Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মেঘ ভেসে যায় মেঘের দেশে


কুম্ভকর্ণের ঘুম নাকি ভাঙতো ছয় মাস পর। আমি আট মাস আগে একবার গিয়েছিলাম নীলগিরি। নীলগিরি যাওয়ার সঙ্গে কুম্ভকর্ণের কোন সম্পর্ক নেই, তবে লেখার সঙ্গে আছে। ঘুরে আসার আট মাস পর আমি লিখছি আমার দেশের মাটি থেকে ২২০০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ের কথা, সবুজ প্রকৃতি, মেঘ, মাটি ও মহাশূন্যতা যেখানে মিলিত হয়েছে। একজন মানুষের সাধারণ উচ্চতা ৬ ফুটের নিচে। যদি ৬ ফুট উচ্চতাও ধরি, তবে ৩৩৬ জন লোক যদি একজন অন্যজনের মাথার ওপর দাঁড়ায় তবে এ পাহাড়ের সমান উঁচু হতে পারবে। আর যদি কিলোমিটারে গুনি বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার উঁচু। সোজা রাস্তায় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে গেলে এক ঘণ্টার চেয়ে একটু কম সময়ের পথ। কিন্তু আপনি তো যাবেন উচ্চতায়, সময় একটু বেশি তো লাগবেই। মেঘের এ রাজ্যে যারা ভ্রমণ করেছেন, দেখতে গিয়েছেন, নীলগিরিতে যারা ঘুরতে গিয়েছেন, তারা জানেন, নীলগিরি পাহাড়টি পাহারা দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ রিসোর্টের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তারাই পালন করছেন। আমি, আপনি, আমরা সাধারণ মানুষ যখন নীলগিরি ঘুরতে যাব, ঘুরতে পারব কিছু সময়ের জন্য। মেঘের দেশে রাতে যদি থাকতে চান, ডিসির অনুমতি নিয়ে যেতে হবে আগে থেকেই। আর প্রতি রাতের জন্য গুনতে হবে সাত-আট হাজার টাকা। নীলগিরিতে থাকার রুম বা কটেজের আকার-আকৃতি কেমন, ভেতরের সৌন্দর্য কেমন? তা দেখা হয়নি। তবে বাইরে থেকে রুমগুলোকে বেশ সুন্দর ও পরিপাটি মনে হয়েছে। ছোটবেলায় যারা গ্রামে বাস করেছেন, মেঘে বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস যাদের আছে, তারাও নীলগিরিতে গিয়ে অন্যরকম আনন্দ পাবেন, কারণ আমাদের মাটিতে বৃষ্টি পড়ে উপর থেকে। বৃষ্টি পড়ে মাথার ওপর, ছাতার ওপর। বৃষ্টি পড়ে হাতে ও শরীরে। আর নীলগিরিতে বৃষ্টি কোথাও পড়ে না, মেঘ ভাসে। আপনি যখন হাঁটবেন, চলবেন, মেঘের জলে শরীর ভিজে যাবে। আপনি দেখবেন মেঘ ভেসে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মেঘ ভেসে যাচ্ছে সবুজ পাহাড়ের শরীরের ওপর দিয়ে। আর আপনারা গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস। তার সঙ্গে সাদা মেঘ। আর এ মেঘেই আপনার শরীর ভিজে যাবে, ভিজে যাবে মনও। আরও একটি মজার বিষয় ঘটবে এখানে। আপনি পাহাড়ের ওপর থেকে তাকিয়ে দেখবেন, আপনার চারপাশে নিচে আরও অনেক পাহাড়ে ভাসছে মেঘ। তার মানে অনেকগুলো পাহাড়ের ওপরের পাহাড় হচ্ছে নীলগিরি। ছবি তোলার জন্য যদি ক্যামেরা নিয়ে যান, সঙ্গে একটি ছাতা নেয়া আবশ্যক। কারণ মেঘের জলে আপনার দামি ক্যামেরার লেন্স ভিজবেই ভিজবে। যদি ছাতা না ধরেন। যার ছবি তুলতে চাইবেন, সেই বলবে, ছাতা ধর, ছাতা ধর, ছাতা ধরহে...। আর যদি ছাতা না থাকে? নিজের হাতের রুমাল, গায়ের জামা, কিংবা ওড়না, ক্যাপ দিয়ে রক্ষা করতে হবে ক্যামেরাটি। পাহাড়ে পাহাড়ে যারা চড়ে বেড়ান, তারা অন্য পাহাড়গুলো থেকে আলাদা করতে পারবেন নীলগিরিকে। আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হচ্ছে জানালার ফাঁক দিয়ে প্রকৃতি দেখার মতো। খুব বেশি পার্থক্য করতে পারব না, তবে এটুকু বলতে পারি, আমার দেখা অন্য পাহাড়গুলোর মাথা রুক্ষ, শুষ্ক সবুজ। যদিও ওসব পাহাড়ের গা চুয়ে জল পড়ে, পাতা নড়ে। আর নীলগিরির মাথা জলে চুবচুব, তেলতেলে, সবুজ তো বটেই। সারাক্ষণ মেঘ যদি তার গায়ের ওপর দিয়ে ভেসে যায়, গা তো ভেজা থাকবেই।  