Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

একজন আনমনা

১০ বছর আগে

"ব্যক্তিগত কষ্টের একটি দিন- প্রিয় মানুষটি শান্তিতে থাক"

 

পৃথিবীর এক নিষ্ঠুর নিয়ম- যত সুখ, যত মায়া, প্রিয়জন সব ছেড়ে একদিন ঠিক ঠিক জীবনের শেষ ট্রেন ধরে অন্য এক পৃথিবীতে পাড়ি দিতেই হবে।

 

এই পৃথিবীতে শুধু দুইজন মানুষ যারা কোনদিন আমার নাম ধরে ডাকেননি। যদি কখনো ডেকেও থাকেন আমার মনে নেই। সারাজীবন তারা আমাকে ডেকেছে "মা" অথবা "আম্মু" বলে। সত্যি বলতে আমার নিজের বাবাও কখনো আমাকে মা বলে ডাকেনি। কখনোই না। আর যাদের কথা বলছি তারা আমার বড় কাকা আর বড় জেঠু। আমি গ্রামের বাড়িতে গেলেই যেই মানুষ টা সারাদিনের সমস্ত ব্যবসা বানিজ্য, শালিস-দরবার, রাজনীতি সব শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকার আগেই আমাকে খুঁজে নিয়ে একসাথে ঘরে ঢুকতেন তিনি আমার বড় কাকা। হাসি ঠাট্টা, মজায় আনন্দে আমার বাপ চাচাদের মধ্যা সেরা। রাতে খাবার টেবিলে বসে আগে আমাকে ডাকতেন। আমাকে আর ছোট ছেলে আলিফ কে একটু বেশীই আদর করতেন। যতদিন বাড়ি থাকতাম প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে আমার আর আলিফের জন্য এইটা সেইটা কতকিছু নিয়েই না বাড়ি ফিরতেন। আমাকে আর আলিফ কে যেন কেও বিরক্ত না করে যেজন্য নিজেই বসে বসে পাহারা দিতেন।

 

বড় কাকার তিন ছেলে মেয়ে নেই। একটা মেয়ে জন্মের তিন দিন পর পৃথিবী ছেড়েছিল। বাবুনী, বাবার আদর বুঝার আগেই সৃষ্টিকর্তা তাকে ডেকে নিয়েছিল। শুনেছি আমাদের আরও একটা বোন ছিল সেও এভাবেই চলে গেছে। একটা মেয়ের জন্য কাকা আর সেঝো বৌ (চাচী, চাচীদের আমরা বৌ বলেই ডাকি) এর সে কি চাওয়া। এই চাওয়া টাই আমাকে বড় কাকার আরও ভয়ংকর কাছের একটা মানুষ বানিয়ে দিলো। আমি তখন বেশ ছোট, একদিন কাকা খুব আফসোস নিয়ে বলছিল- ‘সবার আছে আমার একটা মেয়ে নাই, আল্লাহ্‌ সবাইকে সব কিছু দেয়না’, সেদিন আমি বলেছিলাম- ‘কে বলেছে নাই, আমি তো আছি। আমি আপনার মেয়ে, আজ থেকে আপনার আর সেঝো বৌয়ের মেয়ে আমি’। আমি ঢাকাতেই বড় হয়েছি, পড়াশুনা সবকিছুই এখানে। আমার সব পরীক্ষার আগে কাকা মিলাদ পড়াতেন, রেজাল্টের পড় মিষ্টি বিলাতেন, মসজিদে দোয়া পড়াতেন। কখনো অসুস্থ হলে কাকা সব মসজিদে দোয়া পড়াতেন। ২০১০ যখন ভয়ংকর রোড অ্যাকসিডেন্ট করে খুব খারাপ অবস্থা তখন বাবা, কাকা। জেঠু কেউই আমার পাশে ছিলেন না। এক মাস হসপিটাল আর বিছানায় থাকার পর বাবা আর কাকা মিলে আমাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলো। তখন ও আমি হাঁট তে পারতাম না ঠিক ঠাক কথাও বলতে পারতাম না। সেখানে প্রতি মুহূর্তে কি লাগবে, কেমন আছি এই সেই মিলাদ পড়ানো সব করেছিল কাকা। সবসময় গ্রামের বাড়িতে গেলে বাড়ি ঢুকার আগে বাস থেকে নামলেই দেখেছি কাকা বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। বাস থেকে নেমেই ভরা বাজারে কাকাকে সালাম করেছি সবসময়, আর কাকা আব্বু আম্মুকে। গ্রামে বাবা চাচাদের বেশ নাম ডাক। সবাই চেনে। আল্লাহ্‌র রহমতে শ্রদ্ধা আর সম্মানের মোটামুটি বেশ ভালো অবস্থানেই আছেন তারা। সবাই অবাক হয় ভাইদের এমন মুহূর্ত দেখে। প্রতি ঈদে বাবা মায়ের বর কাকা আর সেঝ বৌ কে সালাম করেছি। আর সবার আগে কাকা আমাকে সালামি দিতেন। দিনে কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় কাকা সহ সবার ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াতাম। হাসি মজা খাওয়া দাওয়া সব মিলিয়ে ঈদ বেশ আনন্দে কেটে যেতো। 

