Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

বর্ণ হীন

১০ বছর আগে

বুদ্ধদেব বসু-র একটি গদ্য কবিতা : দোকানিরা

এই নিবন্ধের বিষয় হচ্ছে, বুদ্ধদেব বসু-র একটি গদ্যকবিতা, “দোকানিরা”, একদিন চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা, ১৯৭১। মূল কবিতাটিতে যাবার আগে একটু তথ্যপঞ্জী সংগ্রহ ও স্মরণ করা যাক। বাংলা ভাষার প্রথম গদ্যকবিতা, “শিশুতীর্থ”, ১৯৩১, লেখা হয় রবীন্দ্রনাথের কলমে। প্রকাশিত প্রথম গদ্যকবিতার বই “পুনশ্চ”,১৯৩২, রবীন্দ্রনাথ। শেষ বয়সে যে সব গদ্য কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বাংলা কবিতার ইতিহাসে তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আমার বিচারে, “আমি” এবং “পৃথিবী” সেই ফসলের শ্রেষ্ঠ নজীর। মহাকবির হাতে প্রসূত হয়েও, বাংলা গদ্যকবিতা অবশেষে ঋজু, সবল, সাবালক হয়ে মাত্রাস্তনিত কবিতার সমকক্ষ রূপ পরিগ্রহ করেছিলো তিরিশের দু-জন কবির কলমে - জীবনানন্দ দাশ-এর হাতে আগে (১৯৩৫ – ১৯৫৪)১ ও বুদ্ধদেব বসু-র লেখায় একটু পরে (১৯৫২-১৯৭১)২ ।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত দিক-নির্দেশক প্রবন্ধ, “কাব্যের মুক্তি”, লিখলেও কাজে-কর্মে কোন গদ্যকবিতা লেখেন নি। বরং মন্তব্য করেছিলেন, “সাত্ত্বিক কবিমাত্রেই গদ্য-পদ্যের বিবাদ মেটাতে চেয়েছেন, কিন্তু কৃতকার্য হন নি। এতদিন পরে রবীন্দ্রনাথের অধ্যবসায়ে হয়তো সে বিরোধ ঘুচল। … স্বরাজ্য মজ্জায় মজ্জায় না থাকলে, নৈরাজ্য অমঙ্গলপ্রসূ। তাই, ভয় পাই, তপস্যকঠিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যেটা মোক্ষ, আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়তো সর্বনাশের সূত্রপাত।” ৩ বিষ্ণু দে সামান্য গদ্যকবিতা শেষ বয়সে লিখলেও, তিনি মূলত ফর্মের কবি এবং ছন্দোবদ্ধ কাব্যেই তিনি অনন্যতা সম্পন্ন। তিরিশের দশকে সমর সেন-এর গদ্যকবিতা বাহুল্যহীন ঋজু স্টাইলে নাগরিকতা ও বাম মতবাদ তুলে ধরেছিলো। কিন্তু মহৎ গদ্যকবিতা তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না।

গদ্য কবিতাকে মেরুদন্ডসম্পন্ন ঋজু হতে গেলে যে রাবীন্দ্রিক গদ্যকবিতাকে অতিক্রম করতে হবে, সেই চিন্তাটা জীবনানন্দ দাশ ৪ করেছিলেন : “ … গদ্য কবিতার একটা বিশেষ ভঙ্গি – যা ঠিক রবীন্দ্রনাথে পাওয়া যায় না – তার ভিতর কল্লোল নিজের মন খুঁজে পেয়েছিলো বোধ হয় ” ; “… আমাদের দেশে গদ্যকবিতার দাবি যখন নানা রকম অদেয় জিনিস চাইছিলো যখন খানিকটা রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে, অথবা আজকে – মার্কসীয় বিচারে কবিতা শুদ্ধ হল কিনা কোথাও কোথাও তার আশ্চর্য আতিশয্যের ভিতরে।” এই দুটো উদ্ধৃতি এবং চৈত্র, ১৩৪২ (১৯৩৫)-এ কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত গদ্যকবিতা “হাওয়ার রাত” – তার চলন, নির্মাণ, চিত্র-শ্রুতিকল্প, সংবেদনের রীতি এবং রাবীন্দ্রিক গদ্যকবিতার সঙ্গে পার্থক্যর থেকে এই সিদ্ধান্ত সমুচিত।