বর্ষাকালে আমরা গিয়েছিলাম নীলগিরি। স্বাভাবিকভাবেই মেঘ ছিল বেশি। তখনই ভেবেছিলাম একবার শীতকালে যাব। দেখব শীতে নীলগিরির শরীর কেমন ভেজা থাকে? কিংবা চৈত্র মাসে। সারা দেশ যখন জলের অভাবে ফেটে চৌচির, তখন নীলগিরি পাহারের চূড়ায় মেঘ কতটুকু ভেজাতে পারে। নীলগিরির প্রকৃতি প্রতিবার আমাদের সামনে কি নতুন রূপে নতুন সাজে ধরা দেবে? নাকি আমাদের এবারের দেখা নীলগিরিটির মতোই থাকে?  নীলগিরির চূড়ার কথা বললাম এতক্ষণ। সে চূড়ায় আরোহণের কথা বলা হয়নি। বান্দরবান থেকে আমরা ছয়জন সাড়ে তিন হাজার টাকায় ৮ সিটের একটি গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিয়েছিলাম চূড়ার উদ্দেশ্যে। চূড়া মানে তো চূড়া। গাড়ি ক্রমশ উঠতে থাকল উপরের দিকে। রাস্তায় গাড়ি সাধারণত চলে। নীলগিরির রাস্তায় গাড়ি চলে বলা বোধহয় ঠিক হবে না, গাড়ি ওঠে, ক্রমশ ওঠে, ওপরের দিকে। আঁকাবাঁকা রাস্তা, ক্রমশ উপরের দিকে চলে, মাঝে মাঝে নিচের দিকে পতিত হয়, তুলনামূলক বিবেচনায় পতিত হওয়ার চেয়ে ওপরে ওঠার পথ বেশি। বর্ষাকাল হওয়ায় সারাক্ষণ বৃষ্টি, কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টি, গাড়ি চড়ে উপরে উঠার গল্পবাদে আর কোন গল্প নেই। তবে আপনি যদি গাড়ির জানালা দিয়ে চারপাশে তাকান, প্রকৃতির মতোই বিস্ময় আপনাকে অভিভূত করবে। হঠাৎ মনে হবে জনমানবহীন পথ। চারপাশে সবুজ প্রকৃতি। আবার  কিছুক্ষণ পরই আপনার চোখে পড়বে নাগরিক বিলাসিতাবিবর্জিত কয়েকজন মানুষÑ শিশু, নারী, পুরুষ। আবার মনে হবে কোথাও কেউ নেই...। কিছুক্ষণ পর দেখবেন রাস্তার একপাশে বিশাল উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন কয়েকজন মারমা কর্মজীবী। কর্মজীবীদের কাজের মধ্যেÑ কেউ আনারসের ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়ে আসছে, কেউ কাঁচা-পাকা পেঁপে ও কলার ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়ে আসছে, কেউ নিয়ে আসছে কাঠ মানে লাকড়ি, লাকড়ির বোঝা। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এসব দৃশ্য। কত সহজ-সরল পাহাড়ের মানুষ।
পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে দেখে কিন্তু মনে হয় না, এরা বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। সাপের লেজে পা না দিলে নাকি সাপও কামড় দেয় না। আমাদের গাড়িতে বাজছে গান। আমরা মুগ্ধ, অভিভূত চারপাশের দৃশ্য দেখে। গান আমাদের মুগ্ধতার পাতে ঘি ঢেলে দিল। তার সুঘ্রাণ নিতে নিতে আমরা এগিয়ে চললাম পাহাড়ের চূড়ার পথে। গন্তব্য নীলগিরি। পায়ে হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার গল্প ছিল আগে। মানুষের উঁচুতে উঠার যত রেকর্ড আছে, তা ঘাঁটলে, আমাদের সারা জীবন ব্যয় হবে, তাও তার ইতিহাস শেষ হবে না। সম্প্রতি মুসা ইব্রাহীমরা বেশ আলোড়ন তুলছেন উঁচুতে ওঠে। কালিদাস তো