শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মহিলা যাত্রীর বিরম্বনায়
(দ্বিতীয় পর্ব)
মহিলার হাতের ব্যাগের কারণে হাঁটতে না পারায় তার সাথে সাথে হাটতে গিয়ে আমরও হাঁটার গতি মন্থর। কিছুদুর যেতে না যেতেই আমাদের পিছনের যাত্রী আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেল। আমরা দু’জন ছাড়া রাস্তায় আর কেউ নেই। এ অবস্থায় মহিলা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।
আমি বললাম, দাঁড়ালেন কেন? চলেন।
মহিলা আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ভাই একটা কথা বলবো শুনবেন?
আমার কলিজার ভিতর ধক্ করে উঠল, রাতের এই নির্জনতায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে আবার কি বলবে? ভয়ে ভয়ে বললাম, কি বলবেন?
-- আমার ব্যাগটা একটু নিবেন?
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলার ভঙ্গি দেখে ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু ব্যাগ নেয়ার কথা বলার পরে ভয়ের বদলে কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম, আমার পক্ষে দুইটা ব্যাগ নেওয়া সম্ভব নয়।
মহিলা আমার কথার মাঝে বিরুক্তিভাব বুঝতে পেরে আমতা আমতা করে বলল, না বলছিলাম কি, আপনার ব্যাগটা আমাকে দেন আর আমার ব্যাগটা আপনি নেন।
আমি বললাম, আপনার ব্যাগের ভিতর কি আছে?
-- কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে অনেক কিছু।
-- ব্যাগ কি খুব ভারি?
-- খুব বেশি ভারি নয় তবে আমি মেয়ে মানুষ তো আমার নিতে কষ্ট হচ্ছে।
বললাম, ঠিক আছে দেন। হাতে নিয়ে দেখি ব্যাগের ওজন আধামনের কম নয়। মহিলা আমার পা চেপে ধরার কারণ এবার বুঝতে পারলাম। কুলি না পেয়ে ব্যাগের ওজনের কারণেই আমার পা চেপে ধরে আমাকে সাথে থাকতে বাধ্য করেছে। ব্যাগটি হাতে নিয়ে কিছুদুর যাওয়ার পর ব্যাগের ওজনের কারণে হাতে রাখা সম্ভব হলো না। বিরুক্ত হয়ে বললাম, আপনি একা আসছেন তো এতো ভারি ব্যাগ নিয়ে আসছেন কেন?
মহিলা কিছুটা অসহায়ভাব কঠে তুলে বলল, ভাই, আমি তো আর জানিনা এরকম গাড়ির বিরম্বনা হবে। জানলে কি আর এতবড় ব্যাগ সাথে আনি। বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হ্েচছ। এই বোনের জন্য একটু কষ্ট করেন না ভাই!
চাঁদনী রাত। ধু ধু বালুচর। আসেপাশে বাড়ি ঘর কিছু নাই। সব যাত্রীই সামনে চলে গেছে। শুধু আমরা দু’জন পিছনে আছি। আমাদের ভালো মন্দ দেখার কেউ নাই। আশেপাশে কোন যাত্রী বা কোন লোক না থাকায় কুলির কাজ করলেও শরম পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কাজেই কুলির মত মহিলার ব্যাগটি ঘারে তুলে নিলাম। ব্যাগ ঘাড়ে নেয়ায় হাঁটতে সুবিধা হলো। আমি জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম। মহিলা আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ মহিলা ‘ওোঁ---মা- গো--' করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমিও ‘ওরে বাবারে’ বলে চিৎকার দিয়ে বালুর উপর ছিটকে পরে গেলাম। ব্যাগ আমার হাত থেকে দশ হাত দুরে চলে গেল। মহিলা আমার পিঠের উপর উপুর হয়ে পরে জাপটে ধরেছে। মহিলার মহিলা জাপটে ধরায় ভয়ে আমি কোঁকড়া লেগে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চই মহিলা হাইজ্যাকার বা ছিনতাইকারী হবে। রাতের নির্জন ফাঁকা মাঠে আমাকে মেরে ফেলবে নইলে বড় ধরনের কোন ক্ষতি করবে। তা না হলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে উপুর করে ফেলে জাপটিয়ে ধরল কেন? ভয়ে আমি চিৎকার দিব না ছুটে পালাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। মহিলার কাছ থেকে ছুটে পালানোর জন্য জোরে ঝাঁকি দিয়ে নিট থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। মহিলা পুরো শরীর আমার উপর ছেড়ে দিয়ে জাপটিয়ে ধরেছে। বুঝতে বাকি থাকলো না আর, এই নির্জন বালুচরে গভীর রাতে আমাকে অতি সহজে মেরে ফেলবে। আমি ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, আপনি আমাকে ছাড়েন। আপনি আমাকে এভাবে ঠেসে ধরলেন কেন?
