Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মহব্বত আলীর মাইক্রো বিলাস (পর্ব-৩, ক্যাটাগরি-২)

মহব্বত আলী । সহজ-সরল ধাঁচের সাধারণ একজন মানুষ । বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি । জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন বেশ কয়েক বছর আগে । কাজ করেন গার্মেন্টস কারখানায় । সুপারভাইজার জাতীয় কোন এক পদে চাকরি করছেন প্রায় দু’বছর । ১২ হাজার টাকা বেতন থেকে খাওয়া-দাওয়া আর ঘর ভাড়া দিয়েও মাসে প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন । বাড়িতে বৃদ্ধ মায়ের সাথে স্ত্রী আর দুই ছেলে-মেয়ে । স্বল্প আয়ের হলেও বেশ গোছানো সংসার মহব্বত আলীর । মেয়েটা সামনে এসএসসি দেবে ছোট ছেলেটা ক্লাস সেভেনে পড়ে । ওদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেই মূলত মহব্বত আলীর গ্রাম ছেড়ে শহরে আগমন । পরিবারের প্রতি যথেষ্ট সচেতন আর ত্যাগী এই সহজ-সরল মানুষটি । প্রায় প্রতি মাসেই বাড়ি যান তিনিছুটি পেয়ে গেলে সেটার ব্যবধান কমে ১৫ দিনও হয় । ভালবাসার টানে কি আর টাকা-পয়সা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ? আর তাই সুযোগ পেলেই ছেলে-মেয়ের টানে ছুটে যান তিনি আর, ফোন ? এমন দিন হয়তো খুব কমই আছে যেদিন তিনি বাড়িতে কথা বলে কোন খোঁজ-খবর নেন না !

 

বিগত কয়েক মাসে তিনি বাড়িতে কেমন যেন একটু হিসেব করে টাকা দিচ্ছেনস্ত্রী জানতে চাইলেও ঠিকঠাক কিছু বলছেন না । আসলে মহব্বত আলী মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে হিসেব কষেছেন । সামনেই কোরবানির ঈদ ! বেশ কয়েক বছর হলো সবাইকে একসাথে ঈদের নতুন জামা দেয়া হয় না । এবার যে করেই হোক সবাইকে ঈদের নতুন জামা দিতেই হবে ! কোরবানিতে শরীক হতে ১০-১২ হাজার টাকা তো লাগবেই ! তাছাড়া ঈদের কিছুদিন পরেই মেয়েটার ফরম ফিল-আপ, পরীক্ষার খরচ, ছেলেটার ভর্তি, নতুন ইউনিফর্ম, ব্যাগ কতো কি ! এতো কিছুর খরচ সামাল দিতে আগে থেকে প্রস্তুতি না নিলে হবে কিভাবে ! আর তাই মাসে মাসে কিছু টাকা ব্যাংকে রাখছেন তিনি ।

 

দিনে দিনে সময় গড়িয়ে ঈদ খুব সামনে চলে এসেছে । মহব্বত আলীও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাড়ি যাওয়ার । আগামী সপ্তাহেই ছুটি । বেতন-বোনাসও হয়ে যাবে দু’এক দিনের মধ্যে ! বাড়িতে যেতে যেন আর তর সইছে না মহব্বত আলীর ।

 

বাড়ি যাবার চিন্তায় চিন্তায় কেটে গেল সপ্তাহ । বেতন-বোনাসও পাওয়া হয়ে গেছে । কালই অফিস শেষে বাড়ি যাচ্ছেন মহব্বত আলী । এরই মধ্যে মা, ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীর জন্য কেনা হয়ে গেছে ঈদের নতুন পোশাক । নিজের জন্যও কিনেছেন একটা নতুন পাঞ্জাবী । অফিস শেষে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়েছেন । কিন্তু কখন সকাল হবে সে চিন্তায় যেন ঘুম আসছে না তার । বিছানার এপাশ-ওপাশ করে কখন একটু চোখ লেগেছিল জানা নেই ।

 

ফজরের আযান শুনেই উঠে গেলেন মহব্বত আলী। নামায পড়ে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে গোসল সেরে রওনা দিলেন অফিসে । উদ্দেশ্য অফিস শেষ করে বাড়ির পথে রওনা হওয়া । দুপুর নাগাদ ছুটি হয়ে গেল অফিস । এবার তবে বাড়ি যাবার পালা !

 

ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারই এলাকার এক পরিচিতজনের সাথে রওনা হলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে ! কিন্তু যাবেন কিভাবে ? রাস্তায় যে মানুষের ঢল ! সব গার্মেন্টস আজই ছুটি হয়েছে পাশাপাশি কিছু অফিস-আদালতও । সবাই যেন বাড়ি যেতে উদগ্রীব ! সিএনজি, বাস, রিকশা কিচ্ছু খালি নেই রাস্তায় ! তবে কি আজ বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না ? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কিছু না পেয়ে চিন্তা করে দেখলেন এখন যাওয়া সম্ভব নয়, সন্ধ্যায় রওনা হবেন । এই ভেবে পরিচিতজনকে সাথে নিয়ে ফিরে গেলেন রুমে ।

 

