Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Mishu Milan ..

১০ বছর আগে

শিবে, পারু আর ঘুণট রোদ্দুর

দুই লেনের চওড়া রাস্তার পশ্চিমপাশে একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। হাসপাতালের গেটের পাশে একটি ব্যস্ত এ,টি,এম বুথ। বুথের পাশে ফুটপাতে সামনে ওজন যন্ত্র নিয়ে বসে থাকে একজন মধ্যবয়ষ্ক বোবা লোক। সে বারবার পথচারীদের শরীরের দিকে তাকায়, মুখের দিকে তাকায়। কেউ ওজন হয়, কেউ হয় না। পাশেই একটি চায়ের দোকান। রোগী দেখতে আসা লোকজন, হাসপতালের সামনের রাস্তায় অপেক্ষমান সি,এন, জি-ট্যাক্সিক্যাবের চালকেরা ভিড় করে চায়ের দোকানে। তারা চা-সিগারেট খায়। হাসি-তামশায় মত্ত থাকে। দু-একজন ভিক্ষুকও জুটে যায়। চায়ের দোকানে আগন্তুকদের দিকে হাত-বাড়ায়। বোবা লোকটির পাশে শীর্ণ শরীরের একজন ভিক্ষুক বসেও পড়ে। ফুটপাত ধরে মানুষ আসে, মানুষ যায়। কেউ কেউ একটা-দুটো টাকা ছুঁড়ে দেয় ভিক্ষুকের থালায়। ভিক্ষুক বোবা লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসে। বোবা লোকটির গা জ্বলে যায়। এই হলো রাস্তার পশ্চিম।
আর রাস্তার পূর্বদিকের ফুটপাতে হাসপাতাল বরাবর ‘চিরবিদায় স্টোর’। ছোট্ট, দেখতে চায়ের দোকানের মতো। দোকানের ভেতর ডেড বডির জন্য চা পাতা, কাফনের কাপড়, গোলাপজলসহ যা যা লাগে সবই আছে। আর দোকানের বাইরে ডুমুর গাছের নিচে ফুটপাত লাগোয়া সরকারী কোয়ার্টারের সীমানা প্রাচীরে ঠেস দিয়ে রাখা গোটা তিনেক কফিন। নতুন, কাছে দাঁড়ালে এখনও কাঁচা কাঠের গন্ধ পাওয়া যায়। কফিনের পাশেই প্রাচীরের গায়ে একটি সাইনবোর্ড লাগানো-‘এখানে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া পাওয়া যায়’। ডুমুর গাছটির গোড়া কোয়ার্টারের প্রাচীরের ভিতরে। কিন্তু সারাক্ষণ প্রাচীরের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে থাকে রাস্তার দিকে। ফুটপাতে ছায়া দেয়। শ্রীদাম মুচির মুখ নিশ্রিত পানের পিকের মতো একটু পরপরই ফুটপাতের ওপর পাকা ডুমুর ফেলে। মৌমাছি আর চড়–ই পাকা ডুমুরের থোকায় হল্লা করে!
দোকানটির মালিকের নাম হাসান। সাতাশ-আটাশ বছর বয়স। বছর দুয়েক হলো সে এই ‘চিরবিদায় স্টোর’ দিয়েছে। রমরমা ব্যবসা চলছে। আজকাল চিকিৎসা শাস্ত্র যেমন উন্নত হয়েছে, তেমনি তার সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে রোগের প্রকোপও বেড়েছে। এই হাসপাতাল থেকে প্রতিমাসে গড়ে বিশ-পঁচিশটি লাশ বের হয়। আর অ্যাম্বুলেন্সের তো জিরোবার ফুসরত-ই নেই। এই দক্ষিণবঙ্গ তো এই উত্তরবঙ্গ। হাসান ভাবছে, সামনের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীর দিকে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স কিনবে।
