Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শহীদ দেশপ্রেমিক তিতুমীরের ১৮২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি


দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনচেতা পুরুষ হিসেবে খ্যাত তিতুমীর। তিতুমীরের আসল নাম মীর নিসার আলী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা । ভারতবর্ষের পরাধীনতাকে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করার জন্য তিনি নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন। তিতুমীর তাঁর পাঁচশ অনুগামী সহ নারিকেলবাড়িয়ায় নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ ঘোষণা করেন এবং শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এরফলে ক্ষুব্ধ বৃটিশ সরকার তিতুমীরকে দমন করার জন্য বিপুলসংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য এবং কামান নিয়ে বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও বৃটিশদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে বেশীক্ষন টিকে থাকতে পারেনি। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর কামানের গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই তিতুমীর শহীদ হন। আজ তাঁর ১৮২তম শহীদ দিবস, শহীদ দিবসে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

তিতুমীরের জন্ম ১৭৮২ সালের ২৭শে জানুয়ারী। চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার আন্তঃপাতী চাঁদপুর গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মীর হাসান আলী। মায়ের নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীররা চার ভাই-বোন। তিতুমীরের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, বাবার কাছে। ১৭৮৬ সালে তিতুমীরের বয়স যখন ৪ বছর তখন বাবা মীর হাসান আলী তাঁর হাতে তখতী দিয়ে হাতেখড়ি দেন। হাতেখড়ির পর তিনি গ্রামের ওস্তাদের কাছে উর্দূ, আরবী, ফারসী, বাংলা ভাষা ও ধারাপাত (অংক) শেখেন। এরপর গ্রামের মাদ্রাসায় তিতুমীর ২ বছর শরীয়তী ও তরীকতী পড়াশুনা করার পর ১৭৯৮ সালে শিক্ষাবিদ হাফিজ নিয়ামত উল্লাহ'র সাথে বিহার শরীফে যান। ৬ মাস শিক্ষাসফর শেষে ওস্তাদ-সাগরেদ মিলে চাঁদপুরের হায়দারপুর গ্রামে ফিরে আসেন।১৮০১ সালে ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেইসাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা, দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করেন।

ব্যাক্তিগত জীবনে তিতুমীর মায়মূনা খাতুনকে বিয়ে করেন। মায়মূনা খাতুন ছিলেন চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়ার অন্তর্গত খালপুর গ্রামের হযরত শাহ সূফী মুহম্মদ রহীম উল্লাহ সিদ্দিকীর মেয়ে। কর্মজীবনে তিতুমীর যেখানে যেতেন সেখানেই নানা বিষয় শেখার চেষ্টা করতেন ফলে কর্মজীবনে তিনি কোথাও স্থায়ী হতে পারেনি। খুব সম্ভবত ১৮০৮-১৮১০ সালের কোনো এক সময়ে ভাগ্যন্বেষণে কলকাতা শহরে আসেন তিতুমীর। এখানে তিনি কুস্তি লড়াইয়ের প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন। তিনি একবার কলকাতায় কুস্তি লড়াইয়ে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর থেকে তিতুমীরের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই কারণে তিনি জমিদার মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সুনজরে পড়েন। মির্জা গোলাম আম্বিয়া ছিলেন কলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার। জমিদারের সান্নিধ্যে তিতুমীর এখানে বসে যুদ্ধ জয়ের সামরিক কৌশল আয়ত্ব করেন। ১৮১৫ সালের দিকে ব্রিটিশ-ভারতের সরকারী নথি অনুযায়ী তিতুমীর বাজে ও দুষ্ট প্রকৃতির ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৮২২ সালে তিনি হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলেন। কাবা শরীফে হজ্জ পালনের পর তিনি মদিনায় গমনের উদ্যোগ নেন। হজ্জে যাওয়ার পর থেকেই তিতুমীরের চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। তখন তিতুমীরের বয়স ৩৯ বছর। মদিনার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে মিশর, পারস্য, আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দর্শন ও পীর-আলেমদের কবর জিয়ারত শেষে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন তিনি। এ সময় তিতুমীর ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। ১৮২৭ সালে নিজ গ্রামে ফিরে এসে তিনি শিরক ও বিদয়াতমুক্ত মুসলিম সমাজ গঠনের দাওয়াতে নেমে পড়েন। মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দিকেও মনোযোগ দেন তিনি। তাঁর কাজ শুরু হয় চব্বিশ-পরগনা ও নদীয়া জেলায়। তিতুমীর নদীয়া জেলার নারিকেলবাড়িয়ার কাছাকাছি হায়দরপুরে বসবাস শুরু করেন এবং ধর্ম সংস্কারক হিসেবে তাঁর কাজ অব্যাহত রাখেন। এসময় তিতুমীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। ১৮২৮ সাল পর্যন্ত তিতুমীরের মুসলিম সমাজ গঠনের দাওয়াত শান্তিপূর্ণভাবে চলে। তিনি ধীরে ধীরে ওয়াহাবী আন্দোলনের মতাদর্শ প্রচারের স্বল্পকালের মধ্যেই ৩-৪শ শিষ্য সংগ্রহ করেন ৷