উপরে যেটুকু সংক্ষিপ্ত আকারে বললাম, তা সম্প্রসারণের তাগিদ রাখে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনার। কিন্তু সে সুযোগ এখানে নেই। আমার বিষয় বুদ্ধদেব বসু-র “দোকানিরা” কবিতার আলোচনা। তার আগে, তাঁর গদ্যকবিতা রচনা সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান দিই :
• ১২ গদ্যকবিতা/ মোট ২৬ কবিতা; আরো ২ কবিতায় আংশিক গদ্যকবিতা অংশ; মরচে পড়া পেরেকের গান , রচনা কাল (১৯৬২-১৯৬৬), প্রথম প্রকাশ ১৯৬৬, ভারবি।
• ১৭ গদ্যকবিতা; একদিন চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা, রচনা কাল (১৯৫২-১৯৭০), প্রথম প্রকাশ ১৯৭০, প্রকাশক প্রশান্ত বসু।
• ১০ গদ্যকবিতা/ মোট ২০ কবিতা; স্বাগতবিদায় ও অন্যান্য কবিতা, রচনা কাল (১৯৬৭-১৯৭০), প্রথম প্রকাশ ১৯৭১, এম. সি. সরকার এন্ড সন্স।
উল্লেখযোগ্য, যে কাব্য গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসু তাঁর দ্বিতীয় পর্বের পরিণত কবিতা শিল্পে উত্তরণ করেন, যে আঁধার আলোর অধিক, তার ভিতরে কোন গদ্যকবিতা নেই। তেমনি গ্রন্থাকারে অসংকলিত সর্বশেষ কবিতাগুচ্ছের ৫ টি কবিতার কোনটিই গদ্যকবিতা নয়।
১৯৫২-র দিক থেকে বুদ্ধদেব বসু যে সব গদ্যকবিতা লেখেন, তার বোধ ও নির্মাণ চিন্তার উৎসের উল্লেখ তিনি করেছিলেন ১৯৫২ সনে, নরেশ গুহ-কে লেখা একটি চিঠিতে :
কিছুদিন আগে বোদলেয়ারের গদ্যকবিতা এক খণ্ড আমার হাতে এলো। … ছোট বই, পড়ে উঠতে
এক ঘন্টার বেশি লাগে না, কিন্তু পড়ে ফেলতে সারা জীবন কেটে যায়। তোমাকে বলবো কী –
ঘুমের আগে বইখানা খুলে যে-কোনো পাতায় দুটি-চারটি লাইন যদি পড়ি, তা হ’লেই মন এক
বেদনা-মধুর শান্তিতে ভ’রে যায়। ঐ টুকুর বেশি দরকারই হয় না, ঐ একটুকু নিয়ে ভাবতে-
ভাবতেই মন যেন অসীমে গিয়ে পৌঁছয়। তাও তো অনুবাদে পড়েছি ; মূলে না জানি ভাষা-শিল্পের
দিক থেকে কত আশ্চর্য।
যে কথা প্রতীয়মান, তা হলো বোদলেয়ারের গদ্য কবিতাই শৈলী ও নির্মাণের দিক থেকে বুদ্ধদেবের আরাধ্য হয়ে ওঠে; এমন কি চিন্তার কিছু স্রোতও। অবশ্য তাঁর ভাষা বাংলা, এবং দ্বিতীয় পর্বের কবিতার ভাষাও তিনি ঐ কালেই গড়ে তুলছিলেন বোদলেয়ার, রিলকে অনুবাদের সঙ্গে-সঙ্গে। তাঁর গদ্যকবিতা রচনার শুরুর প্রক্রিয়ার বিবরণও তিনি দিয়ে গিয়েছেন একদিন চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা-র ভূমিকায় :

