শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনকে ছিলেন স্বাধীনচেতা এক নারী। পাকিস্তান আমলের একজন নির্ভিক কলম সৈনিক । যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা করেছেন।
শৈশব : ৩১ মার্চ, ১৯৩১ সালে ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মো: আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায় । যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পরতেন তখন থেকেই তিনি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে গল্প ও কবিতা লিখা শুরু করেন । গ্রামীণ কুসংস্কারের মারপ্যাঁচে তাঁর পড়ালেখার সাময়িক ইতি ঘটে তখন । মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর অমতে তখনকার প্রথামত বিয়ে দেয়া হয় । তিনি ঐ বয়সে স্বামীর সাথে থাকার কথা ভাবতে পারেন নি । ১০ বছর টিকেছিল সে বিয়ে । পরবর্তীতে তিনি আবার পড়ালেখা শুরু করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মেট্রিকুলেশনে কৃতকার্য হন নি ।
কর্মজীবন : ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকুরি নেন । পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন । তিনি পরবর্তীতে একজন রাজনৈতিক এর সাথে সংসার শুরু করেন । তিনি ললনা পত্রিকায় কাজ করতেন বিজ্ঞাপন বিভাগে ৷ বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলা সব কাজ একাই করতেন৷ পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না৷ ললনায় কাজ করতে করতে ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৬৯ বের করেন শিলালিপি নামে একটি পত্রিকা ৷ নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন ৷ শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মত ৷ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সকলেরই নজর কাড়লো ৷ স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি৷ এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি ৷
মুক্তিযুদ্ধে অবদান : ১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ৷ জাতির ক্রান্তিকাল৷ নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে৷ ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন '৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে৷ শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে আর সভায়ও৷ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি৷ এরই মধ্যে শুরু হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন৷ তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন৷ খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন৷ শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন৷ এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ৷ চারিদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ৷ চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু৷ এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ শিলালিপির উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ৷ হাসেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার৷ পরে অবশ্য প্রকাশের অনুমতি মিললো তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে৷ সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তাঁর ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন৷ কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান৷ যেটাতে ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা৷ তাই কাল হলো৷ শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন৷
যেভাবে হারালেন : ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল৷ দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি৷ বেশ কিছু অঞ্চল ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে৷ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়ীতে থাকতো তিনজন মানুষ- তার পুত্র সুমন, মা আর তার ভাই জনাব উজির ৷ সেদিন শীতের সকালে তারা সকলেই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন সেলিনা পারভীন ছাদে একটা চেয়ার টেনে একটি লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ ৷ রাস্তায় মিলিটারি৷ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে৷ হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো ৷ সুমনদের বাড়ীর উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে E.P.R.TC-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো ৷ সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু লোক৷ তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা৷ সুমনদের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা ৷ সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন৷ লোকগুলো তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়৷ এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে ধরে নিয়ে যায় ৷ ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে৷ খুব শীতকাতুড়ে সেলিনার পায়ে তখনও পড়া ছিল সাদা মোজা । এটি দেখেই তাঁকে সনাক্ত করা হয় । ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে৷ ১৮ ডিসেম্বরেই তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়৷
শহীদ বুদ্ধিজীবি সেলিনা পারভীন স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত হওয়া আমার একটি কবিতা:
ঘুমিয়ে গেছে যে তারাটি
ওই তো পড়ে আছে লাশের স্তুপে, হারিয়ে যাওয়া আলো,
সাদা মোজায় আবৃত পা দুটো ভেসে আছে সাদা পদ্মের মতো।
এখনো শীতে কুঁকড়ে আছে সে দেহ,
গুলি আর বেয়নেটে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত যেন!
আর কোনদিন জেগে উঠবে না আমাদের প্রিয় সেলিনা
ঘুমিয়ে গেছে, পাখির মতো।
ঘুমিয়ে গেছে একসময়ের
উদাত্ত কণ্ঠ!
যে কণ্ঠ মুক্তির আন্দোলনে একদিন গর্জে উঠেছিলো।
যে হাতের অনবদ্য সৃষ্টি “শিলালিপিতে” গুনীজনের বৃষ্টি ঝড়েছিল
যে হাত- হতে একদিন শত মুক্তিযোদ্ধা অকপটে সাহায্য নিয়েছিল।
সে হাত আর নড়ে উঠবেনা কখনো;
সে হাত মিছিলে উচিয়ে উঠবেনা আর,
ঘুমিয়ে গেছে সেই সেলিনা,
ঘুমিয়ে গেছে সেই কণ্ঠ; সেই জলন্ত প্রদীপ,
যে প্রদীপ একসময় আলো ছড়িয়েছিল বাংলার আকাশে।
কল্যাণ নগরের সেই স্বাধীনচেতা নারী,
জীবন সংগ্রামের এক জীবন্ত প্রতীক যেন।
উনসত্তুরের গনঅভূত্থানে সন্তানের হাত ধরে যে নারীর কন্ঠে
বারুদ ঝরেছিলো;
সে ছিল স্বাধীন স্বপ্ন দেখা বিভোর এক নারী,
যে কিনা দেশের তরে অকাতরে দিয়ে গেল প্রাণ,
যার স্বপ্ন আর ফুল হলোনা, হলো বলিদান।
মৃত্যুর আকাশে, তুমি ভালো থেকো সেলিনা!
ক্ষমা করো আমাদের। ফেরাতে পারিনি তোমায় মৃত্যু থেকে;
ক্ষমা করো তুমি,
আজ শুধু জানাই অধোবদনে
বাঙালী তোমায় চিরকাল রাখবে স্মরণে॥