সন্ধ্যায় আবার বের হলেন । রাস্তায় মানুষের ঢল কিছুটা কমেছে কিন্তু কিছুটা যানজট রয়েছে । গাড়িগুলো সেই আগের মতোই যাত্রী দিয়ে টইটুম্বুর । গাড়ির জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় বিরক্ত হতে চলেছেন এই মুহূর্তে একটা মাইক্রো এসে দাঁড়ালো সামনে । সামনে ড্রাইভার, পেছনে একজন যাত্রী দেখা যাচ্ছে । “স্যার কোথায় যাবেন ?”- ড্রাইভারের প্রশ্ন ! মহব্বত আলী জায়গার নাম বলাতেই ড্রাইভার বললো- “উঠুন স্যার, আমি ওদিকটাতেই যাচ্ছি ! ওখান থেকে আর ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে একদম বাড়ি চলে যেতে পারবেন ।” “ভাড়া কত দিতে হবে ?”-মহব্বত আলীর প্রশ্ন । “একজন ৪০০ টাকা স্যার !”- ড্রাইভারের উত্তর । মহব্বত আলী মনে মনে ভাবতে লাগলেন- সাধারণ সময়েই বাস ভাড়া দিতে হয় ২০০ টাকা । ঈদের সময় বিবেচনায় সেটা তো ৩০০ হবেই ! তাছাড়া ঈদের ছুটিতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা তো আছেই ! সেখানে মাইক্রোতে বসে আয়েশ করে ৪০০ টাকায় যেতে পারাটা তো দারুণ সুযোগ । তাছাড়া বড় সাহেবদের অফিসে মাইক্রো দিয়ে আসতে-যেতে দেখে মহব্বত আলীর নিজেরও মাঝে-মধ্যে শখ জাগে মাইক্রোতে চড়তে । আজ যেহেতু সুযোগটা সামনে এসেই গেছে- লুফে নিতে সমস্যা কোথায় ?

 

পরিচিতজনেরও কোন আপত্তি না থাকায় মহব্বত আলী তাকে নিয়ে উঠে গেলেন মাইক্রোতে । ৩ জন যাত্রী নিয়ে গাড়ি চলতে লাগলো । কখনো মাইক্রো দিয়ে যাওয়া হয়নি । তাই মহব্বত আলীর কেমন যেন একটু ভয়ভয়ও লাগছিল । ১৫-২০ মিনিট পর এক স্টেশনে গাড়ি থামলে আরো ৪ জন যাত্রী উঠলো । মহব্বত আলী যেন একটু সাহস পেলেন । তাদের দু’জনের দুই পাশে দু’জন, পেছনে ২ জন আর ড্রাইভারের পাশে একজন । মহব্বত আলীর ভাবনায় বেশ নিরাপদই বলা যায় ! এবার আরো ১৫-২০ মিনিট যাবার পর গাড়ি হাইওয়েতে উঠলে রাস্তা প্রায় ফাঁকা, দু’একটা করে গাড়ি যাচ্ছে । হঠাৎ মহব্বত আলী লক্ষ করলেন আশেপাশের সব যাত্রীরা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক নড়াচড়া করছে । কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলেন তাদের দু’পাশ থেকে, সামনে থেকে, পেছন থেকে অস্ত্র ধরে আছে সব যাত্রীরা ! এদের মধ্যে একজন বলছেন- “যা কিছু আছে তাড়াতাড়ি বের কর ! দেরী করলে জানে মেরে দেব !” ভয়ে তো দু’জন প্রায় অস্থির ! ভয়ে ভয়ে দু’জনের সাথে থাকা ঈদের সব নতুন জামা, কোরবানির টাকা, সংসারের খরচের টাকা সব দিয়ে দিলেন । এরপর যা হল- সেটা আরো ভয়ংকর ! সবকিছু দিয়ে দেবার পরও দু’জনকে বেশ কিছু মারধর করে চোখে এক ধরণের মলম দিয়ে নদীর ধারের কোন এক রাস্তার পাশে ফেলে গেল দুর্বৃত্তরা । এরপর তারা যখন তাদের পুনরায় আবিষ্কার করলেন তখন তারা কোন এক হাসপাতালের বেডে । কোন এক ভদ্রলোকের বদৌলতে হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পেরেছেন । কিছুটা সুস্থ বোধ করায় পরদিন ব্যাংক থেকে কিছু টাকা উঠিয়ে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলেন । বেশ কষ্ট করে অবশেষে নিজ এলাকায় গিয়ে নামলেন এলাকার বাজার থেকে ঈদের কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি গেলেন । কোনরকমে কষ্ট করে মা, ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে এবারের ঈদটা কাটিয়ে দিলেন ।

 

একবছর পর ঈদে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে আবার রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন মহব্বত আলী । একটা মাইক্রো এসে থামল তার পাশের দু’জন লোকের সামনে । তাদের উদ্দেশ্যে ড্রাইভারের প্রশ্ন- “স্যার, কোথায় যাবেন ?” উত্তরে এক ভদ্রলোক জায়গার নাম বলার সাথে সাথে ড্রাইভারের প্রতি-উত্তর- “উঠুন স্যার, আমি ওদিক দিয়েই যাব !” মহব্বত আলী ভদ্রলোককে ডেকে বললেন- “স্যার, কিছু মনে না করলে বলছি... আপনি এ মাইক্রো দিয়ে যাবেন না ! পাবলিক বাসে যান ।” উত্তরে ভদ্রলোকের জবাব-“জনাব, গাড়িতে যাত্রীদের অবস্থা দেখেছেন ? এভাবে ঝুলে থেকে এতো দূরে যাওয়া সম্ভব নয় ! তার চেয়ে একটু আরামে বসে যাই । টাকা না হয় ২-১শ বেশি গেল ! তবু একটু আরামে তো যাওয়া যাবে !” মহব্বত আলী ভদ্রলোককে আটকাতে পারলেন না ! ঠিক তার পরমুহূর্তেই যেন তার চোখের সামনে ভাসতে থাকলো গত ঈদে বাড়ি যাওয়ার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার ভয়ানক আর দুঃসহ স্মৃতিগুলো !

১ Likes ০ Comments ০ Share ৩৭২ Views