আজ থেকে অন্তত কুড়ি বছর আগে আমি একদিন কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল থেকে গড়িয়াহাটার ট্রামে বাড়ি ফিরছিলাম। সময়টা বোধ হয় চৈত্র মাস ছিলো, বেলা তিন টে নাগাদ হবে। মনে আছে রোদ ছিলো উজ্জ্বল, বাতাস শুকনো, রাস্তায় বৈকালিক ভিড় তখনো শুরু হয়নি। ট্রাম যখন পার্কসার্কাসের গোলাকার চৌরাস্তায় বাঁক নিচ্ছে ( আমার মতে কলকাতার বিরল সুন্দর স্থানের অন্যতম – অন্তত কুড়ি বছর আগে তা-ই ছিলো), তখন বাইরে তাকিয়ে হটাত আমার মনে হ’লো এই মুহূর্তটা অন্য কোনো দিনের। পরবর্তী মিনিটখানেকের মধ্যে আমার মনে কয়েকটি বাক্য রচিত হ’য়ে গেলো, বাড়ি ফিরে একটা খাতার কোণে তা লিখে রাখলাম। সেই পুরোনো খাতা খুলে দেখছি, একটি শাদাপাতার মাথায় লেখা আছে :“মাঝে-মাঝে এক-একটা দিনকে মনে হয় অন্য কোনো দিনের মতো । যেন একটা ঠেলা দিলেই দরজা খুলে যাবে। একটু আর-একটু।

“আর উপরে লেখা: “একদিন চিরদিন”। যেটুকু আপনা থেকেই ধরা দিল, তা যদি কখন একটি গদ্যকবিতায় পরিণত করতে পারি, তার শিরোনাম। … সে সময় আমি গদ্যকবিতা লেখার প্রথম চেষ্টা করছি : “বৃষ্টির দিন” ও “রাত্রি”র প্রথম খশড়া (খুব সম্ভব) তৈরি হ’য়ে গেছে। কিন্তু তার পর বহুকাল কেটে গেলো, ঐ পথে আর একটুও এগোতে পারলাম না। তবু সেদিন- কার ট্রামে প’ড়ে-পাওয়া ঐ কয়েকটি কথাও রইলো আমার সঙ্গে – আমার স্মরণে ; ঘুরে-ফিরে মাঝ-মাঝেই মনে পড়ে। অবশেষে ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে – আমি তখন ব্রুকলিনে দু-তিনদিন খেটে “একদিন চিরদিন” কবিতাটি লিখে উঠতে পারলাম, আর যেন তারই টানে পরবর্তী বছর দুয়েকের মধ্যে সেই জাতের আরো গদ্যকবিতা বেরিয়ে এলো।”

আমি যা বলছি, তা হলো বোদলেয়ারের গদ্য কবিতা তাঁর জন্য একটি আদর্শ প্রায় হয়ে উঠেছিলো। অবশ্য অভিজ্ঞতা ও বিষয় তো তার নিজস্ব । বুদ্ধদেব-এর কবিতার গদ্য টানা, স্থিতধী, নির্মেদ এবং আবেগ লাগাম আটকানো। তাঁর বাক্যের গঠন, শব্দ-চয়ন – কথ্য ও তৎসম শব্দের নিজস্ব মিশোল –, সিন্ট্যাক্স – ক্রিয়াপদের শেষদিকে অবস্থান-, পঙক্তি করণ, নিজস্ব অনুপ্রাস, মধ্যমিল, শব্দ পুনরাবৃত্তি, প্রশ্ন ও তার জবাব – এসব মিলেমিশেই কবিতার শ্রুতিকল্প তৈরী করে। তাঁর চিত্রকল্পও বুদ্ধদেব মোহর-ছাপা। জীবনানন্দ-র গদ্যকবিতার ধ্বনি-ছবি যদি ধূসর-রেখা, কুয়াশাচ্ছন্ন, ইম্প্রেশনিস্টিক তবে বুদ্ধদেব-এর গদ্যকবিতা তুলনীয়ভাবে স্পষ্ট-স্বচ্ছতর হয়েও সাদাকালোর এক অন্য ‘কিয়ারসোকুরো’তে রহস্যময়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে তাঁর একটি গদ্যকবিতা : উদ্ধৃত করা যাক বুদ্ধদেব বসু-র একদিন চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা গ্রন্থের থেকে:

