Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ভারতের সীমান্ত সম্প্রসারণ এবং অখন্ড ভারত কায়েমের স্বপ্ন

আমরা যে ভারতের কথা অহরহ উচ্চারণ করি সেই দেশটি সাংবিধানিকভাবে ভারত হিসাবে স্বীকৃত। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ইন্ডিয়া এলো কোথা থেকে। ইন্ডিয়া কখনো ভারতের নাম ছিল না। ইংরেজ আমলে দেশটির এ নাম দেয়া হয়। ইন্ডাস বা সিন্ধু থেকে ইন্ডিয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আবার সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। হিন্দুরা ইন্ডিয়া নামের কোনো দেশকে স্বীকার করে না। তাদেরকে এ নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ও বিষ্ণু পুরাণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত হওয়ায় ভারত বা ভারতবর্ষ নামটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আত্মার।

ভারত বরবারই অখণ্ড ভারত কায়েম করতে চায়। মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ধারণা হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত আবেগময় এবং তাদের অস্তিত্বের অংশ। ভারত বিভক্তি তাদের কাছে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা।

 

নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে সংঘ পরিবারের ২০ হাজার স্কুলে পাঠ্য ভূগোল বইয়ের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয় এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে এক্সপ্লেইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, "The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof."
অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না।

 

অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। অখন্ড ভারত গঠনের আদর্শ সাঙ্গাথান (হিন্দু ঐক্য) এবং শুদ্ধি (বিশুদ্ধিকরণ) ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আরএসএস নেতা এইচভি সেশারদির দ্য ট্রাজিক স্টোরি অব পার্টিশন শিরোনামে গ্রন্থে অখন্ড ভারত গঠনের ধারণার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থে সে লিখেছে, “Whenthe new viceroy Lord Mountbatten announced on 3rd June, 1947 theplan of transfer of power, it came as a stunning blow to the people. For thatplan, approved by Nehru and Patel, had envisaged cutting up Bharat and creationof Pakistan.The great and trusted leaders of Congress had turned their back on the sacredoaths they had taken and the pledges they had administered to the people. Whattook place on August 15, 1947, was this gross betrayal of the nation’s faith,the betrayal of the dreams of countless fighters and martyrs who had plungedinto the fire of freedom struggle with the vision of Akhanda Bharat in theirhearts.”

অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন নয়া ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তার এ ঘোষণা জাতির কাছে একটি মারাত্মক আঘাত হিসাবে বিবেচিত হয়। নেহরু ও প্যাটেল অনুমোদিত এ পরিকল্পনায় ভারতকে দ্বিখন্ডিত এবং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়া হয়। কংগ্রেসের মহান ও বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ তাদের পবিত্র ওয়াদা এবং জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে পিঠটান দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা ছিল জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং হৃদয়ে অখন্ড ভারত কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে যেসব অগণিত যোদ্ধা ও শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেঈমানী।  

   
আরএসএস’র সাধারণ সম্পাদক ড. মোহন ভগৎ উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকারের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে ভারতের বর্তমান দুর্দশায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, এখনো সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। এ হিন্দুবাদী সংগঠনের মুখপত্র অর্গানাইজারে জাতিকে রক্ষায় হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করো শিরোনামে তার এসব উস্কানিমূলক উক্তি প্রকাশিত হয়।

সে বলে, আজ পরিস্থিতি এত  বিপজ্জনক যে, আমরা বন্দে মাতরম গাইতে এবং গরুকে মা হিসাবে সম্মান জানাতে ইতস্তত করছি। কেবলমাত্র অখন্ড ভারত এবং সম্পূর্ণ সমাজ (ঐক্যবদ্ধ সমাজ) সত্যিকার স্বাধীনতা বয়ে আনতে পারে।

সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অখন্ড ভারত গঠনের ধারণার ওপর জোর দিয়ে বলেছে, ভারত বিভক্তি হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বরং তাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র অখন্ড ভারত কায়েম করলে শান্তি আসতে পারে।

মোহন ভগৎ আরো বলেছে, সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত বিভক্তি কোনো সমস্যার সমাধান নয়। উপমহাদেশ বিভক্তি সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে যারা বিশ্বাস করত ইতিহাস তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। 

 

