মঙ্গল গ্রহের কথা কে না জানে এই পৃথিবীতে। লাল এ গ্রহকে নিয়ে পৃথিবীর মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তবে কিছটা হলেও শিথিল হতে যাচ্ছে সেই জল্পনা কল্পনার। পৃথিবী থেকে লাল এই গ্রহের দুরত্ত প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটার। তবে প্রযুক্তির কল্যাণেই সেই দুরত্ত এখন কমে এসেছে। আর তাই চলছে সেই খানে মানুষ বসবাস করানোর সকল প্রস্তুতি। কয়েক বছর পর অথাৎ ২০২৫ সালে মানুষ প্রথম বসবাস শুরু করবে এই লাল গ্রহে।
২০২৫ সালে বসবাসের উদ্দেশে মানুষের যাএা শুরু হচ্ছে মঙ্গল গ্রহে :
মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর এ আয়োজন করেছে নেদারল্যান্ডসের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মার্স ওয়ান। আর তার এই জন্য মঙ্গলগ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে আবেদনপত্র চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ১৮ বছরের বেশি বয়সের যে কারও মঙ্গলে যাওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু শর্ত ছিল যে, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কেবল চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত চারজন ব্যক্তিকেই শুধু মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে দেওয়া হবে আর তাঁদেরকে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হবে। পরবর্তীতে মঙ্গলগ্রহের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে অভিযাত্রীদের নিজেদেরই চেষ্টা করতে হবে মঙ্গলে বেঁচে থাকার জন্য।
এক কথায় তাঁরা ফিরতি টিকেট দিচ্ছে না এই অভিযানে।
মার্স ওয়ান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের জন্য লকহিড মার্টিন, সারে স্যাটেলাইট টেকনোলজি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৮ সালে মঙ্গল গ্রহে উদ্দেশ্যে মনুষ্যবিহীন রোবোটিক যান পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ আবেদনকারীদের মধ্য থেকে নির্বাচিতোদের নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস প্রক্রিয়া শুরু করবেন তাঁর।
মার্স ওয়ান কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিটিতে সাড়া দিয়ে ছিলো দুই লাখের বেশি মানুষ যার মধ্যে আমি আর আমার বোসকা ও ছিলাম।এই বিপুল সংখ্যাক আবেদনের মাঝ থেকে ছাঁটাই হয়ে সংক্ষিপ্ত তালিকা হয়েছিলো ১,০৫৮ জনের। এর পর সর্ব শেষ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে ১০০ জনের। যার মধ্যে ৫০ জন নারী ও ৫০ জন পুরুষ।
মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে ৩১ জন কে, এশিয়া থেকে ১৬ জন, আফ্রিকা থেকে ৭ জন, ওশানিয়া থেকে ৭ জনকে আর যুক্তরাষ্ট্র থেকেই নেয়া হয়েছে ৩৯ জনকে।
তবে এই ১০০ জনের মধ্য থেকে আবার বাছাই করে নির্বাচন করা হবে ৪০ জনকে তার পর সর্বশেষ ২৪ জন আগ্রহী নভোচারীদের। দীর্ঘ সময় (৮ বছর) বিভিন্নভাবে মহাকাশযান চালনা, সেখানে অবস্থান এবং কীভাবে নিজেকে বিরূপ আবহাওয়ায় টিকিয়ে রেখে মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন করা যাবে সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। মার্স ওয়ান প্রকল্প পৃথিবী থেকে ২৪ জন নভোচারী নিয়ে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ৭ মাসের মহাকাশ যাত্রা শুরু করবে ২০২৪ সালে।
২০২৫ সালে চার নভোচারীর প্রথম দলটি মঙ্গলে যাবে (তবে সেই ৪ জনের দলটি এখনই নির্বাচিত) আর এরপর প্রতি দুই বছর পরপর নতুন অভিযাত্রীরা যোগ দেবেন তাদের সঙ্গে। এর আগে মঙ্গল গ্রহে চালানো হবে প্রাথমিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী পরিবেশ নির্মাণের চেষ্টা। মহাকাশে মানুষের বসতি ছড়িয়ে দিয়ে সেখানে বংশবৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। সেখানে বেঁচে থাকার মতো উপযুক্ত পরিবেশও তাদেরকেই তৈরি করে নিতে হবে।
মঙ্গলে প্রথম বাংলাদেশী বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন লুলু ফেরদৌস :
মঙ্গল গ্রহে প্রথমবারের মতো ৪ জন মানুষ স্থায়ী বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের মধ্যে লুলু ফেরদৌস নামের বাংলাদেশি এক নারী বিরল এই কৃতিত্বতের অংশীদার হতে যাচ্ছেন। একজন মহাকাশচারী গবেষণার অংশ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে লুলু ফেরদৌস ২০০৭ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি এয়ার ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেন। পরে যোগ দেন নাসার বিশেষ গবেষক হিসেবে। লুলু বর্তমানে নাসাতে সহযোগী গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
