Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজু আহমেদ

৯ বছর আগে

ভূখা পেটে প্রকৃত জ্ঞান বিতরণ সম্ভব নয়

দেহের সুস্থতার জন্য যেমন প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহনের দরকার তেমনি ফুরফুরে ও সতেজ মানসিকতার জন্য দুশ্চিন্তাহীন সময় কাটানোর নিশ্চয়তা আবশ্যক । শরীর ও মন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকলে গোটা পরিবেশ যেন স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরপুর থাকে । অশান্তির মাত্রা কমে গিয়ে শান্তির সুবাতাস বহমান হয় সর্বত্র । দেহ-মন সুস্থ রাখতে পারা সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পরে । তবে বাংলাদেশের মত একটি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়শীল রাষ্ট্রে সকল মানুষের শরীর মন সুস্থ রাখার নিশ্চয়তা দেয়ার আনুষাঙ্গিক উপকরণ আমাদের দেশের নাই । সরাসরি নাই বলাটাও সম্ভবত অনুচিত । যা আছে তা এদেশের মানুষের মন ও শরীর সুস্থ রাখার জন্য পর‌্যাপ্ত না হলেও একেবারে অপ্রতুল নয় । তবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টননীতি এবং যথাযথ ব্যবহারের প্রক্রিয়া না থাকায় এ দেশের মানুষ অনেকটা আত্মগাতিভাবেই কষ্ট পাচ্ছে । কিছু মানুষের স্বার্থলোভী স্বভাব প্রকটভাবে চরিতার্থ হওয়ায় দেশের ষোল কোটির অধিক মানুষকে দুর্বিষহ যন্ত্রনা ভোগ করতে হচ্ছে । অলৌকিক কিছু না ঘটলে গতানুগতিক এ ধারা থেকে কোন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই নিমিষে এ সমস্যার পুরো সমাধান করার যোগ্যতা রাখে বলে মনে হয় না কেননা সমস্যার শিকড় এত গভীরে প্রবেশ করেছে যা বলা মাত্রই উপড়ে ফেলা সম্ভব নয় । তবে দেশের এমন অনেকগুলো ক্ষেত্র আছে যেখানে সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক কিছু পরিবর্তন আনলে রাষ্ট্রের সমস্যা ধীরে ধীরে লোপ পেতে বাধ্য । এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম দেশের শিক্ষক সমাজের সুযোগ-সুবিধা তথা বেতন-ভাতা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করা উচিত । মানুষ গড়ার কারিগরেরা যদি অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে তবে সে দেশের সমস্যা সমাধান হবে এমনটা ভাবার যৌক্তিক কোন কারণ নাই । যে দেশের প্রশাসনিক স্তরের পিয়নের চেয়ে শিক্ষকের বেতন কম-সেদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম নৈতিকভাবে বেড়ে ওঠবে এমনটা আশাও করা যায় না । সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষক যদি তার বেতন দিয়ে পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা না করতে পারেন তবে তার মানসিক অবস্থা ঠিক থাকে না । একজন শিক্ষক যদি মানসিকভাবে পূর্ণ সুস্থ না থাকেন তবে তার থেকে প্রকৃতজ্ঞান বিতরণের আশা করা অসম্ভব । অন্য সকল পেশায় যাই হোক অন্তত শিক্ষক যদি ভূখা পেটে থাকেন তবে তার থেকে জ্ঞান অর্জন করে প্রজন্ম সঠিক পথের দিশা পাবে এমনটা ভাবা অমূলক । প্রশ্ন জাগতে পারে, এতকাল এদেশের শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে যে জ্ঞান বিলিয়েছে তা কি যথেষ্ট নয় ? এর উত্তরে দু’টো কথা সহজেই বলা সম্ভব । প্রথমত-শিক্ষকদের মহানুভবতা । তারা আপন স্বার্থকে ত্যাগ করে, বুকের মধ্যে হাজার কষ্ট, ক্ষুধার যন্ত্রনা, পারিবারিক অশান্তি চেপে রেখে জ্ঞান বিতরণ করে আসছেন । দ্বিতীয়ত-বর্তমানে শিক্ষার্থী সমাজের জ্ঞানের পরিধির চেয়ে আরও ব্যাপক সমৃদ্ধশালী পরিধি হতে পারত যদি শিক্ষকরা নিশ্চিন্তে পাঠদানে মনোযোগী হওয়ার অবকাশ পেতেন । কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের অনেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করতে নারাজ কেননা এখানে যা বেতন পাওয়া যায় তা দিয়ে ভদ্রভাবে সমাজে চলা যায় না । শিক্ষকতার পেশায় সর্বোচ্চ মেধাবীদের প্রবেশের অভাবে শিক্ষার্থীদেরকে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় । তবে আমাদের দেশের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সমপর‌্যায়ের শিক্ষকরা যথেষ্ট জ্ঞানের ধারক কিন্তু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ঘাটতি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরেই সৃষ্টি হয় । যে ক্ষত পরবর্তীকালে অনেক চেষ্টা করেও পূরণ করা সম্ভব হয় না ।

 

গত ১৯ জানুয়ারী ছিল জাতীয় শিক্ষক দিবস । সারা বছরে শিক্ষকদের খোঁজ না নেয়া হলেও অন্তত এই একটি দিনে জানা উচিত শিক্ষকরা কেমন আছে । পিতা সন্তানের জন্ম দিয়েই তার দায়িত্ব অনেকটা পালন করে ফেলেন কিন্তু সে সন্তানকে মানুষ করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব একজন শিক্ষকের । তাইতো শিক্ষককে দ্বিতীয় পিতাও বলা হয় । কবি গোলাম মোস্তফা অত্যন্ত সুন্দর করে বলেছেন, ‘সকলের মোরা নয়ন ফুটাই, আলো জ্বালি সব প্রাণে/নব নব পথ চলিতে শেখাই- জীবনের সন্ধানে । পরের ছেলেরে এমনি করিয়া শেষে/ফিরাইয়া দেই পরকে আবার অকাতরে নিঃশেষে’ । এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে যারা মানুষ গড়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেই তাদের জীবন-যাপনে রাষ্ট্র কতটা স্বাভাবিকতা দিতে পেরেছে তা নিয়ে রয়েছে শত প্রশ্ন । আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে একজন শিক্ষকের রাষ্ট্র নির্ধারিত বেতন দিয়ে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কতটা মানবিক জীবন যাপন করতে পারছেন তা ভেবে দেখার মত অভিভাবকের খুব সংকট চলছে । বাংলাদেশের মত এমন কোন রাষ্ট্র বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ যেখানে শিক্ষকদের বেতন এত সামান্য । এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে শিক্ষকরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোতে মানসম্মত বেতন পায় যা দিয়ে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ ভদ্রভাবেই সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে । এমনকি সেখানে শিক্ষকদের বেতন এতই ভালো অঙ্কের যে কারণে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তূখোড় ছাত্ররা নির্ভাবনায় শিক্ষকতার পেশায় আসছে । অথচ বাংলাদেশ ? এখানে শিক্ষকদেরকে প্রতি বছর মানসম্মত বেতন পাওয়ার দাবীতে রাজপথে আন্দোলনে নামতে হয় । কখনো কখনো শিক্ষকদের দাবী তো পূরণ হয়না বরং নিষিদ্ধ পিপার স্প্রে, লাঠিচার্জ কিংবা রাবার বুলেটে তাদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয় । শিক্ষকদেরকে দমনে যাদের ব্যবহার করা হয় তারা সদ্য কোন শিক্ষকদের দানে পাওয়া জ্ঞান ও শিক্ষা সনদের ভিত্তিতে এ দায়িত্ব পেয়েছে ! বিশ্বের এমন কোন দেশের নাম বিগত এক যুগেও শোনা যায়নি যেদেশের শিক্ষকদেরকে শ্রেণীকক্ষের পাঠদান স্থগিত রেখে মাসের পর মাস আন্দোলন করতে হয়েছে শুধু কোনভাবে দিন গুজরাণ করার নিশ্চয়তা পাওয়ার আশায় । এমন এমন অফিসারের দ্বারে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে যাদেরকে শিক্ষক স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের জ্ঞান দান না করলে আজকের অফিসার তো দূরের কথা কেরাণী হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারত না । শিক্ষকেদেরকে নিয়ে এমন ঠাট্টা কেন ? বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই কেননা ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারী দেশের ২৬ হাজার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে মাইলফলক স্থাপন করেছে এবং শিক্ষকদেরকে অভাবের কষাঘাত থেকে টেনে তুলেছে তবুও বর্তমানে তারা যা বেতন পাচ্ছে তা দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা ও পরিবারের সকল সদস্যদের ভরণ-পোষণ কি আদৌ সম্ভব ।

 

সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমমানের শিক্ষকদের বেতন যদিও পুর্ণ মানসম্মত নয় তবুও তা নিয়ে খুব বেশি বলব না । কারণ তাদের যোগ্যতায় তারা শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেকভাবেই বাড়তি কিছু আয় করার ক্ষমতা রাখেন । কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের এমন নিম্নমানের বেতন দিয়ে কি ভদ্রভাবে জীবন চলে ? প্রাথমিক স্তরের একজন শিক্ষক ছাত্রের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কেননা শিক্ষার এ স্তরে যদি কোন শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় শিক্ষার ঘাটতিতে পড়ে তবে জীবনে সে শিক্ষার্থীর পক্ষে পূর্ণ শিক্ষিত হওয়া অসম্ভব হয় দাঁড়ায় । সেই শিক্ষকদেরকে যদি ক্লাসে বসে দুশ্চিন্তা করতে হয় তবে শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের কতটা দান করতে পারে ?  প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাজীবনে অনেক স্যারকে আফসুস করে তাদের সহকর্মীদের সাথে বলতে শুনেছি তাদের অসহায়ত্বের কথা । বলতেন, যা বেতন পান তা অর্ধ মাসেই শেষ হয়ে যায় । বাকি দিনগুলো ধার-দেনা করে অমানবিকভাবে কাটাতে হয় । নবম শ্রেণীতে বসে বাংলা স্যার সবাইকে জীবনের লক্ষ্য লিখতে বলেছিলেন । শিক্ষকতাকে মহান পেশা ভেবে শিক্ষক হব বলেই লিখে দিয়েছিলাম । স্যার বলেছিলেন, অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা কর; ক্ষক নয় । সেদিন স্যারের কথার পূর্ণার্থ বুঝতে পারিনি কিন্তু আজ সমাজে শিক্ষকদের অবস্থান দেখে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি । সারা জীবন যিনি জ্ঞানের সাধনা করেছেন সেই ব্যক্তিটিকে উপজেলা পর‌্যায়ের শিক্ষা অফিসে গিয়ে ওখানকার করণিককে স্যার সম্মোধন করতে হয় অথচ এ করণিক জ্ঞান তাপসের ছাত্র হওয়ারও যোগ্যাত রাখে না ।

 

দেশের সামর্থ্য সম্পর্কে কম-বেশি আমরা সকলেই অবগত । শিক্ষকদের জন্য বিশাল কিছু দাবি করার বাসনা থাকলেও সাধ্য নাই । তবে শিক্ষকরা যাতে সাধারণ মানের জীবন-যাপন করতে পারে সে নিশ্চয়তাটুকু রাষ্ট্রকে অবশ্যই দিতে হবে । একজন শিক্ষক ন্যায়ের ধারক । অনেক অভাবের পরেও সে কোন অন্যায় পথে পা বাড়াতে পারে না কেননা শিক্ষক জাতির বিবেকতুল্য । কাজেই শিক্ষকদেরকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে তারা নির্বিঘ্নে ফুরফুরে মেজাজে পাঠদান করতে পারে এবং শিক্ষার্থীরাও যাতে উপকৃত হয় । ইতিহাস বলে, শিক্ষকদের অভাব চিরন্তন কিন্তু তাদের সে অসহায়ত্বকে সুযোগ ভেবে তাদেরকে আরো সমস্যায় ঠেলে ফেলার মানসিকতা ত্যাগ করে তাদের সহায়তায় রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে । সকল অভাব অনটনের উর্ধ্বে অবস্থান করে শিক্ষকরা যেন বলতে পারে, ‘শিক্ষক মোরা শিক্ষক, মানুষের মোরা পরমাত্মীয়, ধরণীর মোরা দীক্ষক’-এ নিশ্চয়তাটুকু তাদের দেয়া হোক । রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পেশা হিসেব শিক্ষকতাকে স্বীকৃতি এবং স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দিয়ে শিক্ষকদের জীবন-যাপনকে সহজ করে দেয়া সময়ের দাবী । শিক্ষক ভাবতেই যেন স্মৃতিপটে ভেসে না ওঠে কোন দারিদ্র্যে জর্জরিত মানুষের মুখচ্ছবি । শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদন্ড । সুতরাং এ মেরুদন্ডকে যারা সঠিকভাবে গঠনকরে তারা নিজেরাই যদি রোগাগ্রস্থ হয়ে পড়েন তবে জাতির মেরুদন্ড সঠিকভাবে গঠিত হবে না । তাই জাতীয় স্বার্থেই শিক্ষকদের স্বার্থের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা আবশ্যক ।

 

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

raju69mathbaria@gmail.com

০ Likes ১ Comments ০ Share ৩৬২ Views

Comments (1)

  • - টোকাই

    খুব সুন্দর । বেশ ভালো লাগলো ।

    • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

      ধন্যবাদ আপনাকে