কাশ্মীর সফরে গিয়ে মোহন ভগৎ একই কথা প্নুর্ব্যক্ত করে বলেছে, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা জাতীয় স্বার্থে তাদের ভূখন্ড সম্প্রসারণে কোনো রাখঢাক করছে না। তাই ভারতকেও একই নীতি গ্রহণ করতে হবে। অনুষ্ঠানে জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এসকে সিনহা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুকরণে সার্ক দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, এ কনফেডারেশনের নিউক্লিয়াস হবে ভারত। মোহন ভগৎ তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এক টিভি সাক্ষাৎকারে দাবি করেছে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ভারতের অংশ এবং একদিন এ দু’টি দেশ ভারতে ফিরে আসবে।   

   
২০১২ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় জিডি বিড়লা হল অব রেসিডেন্সে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবার অখন্ড ভারত দিবস পালন করা হয়। ভুপাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ইলেক্ট্রোনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সদানন্দ সাপ্রি এ অনুষ্ঠানে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়।  ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ড. সাপ্রি তার ভাষণে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ধারণা ব্যাখ্যা করে। তার ভাষণে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য ছাত্র অনুরূপ শত শত সেমিনারের আয়োজন করে দেশপ্রেমের এ সত্যিকার মন্ত্র সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার শপথ নেয়। 

 

২০১১ সালের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালোরের বানাপ্পা পার্কে হিন্দুু জাগরণ বৈদিক নামে একটি সংগঠন অখন্ড ভারত সংকল্প দিবস পালন করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. প্রবীণ ভাই তোগাড়িয়া তার মূল প্রবন্ধে অখন্ড ভারতের স্বপ্ন চিরজাগরুক রাখার উদাত্ত আহবান জানায়।  

 

আরএসএস তাদের প্রাত্যহিক সামরিক শাখাস বা সমাবেশে কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয় যে, ভারতবর্ষের প্রাচীনতম জাতি ছিল সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি এবং ভারতবর্ষের অধিবাসীরা ছিল সুখী, সমৃদ্ধ ও ধার্মিক। সংঘ পরিবারের নেতৃবৃন্দ কখনো একথা বলতে ভুলে যান না যে, হিন্দু জাতির অনৈক্য এবং এই পবিত্র ভূমিতে মুসলমান ও ব্রিটিশের আগ্রাসন থেকে ভারতের সকল দুঃখ দুর্দশার জন্ম হয়েছে। সংঘ পরিবারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী এবং পশ্চিমে গান্ধার থেকে পূর্বদিকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত অখন্ড ভারত কায়েম করে অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনা। আরএসএস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়, হিন্দুত্ব হচ্ছে একটি জীবন ব্যবস্থা এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় হিন্দু। এ চরমপন্থী হিন্দু সংগঠনও ভারত সংকল্প দিবস পালন করে।   

 

দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয়দের চক্ষুশূল। ভারতের কংগ্রেস পার্টি কখনো দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন কংগ্রেস এক প্রস্তাবে বলেছিল, ”Geographyand mountains and sea fashioned India as she is and no human agency can changethat shape or come in the way of her final destiny. Once present passions hadsubsided the false doctrine of two nations will be discredited and discarded byall.” 

অর্থাৎ ভূখন্ড, পর্বত ও সমুদ্র ভারতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে এবং কোনো মানবীয় শক্তি ভারতের এ আকৃতি পরিবর্তন অথবা তার চূড়ান্ত ভাগ্যের পথে অন্তরায় হতে পারে না। বর্তমানে বিরাজিত মিথ্যা দ্বিজাতি তত্ত্বের আবেগ একদিন থিতিয়ে আসবে এবং সবাই তা পরিত্যাগ করবে।
কংগ্রেস ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেছে। মুসলিম লীগের মতো সংখ্যালঘু  মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করলে তারাও দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক হতো। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করার অর্থ ভারতে একটি মাত্র জাতি ছাড়া আর কোনো জাতির বসবাসের অধিকার নেই। এ ধরনের মানসিকতা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অস্তিত্ব অস্বীকার করার শামিল।       
    
ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর বসতিস্থল হলেও এখানে একটি মাত্র জাতির শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্যণীয়। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দাবিদার এ জাতি ভারতের তিন-চতুর্থাংশের ওপর নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং উপমহাদেশের বাদবাকি অংশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের অশুভ চক্রান্তে নিয়োজিত রয়েছে। ভারতীয়দের কাছে ভারত হলো মায়ের মতো অবিভাজ্য। ব্রিটিশদের বিদায় করার স্বার্থে তারা সাময়িকভাবে ভারত বিভক্তি মেনে নিয়েছিল। পরবর্তী কার্যকলাপে ধরা পড়ে যে, অখন্ড ভারত কায়েম করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে এক জাতিতে বিশ্বাসী এ শক্তি ধীরে ধীরে উপমহাদেশকে গ্রাস করছে। তাদের আগ্রাসী থাবায় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর ভবিষ্যৎ বিপন্ন। সুদূর অতীতকাল থেকে তারা অখন্ড ভারত কায়েমের স্বপ্ন লালন করছে। বিগত ও চলতি শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অশান্তির মূলে রয়েছে ভারত। দেশটি প্রতিটি প্রতিবেশি বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রতিবেশিদের জন্য বরাবরই নিজেকে একটি হুমকি হিসাবে প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই সব। অন্য দেশগুলো তার ইচ্ছার কাছে জিম্মি। দক্ষিণ এশিয়াকে পদানত করতে ভারত প্রাচীন চানক্য নীতি অনুসরণ করছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ হচ্ছে চানক্য নীতির মূল লক্ষ্য। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিদায় লগ্ন থেকে অখন্ড ভারত কায়েমে ভারতের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ শুরু হয়।

১৯৪৭ সালের ১১ জুলাই প্রণীত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি পায়নি বহু দেশীয় রাজ্য। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টে বলা হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো হয়তো ভারত নয়তো পাকিস্তানে যোগদান করতে পারবে। অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে। কিন্তু এ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গোয়ালিয়রে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে নেহরু ঘোষণা করে যে, যেসব দেশীয় রাজ্য ভারতের গণপরিষদে যোগদানে অস্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হবে। সে এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত একটির পর একটি দেশীয় রাজ্য গ্রাস করে। এসব দেশীয় রাজ্য গ্রাসে ভারত যখন যেমন তখন তেমন নীতি অনুসরণ করে নিজের সীমানা সম্প্রসারিত করেছে। 

১৯৪৭ সালের ২৫ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশীয় রাজাদের এক সমাবেশে বলে, তাদের রাজ্যগুলো টেকনিক্যালি ও আইনগতভাবে স্বাধীন হলেও কিছু ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে রাজাদের নিজস্ব শাসন বজায় রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরে তাদের পরামর্শ দেয়। মাউন্টব্যাটেন ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা বলতে আসলে ভারত সংলগ্ন দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিল। সে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছিল। অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।  

শক্তিপ্রয়োগ করা না হলে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতো। নয়তো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালে চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে এসব রাজ্য সফর করে পরিস্থিতিতে ঘৃতাহুতি দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ গোলযোগপূর্ণ রাজ্যগুলো সফর করা থেকে বিরত থেকে নিজেদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনে।
দুর্বল দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাসে ভারত কোনো ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করেনি। শক্তি ও কূটকৌশল ছিল দেশটির বিজয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। ভারত শুধু অন্যায়ভাবে দেশীয় রাজ্য গ্রাস করেছে তাই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোতেও দেশটি বারবার হস্তক্ষেপ করেছে এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে গলাটিপে হত্যা করেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ভারতকে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, পাকিস্তান একটি সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশদের সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান নয় বরং ভারতই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলে সে দেশে গুজরাট স্টাইলের দাঙ্গা হওয়ার কথা ছিল হাজারে হাজার। কিন্তু শিয়া-সুন্নিতে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেও আজ পর্যন্ত দেশটিতে হিন্দু বিরোধী একটি দাঙ্গাও হয়নি। ব্রিটিশরা পক্ষপাতিত্ব করে থাকলে করেছে ভারতের প্রতি। পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হলে জন্মু ও কাশ্মীর, পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা উড়তো না।

গত ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ঈসায়ী তারিখে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা সুব্রাক্ষণিয়ম স্বামী বাংলাদেশের কাছে এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করেছে। সে বলেছে, খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে এই জমি ভারতের হাতে ছেড়ে দিক বাংলাদেশ।

সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির এই শীর্ষ নেতার যুক্তি হলো, দেশ ভাগের পর অধুনা বাংলাদেশ থেকে এক তৃতীয়াংশ মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। অন্যথায় এসব মুসলমানের সংস্থাপনের জন্য বাংলাদেশকে এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড জমি ছাড়তে হবে ঢাকাকে। গত শনিবার আসামের শিলচর থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ এ খবর দিয়েছে।

পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বামীর যুক্তি হলো-সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ বিশ্বের যেসব দেশে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য সেখানে হিন্দুরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমনকি প্রকাশ্যে ধর্ম পালনেরও অধিকার নেই তাদের। একমাত্র ভারতেই যেহেতু হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে সীমান্তপার (বাংলাদেশ) অনুপ্রবেশ সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

সুব্রাক্ষণিয়ম স্বামীর বক্তব্য হলো, ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল ভারত ভূখণ্ড। তাই পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে এদেশে যেসব মুসলমান অনুপ্রবেশ করেছে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। অন্যথায় এদের সংস্থাপনের জন্য জমি ছাড়তে হবে ঢাকাকে।

স্বামীর মতে, অধুনা বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সীমান্ত টপকে ঢুকেছে এদেশে। তাই এদের ফিরিয়ে না নিলে বাংলাদেশকে ছেড়ে দিতে হবে সে দেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড।
স্বামীর প্রস্তাব, খুলনা থেকে সিলেট অবধি সমান্তরাল রেখা টেনে এই জমি ভারতের হাতে ফেরত দিক বাংলাদেশ। তবে স্বামী জানিয়েছে, এ নিয়ে সে এখনো মোদি বা বিজেপির সঙ্গে কথা বলেনি ঠিকই, কিন্তু নতুন এই তত্ত্বের কথা যথাসময়ে দেশের সংসদে উত্থাপন করবে। সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন সে কথাসে দলীয় নেতৃত্বকে বুঝিয়ে বলবে।

মূলত এ অঞ্চলে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিরোধিকারীদের অধিকাংশই চরম সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষী। তাদের লক্ষ্য মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে সরিয়ে দেয়া। তাই যতদিন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দেশ দু’টির মানুষ নিজেদেরকে ভারতীয়দের থেকে পৃথক হিসাবে ভাববে ততদিন তাদের ভৌগোলিক সীমানা অক্ষুন্ন থাকবে। নয়তো অখন্ড ভারতে আত্মবিসর্জন হবে চূড়ান্ত পরিণতি।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র:
(১) শাহাদাৎ হোসেন খান লিখিত ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ
(২) উইকিপিডিয়া: দ্য ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়া
(৩) ভারত রক্ষা. ডট কম
(৫) কাশ্মীর ইন দ্য ক্রসফায়ার: ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ড
(৫) পাকিস্তান: অ্যা মডার্ন হিস্ট্রি: আয়ান ট্যালবট

০ Likes ০ Comments ০ Share ৮০৪ Views

Comments (0)

  • - মুন জারিন আলম

    ঊষার ভোরে আসে না ছুঁটে চরণে নাই নূপুর ,
    শৈলের চুঁড়ে মেলে না দেখা কাঁকনে সুর বিধুর। 
    গাঙের তীরে বসে না একা পিছনে ছোটে কুকুর,
    কোথায় নারী যাবে সে আজ সামনে আছে অসুর।

    ভাল।ধন্যবাদ।

    • - প্রহেলিকা

      কৃতজ্ঞতা জানবেন।

    - রোদের ছায়া

    উদলা দুপুরে উঁইধরা মনে উঁকি দেয় উন্মনা।
    উথলা দরিয়া বক্ষে ধরে সুর তুলে খঞ্জনা।
    কলসি কাঁখে আসমান পানে খুঁজে ফিরে সান্তনা।
    অবলা বলে রমণীরা কেন এত পায় বঞ্চনা?

    কবিতায় যখন নিজের মনের কথাগুলো খুঁজে পাই তখন বেশ লাগে।

    কবিতায় অনেক ভালো লাগা রইলো। নারীকে সথক রূপে তুলে ধরেছেন মনে হল।

    • - প্রহেলিকা

      ধন্যবাদ আপনাকে। কৃতজ্ঞতা জানবেন।

    - লুৎফুর রহমান পাশা

    আপনার কবিতা ভাল হয়েছে।

    কিন্তু নারীদের সেই দিন কি আর আছে?

    • - প্রহেলিকা

      কৃতজ্ঞতা জানবেন। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায় এমনটি।

    Load more comments...