ক্রমেই তিতুমীরের বিচক্ষণতা এবং পারদর্শিতা সবার দৃষ্টি কাড়ে। শুধু ধর্মসংস্কারই নয়, হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে নিম্নবিত্ত মুসলমান জনসাধারণকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যেও তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বীয় ধর্মের অত্যাচারিত মানুষ তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যে হিন্দু জমিদাররা ভয় পেয়ে যায় ৷ তিতুমীরের কার্যকলাপে রুষ্ট হয়ে ওঠেন জমিদার ও নীলকররা এবং তারা সবাই মিলে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ওয়াহাবীদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার, এমনকি তাঁদের দাড়ির ওপর খাজনা আদায় শুরু হয়। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত দাড়ির খাজনা (Beared Tax) এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপর তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। ফলে তিতুমীর জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।। কিছুদিনের মধ্যেই দেবনাথ রায় (গোবরা গোবিন্দপুর), গৌড়ী প্রসাদ চৌধুরী (নাগপুর), রাজনারায়ণ (তারাকান্দি), কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় (গোবরডাঙ্গা) প্রমুখ হিন্দু জমিদারদের সাথে তিতুমীরের লড়াই বাঁধে। সেইসময় স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে তিতুমীর জয়লাভ করেন ৷ তাঁর দলে অনেকে এসে যোগ দেয়। তাঁর নির্দেশে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা জমিদারদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠায় তিতুমীরকে দমন করার জন্য। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ও তার সিপাহি বাহিনী তিতুমীরের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়। ওই বছর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় পার্শ্ববর্তী সরফরাজপুরে (বর্তমান সর্পরাজপুর) শত শত লোক জড় করে লাঠিসোঁটা, ঢাল-তলোয়ার, সড়কিসহ শুক্রবার জুমার নামাজরত অবস্থায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওইদিন দু'জন মৃত্যুবরণ করেন, আহত হন অসংখ্য যোদ্ধা। ১৮৩১ সালের ১৭ অক্টোবর তিতুমীর তাঁর লোকজন নিয়ে সরফরাজপুর থেকে নারকেলবাড়িয়ায় হিজরত করেন। জমিদার ও ব্রিটিশদের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলার জন্য নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে একটি সুদৃঢ় বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন তিনি ৷ওই বছর ২৯ অক্টোবরেই কৃষ্ণদেব নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে বহু লোক হতাহত করে। ৬ নভেম্বর কৃষ্ণদেব আবার নারকেলবাড়িয়ার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করল। উভয় দলের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হলো। হতাহত হলো প্রচুর। আটী নীলকুটির ম্যানেজার মি. ডেভিস ক্ষেপে গিয়ে প্রায় ৪ শতাধিক হাবশী যোদ্ধা ও বিভিন্ন মরণাস্ত্রসহ নারকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করলেন। প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে এবারও বেশ কিছু লোক হতাহত হল। তিতুমীর বাহিনীর কাছে নিশ্চিত পরাজয় দেখে শেষ পর্যন্ত মি. ডেভিস প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ২-৩ দিন পর জমিদার দেবনাথ বাহিনী নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে এলেন। গোলাম মাসুম এই খবর শুনে তাঁর বাহিনী নিয়ে জমিদার দেবনাথ বাহিনীকে মোকাবেলা করেন। এখানেই জমিদার দেবনাথ প্রাণ হারায়। এ রকম কয়েকটি সংঘর্ষের পর ১৩ নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য, দু'টি কামানসহ নারকেলবাড়ীয়ায় পাঠায়। প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় তিতুমীর বাহিনীর সাথে। এতে উভয় পক্ষের লোক হতাহত হয়। যুদ্ধে দারোগা ও একজন জমাদ্দার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি. আলেকজান্ডার পালিয়ে বেঁচে যান।

