Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজু আহমেদ

১০ বছর আগে

মন্ত্রীমহোদয় আসবেন বলে........

 

 

 

(এ লেখার সকল চরিত্র এবং স্থান কাল্পনিক । তবে লেখার্ প্রতিপাদ্য বিষয় সমাজের জন্য এক বিষফোঁড়া । সচেতনতা এবং উদ্যোগ প্রয়োজনে আইনের মাধ্যমে এ প্রথা বন্ধ করা উচিত)

 

 

 

     সরকারী ঝিকাতলা স্কুল । গত পণের দিন ধরে স্কুলজুড়ে সাজ সাজ রব । পঞ্চাশোর্ধ হেডমাষ্টার আবুল মিয়ার ব্যস্ততার সীমা নাই । নিজের ব্যস্ততার সাথে স্কুলের সকল শিক্ষক কর্মচারীকেও ব্যস্ত রেখেছেন । অন্যসময়ের অলস মানুষটির কর্মতৎপরতা দেখে স্কুলের অন্য শিক্ষরা বিশেষ করে বাংলার শিক্ষক মন্টু মিয়া আড়ালে হাসেন । মন্টু মিয়ার হাসার পিছনে অনেক কারন বিদ্যমান । আবুল মিয়ার অনেকগুলো বদ অভ্যাস আছে । আবুল মিয়া মাসে দু’একদিন স্কুলে আসলেও পারেন আবার না আসলেও পারেন । যতক্ষণ স্কুলে থাকেন তার বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটান । তবে আবুল মিয়ার সবচেয়ে বড় দোষ, তিনি যা দু’একদিন স্কুলে আসেন সে ‍দিনগুলোতে স্কুলে উপস্থিত হয়ে প্রথমে দফতরী ইলিয়াস বিশ্বাসকে তুমুল বকা দেন । তার বকার হাত থেকে স্কুলের কেউ রেহাই পায় না । সবশেষে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষককে বকাদেন । সহকারী প্রধান শিক্ষক নাসের মোল্লা বয়সে আবুল মিয়ার চেয়ে ছোট হলেও আবুল মিয়া নাসের মোল্লাকে খুব মানেন । স্কুলের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে বেশ সুনামের সাথেই তিনি ঝিকাতলা স্কুলকে সকলের কাছে পরিচিতি করে তুলেছেন । সে কারনে হেডমাষ্টার আবুল মিয়া প্রথমে তার সহকারীকে বকা দিলেও পরবর্তীতে খাতির জমানোর চেষ্টা করেন । নাসের মোল্লাও মাটির মানুষ । তাকে কেউ অযথা দোষারোপ করলে তাতে তার মধ্যে বিশেষ কোন ভাবান্তর হয়না । নাসের মোল্লা বিশ্বাস করেন, যে দোষ তিনি করেন নি সে দোষে তাকে দোষী করা হলে তাতে তার কিছুই যায় আসে না । সেকারনে নাসের মোল্লাকে স্কুলের সকল শিক্ষক-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীরা পরম শ্রদ্ধা করে । ঝিকাতলা স্কুলে আগামীকাল মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আগমন করবেন । সাম্রতিক এসএসসির ফলাফলে জেলায় ঝিকাতলা  স্কুল প্রথম স্থান অধিকার করেছে । মন্ত্রীমহোদয়ের বাড়িও একই জেলায় । সেকারনে মন্ত্রীমহোদয় স্ব-উদ্যোগে ঝিকাতলা স্কুলে তার মূল্যবান সময় থেকে বিশ মিনিট সময় দিবেন বলে ঘোষণা করছেন । স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যদের সাথে আবুল মিয়ার দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে । বৈঠকের আলোচ্য বিষয়গুলো ঘুরে ফিরে প্রায় এক ।

 

 

 