দোকানিরা
ষোলো বছর আগে, প্রথম যখন এ-পাড়ায় এসেছিলাম,
তখনের আসবাব ছিলো অন্য রকম। ঘাস ছিলো তখন,
যেখানে-সেখানে নারকোলের ঝাঁকড়া মাথা,
যেখানে-সেখানে গুল্মরের গুঁড়ো, আর মাঠে-মাঠে
জ’মে-থাকা বৃষ্টি, গ্যাসের আলোয় বেগুনি আর সবুজ,
স্বপ্ন আর বীজাণুর গর্ভধারিণী।
আর মশা। হয়তো জোনাকি, আর দূরত্ব। হাটবাজার
প্রয়োজনের দূরত্ব।
এখন সব বদলে গেছে। মাঠের বদলে পাঁচতলা বাড়ি,
ডোবার কবরের উপর রেস্তরাঁ। সারাদিন কর্তব্যপরায়ণ
ট্রাফিক। আর পথ চলতে ঝরা পাতা, ব্যাঙের ছাতা,
থমথমে সন্ধ্যার বদলে – এখন দোকান, অনেক, বিচিত্র,
ডাইন-বাঁয়ে বক্তৃতার মতো বর্ধিষ্ণু । ঝক্ঝকে রঙিন
মলাটে আনকোরা, বা পুরনো কবির বইয়ের খাতার মতো
ফুটপাতে। অথবা কোনো চিলতে রোয়াকে ম্যাজিকের
মতো গজিয়ে ওঠা। সারি-সারি উন্নতির হাস্যময়
দাঁতের মতো, দোকান।
এই দোকানগুলো দেখতে আমার ভালো লাগে :
এখানে খেলা করে অমর লোভ, সনাতন দম্ভ ; অভাবের
সঙ্গে প্রয়োজনের যুদ্ধ চলে ; মহিলারা লজ্জা ভুলে
নিজেদের স্তন আর বাহুর ডৌল নিরীক্ষণ করেন ;
কাচের জানালায় প্রতিহত হ’য়ে কত ইচ্ছা মাছির মতো
ম’রে যায়।
আর দোকানিরা – তাদেরও আমি লক্ষ্য করি। তাদের
চাটুকারী ভঙ্গি, তাদের গৃধ্নু ও সতর্ক চোখ, আর সেই
তাদের অপেক্ষার ধৈর্য । আপনি ভাবছেন তারা
শুধু সাজিয়ে রাখে, জুগিয়ে যায়, গছিয়ে দেয়, হিশেব
লেখে, টাকা গোনে, খুচরো মেলায় ? কখনো আপনার
মনে হয়নি আসল কথাটা ? অপেক্ষা করে তারা,
অপেক্ষা ক’রে থাকে : ঐ তাদের কাজ, তাদের বৃত্তি ।
যখন এক খদ্দের চ’লে গেছে, অন্য জন এখনো
আসেনি, তখন আমি দেখেছি তাদের – কাউন্টারে
কনুই রাখা, হাতের গর্তে থুঁতনি, তাকিয়ে আছে
পথের দিকে, দূরের দিকে, এক অস্পষ্ট ভবিতব্যের
ছায়ার মধ্যে যেন।
তখন মনে হয় তাদের চোখে বিষাদ, যেন স্থির জলে
মাছের মতো ভেসে উঠলো । যেন মাছের মতোই বোবা তাদের দৃষ্টি ।
সুভদ্র পাঠক, ঐ চোখে কোনো চিত্রকল্প কি
দেখতে পান না ! আপনি, আমি – প্রত্যেকে আমরা
যে যার মতো দোকান খুলে বসেছি, অপেক্ষা
দুলছে হৃৎপিণ্ডে । শীত এলে গ্রীষ্মের জন্য,
গ্রীষ্ম এলে বর্ষার ; স্ত্রীর জন্য অন্ধকার অপেক্ষা,
সন্তানের জন্য কৌতূহলী : অর্থ, খ্যাতি,
যাত্রা, ভ্রমণ, প্রত্যাগমন, হয়তো ভাগ্যের কোনো
ইঙ্গিতের জন্য – অন্ত নেই। চিঠি আসবে কার,
সন্ধেবেলা ঘরে যখন আলো জ্বলেনি হঠাত
কার টোকা পড়বে দরজায় ? ভরদুপুরে
ট্রামে উঠে ফিরে পাবো কোনো
হারানো বন্ধুকে ? এমনি, দুলছে আমাদের
হৃৎপিণ্ড, দিনের পর দিন, ঋতুর পর ঋতু,
অবিরাম । সবচেয়ে ভীষণ কথা এই যে
মাঝে-মাঝে সত্যি টোকা পড়ে, বাল্যসখীকে ফিরে পাই
ফ্লরিডায় । কিন্তু যেহেতু আমরা থামতে পারি না,
তাই আবার তাকিয়ে থাকি পথের দিকে, দূরের দিকে,
সেই ঝাপসা দিগন্তের দিকে, যেখানে আমি, আমার
বাল্যসখী, আর ফ্লরিডার তট, সব এক বিন্দুর মধ্যে
বিলীয়মান।
মানুষ, মানুষ, মর্মাহত মানুষ, তুমি কি জানো
তোমার অপেক্ষার শেষ লক্ষ্য কে ? তুমি কি জানো
তোমারই জন্য মৃত্যুর সৃষ্টি হয়েছিলো ?
[আরম্ভ ১৯৫৩, সমাপ্ত ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ; কলকাতা]