 

গত রোজার ঈদে বাড়িতে গেলাম। বাস থেকে নামার আগ মুহূর্তে কিছুই বুঝলাম, খুব কষ্ট লাগছিলো। মনে হচ্ছিল চিৎকার করে কেদে ফেলি। চোখ দিয়ে রীতিমতো পানি পড়ছিল। শুধু একটা কষ্ট তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল- “বাস থেকে নেমে আজ কাকে জড়িয়ে ধরবো, কাকে সালাম করবো, কে আমাকে জিজ্ঞেস করবে; কেমন আছিস মা? ক্ষুধা পেয়েছে? কিছু কিনে দেই??? বাস থেকে নেমে বাড়ি পর্যন্ত গেলাম... যতটুকু রাস্তা পার করে বাড়ির দিকে এগুচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল আর না, আর যেতে চাইনা। অনেক প্রিয় মানুষ আমি হারিয়েছি কখনো এতো কষ্ট পাইনি। বাড়ির রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই বড় পুকুর তাঁর একটু দূরে পারিবারিক কবরস্থান। কাকার কবর টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটা বড় রক্ত জবা ফুল গাছ কবর টা কে ছায়া দিয়ে রেখেছে, গাছ জুড়ে লাল লাল অসংখ্য জবা ফুল। সারাজীবন দেখেছি বড় কাকা প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হবার সময় এই কবরস্থানে যেতেন। দাদা-দাদু আর তাঁর মেয়েদের কবর জিয়ারত করে তারপর বাড়ি থেকে বের হতেন। একটা দিন ও ভুলেও ভুল হতোনা। রোগ শোক সবকিছুর উপেক্ষা করে তিনি তাঁর বাবা-মা আর মেয়েদের কবর জিয়ারত করতেনই। আজ তাদের পাশেই একটা জায়গা তার।

 

 ২০১২ সালের নভেম্বর এর ১৩ তারিখ। সকাল ১১টায় একটা ফোন পেলাম কাকা সেন্সলেস হয়ে গেছে। তার মাত্র কিছুক্ষন পর খবর এলো কাকা নাই। দুনিয়া টা ভেঙ্গে পড়লো। আমার বাবা বেশ অসুস্থ বড় কাকা বাবার ছোট আর ডায়াবেটিক ছাড়া তেমন অসুস্থ ও ছিলোনা বয়স ও বেশি হয়নি। আমার বাবার ভয়াবহ কান্না আমি সেদিন দেখেছি, ভাইয়ের জন্য তার ভিতর তেমন তোলপাড় হচ্ছিল দেখেছি। একটা ছেলে কিংবা পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে আমি কখনো দেখিনি কখনোই না। ততক্ষণে বুঝতে পারলাম আমি কথা বলতে পারছিনা, আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। যন্ত্রণায় বুক ফেটে যাচ্ছিলো। আমি কাদতেও পারচিলাম না। মনে হচ্ছে আমিও বোধহয় মরে যাবো। আম্মু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ‘তোকে এবার মা বলে কে ডাকবে?’ তখন কেন জানিনা চিৎকার করেই কেদে ফেললাম। আমি কখনোই এভাবেই কাদিনা, আমাকেও হয়তো এই প্রথম সবাই এভাবে কাঁদতে দেখেছে। তখন দেখলাম সবাই আমাকে সামলানোর চেষ্টা করছে, এতটা বেসামাল কি করে হয়ে গিয়েছিলাম। মানুষ চলে যাবে এই তো নিয়ম, আমিও একদিন চলে যাবো। তবে এতো কষ্ট কেন হচ্ছিল। বাড়ি যাওয়ার পুরোটা পথ এতো দীর্ঘ কেন হয়ে গিয়েছিলো জানিনা। কাকা সবসময় এসে আমাকে ঘরে নিয়ে যেতো সেদিন আসেনি। আমি তার সামনে বসে গেলাম সে আমাকে জড়িয়েও ধরলনা, মা বলেও ডাকল না। কি অদ্ভুত ভাবে সে ঘুমিয়েই থাকলো, ঘুমের মধ্যেই সে হাসছে। আমি কারো লাশ সহ্য করতে পারিনা, কিন্তু কাকার সামনে থেকে যেতে ইচ্ছে করছিলনা।নিয়ম নীতি, কি করা যাবে যাবেনা জানিনা এই হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম ঘণ্টার পর ঘন্তা। কি পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। এতো শান্তিময় আর হাসিভরা মৃতমুখ আমি এই প্রথম দেখেছি। এই পুরো সময়ে সেঝো বৌ কে একবার দেখেছি। তার অবস্থা কিংবা তিন ভাইয়ের অবস্থা কি ছিল বর্ণনা করার শক্তি আমার নেই। সেঝো বৌ আর ভাইয়েরা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল মনে হচ্ছিলও পৃথিবীটা এই মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাক, আমরা সবাই একসাথে হাসিমুখে চলে যাই। সেঝো বৌ কে পরের তিন দিন আমি ১০ মিনিট পর পর দূর থেকে দেখেছি, তার কাছে যেতে পারিনি। যেই মানুষটা প্রিয় রঙ লাল, যেই মানুষটা সেজে গুজে থাকতে খুব পছন্দ করত আজ এই মানুষটার গায়ে এই সাদা শাড়ীটা আমি কিংবা তিন ভাইয়ের কেউই মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্য আমাদের কারো ছিলোনা। সবাইকে বললাম "এই সাদা শাড়ীটা বদলে ফেলা যায়না??" কেউ উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। আমি তিন ভাইয়েরা, আমার বড় ভাইয়া আমার মা বলতে গেলে আমরা কেউই চাইছিলাম না এই সাদা শাড়ী তার পরনে থাক। কিন্তু সমাজ, নিয়ম, সেই সমাজের মানুষ- আমরা অসহায়। কাকা চলে যাওয়ার পর দেখেছি কতো হাজার হাজার মানুষ তাকে একবার শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করেছে, দুইটা অনেক বড় বড় জানাজার পর ও মানুষের এতো উৎকণ্ঠা, এই মানুষটার জনপ্রিয়তা জানতাম। কিন্তু তার এতো এতো জনপ্রিয়তা ছিল জানতাম না। একজন রিকশাওালা থেকে শুরু করে বর বর নেতা সহ গ্রামের গ্রামের বাইরের শহরের সব মানুষ একবার তাকে দেখতে এসেছিল। তার জানাজায় এসেছিল। মানুষের জন্য সে এতো করেছে। আসলেই মানুষ চলে গেলেই বুঝা যায় সে কতো বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কি অদ্ভুত সব কিছু। আজ একটা বছর হয়ে গেলো বড় কাকা নেই। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করেনা। সত্যি ইচ্ছে করেনা। এক বছর তার মা ডাক শুনিনা। মাঝে মাঝে বৌ কে ফোন করি কথা বলি ভাইদের ফোন করে কথা বলি, সেই অনুভুতি গুলো বলা যায় না। সবার কতটা কষ্ট হচ্ছে আমি বর্ণনা করতে পারবোনা, আমার কষ্টের একভাগ ও আমি বলতে পারছিনা। অনেক শোক অনায়েসে ভুলে গেছি শুধু এই একটা জায়গায় আটকে আছি। সব অনুভুতি আর ঘটনার মাঝের এক ভাগ ও বলা হয়নি। আর বলার মত শক্তিও নেই।

