Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

৭ বছর আগে

মা’কে নিয়ে ভারত ভ্রমণ (৫ম পর্ব)

২২ এপ্রিল সকালবেলা দিল্লী পৌঁছেই হোটেলে উঠি । কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য দিল্লী শাহী জামে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ।দিল্লী শাহী জামে মসজিদ“দিল্লী জামা মসজিদ” নামে পরিচিত । এটি ভারতের বৃহত্তম মসজিদ। জামা মসজিদের বাস্তবিক নাম হল মসজিদ-ঈ জাহাঁ-নূমা। এটি মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে নির্মিত স্থাপত্যের একটি সেরা নিদর্শন। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর চারুকলা ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সুবিখ্যাত ছিলেন। মসজিদটির মূল পরিকল্পনা এবং নকশা ওস্তাদ খালিল দ্বারা করা হয়েছিল। মসজিদের নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ করতে পাঁচ হাজার শ্রমিকদের টানা ছয় বছর সময় লেগেছিল । নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৬৫০ খ্রীষ্টাব্দে এবং শেষ হয় ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে । জামা মসজিদে একসঙ্গে ২৫০০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারে । নামাজ শেষে মেজু ভাইয়া আমাকে মসজিদের পূর্ব পাশের একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন । সেখানে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় । সবাই মহা মূল্যবান বস্তু এক নজর দেখার অপেক্ষায় । কর্তৃপক্ষ এক এক করে দেখালেন সেখানে সংরক্ষিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর পবিত্র দাড়ি মোবারক, মহানবীর ব্যবহৃত চটি, পাঁথরে মহানবীর পদচিহ্ন এবং হস্ত লিখিত একটি কোরআন শরীফ যা হযরত আলী (রাঃ) কিংবা হযরত হাসান (রাঃ)এর নিজ হস্তে লিখা । এই দু’জনের মধ্যে কার হস্ত লিখা ছিল তা আমি নিশ্চিত হতে পারি নি ।   

 

                                                দিল্লী শাহী জামে মসজিদ (জামা মসজিদ)

বিকেলবেলা মা’কে নিয়ে গেলাম স্যার গঙ্গারাম হসপিটালে । এটি দিল্লীর বিখ্যাত কয়েকটি হসপিটালের মধ্যে একটি । সেখানে মায়ের শারীরিক চেকআপ করিয়ে নিলাম । হসপিটাল থেকে মেজু ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে আমরা চলে আসি হোটেলে । আর পূর্বে মাপ দিয়ে আসা কৃত্রিম হাত সংগ্রহের জন্য মেজু ভাইয়া চলে যান জয়পুর । ফলে পরদিনের তাজমহল ভ্রমণে আমরা মেজু ভাইয়াকে মিস করি । অবশ্য তিনি বহু বছর আগেই তাজমহল পরিদর্শন করেছিলেন ।      
 

২৩ এপ্রিল ভোরবেলা আমরা পূর্বেই বুকিং করা ট্যুরিষ্ট এজেন্টের বাসে করে আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস । দিল্লীর বিভিন্ন স্পট থেকে তারা পূর্বে বুকিং দেয়া পর্যটকদের বাসে তুলে নিলেন । এদের অনেকেই ছিলেন ফরেইনার । বাসে দেয়া হল একজন ভ্রমণ গাইড যিনি সারাদিন আমাদের গাইড করবেন এবং পরিদর্শনের সময় বিভিন্ন পর্যটন স্পট সম্পর্কে বর্ণনা দিবেন । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল গাইড অনবরত কথা বলে চলেছেন হিন্দিতে । যা পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছিলো । আমার পাশে বসা তরুণ ব্রিটিশ দম্পতি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গাইড কি বলছেন । আমি জানালাম আমি নিজেও হিন্দি কম বুঝি । আমি গাইডকে ইংরেজিতে বলার জন্য অনুরোধ করলাম । কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না । সম্ভবত গাইডটি স্বল্প শিক্ষিত ছিলেন । ট্যুরিষ্ট এজেন্টদের এমন আয়োজনে আমরা বিস্মিত হই । তাদের বুঝা উচিত ছিল যে তাদের বেশিরভাগ গ্রাহকই হচ্ছেন ফরেইনার । ফলে ইংরেজিতে পারদর্শী ব্যক্তিকেই গাইড হিসেবে রাখা সমীচীন ছিল ।         

 

                                                               আগ্ৰা ফোৰ্ট প্রবেশ পথ 


আমরা পৌঁছে গেলাম আগ্ৰা ফোৰ্ট বা আগ্ৰার লালকেল্লার সম্মুখে । এটি মোগল স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদৰ্শন। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহ্জাহান ও আওরঙ্গজেবের মতো মহামতি মোঘল সম্রাটগণ এখানে বসবাস করেছেন। এখান থেকেই তারা সমগ্র দেশ শাসন করতেন। সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও টাকশাল ছিলো এখানেই। এটি তাজমহল থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । দুর্গের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য দৰ্শনীয় স্থানসমূহ হল - খাচ মহল, শীশ মহল, মুহাম্মান বুৰ্জ (অষ্টভূজাকৃতির মিনার), দেওয়ান-ই-খাচ, দেওয়ান-ই-আম, মোতি মসজিদ এবং নাগিনা মসজিদ। এই স্থাপনাসমূহে 'তিমুরিদ পারসিক' শিল্পকলা এবং 'ভারতীয় শিল্পকলা'র এক আশ্চৰ্য মিশ্ৰণ পরিলক্ষিত হয় ।

 

