১৯৮৭ এর ৩১ অক্টোবর ফজরের আযানের আগে আমার বাবা সবাইকে কাঁদিয়ে তাঁর মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান পরপারে এক অজানা অচেনা দেশে।
বাবা মা থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। সাথে থাকতো কম বয়সী ছোট ভাই বোন। আমি চাকুরী সূত্রে স্ত্রী পুত্রসহ ঢাকায়। আমার আর্থিক অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা পুরায়। তাই তাদেরকে সাথে নিয়ে থাকার সামর্থ আমার ছিল না।
তখন দেশে মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিল না। ল্যান্ড ফোনের এন. ডব্লিউ. ডি. সার্ভিসও ছিল না। ছিল ঝক্কর ঝক্কর ট্রাংকল সার্ভিস। তাও ঘন্টার পর ঘন্টা চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া যেতো না।
চাকুরী সূত্রে আমার বড় ভাই থাকতেন চট্টগ্রামে। আমার এক আত্মীয় কুমিল্লায় রূপালী ব্যাংকের একটি শাখায় নিম্ন পদে চাকুরী করতেন। একই ব্যাংকের কুমিল্লা শহরের একটি শাখায় আমার ক্লাসমেট, কলিগ এবং বন্ধুও চাকুরী করতেন। তার সাথে আমিও দীর্ঘ সাত বছর চাকুরী করেছি। সেই সুবাদে আমার আত্মীয়টি ভোর বেলা কুমিল্লা শহরে এসে তার বাসায় গিয়ে আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ জানান এবং তাকে অনুরোধ করেন তিনি যেনো অফিসে গিয়েই ট্রাংকল করে আমাকে মৃত্যু সংবাদটি জানিয়ে দেন। তারপর আমার আত্মীয়টি আমার বড় ভাইকে আনতে চট্টগ্রামের পথে যাত্রা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। আমার ক্লাসমেট, কলিগ এবং বন্ধুর ট্রাংকলটি আমার কাছে পৌছে বিকাল সাড়ে চারটায়। সংবাদ পেয়ে বাসা হয়ে আমি বাড়ির পথে রওয়ানা হই।
তখন ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসতে দুটি ফেরী পার হতে হতো। বিরতিহীন বাস সার্ভিস ছিল না। ছিল লোকাল বাস সার্ভিস। আর ট্রেন? ট্রেন তো আজীবনই কচ্ছপ গতিতে চলার বাহন। কখন ছাড়বে, কখন পৌছুবে কেউ জানে না। এখনও তাই।
কখন বাড়ি পৌছুতে পারবো তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তাই আড়াই বছরের ছেলে আর স্ত্রীকে সঙ্গী করা সম্ভব হয়নি। এ দুঃখ আমার আমরণ থেকে যাবে।
আমরা হরহামেশাই জীবন নিয়ে জুয়া খেলি। আর না খেলেই বা উপায় কি। আমরাতো ছাপোষা মানুষ। বিধির হাতের খেলার পুতুল। তিনি যেমন খুশি তেমন নাচান। আমিও বাধ্য হয়ে জীবন নিয়ে জুয়া খেলায় অংশ নিলাম। খেলতে খেলতে বাড়ি এসে পৌছলাম রাত ১১টায়। এসে দেখি সব শেষ। মাগরেবের আগেই বাবার দাফন করা হয়ে গেছে। দাফন না করেই বা কি করবে। দাফন না করলে তো লাশে পচন ধরবে। গ্রামেতো হিম ঘর বা এসি এম্বুলেন্স নেই।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। মৃত বাবার মুখটাও শেষ বারের মতো একবার দেখতে পারলাম না। এ দুঃখ আমি কারে বলি।
Comments (0)
ভাল লিখেছেন।
সুন্দর অনুভূতি!
ভাল লাগলো ।
গানের মতো।
শুভেচ্ছা কবি ভাই