Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

৭ বছর আগে

মা’কে নিয়ে ভারত ভ্রমণ (১ম পর্ব)

“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মা’কে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে

তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে”  

ছোটবেলায় ছড়াটি পড়ে মা’কে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন বুনেছিলাম । আর তাই নিজেই ছড়াটিতে খানিক পরিবর্তন এনেছিলাম এরূপ-

“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মা’কে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে

তুমি যাচ্ছ বিমানে মা চড়ে”

বুনন করা স্বপ্ন সম্প্রতি পূরণ হলো, মা’কে নিয়ে ভারত ভ্রমণ করে এলাম । ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আজমীর শরীফ জেয়ারত, মা’কে ভারতের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো দেখানো এবং মায়ের শারীরিক চেকআপ । মেজু ভাইয়া ইতিপূর্বে ৮ বার ভারত ভ্রমণ করেছেন । পথঘাট সবই তাঁর জানা । তাই তিনিও আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হলেন ।

 

১৫ এপ্রিল ২০১৬ইং । বাংলাদেশ বিমানের সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম শাহ্‌ আমানত বিমানবন্দর থেকে কলকাতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বিমানবন্দরে পৌঁছলাম । কলকাতায় তখন তীব্র তাপদাহ । আমাদের একই বিমানে চট্টগ্রামের পটিয়ার এক দম্পতি তাদের শিশুপুত্রকে নিয়ে আজমীর শরীফ জেয়ারতের উদ্দেশ্যে এসেছেন । তারা পথঘাট কিছুই চিনেন না । তাই আমাদের সঙ্গী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন । আমরা ৬ জন বিমানবন্দর থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট চলে আসি । রবীন্দ্র সরণী লেইনস্থ ‘স্ট্যান্ডার্ড হোটেল’ এ রুম বুকিং দিয়ে পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে আসি । মসজিদটি কলকাতায় ‘বড় মসজিদ’ নামে খ্যাত । ঐ এলাকাটি  মুসলিম ঘনবসতি সম্পন্ন হওয়ায় দুপুরের খাবার, বিকালের নাস্তা ও রাতের খাবারে গরুর মাংস ভোজন বেশ ভালোই হলো । তাছাড়া সেখানে গরুর মাংস খুবই সস্তা । শিক কাবাব মাত্র ১০ রূপি । বিকেলবেলা আমি, মেজু ভাইয়া এবং পটিয়ার রহিম ভাই ট্যাক্সি কার নিয়ে ঘুরতে বের হলাম । সেখানে ট্যাক্সি কারের ভাড়া খুবই কম । চট্টগ্রামে সিএনজি ট্যাক্সিতে উঠানামায় ৮০/১০০ টাকা গুনতে হয় । ঢাকায় তো আরও বেশি । অথচ কলকাতায় ৪০/৫০ রূপি দিয়েও বহুদূর পথ ভ্রমণ করা যায় । তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় কারণ কলকাতার ট্যাক্সি কারের চালকগুলো বেশ চতুর । বাংলাদেশী মানুষ বুঝতে পারলে বেশি ভাড়া হাকিয়ে বসে । আমরা রেলওয়ে ফরেইনার ব্যুরোতে আসি দিল্লীর টিকেট বুকিং দেওয়ার জন্য । পরদিনের টিকেট না পাওয়ায় আমাদেরকে অতিরিক্ত একদিন কলকাতায় অবস্থান করতে হবে ।

 

১৬ এপ্রিল সকালে নাস্তা সেরে আমি মা আর মেজু ভাইয়া বের হলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি জোড়া সাঁকো ঠাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে । হোটেল থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পথ । বাড়ির ফটকে ঢুকতেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট । বর্তমানে বাড়িটি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন । গেইটের ভিতরে ঢুকতেই চোখ জুড়ানো লাল রঙের বিশাল জমিদার বাড়ি । সামনে সবুজ মাঠ । কর্তৃপক্ষ জানালেন বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার নির্ধারিত সময় এখনো হয় নি, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে । আমরা অপেক্ষা করছি; এরই মধ্যে আরও অনেক দর্শনার্থী আসতে শুরু করেছে । আসাম থেকে আসা এক নব দম্পতির সাথে পরিচয় হলো । তারা প্রথমে হিন্দিতে কথা বলায় আমি জানালাম যে, আমি হিন্দি পারি না । তারপর ইংরেজিতে শুরু হল কথোপকথন, জমে উঠে আড্ডা ।