হাসানের দোকানের পঞ্চাশ গজ দূরে বাস স্টপেজ। আর উত্তরে ত্রিশ গজ দূরে হামিদের চায়ের দোকান। বলা যায় হামিদের বউয়ের চায়ের দোকান। বউটি-ই চা বানায়, বিড়ি-সিগারেট দেয়, টাকা-পয়সার লেনদেনও সে-ই করে। হামিদ কেবল দোকানে পাছা ঠেকিয়ে পা দুটো ফুটপাতে রেখে বসে থাকে। মাঝে মাঝে খরিদ্দারদের দিকে চা এগিয়ে দেয়, বড় নোট ভাংতির জন্য এদিক-ওদিক ছোটে আর ডাক পড়লেই হাসানের দোকানে চা দিয়ে আসে। বছর পঁচিশের যুবক হামিদ। বউটির বয়স আরো বেশি মনে হয়।
হাসান দোকানের বাইরে গলা বাড়িয়ে কন্ঠ তারায় তুললো, ‘হামিদ, একটা চা দিয়া যা।’
কয়েক মুহূর্ত পর হাসানের দৃষ্টি পড়লো আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়ানো সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরিহিত ফরিদের দিকে। হাসান আবার গলা হাঁকলো, ‘হামিদ, দুইডা চা দিস। একটায় চিনি কম।’
জুম্মার নামাজ শেষ করে আসছে ফরিদ। অন্যরাও এসে যাবে এখনই। অন্যরা বলতে কাউসার, দেবজিৎ, মধু খা, শালিক্যা, টিটু, কায়েস, আরমান, আর পারভেজ। এরা সবাই হাসানের স্কুলবন্ধু। দু-বার এইচ, এস, সি ফেল করার পর হাসানের লেখাপড়ার পাট চুকেছে। আগে বাবার জুতার দোকানে বসতো। কিন্তু বড় ভাইয়ের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বছর দুয়েক হলো বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই ‘চিরবিদায় স্টোর’ দিয়েছে।
হাসান অল্প শিতি হলেও তার বন্ধুরা সবাই উচ্চ শিতি এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ফরিদ যেমন ব্যাকার। ফরিদের বাবা-মা দুজনই সরকারী চাকরি করতেন। রিটায়ার্ড করেছেন দুজনই। এখন রাস্তার পশ্চিমে হাসপাতালের পিছনে নিজস্ব ফ্যাটে থাকছেন।
‘কিরে কেউ আহে নাই?’ বেঞ্চে বসতে বসতে বললো ফরিদ।
‘দেহি না তো কাউরে।’
পরমুহূর্তেই উল্টোদিকের ফুটপাতে তাকিয়ে হাসান বললো, ‘ঐ যে শালিক্যা আইতাছে।’
শালিক্যার আসল নাম শোভন। কিন্তু সারাক্ষণ শালিকের মতো কিচির-মিচির করা তার স্বভাব। এজন্য বন্ধুরা আড়ালে তাকে ডাকে-শালিক্যা। শালিক্যা সত্যিই এক বিচিত্র চরিত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছে। ছাত্র রাজনীতি করে। কিন্তু আসলে ও কোন দল করে তা বোঝার উপায় নেই। বন্ধুরা চাকরি করার কথা বললে বলে, ‘আমি চাকরিতে ঢুকলে ম্যাডাম মাইন্ড করবো ব্যাটা। এই সাইড পুরাডা তো আমারেই দেখতে হয়। দলের প্রতি কমিটমেন্ট আছে না!’ আবার কিছুদিন পর হয়তো ওর মুখে শোনা যাবে অন্য দলের প্রতি কমিটমেন্টের কথা। নিজেকে ছোটখাটো টেন্ডারবাজ হিসেবে দাবী করলেও নানা ধরণের ব্যবসা বুদ্ধি ওর মাথায় ঘোরে। কিছুদিন আগেও কাউসার বেকার ছিল। তখন কাউসারকে এক অভিনব ব্যবসার প্রস্তাব দিয়েছিল সে। ব্যবসার গোপনীয়তা বজায় রাখতে সেদিন সন্ধ্যায় কোয়ার্টারের আম তালায় ডেকে নিয়েছিল কাউসারকে।