কবিতাটি একটি শহরতলির ষোলো বছরের গ্রাম থেকে ব্যবসা-ব্যস্ত নগরে ক্রম-পরিবর্তনের দিয়ে সারি-সারি দোকানে প্রাত্যহিক বেচাকেনা এবং দোকানি-ক্রেতার প্রবৃত্তি অনুসরণ ; অবশেষে মানুষের আকাঙ্ক্ষা-অপেক্ষা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা ও আশাভঙ্গের গভীর-আলোকিত চিত্রণ। অন্তিমে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে বাসনার লাভ-অলাভ সত্ত্বেও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কবিতাটিতে কালের পট-পরিবর্তনের এবং মানবিক প্রবৃত্তির যে বিস্তার আছে, তাতে শুধু কিছু চরিত্র অনুপ্রবেশ করালেই কোন গল্প-উপন্যাস স্ফূরণ সম্ভব। কিন্তু এটি কবিতা, এবং নির্দিষ্ট চরিত্রবিহীনতার মধ্যেও পরিশ্রুত আবেগে, শ্রুতি-চিত্রকল্পে আমাদের নিজেদের ভিতরে তাকাতে বাধ্য করে।

“দোকানিরা” ৫টি স্তরে ক্রম-ব্যাপৃত। এই বিস্তারগুলো আরেকটু ভাঁজ খুলে দেখা যাক:
২.১ যখন পাড়ায় প্রথম এসেছিলেন, ষোলো বছর আগেকার গ্রাম-প্রায় স্মৃতি দিয়ে কবিতার শুরু :ঘাস ছিলো, যেখানে-সেখানে নারকেলের ঝাঁকড়া মাথা, মাঠে-মাঠে জমা বৃষ্টি, গ্যাসের আলো, মশা, জোনাকি, আর হাট-বাজার প্রয়জনের দূরত্ব । এবং এরই মধ্যে লুকোনো ছিলো স্বপ্ন এবং বীজাণু উভয়ই।
২.২ সব বদলে গ্যালো ষোলো বছরে। মাঠের বদলে পাঁচতলা বাড়ি, কবরের উপরে রেস্তোরাঁ, সারাদিন অপ্রতিহত ট্রাফিক এবং ঝরা পাতা, ব্যাঙে র ছাত, থম থমে সন্ধ্যার বদল্রে অনেক বিচিত্র দোকান ।
২.৩ দোকান ও বাণিজ্যের অন্তঃসার : দোকানের মধ্যে খেলা করে মানবিক বাসনা, অমর লোভ ও সনাতন দম্ভ, অভাবের সঙ্গে প্রয়োজনের যুদ্ধ, চরিতার্থতা অথবা কাচের জানালায় মাছির মতো মৃত্যু । এই চাহিদা, বাসনা উপচে আত্মতৃপ্তি – মহিলারা লজ্জা ভুলে নিজেদের স্তন আর বাহুর ডৌল নিরীক্ষণ করেন।
২.৪ শুধু জুগিয়ে, সাজিয়ে, গুছিয়ে, হিশেব করে, টাকা গুনেই ক্ষান্ত নয় দোকানিরা, আশলে তাদের বৃত্তি হচ্ছে অপেক্ষা – কাউন্টারে কনুই রেখে অস্পষ্ট ভবিতব্যর দিকে তাদের আকাঙ্ক্ষা ও পরিতৃপ্তির প্রতীক্ষা।
২.৫ এই অপেক্ষা কি শুধু দোকানিদেরই, সে কি শুধু ব্যবসারই নিহিত সত্য ? না, প্রত্যেক মানুষের মনের দোকানেই অপেক্ষার হৃৎপিণ্ডের দুলুনি।