 

আমরা ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করলাম । সমস্ত বাড়ি জুড়ে শুধু রুমের ছড়াছড়ি । প্রতিটি রুমই বেশ পরিচ্ছন্ন । রাখা আছে ঠাকুর পরিবারের ব্যবহৃত নানান জিনিসপত্র । কয়েকটি রুমে ছাঁদের কার্নিশ থেকে ঝুলছে বাঁশের চিকন কাঠির পর্দা । আবার কয়েকটি রুমকে বিভিন্ন দেশের নামকরণে গ্যালারী সাজানো হয়েছে । গ্যালারী গুলোতে রাখা আছে ঐসকল দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণের স্মৃতিময় ছবি ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী । জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হলেন নীলমণি ঠাকুর। তাঁর পুত্রের নাম রামলোচন ঠাকুর । মৃত্যুর আগে ১৮০৭ সালেরামলোচন ঠাকুর তাঁর দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে  তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান। অতঃপর জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ঠাকুর পরিবারের চার পুরুষের জীবন কাটে । দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এদের মধ্যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু এই বাড়িতেই হয়েছে । রবীন্দ্রনাথের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের বেশির ভাগ সময় এখানেই কেটেছে । তাঁর পায়ের ধুলো মিশে আছে এই বাড়ির প্রতিটি কক্ষে । শৈশবে বারান্দার রেলিংগুলোকে ছাত্র বানিয়ে বলতেন, “আমি আজ কানাই মাস্টার” ।  

 





বিশাল ঠাকুর বাড়িতে হেঁটে মা খুবই ক্লান্ত; পায়ের ব্যথাটাও বেড়েছে । মেজু ভাইয়া মা’কে নিয়ে হোটেলে চলে যান । আমি চললাম ভারতীয় সংগ্রহালয়ের (জাদুঘরের) উদ্দেশ্যে । কলকাতার চৌরঙ্গীতে ভারতীয় সংগ্রহালয় অবস্থিত । এটি ভারতের বৃহত্তম জাদুঘর । ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল ১৮১৪ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে । জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর ছিলেন ড্যানিশ বোটানিস্ট ড. নাথানিয়েল ওয়ালিচ । ভারতীয় সংগ্রহালয় মোট ৬ টি বিভাগে সাজানো হয়েছে । নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, প্রাণীতত্ত্ব, উদ্ভিজ্জ ও শিল্পকলা । বিভিন্ন বিভাগে উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে একটি মিশরীয় মমি, হাতি-হরিণের কংকালসহ প্রাগৈতিহাসিক প্রাণিদের ফসিল, বিভিন্ন সময়ের ভারতীয় মুদ্রা, শিল্প সংগ্রহ, দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন সামগ্রী, মানববিবর্তন, ভূতাত্ত্বিক প্রস্তর ।

 

