[রোমান্টিসিজমের অগ্রপথিক ফরাসি সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী ভিক্টর হুগো ১৮০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের বেসানকনে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা দিয়ে শুরু করে উপন্যাসে হাত ছোঁয়ান। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়েছে। মুক্তিকামী এ লেখক দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জীবনসংগ্রামে, সামাজিক সংস্কারের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু তৃতীয় নেপোলিয়নের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ করার জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়। তাঁর জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হয় সোনালি বিশ-বিশটি বছর। তাঁকে ব্রাসেলস, জার্সি ও ওয়ের্নাসিতে এ বিশ বছর নির্বাসন জীবন কাটাতে হয়। নির্বাসিত বিশ বছর কালে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত ‘নেপোলিয়ন ডি পেটিট’ ও ‘হিস্টোরি ডান ক্রাইম’| এ বই দুটো লিখে তিনি তৎকালীন সময়ে আলোচনার ঝড় তোলেন। যৌবনের প্রারম্ভে উদার রক্ষণশীল হলেও কয়েক দশকের ব্যবধানে বাম ঘরনার রাজনীতিতে প্রভাবিত হন বিখ্যাত এ লেখক।
জোসেফ লিওপল্ড সিগিসবার্ট হুগো এবং সোফি টেবুচের অবৈধ সন্তান ভিক্টর হুগো। তাঁর জন্মের দুই মাস পর নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সম্রাট হন। তাঁর ত্রয়োদশ জন্মদিনে বরবন রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কালের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ভিক্টর হুগোর প্রথম উপন্যাস ‘দি লাস্ট ডে অব এ কন্ডেমড ম্যান’ প্রকাশিত হয় ১৮২৯ সালে। বিবেকের তাড়নায় তাড়িত হয়ে ১৮৩০ সালে রচনা করেন অমর উপন্যাস ‘হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম’।
কবিতা, উপন্যাস, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, দর্শন, সাহিত্য সমালোচনা সমগ্র ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৮৮৫ সালের ২২ মে এ মনীষী দেহত্যাগ করেন।]
উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করা ফরাসী সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, রোমান্টিসিজমের অগ্রপথিক ভিক্টর হুগোর কালজয়ী উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’| ক্লাসিক উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’ সমাজের সর্ব কোণে লুক্কায়িত বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, সামাজিক নিগূঢ় সমস্যা, জীবনের বিড়ম্বনা, নিগ্রহ জীবনযাপন, অপরিমেয় প্রাণপ্রাচুর্য, জীবনের উত্থান-পতন, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, কষ্টের এক নিখুঁত উপাখ্যান।
সর্বতোমুখী এই প্রতিভাধর নিজের জীবনে যেমন অসহনীয় দু:খ-কষ্ট-যাতনা মোকাবিলা করেছেন, তেমনি তাঁর লেখনিতেও স্থান পেয়েছে সমাজের ছিন্নমূল মানুষের মর্মবেদনা, হাসি-কান্না। উনিশ শতকের তৎকালীন ফ্রান্সের দরিদ্রক্লিষ্ট অসহায় মানুষের জীবন সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় কাহিনী ‘লা মিজারেবল’| সত্যিকারের বিপ্লব নির্যাতিতের মর্মঘাত বিস্ফোরিত হয়েই বের হয়। মানব জীবনের সুখ-দু:খ মিশ্রিত সত্যনিষ্ঠ উপখ্যান আর গভীর উপলব্ধির আশ্চর্য উপন্যাস এ ‘লা মিজারেবল’।