‘একটা নতুন ব্যবসার ধান্দা পাইছি মামা!’
‘আবার কোন দু-নম্বরী ব্যবসার ধান্দা ঢুকছে তোর মাথায়! এই কইতে তুই এতো সিরিয়াসলি আমারে ডাকলি?’
‘আগে হুনবি তো ব্যাটা। ব্যবসার আগেই নম্বর লাগাইয়া দিস। এহন এক নাম্বার ব্যবসা করে কোন হালার পুতে ক দেহি! হুন মামা, ব্যবসাডা একবার রান করাই পারলে তোরে আর পিছে তাকাইতে অইবো না। চাকরি কইরা কয় টাকা বেতন পাবি, বিশ হাজার, ত্রিশ হাজার? এই দিয়া বর্তমান বাজারে বিয়া কইরা ঢাকা শহরে ঠিকতে পারবি তুই? আরে মামা, বউয়ের পারলার খরচই অহন মাসে কম অইলেও দশ হাজার যায় গা। বাড়িভাড়া আর খাওন খরচের পর তুই তো মাসে মাসে বউরে দশ হাজার দিবার পারবি না। তহন কি অইবো? তুই অফিসে যাবি আর তোর বউ পরকিয়া করবো পারলারে যাওনের খরচ যোগাইতে।’
‘ফ্যাদলা বাদ দিয়া আসল কথা ক দেহি।’
‘হুন, মনে কর হামিদ্যার মতো চায়ের দোকানদারগো রোজ আধা কেজি কইরা চা লাগে। চা বানানোর পর ওরা ঐ চা পাতিগুলা ফালাইয়া দেয়। আমগো বিজনেস অইলো, বিভিন্ন দোকান থেইকা আমরা এই ফালান্যা চা পাতিগুলো নিমু। নিজেরা যাইয়া নিমু না। চার-পাঁচটা টোকাই রাইখা নিমু। ওরা যাইয়া কালেক্ট করবো। দেন, আমরা কি করমু? হাসান্যা যে জায়গা থেইকা ডেডবডিতে দেওয়ার জন্যে সস্তা চা কিন্যা আনে, আমরাও ঐখান থেইকা সস্তা চা কিন্যা আনমু। তারপর ঐ টোকান্যা চায়ের সাথে মিক্সিং কইরা, প্যাকিং কইরা এইসব দোকান গুলাতেই আবার সেল দিমু। আইডিয়াটা চরম না মামা?’
কাউসার মুখ দিয়ে লম্বা বাতাস ছেড়ে নিজের কপালে দুটো থাপ্পর মেরে বললো, ‘ওরে..বাবুরে! এই কওনের জন্যে তুই এতো সিরিয়াসলি আমারে ডাইকা আনলি! একবার সেকেন্ড হ্যান্ড জাঙ্গিয়ার ব্যবসা, একবার সেকেন্ড হ্যান্ড চায়ের ব্যবসা! তোর মাথায় কি খালি এইসব উদ্ভট ব্যবসার চিন্তাই আসে! ভাল চিন্তা করতে পারস্ না তুই?
‘তুই যে কি কস মামা, এইডা কি খারাপ চিন্তা! শুন ছোট’র থেইকা ব্যবসা শুরু করতে অয়। এইডা করতে করতেই একদিন দেখবি তুই ইস্পাহানির মতো কোম্পানীর মালিক হয়ে গেছস।’
‘আর এই চা খাইয়া যে মাইনষের কিডনি নষ্ট হইবো, ক্যানসার-ফ্যানসার অইবো!’
‘হউকগা। তা আমাগো কি! আরে মামা দ্যাশে কি মাইনষের অভাব! একটা মরবো, চাইরডা বাইর অইবো। দ্যাহস না, মাইনষের ভিড়ের ঠ্যালায় বাস-গাড়িতে ওঠোন যায় না। তুই মামা মার্কেটিং এ পড়ছোস। সমাজ বিজ্ঞানের ভাবনা তোরে ভাবতে অইবো না। তুই তোর প্যাট আর চ্যাটের চিন্তা কর।’
‘তুই একজন ফাস্টক্লাস অফিসারের পোলা শোভন। তোর রুচি এতো নিচে ক্যান কতো? তুই আউ-ফাউ পোলাপানের লগে মিশস আর এইসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করস। তোরে না কইছি এইসব উদ্ভট ব্যাপারে আমারে ডাকবি না।’
‘তোগোরে দিয়া কিছু অইবো না। তোরা স্বপ্ন দ্যাকতে জানস না।’