মহিলা আমার পিঠের উপর শুয়ে থেকেই বলল, না ভাই আমি আপনাকে ঠেসে ধরি নাই।
-- ঠেসে না ধরলে আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পিঠের উপর চড়ে জাপটে ধরে আছেন কেন?
মহিলা কাতরাতে কাতরাতে বলল, আমি ধাক্কা দেই নাই ভাই।
-- ধাক্কা না দিলে আমার গায়ের উপর পরলেন কেন?
-- রাত করে হাটার অভ্যাস নেই তো। হঠাৎ গর্তের ভিতর পা পরে তাল সামলাতে না পেরে, আপনার উপর পরে গিয়েছি।
-- পরে গিয়ে থাকলে পিঠের উপর থেকে নামছেন না কেন?
-- নামার চেষ্টা করছি ভাই, পা নাড়াতে পারছি না।
-- আপনি দিব্যি একজন সুস্থ মানুষ হয়ে পা নাড়াতে পারছেন না, এই কথা আমার বিশ্বাস হ্েচছ না? আপনি সত্যি করে বলেন তো, রাতের এই নির্জনতায় আপনি কি কোন খারাপ চিন্তাভাবনা করছেন?
একথা শুনে মহিলা কিছুটা লজ্জিতভাব প্রকাশ করে বলল, ছি ছি ভাই, আপনি এসব কি বলছেন?
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, তা হলে এভাবে আমাকে ঠেসে ধরে পিঠের উপর শুয়ে আছেন কেন? আমাকে উঠতে দিচ্ছেন না কেন?
এবার মহিলা কাতরাতে কাতরাতে বলল, ভাই গর্তের মধ্যে পা পড়ায় পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছি। এখন পা সোজা করে উঠতে পারছি না।
-- আপনি আমার পিঠের উপর থেকে নেমে যান, আমাদের এ অবস্থায় মানুষে দেখলে কি বলবে?
মহিলা এবার কাতরাতে কাতরাতে আমার পিঠ থেকে বুকটা সরিয়ে নিল। কিন্তু পুরোপুরি নামল না। আমি মনে মনে ভাবলাম, মহিলার নিশ্চয়ই কোন কুমতলব আছে? তা না হলে আমার উপর থেকে নেমেও পুরোপুরি নামছে না কেন?
আমি নিচে থেকে জোরে ঝাঁকি দিয়ে উঠার চেষ্টা করায় মহিলা আমার পিঠ থেকে গড়িয়ে বালুতে পরে গেল।
মাহিলাকে পিঠ থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মাঝারি ধরনের মহিলা হলেও ওজন দেড়মনের কম নয়। এতোবড় জোয়ান মহিলা হঠাৎ গয়ের উপর ছিটকে পরায় কোমরে কিছুটা ব্যাথা পেয়েছি। উঠে দেখি জামা কাপড় বালু দিয়ে একাকার। শার্ট প্যান্ট গায়ের বালি ঝেড়ে পিছন ফিরে চেয়ে দেখি তখন মহিলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার শুয়ে থাকার অবস্থা দেখে মহিলাকে স্বভাব চরিত্রে বদমায়েস মনে হলো। চিন্তা করলাম এই বদমায়েস মহিলার সাথে থাকা উচিৎ নয়। মহিলা বালিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় আমার ব্যাগটা নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবো। বদমায়েস মহিলা বালুচরে শুয়ে থাক। এ মহিলার সাথে থাকলে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে। এমন কি জীবন নিয়েও টানাটানি হতে পারে। কজেই আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার দ্রুত চলে যাওয়া দেখে মহিলা মাথা উঁচু করে অসুস্থ্য রোগীর মত কাতরাতে কাতরাতে বলে উঠল, ভাই, ভাই আপনি কই যান? আমাকে নিয়ে যান। প্লিজ, প্লিজ আমাকে নিয়ে যান। আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে না নিয়ে যাবেন না। প্লিজ ভাই, প্লিজ, আমি উঠতে পারছি না, আমাকে নিয়ে যান।
(চলবে)
Comments (11)
"নিজের বুঝ ঠিকই বুঝি
পরের বেলায় অন্ধ!" - যতদিন এই বোধ আমাদের মনে ততদিন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবেনা।
সার্বিক বিবেচনায় মনে হয়- অরণ্য-জীবনই যদি হতো অনন্ত-জীবন...
আপনার সুন্দর লেখাটির জন্য ধন্যবাদ...
মাসুম বাদল অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
সুন্দর মন্তব্য করার জন্য
শুভেচ্ছা খুব চমৎকার একটা বিষয় তুলে ধরবার জন্য
একটা গুরুত্বপুর্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশ এখন মানবাধীকার সঙকটে ভুগছে।