ভিক্টর হুগোর অমর সৃষ্ট চরিত্র জাঁ ভালজা জীবনের উত্থান-পতন, ঘটনা-দুর্ঘটনার এক করুণ সংগ্রামী জীবন কাহিনী এটি। দরিদ্রক্লিষ্ট অসহায় ভালজার মা অভাব-অনটনে বিনে চিকিৎসায় মারা যায় আর দারিদ্র্যপীড়িত কাঠুরে পিতাও পরপারে পাড়ি জমায় জাঁ ভালজাকে অনিশ্চয়তায় ফেলে। ফলে সে আশ্রয় নেয় বোনের সংসারে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সাতটি ভাগ্নে-ভাগ্নীসহ বোনের দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে বোন জামাইয়ের মৃত্যুর পর। এ অনাথ কচি শিশুদের মুখের আহার জোগাড় করতে এক টুকরো রুটি চুরির অপরাধে তাকে জেলে যেতে হয় এবং জেল থেকে পালানোর অপরাধে জেলের মেয়াদ বেড়ে মোট উনিশ বছর জেলের ঘানি টানতে হয়।
সৎভাবে জীবনযাপন করতে চান জাঁ ভালজা। বারবার হোঁচট খান। তবু তার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। সফলও হন। কিন্তু যাতনা তার পিছু ছাড়ে না। জীবনের বিড়ম্বনা তার যেন নিত্যসঙ্গী। একাধিকবার জায়গা বা নাম পরিবর্তন করেও অতীত মুছতে পারে না। পেছন তার সামনে এসে মোলাকাত করেই ছাড়ে। তবু সে ধৈর্য হারায় না। চেষ্টা ছাড়ে না। সৎভাবে বাঁচার সংগ্রামে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েও পুলিশ জাভেয়রের চোখ সে ফাঁকি দিতে পারে না। সে ভালজাকে আবিষ্কার করেই ছাড়ে। সৎ জীবনযাপন প্রত্যাশী, সমাজকে সৎভাবে পরিচালিত করার আইকন এ ভালজাকে সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আবারো শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জেলের কুঠুরিতে বন্দি করে। সুখের নাগাল সে পায় না।
তারপর সবকিছু হারিয়ে বৃক্ষহীন ক্লান্তিহীন নিদ্রাহীন পথচলায় অনাথ কোজেতকে আশ্রয় করে সুখের ঠিকানা খোঁজে সে। একটু সুখ, একটু স্বস্তি। হৃদয় নিংড়ানো মায়া-মমতা, স্নেহ, আদর, ভালোবাসা সবকিছু উজাড় করে এ অসহায় মেয়ের পিতৃত্বের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করে।
নিরন্তর উত্থান-পতনের মধ্যে নিঠুর এ পৃথিবীর নানা রকম কষ্ট ও যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে করতে কোজেতের স্বামী ম্যারিউসের কাছ থেকে বাবা-মেয়ের বিয়োগ ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে চিরদু:খী ভালজা মৃত্যুর সুমধুর শরবত পানের অধীর অপেক্ষায় প্রহর গোনে। পরিশেষে অন্তিম মুহূর্তে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়। স্নেহের বন্ধনে পুনরায় আবদ্ধ হয়ে তৃপ্তির স্বান্ত্বনা নিয়ে মৃত্যুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে ভালজা। এভাবে জাঁ ভালজা নামক এক হতভাগা তার দরিদ্র ও অসহায় জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনার ইতি টানে।
জীবনভর সৃষ্টিমুখর ভিক্টর হুগো মানব জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা-মর্মবেদনার গভীর উপলব্ধি আশ্চর্য শিল্পসুষমার সন্নিবেশ করেন এ উপন্যাসে। এ কারণেই ‘লা মিজারেবল’ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আর এর নায়ক জাঁ ভালজা বিশ্বসাহিত্যের এক বিশিষ্ট চরিত্র হিসেবে অমর হয়ে আছে।
লেখক: শেফালী সোহেল
Comments (4)
প্রকৃত অর্থে আমরা শান্তি চাই ...
হে ঈশ্বর সেই সাথে ডাইনীদের হাত থেকে মুক্তি চাই।
কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা ফেরৎ চাই।
নিজের ক্ষমতা বলেই স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে।