১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার দিবস । ১৭ এপ্রিল-মুজিবনগর সরকার-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত সময়কে একটি Historical Entity গণ্য করলে তার মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদ । ২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পরে নিরীহ বাঙ্গালীর উপর ।শেখ মুজিবর রহমান গ্রেপ্তার হলে সমগ্র নিপীড়িত জাতি হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন । এই ক্লান্তিকালে জাতিকে রক্ষার জন্য যিনি হাল ধরেন তিনি তাজউদ্দীন আহমদ । একটি লুঙ্গি এবং ফতুয়া পরা অবস্থায় কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে ব্যারিস্টার আমীর - ঊল ইসলামের সাথে তাৎক্ষণিক তিনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেন । যাবার সময় পরিবার পরিজনকে কিছুই বলে যেতে পারেন নি । তাই পরবর্তীতে একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন সহধর্মিণী জোহরা তাজউদ্দীনের নিকট । এতে লিখা ছিল, “খুব তাড়াতাড়ি করে চলে আসার সময় তোমাদের কাউকে কিছু বলে আসতে পারিনি । আমি চলে গেলাম । তোমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও । কবে দেখা হবে জানি না - - - মুক্তির পর”। চিরকুটের নিচে লিখা ছিল “দোলন চাপা” (ছদ্মনাম)। [সুত্রঃ জোহরা তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকার, তাজউদ্দীন আহমদঃ নিঃসঙ্গ সারথি]
তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষনিক দুটি সিদ্ধান্ত নিলেন । (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসাবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া [সুত্রঃ মূলধারা ৭১] । ৩ এপ্রিল রাত ১০ টায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদ সাক্ষাৎ করেন । তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নিকট মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার জন্য ভারতে আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এবং অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আহ্বান জানান । এছাড়াও দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরণার্থী ভারতে ঠাই নেবে, তাদের আশ্রয় ও আহারের ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানান । তিনি বলেন এই মুক্তির লড়াইয়ে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে সহায়তা কামনা করছেন অপর স্বাধীন রাষ্ট্রের। এই স্বাধীনতার যুদ্ধ একান্ত বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং ভারত যেন এই যুদ্ধে না জড়ায়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন । ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাফল্যজনক সাক্ষাতের আলোকে ভারতসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । ৩০ মার্চ, ১৯৭১, কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী টুঙ্গি নামের একটি জায়গায় সেতুর নীচে আত্মগোপন কারী তাজউদ্দীন আহমদ ক্লান্ত দেহ এলিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি স্বাধীন সরকারের অধীনে একতাবদ্ধ করে দেশ মুক্তির জন্য যে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা বাস্তব রূপ লাভ করে।
অবশেষে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যারা ছায়া সরকারের কাজ করেছিল; তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে । ১০ এপ্রিল শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় । সেদিনই বাংলাদেশ সময় রাত ১০ টায় আকাশবানী কলকাতা রেডিও থেকে তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন । তাঁর এই ভাষণে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতভয় সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের কথা । পাক হানাদারদের রুখে দেয়ার জন্য সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন অংশে ইতিমধ্যে পাক বাহিনীকে পরাস্ত করার সংবাদ ফুটে উঠেছিল তাঁর এই ভাষণে । স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সেবায় আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আহ্বান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ইনজিনিয়ার, সংবাদপত্র সেবী, বেতার শিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের, তারা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন । আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ-তার জন্য বহু পারদর্শীর প্রয়োজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ পাবেন”। তাজউদ্দীন আহমদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই যুদ্ধে বাঙালি জাতিই বিজয়ী হবে । তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, “এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারণ নেই । আপনারা ইতিমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে । তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমর সজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নীচে স্তব্ধ করে দিবে বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা । আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙ্গালিকে তারা বুটের নীচে নিষ্পেষণ করবে । কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে । আমরা তাদের মারমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাদেরকে যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে । তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ, ঢাকার সাথে আজ তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন । উড়োজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না । ওদের জ্বালানি সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে । ইয়াহিয়ার উড়োজাহাজ আর বেশি দিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না । বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত । বাংলাদেশের আকাশে শীঘ্রই ঝড়ের মাতন শুরু হচ্ছে । ওরা জানে ওরা হানাদার । ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভ্রুকুটি ও ঘৃণা । ওরা ভীত, - ওরা সন্ত্রস্ত, - মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরোয়ানা নিয়ে হাজির । তাই ওরা উন্মাদের মত ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে”। তাজউদ্দীন আহমদ আরোও বলেন, “যারা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাদের জন্য রইল আমাদের আমন্ত্রণ । যাদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আশা সম্ভব নয় তাদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাই বোনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে । শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না । ইনশাআল্লাহ্, জয় আমাদের সুনিশ্চিত”। [সুত্রঃ ওয়েবসাইড-তাজউদ্দীন আহমদ ডট কম]
১৭ এপ্রিল নবগঠিত মন্ত্রীসভার প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদনাথতলায়, যার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর । স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর নামকরণ তাজউদ্দীন আহমদেরই করা । শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে । স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য । সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন । দুনিয়ার কোনো জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না । আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এই নতুন জাতিকে । স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে”।
প্রকৃতপক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠনের মাধ্যমেই সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে । ফলে আমরা অর্জন করতে পেরেছি প্রিয় স্বাধীনতা । তাই আজ মুজিবনগর সরকার দিবসে মুজিবনগর সরকারের রূপকার বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ।
শফিক সোহাগ
সভাপতি- বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ
Email: shafiq_shohag@yahoo.com
Comments (0)
এই পর্বে ভালো লাগা রেখে গেলাম।
শুভ সকাল।
অনেক ধন্যবাদ--