সাহেবকে সমর্থন দেয় যেন তা সত্যিই একটা বাস্তব চরিত্র। গল্প পড়তে পড়তে “চাকরি থেকে ছাটাই” বাক্যটা পড়ে আমজাদ সাহেবের মত সেও কিছুটা আঁতকে উঠে। হ্যাঁ, তারও এরকম হতে পারে কারণ সে শুনেছে তাদের এইচ আরে নতুন জিএম জয়েন করেছে সে কিনা আগের কোম্পানীর সত্তর জনের চাকরি খেয়েছে। রানা অবশ্য এসব পাত্তা দেয় না। চাকরি গেলে যাবে, এখন একবেলা উপোস দেয় তখন দুবেলা উপোস দিবে। জ্বর হয়ে একদিক দিয়ে তাই তাঁর ভালই হয়েছে, আজ সকালেই সে হিসাব করে দেখছিল এই তিনদিনে অফিসে যায় নাই তাই কত টাকা বেঁচে গিয়েছে, সবমিলে চারশ টাকার কাছাকাছি এবং সেটার জ্বরের জন্যে আনা ওষুধ নাপা এক্সট্রার দাম বাদ দিয়েই। একদম এ্যাকুরেট বললে তিনশত একানব্বই টাকা যা এই বাজারমূল্যে খুব সামান্য হলেও তার কাছে মোটেও সামন্য নয়। সে আবার গল্পের মধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করে। শেষের দিকে গিয়ে যখন সত্যি আমজাদ সাহেবের চাকরি চলে যায় তখন তার সাথে নিজের আত্নিক বন্ধন অনুভব করে। চাকরি চলে যাওয়ার পরে আমজাদ সাহেব তার বাড়ির দেয়ালে আরো একটি নতুন পোস্টার দেখতে পান এবং হাতে নাতে পোস্টার লাগানো ছেলেটাকেও ধরে ফেলেন। এ এক অসাধ্য সাধন কিন্তু পোস্টারের কাছে গিয়ে সেখানে লেখাটির দিকে তাকিয়ে থমকে তাকান। সেখানে যে লেখা, “ছাঁটাই করা চলবে না”। এবার কি আমজাদ সাহেব ছেলেটিকে সমর্থন না করে পারবেন? রানা সমর্থন না করে পারল না। এরকম পোস্টার শুধু আমজাদ সাহেবের দেয়ালে কেন? শহরের প্রত্যেকটা দামি দেয়ালে দেয়ালে লাগানো উচিত। পুরো শহরটাই ছেয়ে যাক এই পোস্টারে।
রানা বিছানা থেকে উঠে পানি খাওয়ার চেষ্টা করে। ওর লেবুর শরবত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজকাল তার হয়েছে এই সমস্যা, কখন যে কি ইচ্ছে হয় তার আর তখন শুধু নিজেকে শাসন করে যায়। হঠাত মনে পড়ে তার, কাল ওর রুমমেট একটা ট্যাং এর মিনিপ্যাক এনেছিল। দিনের এ সময়টায় কেউ সাধারণত থাকে না। এই সুযোগে সে মিনিপ্যাকটা উদ্ধার করে স্ট্যাপ্লারের পিন দিয়ে ছোট্ট একটা ফুটো করে অল্প কিছু ঢেলে দেয় গ্লাস ভর্তি পানিতে। পানির পরিমাণ অনুযায়ী না হওয়ায় শরবত তেমন ভাল হল না ঠিকই তবে পানির সেই তিতা ভাবটা কমে গিয়েছে।
রানা আবার বিছানায় এসে বসে। নিয়মিত আর্তনাদ করে মাথার উপরে চলতে থাকা ফ্যানটাকে অসহ্য লাগে তার। মনে হয় ফ্যানটার গলা টিপে কেউ বলে চলেছে, চল, চল, চল......। আষাঢ়ের শুরুতে এসে গ্রীষ্মের গরম যেন আরো জাঁকিয়ে বসল। ঘামে ভেজা গেঞ্জীটা খুলে ফেলে তিনদিনে এই প্রথমবার। নিজের শরীরের গন্ধে নিজেই নাক সিটকে গেঞ্জীটাকে বালতিতে ভিজিয়ে রাখতে বাথরুমের দিকে এগোয়। একটা ডেটল সাবান হলে বেশ হত, গোসল আজ আর না করলেই নয়। গেঞ্জিটা ভিজিয়ে রাখতে রাখতেই চোখ যায় শোপকেসে, সদ্য