ভারতীয় সংগ্রহালয় পরিদর্শন শেষে এবার চললাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বা ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে । তীব্র তাপদাহে অতিষ্ঠ আমি । কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্রি হয় বিভিন্ন ফলের জুস এবং লাচ্ছি । সবই বিশুদ্ধ, নির্ভেজাল এবং দামেও সস্তা । এসব পান করছি আর ঘুরে বেড়াচ্ছি । ইতিমধ্যে পৌঁছে গেলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বা ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধে । এটি কলকাতায় অবস্থিত রানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ । রানী ভিক্টোরিয়া ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধির অধিকারী ছিলেন। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ একটি জাদুঘর এবং কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ । চতুরপাশে পার্ক স্বরূপ সুরম্য উদ্যান পরিবেষ্টিত শ্বেতপাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ । বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন । সৌধ-সংলগ্ন বাগানটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন লর্ড রেডেসডেল ও স্যার জন প্রেইন । স্মৃতিসৌধের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই বাঁ’পাশে চোখে পড়ে একটি পিয়ানো । এছাড়া সেখানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে কোরআন, পুরাণ, রাজকীয় পোশাক, স্ট্যাচু, তলোয়ার-কামানসহ যুদ্ধের বিভিন্ন সরঞ্জাম । ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৯০৬ সালে। সৌধটির উদ্বোধন হয় ১৯২১ সালে। সৌধের সর্বোচ্চ গম্বুজে বিউগল-ধারিণী বিজয়দূতীর একটি কালো ব্রোঞ্জমূর্তি রয়েছে। বায়ুপ্রবাহ শক্তিশালী হলে বল-বিয়ারিং যুক্ত একটি পাদপীঠের উপর স্থাপিত মূর্তিটি হাওয়ামোরগের কাজ করে।

 

১৭ এপ্রিল ২০১৬ইং । মা এবং মেজু ভাইয়া হোটেলেই ছিলেন । আমি সকালের নাস্তা সেরে একাই রওনা হলাম মান্না দে’র সেই বিখ্যাত কফি হাউজের উদ্দেশ্যে । টানা রিক্সা নিয়ে চলছি আর অপরাধবোধে ভুগছি । আমি বসে আছি এদিকে বৃদ্ধলোকটি আমায় টেনে ঘাম ঝড়াচ্ছেন ! আমি কতটাই না অমানবিক ! এই অমানবিক কাজটি দিব্যি হয়ে চলেছে কলকাতার পথে পথে । আমি টানা রিক্সা থেকে নেমে বৃদ্ধকে টাকা পরিশোধ করে হাঁটতে শুরু করি । অতঃপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে গেলাম কলেজ স্ট্রিট চত্বরে অবস্থিত বিখ্যাত কফি হাউজের সামনে । সাদামাটা সিঁড়ি বেয়ে দো’তলায় কফি হাউজে এসে বসলাম । চারপাশ তাকিয়ে দেখি দেয়ালে সারি সারি সাজানো ভারতবর্ষের বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিত্রকর্ম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাবছি আমি আজ সেই কফি হাউজে বসে আছি যেখানে আড্ডা দিতেন মহাত্মাগান্ধী, নেতাজীসুভাষবসু, কবিগুরুরবীন্দ্রনাথঠাকুর, সত্যজিৎ রায়,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, অমর্ত্য সেনের  মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা ! ক্ষণিকের জন্য মনে হলো তাঁরা সকলে আমার পাশেই আছেন । আরও আছেন মান্না দে, মান্না দে’র সঙ্গী নিখিলেশ , মইদুল, গোয়ানিস ডি সুজা,রমা রায়, অমল এবং সুজাতা । হঠাৎ এই ঘোড়টি ভাঙলো বাংলাদেশ থেকে আসা নূরের ডাকে । পরিচয়ের পর জানতে পারলাম তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন । দুপুরবেলা আমাদের সাথে একই ট্রেনে দিল্লী যাবেন । তিনিও আমার মতই কৌতূহলী হয়ে এখানে এসেছেন । মান্না দে’র সেই কালজয়ী গানের জন্য আমাদের মত অনেকেই কৌতূহলী হয়ে কফি হাউজে আসেন, তবে সাদা শেরওয়ানী ও পাগড়ী পরা বেয়ারাগুলো অতিথি আপ্যায়নে ততটা আন্তরিক নয় । (চলবে...)

 

Email: shafiq_shohag@yahoo.com
০ Likes ০ Comments ০ Share ৬৭৭ Views

Comments (0)

  • - শাহআজিজ

    ধন্যবাদ সহযাত্রী।

    - রুদ্র আমিন

    অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এভাবেই পাশে চাই প্রতিমুহূর্ত।