২.৬ আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পৌণঃপু্নিক অপেক্ষার পরও কঠিনতর সত্য হচ্ছে – মানুষের জন্য প্রতীক্ষ্যমাণ মৃত্যু।
এই হলো কবিতার বিষয় ও বোধ। কিন্তু নির্মাণ হয়েছে স্তরের উপরে স্তরে চিত্রে, চিত্রকল্পে। অন্তত দুটো চমৎকার বাক-প্রতীমা : “সারি-সারি উন্নতির হাস্যময় দাঁতের মতো, দোকান”, “তাদের চোখে বিষাদ, যেন স্থির জলে মাছের মতো ভেসে উঠল। ” তার উপরে, প্রশ্নবোধ ও নাটকীয়তা : “কোনো চিত্রকল্প কি দেখতে পান না ? আপনি, আমি – প্রত্যেকে আমরা যে যার মতো দোকান খুলে বসেছি। ”
যে আঁধার আলোর অধিক, রচনাকাল (১৯৫৪-৫৮)-এর আগে বুদ্ধদেব ছিলেন রক্ষণশীল রোমান্টিক, এতোটা যে জীবনানন্দ-র সাতটি তারার তিমির , গ্রন্থের ইতিহাস-সচেতন কবিতা তিনি পছন্দ করেন নি ৫। এই বইতেও তিনি লিখেছিলেন, “এতে নয় জড়িত জনগণের বিরাট নিয়তি – অভ্যুদয়, পতন, পথ্য, সেবা, স্বাধীনতা” /কেন? , যে আঁধার আলোর অধিক , এমনকি – “শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যাক্তিগত” / রাত তিনটের সনেট : ১, যে আঁধার আলোর অধিক , এমনকি – “ প্রান্তরে কিছুই নেই, জানলায় পর্দা টেনে দে”, আটচল্লিশের শীতের জন্য : ২, যে আঁধার আলোর অধিক । এবং তাঁর বিষয় কয়েকটি প্রেমের কবিতা ছাড়া প্রধানত কবিতা নিজেই – কবিতার শিল্প , সৃজনের আরাধনা, আকাঙ্ক্ষা, নির্বেদ , অবধারিত মৃত্যু, এমনকি স্টিল লাইফ এবং ল্যান্ডস্কেপ । এখানে মাত্রস্তনিত কবিতায় তিনি বিষয়ে, বুনোটে, বচনে বেশ কিছুটা বোদলেয়ার এবং রিলকের ছায়ায়। কিন্তু দুর্মর পরিশ্রমী এবং কৈবল্যে নিখুঁত। অথচ গদ্য কবিতায় এসে বিষয়ের বিস্তারে, কিছুটা জানালা-দরোজার বাইরে তাকানোয় তিনি তুলনামূলকভাবে উদার । “দোকানিরা”, কবিতাটিতে তিনি বেশ কিছুটা কাল ও প্রতিবেশের পরিবর্তনের কথা বলেছেন। এবং পণ্য, দোকান, বেচা-কেনার মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রবৃত্তির কেন্দ্রে আকাঙ্ক্ষা ও অপেক্ষার অবলোকন করলেও কবিতাটির বিস্তারের ভিতরে কাপিটালিজমের একটা মৌলিক সূত্র অন্তর্হিত আছে – বুদ্ধদেব সেটাকে প্রাধান্য দিন বা না দিন। বিষয়, বুনোট, বিস্তার এবং সর্বোপরি সংবেদনের দিক থেকে এমন গদ্য কবিতা কি বাংলা ভাষায় খুব বেশি আছে?