কিনে এনে ব্যবহার করা ডেটল সাবান। আহ, আজ গোসলটা সেরে নেওয়ায় যায়। রুমের মধ্যে এসে ঝুলানো আয়নাটাতে নিজের চেহারা দেখে গোসল করার আগে দাঁড়ি কামিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। ওয়ান টাইম রেজারটা সে কিনেছিল গত মাসে, এখনও চালিয়ে নিচ্ছে কিন্তু আজ ব্যবহার করতে গিয়ে বুঝল একদম আয়ু নেই। জোরে জোরে চালিয়ে গালের দাঁড়িগুলোকে পরাজিত করে যখন থুতনির কাছে গেল তখন বুঝতে পারলে এই রেজর দিয়ে আর হবে না। মানুষের রেজর যে ব্যবহার করবে, রুচি এখনো সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি রানা। তার চেয়ে থুতনিতে গোল করে কিছু দাঁড়ি রেখে দিলে কেমন হয়? সে খুব চেষ্টাচরিত করে থুতনির নিচে গোল করে দাঁড়ি রাখে আর বাথরুমের আয়নায় লাইটের আলোতেও মুখ ঠিকভাবে দেখতে না পেয়ে বাইরে এসে ঘরের আয়নায় রেজরটা নিষ্ঠুরভাবে দুগালে চালিয়ে নেয়।
গুঁড়োদুধ পানিতে মিশিয়ে তার মধ্যে ওয়াটার হিটারটা গলিয়ে দিয়ে গরম করতে বসে রানা। জ্বরের এই কয়েকদিন খাদ্য বলতে এই, গরম দুধের সাথে পাউরুটি। পাউরুটি যেদিন এনেছিল সেদিন ডেট এক্সপ্যায়ার হয়ে গিয়েছে। শালার দোকানদার সেটাই ধরিয়ে দিয়েছে তাকে, লক্ষ্য করে নাই সে। এখন আর ফেলে দেওয়া যায় না, ২৮ টাকা কি মুখের কথা। গরম দুধে নরম তুলতুলে পাউরুটি খেতে খেতে আরো একটি বই খুলে বসে সে। এবারের গল্পের লেখক অপরিচিত, অখ্যাত। শুরুটা এরকম,
“তানভিরের জীবনে অবসর-আনন্দ কিছুই অবশিষ্ট নেই বলেই কি এত বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল? শুধু কাজ করা আর বেঁচে থাকা। এভাবেই একদিন পরপারের দরজায় উপস্থিত হয়ে যাবে।”
রানা এই গল্পে যেন নিজেরই ছায়া দেখতে পেল। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না প্রায় বছরখানেক হতে চলল। বাবা-মা লেখাপড়া জানে না বলে চিঠিপত্র কম আসে কিন্তু ছোট ভাইয়ের পরীক্ষার জন্যে ফিসের টাকা চেয়ে মাসে অন্তত দুটি চিঠি আসবেই। তারপর তানভিরের অফিসেও ছাটাইয়ের কথা উঠতেই রানার মনে হল, প্রকৃতি তাকে মনে হয় আগাম সংকেত পাঠাচ্ছে। সে বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
পরেরদিন বের হওয়ার আগে আগেই রানার একজন কলিগ এসে উপস্থিত।
-রানা সাহেব, খবর আছে।
-কি খবর মজিদ সাহেব?
-না মানে, আপনার চাকরিটা আর নেই। আপনি যেন অফিসে গিয়ে অপমানিত না হন তাই আগেই জানিয়ে দিতে এলাম।
-ও আচ্ছা। চাকরি নেই?
রানা কাকে প্রশ্ন করল ঠিক বুঝা গেল না। নিজেকেও করতে পারে আবার মজিদ সাহেবকেও করতে পারে। তার তাহলে অফিসে যাওয়ার অত তাড়া নেই কিন্তু মজিদ সাহেবের আছে বলে চলে গেল। সাড়ে দশটার দিকে সে অফিসে ঢুকতেই অ্যাকাউন্টসের জিএম রহমতুল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা।
-কি রানা সাহেব? কেমন আছেন?