    কার বাড়ীতে মন্ত্রীমহোদয়কে আহার করানো হবে । আহারে কতপ্রকার ফল, সবজি, মাছ, মাংসসহ অন্যান্য সু-খাদ্য রাখা যায় । অনুষ্ঠানে কে শুভেচ্ছা ব্যক্তব্য রাখবে । স্কুলের জন্য কতগুলো দাবি উত্থাপণ করা যায় । লালগালিচা না দিলে মন্ত্রীমহোদয়কে অপমান করা হয় বলেও অনেকে মত দিলেন । তবে পরমার্শ সভায় একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মোটামুটি হট্টোগোল বেধে গেল । ঝিকাতলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা সর্বসাকুল্যে সহস্র ছুঁই ছুঁই । এ পরিমান শিক্ষার্থী দিয়ে মন্ত্রীমহোদয়কে মানসম্মত ভাবে শুভেচ্ছা জানিযে বরণ করা সম্ভব কিনা ? নাকি আরও শিক্ষার্থী দরকার ? এ প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক নাসের মো্ল্লা সমাজের সাথে বেমানানসই এক উদ্ভট প্রস্তাব উত্থাপন করে বসলেন । নাসের মোল্লা বললেন, মন্ত্রীমহোদয় শিক্ষিত মানুষ । শিক্ষার্থীদের কষ্ট দিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা উচিত হবে কি ? তার একথা মুখ দিয়ে সম্পূর্ণ বের হওয়ার আগেই স্বুলের সভাপতি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন । তিনি বললেন, আপনি মানুষের ইজ্জতের বোঝেন কি ? সারা জীবন চক-ডাষ্টার নিয়ে নাবালক-নাবালিকার সাথে সময় পার করেছেন । আপনি রাজনৈতিক নেতাদের ইজ্জতের কি বুঝেন ? আমি ওয়ার্ড কমিটির সহ-সভাপতি হয়ে বুঝেছি সম্মান কি জিনিস ! মন্ত্রীমহোদয় তো আমাদের থেকে কোটি-কোটিগুন উচ্চ মর‌্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি । তাকে সম্মানেরসহিত শুভেচ্ছা জানাতে না পারলে আমার এবং প্রধান শিক্ষকের মর‌্যাদার কতটা হানি হবে সেটা আপনি কেমনে বুঝবেন । স্কূল কমিটির অন্যান্য সদস্যরা সভাপতি সাহেবের কথার সাথে তাইতো-তাইতো করে উঠলেন । প্রধান শিক্ষক আবুল মিয়া সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেও সভাপতির বিরুদ্ধে যাওয়া তার সাহসে কুলিয়ে ওঠল না । তিনিও আমতা আমতা করে নাসের মোল্লাকে বললেন, আপনি চুপ থাকেন । সভাপতি সাহেব আমাদের সকলের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত দিবেন । নাসের মোল্লার আর কিছুই বলার থাকল না ।

 

 

 

      মন্ত্রীমহোদয়ের আগমনের আগের দিন দশটার দিকে মন্ত্রীমহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারী কর্তৃক স্কুলের সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষকের কাছে ফোন আসল । মন্ত্রীমহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারী আদেশের সুরে সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষকের কাছে বলল, জানেনতো আমাদের মন্ত্রীমহোদয়ের সময়ের কতমূল্য । তারপরেও তিনি মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে আপনাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য কথা দিয়ে ফেলেছেন । এমন আয়োজন করবেন, যাতে মন্ত্রীমহোদয় আপনাদের উপর খুশি হয় । বিশেষ করে রাস্তার দু’পাশে আপনাদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে বাঁধ সৃষ্টি করবেন এবং তাদের প্রত্যেকের হাতে ফূল দিয়ে রাখবেন, মন্ত্রীমহোদয় রাস্তায় প্রবেশ করার সাথে সাথে সকলেই যেন উষ্ণ অভিভাষণের মাধ্যমে ফূল দিয়ে বরণ করে নেয় । মন্ত্রীমহোদয়ের আগমনের অন্তত ঘন্টা দু’য়েক আগেই শিক্ষার্থীদের রাস্তার দু’ধারে প্রস্তুত করে রাখবেন । মন্ত্রীমহোদয় আপনাদের স্কুলে পৌঁছার আগেই সেখানে অনেক সাংবাদিক এবং বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হবেন । আপনাদের আয়োজন দেখে তারা যেন মন্ত্রীমহোদয়ের সম্মানের উচ্চতা আন্দাজ করতে পারে ।