 

 আল্লাহ্‌ আমার এই বাবাকে বেহেশত্‌ নসিব করুক, উনাকে খুব শান্তিতে রাখুক।

 

জীবনে এতো বড় বড় কষ্ট আছে যে ছোট খাটো মন ভাঙ্গা, অবিশ্বাস, মিথ্যা এসব এখন খুব একটা কষ্ট দিতেই পারেনা... কথা গুলো এখানে কেন দিলাম? না দিলেই কি হত জানিনা। ঘরে একা বসে আছি, কষ্ট হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে, লিখতে লিখতেও কাঁদছিলাম। একটা মানুষ নেই যার সাথে শেয়ার করবো। মা বাবা সব গ্রামে, আমার যাওয়ার সুযোগ হলনা। একা একাই কষ্ট পাচ্ছি, খুব বেশী। এই অনুভুতি গুলো বুঝার ক্ষমতা অনেকেই রাখেনা। প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট কি প্রকট, কি তীব্র, কি ভয়ংকর। ফিরে আসবেনা কেউ, কোন কিছুর বিনিময়েও না।

-সৃষ্টিকর্তাও মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুর হয়ে যায়। মানুষ খুব অসহায়। খুব অসহায়।

 

 

প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর আজ জন্মদিন। তিনিও আজ এই পৃথিবীতে নেই। ক্ষমা করবেন প্রিয় লেখক, আপনাকে আজ মনে করে কষ্ট পাচ্ছিনা। এই সত্যটুকু বলার জন্য শুধু ক্ষমাই চাইতে পারি। আমার আজকের শোক খুব ব্যক্তিগত, আজকের দিনটি আমার বাবার জন্য। জানি এতে আপনার কিছুই এসে যাবেনা। আপনাকে মনে করবে কোটি কোটি ভক্ত কিন্তু আমার বাবার তো একটিই মেয়ে। ক্ষমা করবেন। 

১ Likes ১৭ Comments ০ Share ১০১২ Views

Comments (17)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    বাহিরে অনেক দেশেই বাংগালীর বদনাম আছে। তারা যদি এই গুলো একটু খেয়াল করতো তবে দেশটা অনেক এগিয়ে যেতো।

     

    • - জামাল হোসেন সেলিম

      ধন্যবাদ পাশা ভাই আমার পোষ্টে প্রথম মন্তব্য করার জন্য। বাহিরে বাঙালীর যেমন বদনাম আছে তেমন সুনামও আছে। পরিশ্রমী জাতি হিসেবে আমাদের সুনাম প্রায় সব দেশে। অভাব শুধু নীতি নৈতিকতা আর মানবিকতা বোধের। যার দায় আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা এড়াতে পারেন না। দেশে তাঁরা আমাদের ভিত্তিগুলো গড়ে দিতে পারছেন না। যার প্রতিফল এই।

    - সনাতন পাঠক

    বয়স্কা ঐ মহিলার ঘৃনা মেশানো হতভম্ব ঐ দৃষ্টি লাইন ভাঙ্গা সেই লোকটার নয় যেন আমার পিঠে এসে বিঁধছিলো বার বার।  কিছু বলার নেই

    ধন্যবাদ আপনাকে।

    • - জামাল হোসেন সেলিম

      আপনাকেও ধন্যবাদ রোদ ছায়া। শুভকামনা আপনার জন্য।

    - কামরুন নাহার ইসলাম

    "আমরা কী কোন দিনও সভ্য হতে পারবো না? দেশে আমরা অসভ্য জানোয়ারের মত চলাফেরা করি। সভ্যতা শেখানোর মত দেখানোর মত কেউ কোথাও নেই বলেই হয়তোবা। লাইন ভাঙ্গার সংস্কৃতি আইন আদালত থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্য্যন্ত সর্বত্র।"----------------

    আপনার প্রশ্নের জবাব আপনার  এই লেখাতেই বর্তমান। জাতি হিসেবে আমরা বাইরে গেলে লজ্জিত হই। কি আর করা -----------

    • - জামাল হোসেন সেলিম

      ধন্যবাদ আপা আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য।

    Load more comments...