যোগ্য পার্টনারের অভাবে শালিক্যা সেই ব্যবসাটা আজও দাঁড় করাকে পারেনি।
হামিদ দুটো চা নিয়ে এলে থালা থেকে একটা কাপ তুলে নিল ফরিদ। আরেকটা কাপ হাসানের আগেই শালিক্যা হাতে নিয়ে হামিদকে অর্ডার করলো, ‘অই হামিদ্যা হাসান্ন্যারে আরেকটা চা আইন্যা দে।’
চায়ে চুমুক দিয়ে আবার বললো, ‘ঐ হাসান, দেবের লগে কথা অইছে?’
‘না।’
‘দাঁড়া, হালার মালুরে আমি ফোন দিতাছি।’
‘হ্যালো, ঐ তুই কইরে বাজান? আবি না? ফরিদ আইছে তো। ...অই তোর লগে ক্যাডারে, চামড়া নি? চামড়ার গন্ধ পাইতাছি মামা, মিথ্যা কওন চুদাইয়ো না। হুম...ভর দুপুরে চামড়া নিয়া ঘুরতাছ! তয় মামা, চামড়ার কন্ঠডা কিন্তু এক্সিলেন্ট। নিশ্চয় জিনিস-পত্তরও বালা অইবো! .... অই পারুরে পাইছস? না কইলে অইবো না মামা, ওরে ধইরা নিয়া আয়। আয়া নিস। কইলাম তো দিমুনে।...আয় আয় দেরি করিস না। জলদি আয় বাজান।’
ফোন রেখে একহাতে চায়ের কাপ আরেক হাত উঁচিয়ে নাচতে নাগলো শালিক্যা, ‘আইতাছে মামা, আইতাছে। পারুরে নিয়ে আইতাছে। মুন্নি বদনাম হে, ডার্লিং তেড়ে লিয়ে....।’
পিছন থেকে টিটু এসে শালিক্যার কাঁধে চাপড় মেরে বললো, ‘কিরে নাচস ক্যান?’
‘আভি..আভি.. আইতাছে মামা, পারু আইতাছে।’
টিটু বাস স্টপেজের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘থাম ব্যাটা। ঐ দ্যাক, তোর ভাই খাড়াইয়া আছে।’
বাস স্টপেজের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালো শালিক্যা। ওর বড় ভাই শাওন দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপোয়। গায়ে একটা সবুজ পাঞ্জাবী। চোখে চশমা।
টিটু আবার বললো, ‘ভরদুপুরে মাঞ্জা মাইরা যায় কই? অই তোর ভাইরে বিয়া দিস না ক্যান?’
শাওনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে শালিক্যা বললো, ‘অরে বিয়া করবো ক্যাডা, অর কিছু আছেনি!’
ফরিদ বললো, ‘কি কস ব্যাটা আন্দা-মুন্দা! দ্যাকতে তো তাগড়া।’
শালিক্যা বললো, ‘কিছু থাকলে তো বিয়া করতোই। বাসা থেইকা এই যে কইতাছে বিয়া কর, বিয়া কর। অয় বিয়া করবো না। হারামজাদা এইডা বোঝে না, যে অর দুই দুইডা ছোট ভাই আছে। অর না উঠুক, তাগো তো পিনিক ওঠে!’
ওরা তিনজন হেসে উঠলো। শালিক্যাও হেসে আবার শুরু করলো, ‘তোরা হাসতাছস মামা, অর লগে এক বাসায় থাকলে বুঝতি। অয় একটা বিখাউজ। সেই ভোর বেলা উইঠ্যা হারমনিয়াম নিয়া ভ্যাঁ ভ্যাঁ, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতেই থাকে। কি সব রবীন্দ্রগীতি না কি গায়, মনে অয় নাকের ভিত্রে দুইডা তেলাপোকা ঢুকছে।’
ফরিদ বললো, ‘আরে ব্যাটা রবীন্দ্রগীতি না, রবীন্দ্র সংগীত।’