 

 

 

    স্কুল কমিটির সদস্যবৃন্দের এবং প্রধান শিক্ষকের এতদিনের পরিকল্পনার সাথে মন্ত্রীমহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারীর ফোনে প্রেরিত নতুন বার্তায় তাদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলল । সভাপতি সাহেব প্রস্তাব দিলেন, আমাদের স্কুলে যে সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আছে তাতে মন্ত্রীমহোদয়ের সম্মান পুরোপুরিভাবে প্রদর্শন করানো সম্ভব নয় । আবুল মিয়া আপনি এক কাজ করেন । আমাদের পার্শ্ববর্তী কল্যানপুর এবং সোনাপুর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও নিয়ে আসেন । তিন স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে একসাথ করে মাইল খানেক রাস্তাব্যাপী ওদেরকে দাঁড় করিয়ে মন্ত্রীমহোদয়কে সম্মান জানানো যাবে । মন্ত্রীমহোদয়ও আমাদের উপর বেজায় খুশি হবেন ।

 

 

 

   আজ অনুষ্ঠান । দুপুর বারোটায় মন্ত্রীমহোদয় ঝিকাতলা স্কুলে তার পদ-ধূলি দিবেন বলে কথা আছে । স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সকল সদস্য, স্থানীয় রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা এবং স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীর যৌথ প্রচেষ্টায় সকাল নয়টার মধ্যেই শিক্ষার্থীদেরকে রাস্তার দু’ধারে ফূল হাতে দাঁড় করানো হল । শিক্ষকদের কড়া আদেশ ; কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না, দুষ্টামি করা যাবে না , রোদ-বর্ষা যাই হোক স্থান ত্যাগ করা যাবে না । যদি কারো দ্বারা এ আদেশের বিরুপ কিছু হয় তবে তাদেরকে অবশ্যই কঠিন শাস্তির মুখোমূখি হতে হবে । শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অনুগত । তারা গুরুজনের আদেশকে যথার্থভাবে পালন করেছে । সময় আস্তে আস্তে গড়িয়ে দুপুর হল । কাটায় কাটায় বেলা বারোটা । বারোটা গড়িয়ে একটা । মন্ত্রীমহোদয়ের দেখা নেই । মন্ত্রীমহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারীকে স্কুলের সভাপতি ভয় মিশ্রিতভাবে ফোন করে জানতে চাইল, আপনারা কতদুর । পৌছতে আর কত সময় লাগবে ? মন্ত্রীমহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারী গর্জন করে বললেন, এই মিয়া ! এত তাড়া কিসের । মন্ত্রীমহোদয় কথা দিয়েছেন আপনাদের ওখানে যাবেন । তার কথার নড়চড় হয় না । তিনি অবশ্যই যাবেন । একটু ধৈরর‌্য্য ধরতে পারেন না । মন্ত্রীমহোদয় একটা সিনেমাহল উদ্ভোধন করছেন । সেটা শেষ হলেই আপনাদের ওখানে যাবেন । আরও ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করেন ।

 

 

 