১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। তত্কালীন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ও কর্নেল স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে বিরাট সেনা বহর পাঠান তিতুমীরকে শায়েস্তা করার জন্য। কর্নেল স্টুয়ার্ড বিরাট সেনাবহর আর গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। স্টুয়ার্ডের ছিল হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য আর অজস্র গোলাবারুদ। তিতুমীরের ছিল মাত্র চার-পাঁচ হাজার স্বাধীনতাপ্রিয় সৈনিক। তাঁর না ছিল কামান, না ছিল গোলাবারুদ-বন্দুক। তবুও প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। তিতুমীর আর তাঁর বীর সৈনিকরা প্রাণপণ যুদ্ধ করলেন। কিন্তু তাঁরা তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে কেউ পিছু হঠেননি, জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়েও যাননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইংরেজ সৈনিকদের গোলার আঘাতে ছারখার হয়ে যায় নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা। শহীদ হলেন বীর তিতুমীর। শহীদ হলেন অসংখ্য মুক্তিকামী বীর সৈনিক। তিতুমীরের ২৫০ জনেরও বেশী সৈন্যকে ইংরেজরা বন্দী করল। এঁদের কারও হলো কারাদণ্ড, কারও হলো ফাঁসি। আর এভাবেই শেষ হলো নারিকেলবাড়িয়ার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা যুদ্ধ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই বাঁশের কেল্লা পরবর্তী লড়াই-সংগ্রামকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তিতুমীর জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তাঁর বাঁশের কেল্লার জন্য জগৎবিখ্যাত হয়ে আছেন।

আজ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শহীদ তিতুমীরের তাঁর ১৮২তম মৃত্যুৃবার্ষিকী। তিতুমীরের শহীদ দিবসে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

১ Likes ৪ Comments ০ Share ১২৭৪ Views

Comments (4)

  • - নীল সাধু

    ধন্যবাদ আপনাকে।

    আশা করছি বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড এর আহবানে সাড়া দেবে আগ্রহীরা; এই সুযোগ গ্রহণ করবেন নবীন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকেরা।

    ভালো থাকুন।

    • - জাজাফী zazafee

      নীল সাধু আপনার মন্তব্য দেখে ভীষন ভাল লাগলো। তবে আমার মনে হয় অনেকেই আছেন যারা ভাল লেখেন কিন্তু পান্ডুলিপি চুরি হওয়া বা নকল হওয়া (কুম্ভীলকদের হাত থেকে বাচার জন্য) জমা দিতে চায়না। যারা লেখা প্রকাশ করে নবীন লেখকদের এতো বড় উপকার করবেন তাদের জন্য শুভ কামনা।

    - লুৎফুর রহমান পাশা

    দারুন উদ্দ্যোগ। এগিয়ে যান।

     

    - শামীম চৌধুরী

    ভাল উদ্যোগ

    Load more comments...