                                                        আগ্ৰা ফোর্টের অভ্যন্তরে প্রাসাদ 

আগ্রা ফোৰ্ট পরিদর্শনের সময়ও অন্য আরেকজন গাইড সবাইকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পালন করছেন আর ব্রিফিং করছেন । দুঃখের বিষয় হলো তিনিও ব্রিফিং করছেন হিন্দিতে । ফলে পরিপূর্ণ ভাবে অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । ইতিহাস থেকে জানা যায় এক সময় এটি ছিলো চৌহান রাজপুতদের অধিকৃত ইট-নির্মিত একটি দুর্গ । ১০৮০ খ্রিস্টাব্দে গজনোভিদের বাহিনীর আওতায় চলে আসে এ দুর্গ। সিকান্দার লোদী ছিলেন দিল্লীর প্রথম সুলতান । তিনি দিল্লী থেকে আগ্রা এসে এই ফোর্টে বসবাস করেন। তিনি এখান থেকে দেশ শাসন করায় আগ্রা দেশের দ্বিতীয় রাজধানীর গুরুত্ব লাভ করে। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার লোদী আগ্রা ফোর্টে মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাঁর পুত্র ইব্রাহিম লোদীর অধিকারে এ দুর্গটি ছিলো প্রায় ৯ বছর। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিম লোদী মৃত্যুবরণ করার পর আগ্রা ফোর্ট চলে যায় মোঘলদের অধিকারে।১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন বিলগ্রামে পরাজিত হলে আগ্রা ফোর্ট শেরশাহের অধিকারে চলে যায়।


                                                     আগ্ৰা ফোর্টের অভ্যন্তরে প্রাসাদ 

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথে মোঘলরা চূড়ান্তভাবে আফগানদের পরাজিত করে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে তাদের দেড়শ' বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসন কায়েমের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে। মোঘল সম্রাট আকবর শাসনকালে তিনি আগ্রা ফোর্টের পুনঃ নির্মাণ করেন । ফোর্টের বিশাল সীমানা প্রাচীরের অভ্যন্তর ভাগ ইট দ্বারা নির্মাণ করে এর বহিরাংশে দেয়া হয় লাল বেলে পাথর। চারিদিকে পরিখা এবং বাগান ঘেরা । শত্রুপক্ষ যেন  দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্যে পরিখায় থাকতো কুমিরের মতো হিংস্র জলজ প্রাণী । আমরা ঘুরে ঘুরে আগ্রা ফোর্টের স্থাপনাসমূহ দেখতে লাগলাম । একটি আকর্ষণীয় বিষয় হল, আগ্রা ফোর্টের প্রাসাদের ছাঁদ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম দূরের ঐ তাজমহলটি ।

 

                                   আগ্রা ফোর্টের প্রাসাদের ছাঁদ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দূরের ঐ তাজমহলটি


আগ্রা ফোর্ট এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর গাইড আমাদের নিয়ে এলেন একটি শপিং মলে । আমার বুঝতে দেড়ি হল না যে, এসকল শপিং মলের সাথে ট্যুরিষ্ট এজেন্টদের কমিশন ভিত্তিক চুক্তি আছে । ফলে অযথা পর্যটকদের এখানে নিয়ে এসেছে । এতে আমাদের সময় নষ্ট হচ্ছে । আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বাহিরে এসে বসে থাকি । সেখানে আগে থেকেই বসে ছিলেন ব্রিটিশ ঐ দম্পতি । তাড়াও খুব বিরক্তবোধ করছিলেন । বিরক্তকর সময়টি আমরা গল্প করে কাটিয়ে দিলাম ।       

অতঃপর এসে পৌঁছলাম ইতিহাস সৃষ্টি করা তাজমহলের নিকটে । টিকেট কেটে অভ্যর্থনা ডেস্কে যাওয়ার পর আমাদেরকে এক বোতল করে পানি এবং এক জোড়া ওয়ানটাইম সু কভার দিলো । টিস্যু কাপড়ের তৈরি সু কভার যা জুতার উপরে পরে তাজমহলে প্রবেশ করতে হয় । তাজমহল ময়লা না হয়ার জন্য এটি একটি প্রতিরোধক ব্যবস্থা । টিকেট কাউন্টার থেকে তাজমহলের মূল গেইট বেশ দূরেই । অভ্যন্তরীণ কিছু গাড়ি করে গেইটে যেতে হয় । পানির বোতল, সু  কভার ও অভ্যন্তরীণ গাড়ি সার্ভিস ফরেইনারদের জন্য ফ্রি ।

                                                             তাজমহলে প্রবেশ গেইট 


                                      মা'কে নিয়ে তাজমহলে 

মূল গেইট অতিক্রম করে আরও একটি গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো বিশ্ব আচার্য তাজমহল । ঐতিহাসিক প্রেমের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে । আমরা সকলেই অবগত আছি যে, মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ নামে পরিচিত তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এবং সম্পন্ন হয়েছিল ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে । তাজমহল মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটেছে । যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতির রাজকীয় সমাধীটিই বেশি সমাদৃত, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য।

                                                 সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের সমাধি 

তাজমহলের মূলে হল তার সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি। একটি ধনুক আকৃতির দরজা, উপরে বড় গম্বুজ রয়েছে। সমাধিটি একটি বর্গাকার বেদিকার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভিত্তি কাঠামোটি বিশাল এবং কয়েক কক্ষবিশিষ্ট। প্রধান কক্ষটিতে মমতাজ ও শাহজাহানের স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে, এর এক স্তর নিচেই রয়েছে তাদের কবর । বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে আছে তাজমহল । (চলবে...)  

 

Email: shafiq_shohag@yahoo.com

০ Likes ২ Comments ০ Share ৭২৪ Views