‘অইতো একই কথা। নাক চাইপ্যা ধইরা অই গান গাইয়া কি অইবো? ক্যাডা চিনবো অরে! পয়লা বৈশাখে ভিড়ের ভিতরে হান্দাইয়া মাইয়াগো মতো ঢুলে ঢুলে গায়, এসো হে বৈশাখ। গান গাইতে অইলে ব্যান্ডের গান গা। শালা, বলদ কোনহানকার। অয় নাকি একটা মাইয়ার লগে প্রেম করে, হেও নাকি রবীন্দ্রগীতি গায়। অয় যখন অই মাইয়ারে বিয়া করবো, তহন বাসার অবস্থাডা কি অইবো একবার ভাব! ভোর বেলা উইঠ্যা একটা বলদ আর একটা বলদী নাক চাইপ্যা ধইরা ভ্যাঁ ভ্যাঁ শুরু করবো। বাসাডারে একটা খামার বানাইয়া ফ্যালাইবো। আমি আম্মারে কইছি, অর বিয়ার পর কিন্তু এক বাসায় থাকুম না।’
শালিক্যার নামের বিশেষত্ত্ব এখানেই, সে কথা বলতে শুরু করলে থামে না। তার কথার ভেতরে কাউকে কথা বলার সুযোগও দিতে চায় না।
হাসান বললো, ‘অই থাম তো। বড় ভাইরে নিয়া কি সব কথা কস!’
হাসানকে ধমকালো শালিক্যা, ‘যাঃ ব্যাটা, বড় ভাই। অরে চিনস তুই। অয় আমার নামে আব্বা আম্মার কানে কথা লাগায়। আমি নাকি আন্দা-মুন্দা পোলাপানের লগে মিশি। আমি তো মামা বাসায় এক্কেরে চোদনা অইয়া যাইতাছি ওর জন্যে।’
‘এইডা ঠিক কথাই কইছে। তুই জুনিয়র ব্যাচের কিছু উল্টা-পাল্টা পোলাপানের লগে মিশস।’ বললো ফরিদ।
‘আরে মামা পলিটিকস করতে অইলে এইসব পোলাপান হাতে রাখতে অয়। এইডা তোরা বুঝবি না।’
হামিদ আরেকটা চা নিয়ে এলো। হাসানের আগেই কাপটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল টিটু। হাসান সবার মুখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললো, ‘কিরে ভাই, তোরা একজন করে আবি, আর আমার চা ডা নিয়া নিবি?’
টিটু বললো, ‘কথা কস না ব্যাটা, বহুত পেরেশান গেছে। হামিদ, আর একটা চা আনে দে ওরে।’
হামিদ মনে মনে ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু কিছু বলার সাহস তার নেই। তাই এই ত্রিশ গজ দূরত্বের ভেতরে লুকোনো হাজার গজ পথ তাকে পাড়ি দিতে হয় প্রতিদিন। ওদের গল্প চলতে থাকে। অনিচ্ছার হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে হামিদ আবার চা-সিগারেট দিয়ে যায়।
হাসানের দোকানের সামনের ঝাঁপের নিচে একটা বেঞ্চ, আরেকটা দোকানের দক্ষিণে। একটায় ঝাঁপের ছায়া পড়ে আরেকটাতে ডুমুরগাছের ছায়া। সূর্য পশ্চিমে বেশি হেলে গেলে ঝাঁপের নিচে রোদ পড়ে। যখন রোদের তাপ বেশি থাকে তখন হামিদ একটা কাপড় টাঙিয়ে দেয়। এখনও সূর্য বেশি হেলে যায়নি, তাই কাপড় টাঙানোরও দরকার পড়েনি। ফুটপাত ধরে কোন লোক এলে, তাকে নিচে দিয়ে যেতে হয়। দোকানের সামনেটা পুরোটাই ওদের দখলে থাকে। বাস স্টপেজের দিকে তাকিয় টিটু বললো, মামা, গোশ্ টা দ্যাখ! উমম...হেভি!
সবাই বাস স্টপেজের দিকে তাকালো। তখনই বাসে উঠলো মেয়েটি।
সিগারেট টানতে টানতে এসে দাঁড়ালো মধু খা। কাঁধে গিটার। দোকানের ঝাঁপের লাঠিতে ওর পিঠের ধাক্কা লাগতেই ঘুণ জর্জরিত ঝাঁপ থেকে কাঠের গুড়ো ঝরে পড়লো টিটুর মাথায়, কপালে, ফুটপাতে।
‘ধুর ব্যাটা! আয়াই তো করলি অকাম।’ মাথা থেকে কাঠের গুড়ো ঝাড়তে লাগলো টিটু।