৩৫ বছর বয়সী লুলু ফেরদৌস জন্ম গ্রহণ করেন ঢাকায়। লুলু ফেরদৌসের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নে। লুলু ঢাকায় ভিকারুননিসা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এরপর আমেরিকায় গিয়ে গবেষণার পাশাপাশি পড়াশোনাও করছেন। লুলুর বাবা ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক পরিচালক ওবায়েদুর রহমান খান। মা রেজিয়া সুলতানা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (আইইউবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।
মঙ্গল গ্রহে মানুষ বাঁচবে কত দিন ? :
বিজ্ঞানীদের মতে , “মঙ্গলের বর্তমান যে অবস্থা তাতে সেখানে মানুষ ৬৮ দিনের বেশি বাঁচতে পারবে না”।
বিজ্ঞানীদের মতে মার্স ওয়ান এই মঙ্গল গ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যে প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র (এমআইটি) একদল গবেষকের গবেষণা দেখিয়ে দিয়েছে, মঙ্গল গ্রহের পরিস্থিতি ও মানুষের প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে মার্স ওয়ানের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা এখনও পর্যন্ত অসম্ভব না।
বিজ্ঞানীদের মতে – বর্তমান অবস্থায় লাল গ্রহ মঙ্গলের পরিস্থিতি এমন যে, সেখানে যাওয়ার পর দুই মাসের মধ্যেই অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে শুরু করবে এবং ৬৮ দিন পর মানুষ মারা যেতে থাকবে। মঙ্গলের ওই উপনিবেশে অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য যে গাছপালা নিতে হবে, তা নেয়ার সময়, মহাকাশযানে “অনিরাপদ” পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদিত হতে পারে। আবার এই অক্সিজেন অপসারণের জন্য কোনো এক ধরনের “অক্সিজেন রিমুভাল” প্রয়োজন হবে, কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রযুক্তি মহাকাশযানের জন্য এখনও তৈরি করা হয়নি। মঙ্গলে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের বিষয়টিও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এসব রসদ সরবরাহের খরচ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে বলে গবেষকরা বলেন।
মঙ্গলে চাষ শুরু হতে যাচ্ছে লেটুস গাছের :
২০১৮ সাল লেটুসের বীজ যাচ্ছে মঙ্গল গ্রহে। আর সেটাই যদি হয় তবে সেটিই হবে ওই গ্রহে প্রথম কোনো প্রাণের প্রথম মঙ্গলভ্রমণ। লেটুসের চারা মঙ্গলে পৌঁছানোর পর সেটি অ্যালুমিনিয়াম ও পলিকারবোনেট গ্রিনহাউসে বেড়ে উঠবে। গ্রিনহাউসে তাপমাত্রা রাখা হবে ২১ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গলে মানুষ গেলে যেখানে যাবে বলে ধারণা করা হয়, সেখানেই এই চারা রোপণ করা হবে। মঙ্গলে সূর্যতাপ পৃথিবীর চেয়ে প্রায় অর্ধেক। দিনে তাপমাত্রা মোটামুটি ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তবে রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এখানে দিনও পৃথিবীর চেয়ে ৪০ মিনিট দীর্ঘ। অর্থাৎ এসব লেটুস চারা একটি মেঘাচ্ছন্ন শীতের দিনে যতটা তাপ পাওয়া যায় তাই পাবে। লেটুস উৎপাদনে এই তাপ যথেষ্ট। লেটুস জন্মানোর পর এগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হবে। কোনো জৈব বস্তু মঙ্গলে নেই, সেটি নিশ্চিত করতেই এভাবে পোড়ানো হবে লেটুস। ঙ্গলে পাঠানোর জন্য লেটুসকে বেছে নেওয়ার কারণ এই প্রজাতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। এটি খাওয়া যায়, এটিও একটি কারণ। এটি পাঠানোও যথেষ্ট সহজ। পৃথিবীর মতো মহাশূন্যের কঠিন পরিবেশে লেটুস সফলভাবে উৎপাদনও করা হয়েছে।
নভোযানে লেটুসের বীজ পাঠানো হবে। মঙ্গলে পৌঁছানোর পর সেখান থেকে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে। মঙ্গলে লেটুস পাঠানোর প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, ভ্রমণপথে টিকে থাকার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী লেটুসের বীজ। তবে কোন তাপমাত্রায় বীজ টিকতে পারে এ-সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য নেই। আর এই পরিকল্পনাটির নাম দেয়া হয়েছে ‘লেটুস অন মারস’।
এখন দেখার বিষয় এই যে, এই যাএা কতখানি মানব কুলকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখন শুধু অপেক্ষা সেই দিন গুলোর জন্য।