   একঘন্টা হতে কয়মিনিট লাগে সভাপতি সাহেব সেটা চিন্তা করতে লাগলেন । ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকানো যায় না । শিক্ষার্থীদের চেহারার দিকে তাকালে বিবেকবানদের চোখে পানি আসে । আর কত সহ্য করা যায় । নাসের মোল্লা ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা দেখে লাইব্রেরীর নিভৃত কোনে বসে কিছু সময় কাঁদলেন । কাঁদা ছাড়া তার কিইবা করার আছে ? প্রধান শিক্ষক সাহেব মনে মনে কান ধরছেন । কোন মন্ত্রীমহোদয়ের আগমন উপলক্ষ্যে তিনি তার নৈতিক শিক্ষাকে বিসর্জন দিবেন না । অভিভাবকরা চরম বিরক্ত । অবশেষে আসল সে মহেন্দ্রক্ষন । বিকেল তিনটার কিছু পূর্বে বিশাল গাড়ীবহর নিয়ে মন্ত্রীমহোদয় ছাত্রদের বিরক্তি মিশ্রিত অভিবাধন নিয়ে উপবিষ্ট হলেন তার জন্য নির্ধারিত আসনে । উপস্থাপকের ডাকে উঠে আসলেন বক্তৃতার মঞ্চে । শুরু করলেন তার সরকারের উন্নয়নের বিশাল ফর্দ পাঠ । দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটব্যাপী চলল তার আলোচনা । অবশেষে সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে আজকের মত বিদায় নিলেও সুযোগ পেলে আবারও আসবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন ।

 

 

 

    মন্ত্রীমহোদযের আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠান কভার করতে আশা এক সাংবাদিক মন্ত্রীমহোদয়ের সময়জ্ঞানের প্রতি বিরক্ত হয়ে বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের করুনদশা এবং তাদের হৃদয়ের ভাবাবেগ উপলব্ধি করে লিখে ফেললেন বিশাল কলাম । সেখানে তুলে ধরলেন দেশের বিভিন্ন স্কুলে মন্ত্রীমহোদয়দের আগমনের হেতুতে কোমলমতিদের বেহালদশা । সংবাদটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল । মন্ত্রীমহোদয়দের সম্মান জানানোর উপায় হিসেবে কোমলমতিদের ব্যবহার করা যাবে না মর্মে বিবৃতি দিল দেশের হাজার হাজার শিক্ষাবিদ । খবরটি সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টিতে পড়ল । তিনি ঘোষণা করলেন, কোন মন্ত্রী বা বিশেষ ব্যক্তিদের বরণ করার জন্য শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করানো যাবে না । শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগটি ব্যাপক বাহবা পেল সাথে শিক্ষামন্ত্রীও । কয়েকদিন প্রবর্তিত নিয়মটির চর্চাও হল । অবশেষে আসল সে কু’ক্ষন । আবারও মন্ত্রীমহোদয়দের বরণ করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাস্তার দু’ধারে দাঁড় করিয়ে রাখার সংস্কৃতি চালু হল । এইতো গত দিন তিনেক আগে পত্রিকায় পড়লাম, মন্ত্রীমহোদয়কে বরণ করার জন্য পাঁচঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হল স্কুলের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে । এরকম সংস্কৃতি থেকে কবে মুক্তি পাবে এ দেশ, এদেশের শিক্ষার্থীরা ? কবে বিবেকের কাছে আবেগকে জবাবদীহি করতে বাধ্য করতে পারব ? সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় ।

 

 

 

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।

 

raju69mathbaria@gmail.com

 

 

 

 

 

০ Likes ২ Comments ০ Share ৬০৯ Views

Comments (2)

  • - কামাল উদ্দিন

    যে কোন একটা ছবির উপর মাউস নিয়ে রাইট বাটন ক্লিক করুন, দেখবেন অনেকগুলো অপশন আসবে। আপনি সব বাদ দিয়া শুধু কপি ইমেজে ক্লিক করুন (আমার দেখানো চি্ত্রে মার্ক করা আছে)।

    তারপর যেখানে ছবিটা দিবেন ওখানে নিয়ে শুধু পেষ্ট করে দিন, ব্যস হয়ে গেলো।

    • - আমির আসহাব .

      ধন্যবাদ।