এ নস্যি মেঘকে দূত বানিয়ে ছেড়েছেন। মহামনীষীদের মধ্যে ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রতি রাতে, প্রতি ভোরে প্রার্থনা করতেন তিনি, তবে তা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কিংবা মেঘের কাছাকাছি মাদুর পেতে বসে নয়, লোকালয়ে বসে। সে জন্য আমরা রামায়ণ মহাভারতে পাই পাহাড়-পর্বতের কথা আর রবীন্দ্রনাথের কাছে জাহাজ ভ্রমণের গল্প। সাধারণ মানুষ জাহাজে ভ্রমণ করতেন তখন, পাহড়ের চূড়ার উঠতেন না তেমন। যদিও ইতিহাস বলে রবীন্দ্রনাথ জšে§র প্রায় ৪০ বছর আগে ১৮২৪ সালের বার্মা ব্রিটিশ যুদ্ধে পরাজয়ের পর আরাকানিরা বান্দরবান এলাকায় অন্যতম প্রধান অভিবাসী উপজাতি হিসেবে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ পাহাড় নিয়ে লেখেননি, সাধারণ মানুষ তখনও বসতি স্থাপন করেননি পাহাড়ের বাঁকে! এটাই কি কারণ! সঠিক উত্তর দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথের যোগ্য শিষ্য ক্ষিতিমোহন সেন। তিনিও নেই। আমরা সাধারণ মানুষ। অন্যের শ্রমে গড়া পৃথিবীতে নিজেরা কোন শ্রম দিতে রাজি নই। ভেবে সময় নষ্ট করতেও চাই না, আনন্দ উপভোগ করতে চাই শতভাগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ নীলগিরিতে এলে হয়তো প্রকৃতি সপ্রাণে জেগে উঠত কবিতায়। আমরা ভোগে বিশ্বাসী। নীলগিরি গিয়ে যে নির্মল আনন্দ উপভোগ করেছিলাম, আট মাস পরও সে আনন্দ মনে ধরে রেখেছি। কিংবা বলা যায়, সে আনন্দরস এতই তীব্র ছিল যে, তার কিছুটা রেশ আজও মনে রয়ে গেছে।

ফয়েজ রেজা
কুম্ভকর্ণের ঘুম নাকি ভাঙতো ছয় মাস পর। আমি আট মাস আগে একবার গিয়েছিলাম নীলগিরি। নীলগিরি যাওয়ার সঙ্গে কুম্ভকর্ণের কোন সম্পর্ক নেই, তবে লেখার সঙ্গে আছে। ঘুরে আসার আট মাস পর আমি লিখছি আমার দেশের মাটি থেকে ২২০০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ের কথা, সবুজ প্রকৃতি, মেঘ, মাটি ও মহাশূন্যতা যেখানে মিলিত হয়েছে। একজন মানুষের সাধারণ উচ্চতা ৬ ফুটের নিচে। যদি ৬ ফুট উচ্চতাও ধরি, তবে ৩৩৬ জন লোক যদি একজন অন্যজনের মাথার ওপর দাঁড়ায় তবে এ পাহাড়ের সমান উঁচু হতে পারবে। আর যদি কিলোমিটারে গুনি বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার উঁচু। সোজা রাস্তায় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে গেলে এক ঘণ্টার চেয়ে একটু কম সময়ের পথ। কিন্তু আপনি তো যাবেন উচ্চতায়, সময় একটু বেশি তো লাগবেই। মেঘের এ রাজ্যে যারা ভ্রমণ করেছেন, দেখতে গিয়েছেন, নীলগিরিতে যারা ঘুরতে গিয়েছেন, তারা জানেন, নীলগিরি পাহাড়টি পাহারা দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ রিসোর্টের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তারাই পালন করছেন। আমি, আপনি, আমরা সাধারণ মানুষ যখন নীলগিরি ঘুরতে যাব, ঘুরতে পারব কিছু সময়ের জন্য। মেঘের দেশে রাতে যদি থাকতে চান, ডিসির অনুমতি নিয়ে যেতে হবে আগে থেকেই। আর প্রতি রাতের জন্য গুনতে হবে সাত-আট হাজার টাকা। নীলগিরিতে থাকার রুম বা কটেজের আকার-আকৃতি কেমন, ভেতরের সৌন্দর্য কেমন? তা দেখা হয়নি। তবে বাইরে থেকে রুমগুলোকে বেশ সুন্দর ও পরিপাটি মনে হয়েছে। ছোটবেলায় যারা গ্রামে বাস করেছেন, মেঘে বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস যাদের আছে, তারাও নীলগিরিতে গিয়ে অন্যরকম আনন্দ পাবেন, কারণ আমাদের মাটিতে বৃষ্টি পড়ে উপর থেকে। বৃষ্টি পড়ে মাথার ওপর, ছাতার ওপর। বৃষ্টি পড়ে হাতে ও শরীরে। আর নীলগিরিতে বৃষ্টি কোথাও পড়ে না, মেঘ ভাসে। আপনি যখন হাঁটবেন, চলবেন, মেঘের জলে শরীর ভিজে যাবে। আপনি দেখবেন মেঘ ভেসে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মেঘ ভেসে যাচ্ছে সবুজ পাহাড়ের শরীরের ওপর দিয়ে। আর আপনারা গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস। তার সঙ্গে সাদা মেঘ। আর এ মেঘেই আপনার শরীর ভিজে যাবে, ভিজে যাবে মনও। আরও একটি মজার বিষয় ঘটবে এখানে। আপনি পাহাড়ের ওপর থেকে তাকিয়ে দেখবেন, আপনার চারপাশে নিচে আরও অনেক পাহাড়ে ভাসছে মেঘ। তার মানে অনেকগুলো পাহাড়ের ওপরের পাহাড় হচ্ছে নীলগিরি। ছবি তোলার জন্য যদি ক্যামেরা নিয়ে যান, সঙ্গে একটি ছাতা নেয়া আবশ্যক। কারণ মেঘের জলে আপনার দামি ক্যামেরার লেন্স ভিজবেই ভিজবে। যদি ছাতা না ধরেন। যার ছবি তুলতে চাইবেন, সেই বলবে, ছাতা ধর, ছাতা ধর, ছাতা ধরহে...। আর যদি ছাতা না থাকে? নিজের হাতের রুমাল, গায়ের জামা, কিংবা ওড়না, ক্যাপ দিয়ে রক্ষা করতে হবে ক্যামেরাটি। পাহাড়ে পাহাড়ে যারা চড়ে বেড়ান, তারা অন্য পাহাড়গুলো থেকে আলাদা করতে পারবেন নীলগিরিকে। আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হচ্ছে জানালার ফাঁক দিয়ে প্রকৃতি দেখার মতো। খুব বেশি পার্থক্য করতে পারব না, তবে এটুকু বলতে পারি, আমার দেখা অন্য পাহাড়গুলোর মাথা রুক্ষ, শুষ্ক সবুজ। যদিও ওসব পাহাড়ের গা চুয়ে জল পড়ে, পাতা নড়ে। আর নীলগিরির মাথা জলে চুবচুব, তেলতেলে, সবুজ তো বটেই। সারাক্ষণ মেঘ যদি তার গায়ের ওপর দিয়ে ভেসে যায়, গা তো ভেজা থাকবেই।  বর্ষাকালে আমরা গিয়েছিলাম নীলগিরি। স্বাভাবিকভাবেই মেঘ ছিল বেশি। তখনই ভেবেছিলাম একবার শীতকালে যাব। দেখব শীতে নীলগিরির শরীর কেমন ভেজা থাকে? কিংবা চৈত্র মাসে। সারা দেশ যখন জলের অভাবে ফেটে চৌচির, তখন নীলগিরি পাহারের চূড়ায় মেঘ কতটুকু ভেজাতে পারে। নীলগিরির প্রকৃতি প্রতিবার আমাদের সামনে কি নতুন রূপে নতুন সাজে ধরা দেবে? নাকি আমাদের এবারের দেখা নীলগিরিটির মতোই থাকে?  নীলগিরির চূড়ার কথা বললাম এতক্ষণ। সে চূড়ায় আরোহণের কথা বলা হয়নি। বান্দরবান থেকে আমরা ছয়জন সাড়ে তিন হাজার টাকায় ৮ সিটের একটি গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিয়েছিলাম চূড়ার উদ্দেশ্যে। চূড়া মানে তো চূড়া। গাড়ি ক্রমশ উঠতে থাকল উপরের দিকে। রাস্তায় গাড়ি সাধারণত চলে। নীলগিরির রাস্তায় গাড়ি চলে বলা বোধহয় ঠিক হবে না, গাড়ি ওঠে, ক্রমশ ওঠে, ওপরের দিকে। আঁকাবাঁকা রাস্তা, ক্রমশ উপরের দিকে চলে, মাঝে মাঝে নিচের দিকে পতিত হয়, তুলনামূলক বিবেচনায় পতিত হওয়ার চেয়ে ওপরে ওঠার পথ বেশি। বর্ষাকাল হওয়ায় সারাক্ষণ বৃষ্টি, কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টি, গাড়ি চড়ে উপরে উঠার গল্পবাদে আর কোন গল্প নেই। তবে আপনি যদি গাড়ির জানালা দিয়ে চারপাশে তাকান, প্রকৃতির মতোই বিস্ময় আপনাকে অভিভূত করবে। হঠাৎ মনে হবে জনমানবহীন পথ। চারপাশে সবুজ প্রকৃতি। আবার  কিছুক্ষণ পরই আপনার চোখে পড়বে নাগরিক বিলাসিতাবিবর্জিত কয়েকজন মানুষÑ শিশু, নারী, পুরুষ। আবার মনে হবে কোথাও কেউ নেই...। কিছুক্ষণ পর দেখবেন রাস্তার একপাশে বিশাল উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন কয়েকজন মারমা কর্মজীবী। কর্মজীবীদের কাজের মধ্যেÑ কেউ আনারসের ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়ে আসছে, কেউ কাঁচা-পাকা পেঁপে ও কলার ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়ে আসছে, কেউ নিয়ে আসছে কাঠ মানে লাকড়ি, লাকড়ির বোঝা। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এসব দৃশ্য। কত সহজ-সরল পাহাড়ের মানুষ।
পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে দেখে কিন্তু মনে হয় না, এরা বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। সাপের লেজে পা না দিলে নাকি সাপও কামড় দেয় না। আমাদের গাড়িতে বাজছে গান। আমরা মুগ্ধ, অভিভূত চারপাশের দৃশ্য দেখে। গান আমাদের মুগ্ধতার পাতে ঘি ঢেলে দিল। তার সুঘ্রাণ নিতে নিতে আমরা এগিয়ে চললাম পাহাড়ের চূড়ার পথে। গন্তব্য নীলগিরি। পায়ে হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার গল্প ছিল আগে। মানুষের উঁচুতে উঠার যত রেকর্ড আছে, তা ঘাঁটলে, আমাদের সারা জীবন ব্যয় হবে, তাও তার ইতিহাস শেষ হবে না। সম্প্রতি মুসা ইব্রাহীমরা বেশ আলোড়ন তুলছেন উঁচুতে ওঠে। কালিদাস তো এ নস্যি মেঘকে দূত বানিয়ে ছেড়েছেন। মহামনীষীদের মধ্যে ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রতি রাতে, প্রতি ভোরে প্রার্থনা করতেন তিনি, তবে তা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কিংবা মেঘের কাছাকাছি মাদুর পেতে বসে নয়, লোকালয়ে বসে। সে জন্য আমরা রামায়ণ মহাভারতে পাই পাহাড়-পর্বতের কথা আর রবীন্দ্রনাথের কাছে জাহাজ ভ্রমণের গল্প। সাধারণ মানুষ জাহাজে ভ্রমণ করতেন তখন, পাহড়ের চূড়ার উঠতেন না তেমন। যদিও ইতিহাস বলে রবীন্দ্রনাথ জšে§র প্রায় ৪০ বছর আগে ১৮২৪ সালের বার্মা ব্রিটিশ যুদ্ধে পরাজয়ের পর আরাকানিরা বান্দরবান এলাকায় অন্যতম প্রধান অভিবাসী উপজাতি হিসেবে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ পাহাড় নিয়ে লেখেননি, সাধারণ মানুষ তখনও বসতি স্থাপন করেননি পাহাড়ের বাঁকে! এটাই কি কারণ! সঠিক উত্তর দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথের যোগ্য শিষ্য ক্ষিতিমোহন সেন। তিনিও নেই। আমরা সাধারণ মানুষ। অন্যের শ্রমে গড়া পৃথিবীতে নিজেরা কোন শ্রম দিতে রাজি নই। ভেবে সময় নষ্ট করতেও চাই না, আনন্দ উপভোগ করতে চাই শতভাগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ নীলগিরিতে এলে হয়তো প্রকৃতি সপ্রাণে জেগে উঠত কবিতায়। আমরা ভোগে বিশ্বাসী। নীলগিরি গিয়ে যে নির্মল আনন্দ উপভোগ করেছিলাম, আট মাস পরও সে আনন্দ মনে ধরে রেখেছি। কিংবা বলা যায়, সে আনন্দরস এতই তীব্র ছিল যে, তার কিছুটা রেশ আজও মনে রয়ে গেছে। - See more at: http://touristguide24.com/details.php?id=2211#sthash.QNnQlKW0.dpuf
০ Likes ০ Comments ০ Share ৪৮১ Views

Comments (0)

  • - নুসরাত জাহান আজমী

    কি সুন্দর তাই না??? emoticons