‘আমার কি দোষ! ধাক্কা লাগতেই পারে। ঐ হাসান এইডা পাল্টাস না ক্যান?’ বললো মধুখা।
‘আরে পাল্টামু। সময় পাইতাছি না। মিস্ত্রি হালার পুতরে সেদিন আইতে কইছি আহে নাই।’ হাসানের উত্তর।
মধুখা একটা সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করে। ভাল বেতন পায়। সুদর্শন চেহারা আর প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি মতো লম্বা। গায়ের রঙও টকটকে ফর্সা। ওর বাহ্যিক সৌন্ধর্য্যরে আলো ফেলেই মেয়েদের মনের চোরা অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ায় ও। কিন্তু কোন গলিতে, কারো মনোবাড়ির অন্দরমহলে বেশিদিন থাকতে পারে না সে। একঘেয়ে লাগলেই নতুন চোরা গলির সন্ধান করে। এজন্যই বন্ধুরা তার নাম দিয়েছে মধুখা!
‘কিরে হাসান বইয়া রইলি যে! বানাস না ক্যান?’ টিটু বললো।
‘আর কেউ আইবো না?’
‘ক্যাডা আইবো, তার জন্যে বসে থাকবো নাকি! বানা।’
‘দেব তো আইতাছে। কাউসার আইবো না। অই টিটু পারভেজরে একটা ফোন লাগা তো।’ বললো শালিক্যা।
এরই মাঝে দোকানে দুজন খরিদ্দার এলো অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার জন্য। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে না। সকালে রোগী নিয়ে টাঙ্গাইল গেছে। অগত্যা তারা একটা কফিন আর লাশের সরঞ্জাম কিনে নিয়ে গেল। ফোনে কথা বলছে টিটু, ‘কিরে মামা, আবি না?...তোর কন্ঠ এমন শোনায় ক্যান? তুই কি উপড়ে নাকি! না, কেমন জানি জড়াইন্যা গলা। ঠিক আছে রাখতাছি।’
ফোন রেখে বললো, ‘আইবো না হালার পুতে।’
এরই মধ্যে একটা সাদা বিড়াল কোলে ফুটপাত ধরে এগিয়ে এলো দেবজিৎ। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ। পিঠের মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত ছড়ানো চুল। কানে এয়ারফোন। কাঁধে ছোট্ট একটা ব্যাগ। গায়ে কালো টি-শার্ট, পরনেও কালো হাফপ্যান্ট। পায়ে দু-ফিতের স্যান্ডেল। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা ভোঁতা, তামাটে। দেবজিৎ আর্কিটেক্ট। সদ্য বুয়েট থেকে বেরিয়ে একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানীতে ডিজাইনার হিসেবে ঢুকেছে। কোলের বিড়ালটির নাম মারিয়া। বিড়াল পোষা ওর সখ। ওর বাসায় অপরিচিত কেউ ঢুকলে তার মনে হবে এটা বুঝি বিড়ালেরই বাসা। হয়তো তখন মারিয়া সোফার ওপর ঘুমাচ্ছে, ফরিয়া বিছানায় মুখ গুজে বসে আছে, অ্যালেন গড়াগড়ি খাচ্ছে পাপশের ওপর । নানান জায়গায় কেবল বিড়াল আর বিড়াল। শুরুতে দুটো বিড়াল ছিল। এখন সর্বমোট ষোলটি! বিড়ালের তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। এবং কে কার ছেলে-মেয়ে, কে কার নাতনী, পুরো বিড়ালের গুষ্টির কুষ্ঠি দেবজিতের মুখস্ত!
‘কিরে মামা, এতো দেরি করে আইলি! পারু কই?’ বললো শালিক্যা।