-জ্বি ভাল।
-আজকে ক্যাশিয়ারের সাথে দেখা করবেন কিন্তু।
-জ্বি আচ্ছা।
অফিসের নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তিনটি নামের মধ্যে সে প্রথম। রিসেপশনে যেতেই তাকে দেখে রিসপশনিস্ট একটা খাম ধরিয়ে দিল। সে খুলে দেখল না, বরখাস্তের কথাও কত সুন্দর করে লিখে এরা। এরপর সবার সাথে দেখা হতেই সবাই সমবেদনা জানালো। সে যে টেবিলে বসত সেখানে এখন লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পড়া একটা মেয়ে বসে আছে। সে মনে মনে একটা গল্প ফাঁদে। ধরা যাক, সে মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলল তাহলে মেয়েটিকে আর চাকরি করতে হবে না ফলে তার চাকরিটাও আর যাবে না।
-আপনার গত মাসের বেতন আর এ মাসের তিনদিনের বেতন দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা সিগনেচার করুন।
-আচ্ছা।
প্রতিবার বেতন নেওয়ার সময় রানার অহেতুক একটা শিশুর মত চাঞ্চল্য আসত কিন্তু আজ তা অনুপস্থিত। টাকাগুলো নিয়ে অফিসের বাইরে চলে এসে চায়ের দোকানে দাড়ায়। অন্যমনস্কভাবে এলেমেলো ভাবনা ভাবতে থাকে এবং অফিস আওয়ারটা পাশেই একটা হোটলে কাটিয়ে দেয়। অফিস ছুটি হতেই মেয়েটা বের হলে রানা তার পিছু নেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটা দাড়িয়ে গিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে,
-আচ্ছা আপনাকে কি আমি অফিসে দেখেছি?
-জ্বি।
-আপনি কি রানা?
-জ্বি।
-ও আচ্ছা। আপনার বদলেই তাহলে আমার চাকরিটা হল।
-জ্বি।
মেয়েটি তার দিকে কিছু খাম এগিয়ে দেয়।
-এই নিন। এগুলো সম্ভবত আপনার। অফিসের ড্রয়ারে ছিল।
-আমার চিঠি? আপনার কাছে?
-হ্যাঁ।
মেয়েটা লজ্জায় হাসে।
-এত সুন্দর করে চিঠিগুলো লেখা যে নিজের সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছিল।
-রাখেন সমস্যা নেই।
-না না। কি বলেন? এমনিতে একটা চিঠি পড়ে ফেলেছি দেখে খুব লজ্জা লাগছে।
-না লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।
-আচ্ছা কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করি?
-করেন।
-রেবেকা আপনাকে খুব ভালবাসে তাইনা?
-জ্বি।
-আপনাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে?
-নাহ।
-উনি এখন কোথায়?
-ও আত্নহত্যা করেছে দুমাস হল।
মেয়েটা অবাক হয়ে খামগুলো হাতে দাড়িয়ে থাকে। রানা এভাবেই মেয়েটাকে রেখে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে ফুট ওভারব্রিজে উঠে পড়ে কারণ ওর বাস আসবে উল্টোদিকে।
Comments (14)
৪২ বছর ধরে স্বাধীন বলে বলে সাগর মুখে
দুর্গন্ধ তুলেছে ফেনা; বাস্তবে নাই তুলনা
হাজার লক্ষ রক্তের গাঁথা শিমুল পলাশ ফুলেরা
লাল হাসির মাঝে কি দেখছ,১৬ই ডিসেম্বর?
চমৎকার...
চমৎকার লাগার জন্য
অসংখ্যা ধন্যবাদ
ভাল থাকুন-----
খুব ভাল লাগল আপনার আজকের কবিতা।
মাটির পুতুন - মাটির পুতুল ঠিক করে নিবেন
দাদা
ঠিক করেছি ভাল লাগল
অনেক ধন্যবদ ভাল থাকুন
দারুন লিখেছেন ভাই।
পাশা দা
আপনাদের অনুপ্রেরণা মোর পথ চলা
অনেক ধন্যবাদ ভাল থাকুন---------