‘বাইর কর।’ শালিক্যার দিকে পিঠ এগিয়ে দিল দেবজিৎ।
শালিক্যা ব্যাগ খুলে দুটো কালো কাচের বাতল বের করে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো! একটা ফরিদের হাতে দিয়ে আরেকটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেয়ে বললো, ‘পারু মাই ডার্লিং, মেরে জান, দিলকে টুকরে! অই হাসান্যা শিবেরে বাইর কর।’
হাসান দোকানের তাকে সাজানো গোলাপজলের পিছন থেকে একটা কাগজের পোটলা বের করলো। পোটলাটা খুলে খবরের কাগজে ঢাললো- গাঁজা! ওরা গাঁজাকে শিবে বলে। আর ফেনসিডিলকে বলে পারু। দেবজিৎ দিয়েছে এই নাম। এই গোপন নাম দেবার কারণ, যাতে অন্যরা শুনলেও বুঝতে না পারে। এবং কিছুদিন পর পর এই নাম চেঞ্জও করে। যেমন শিবে আর পারুর আগে ছিল-বাসু আর হাসু।
হাসান অভিজ্ঞ গাঁজা সাঁজিয়ে। নিপূণ হাতে পূর্ণ মনযোগ দিয়ে সে গাঁজার আগাছা-ছোট ছোট ডালপালা, ফুল বেছে ফেলে দেয়। তারপর যত্ন নিয়ে একেকটি স্টিক বানায়। ও এমন দরদ দিয়ে এই কাজটি করে দেখে মনে হয় যেন, এই কাজটি করতেই ওর জন্ম হয়েছে!
পারু আর শিবে এখন হাতে হাতে ফিরছে। শালিক্যার কথার তুবড়ি ছুটছে। ফরিদ চুপ হয়ে গেছে, ওদের ভাষায় ট্যাবা খেয়ে গেছে। খাওয়ার পর ওর এমনই হয়। মারিয়া হামিদের দিয়ে যাওয়া কেক খাচ্ছে আর বারবার দেবজিতের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
ওদের পৃথিবীটা এখন অন্যরকম। কাউকে পরোয়া করার সময় নেই। সূর্যটা পশ্চিমে বেশ হেলেছে। টিটু আর ফরিদের পিঠে রোদ পড়েছে। পড়ুক, রোদকে পড়োয়া করার সময়ও এখন ওদের নেই। আবার ঘুণট ঝাঁপ থেকে কাঠের গুড়ো পড়ছে। বাদামী রঙের মিহি গুড়ো। সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। মধুখা গিটারে ঝঙ্কার তুলে লালনের মোলায়েম সুরে ধাতব পিটিয়ে গাইছে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না...।’ তার সাথে কন্ঠ মিলিয়েছে টিটু। হাসান দোকানের মেঝেতে আঙুলে তাল ঠুকছে। শালিক্যা গাইতে না পারলেও মাথা দুলিয়ে চলছে অবিরাম। দেবজিতের মুখ নিশ্রিত শিবের ধোঁয়া রোদ্দুরে মিশে যেন কৈলাশে ফিরে যাচ্ছে। চারিদিকে ঝলমলে রোদ্দুর ঢেউ খেলছে। আজকের রোদ্দুরটাও যেন কেমন বাদামী, ঘুণট রোদ্দুর!

 

ঢাকা।
অক্টোবর, ২০১৩

 

 


০ Likes ১৩ Comments ০ Share ৪৩০ Views

Comments (13)

  • - সনাতন পাঠক

    সুন্দর লিখেছেন।

    • - চারু মান্নান

      অনেক অনেক ধন্যবাদ,,,,,

    - গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা

    চমৎকার লিখেছেন।

    • - চারু মান্নান

      অনেক অনেক ধন্যবাদ,,,,,

    - ঘাস ফুল

    কবিতা অনেক ভাল লাগলো মান্নান ভাই। হেমন্ত শুভেচ্ছা রইলো। 

    • - চারু মান্নান

      অনেক অনেক ধন্যবাদ,,,,,

    Load more comments...