পাদটিকা :
১. গদ্যকবিতা “হাওয়ার রাত”, চৈত্র, ১৩৪২ (১৯৩৫) সনে কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিলো।
২. বুদ্ধদেব বসু ১৯৫১-৫২ তে প্রথম তার দ্বিতীয় পর্বের গদ্যকবিতার প্রাথমিক খশড়া শুরু করেছিলেন। আলোচিত “দোকানিরা” কবিতাটিও ভালো উদাহরণ, আরম্ভ ১৯৫৫ – সমাপ্ত সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।
৩. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ; ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ, কুলায় ও কালপুরুষ, সিগনেট প্রেস, ১৩৬৪
৪. জীবনানন্দ দাশ ; দেশ কাল ও কবিতা, কবিতার কথা, সিগনেট প্রেস, ১৩৬২

লেখকঃ ওমর শামস

১ Likes ৫ Comments ০ Share ৫৫৩ Views

Comments (5)

  • - নীল সাধু

    শুভেচ্ছা পাশা! 

    ভাবীর লগে আলাপ কইরতে হইবু মুনে অয়! সত্যি কইরা কন এইডা কবে লিখসেন!

    আমার আরো কিছু তথ্য লাগব। রমণী নিয়ে এই গবেষনা!! কেমনে কি!! 

    আমার মাথা কিছু ঢুকতাসে না

     

    গল্পে ভালো লাগা রইল। সুন্দর থাকুন।

    • - লুৎফুর রহমান পাশা

    - ঘাস ফুল

    শরৎ পড়ি না অনেক দিন হল। তবে আজ যেন আবার পড়লাম। তবে সর্বনাম ব্যবহারে কিছু জায়গায় ভুলভ্রান্তি রয়েই গেছে। বিশেষ করে আপনি অনেক জায়গায় 'তার' এবং 'তাকে' সর্বনাম ব্যবহার করেছেন। সাধু ভাষার বেলায় এই দুটো মনে হয় 'তাহার' এবং 'তাহাকে' হওয়া উচিৎ। আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। সেটা হল 'চন্দ্রবিন্দু', যা আপনি কোন শব্দেই ব্যবহার করেন নাই, যেখানে করা উচিৎ ছিল।

    এইবার আসি গল্পের বিষয়বস্তুতে, যা মূলত নারী মনের ওপর আলোকপাত করেছেন। আপনার বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করছি। নারীদের অন্যতম একটা গুণ বা দোষ হল, তার পছন্দের পুরুষের বা স্বামীর অন্য কোন নারীর প্রতি বিন্দু মাত্র ভালো লাগা বা ভালোবাসা থাকতে পারবে না। এমন কি এই ভালোবাসা যদি একান্তই শুধু ভালোবাসা হয়, যেখানে নিজের সঙ্গী করার কোন বাসনা নাই। নারীরা আসলেই বিয়ের পর কিংবা কাউকে ভালোবাসার পর অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। পছন্দের পুরুষকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তারা চক্রারে ঘুরতে থাকে, যেখানে অন্য কারো উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সহনীয় পর্যায়ে থাকা ভালো কিন্তু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেলে জীবনে অশান্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। রাজকুমার নিয়ে মালতী, কালী, সরসী আর রিনির ওপর আপনার পর্যবেক্ষণও ঠিক আছে। নারীরা এমনি হয়। মালবিকাকে আপনার শুধু ভালো লাগে, কারণ সে সুন্দরী। যে কারো তাকে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু এই ভালো লাগা আর তাকে ভালোবাসা তো এক হতে পারে না। আর ভালবাসলেও যে তাকে সঙ্গী করে পেতে চাচ্ছেন সেটাতো না। সুতরাং এটা নিয়ে আপনার বউয়ের অভিমান করা বা রাগ করা মোটেই ঠিক না। এটা সংকীর্ণতার পরিচয় বহন করে। নারীরা তাদের যুক্তিকে অনেক সময় যেকোনো মূল্যে উচ্চে ধরে রাখতে চায়, তার জন্য তারা রাগ বা অভিমান কিংবা কান্নাকাটির আশ্রয় নিয়ে থাকে। সহমত। আপনার এই গল্প পড়ে, না জানি নারীরা আজ ক্ষেপে যায়। তাইলে কিন্তু খবর আছে। সব শেষে বলবো, এই সবের কিছুই দরকার নাই বা থাকবে না যদি পরস্পরের ওপর বিশ্বাস থাকে। যেকোনো সম্পর্ক স্থায়ী হওয়ার মূলমন্ত্র হল পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। আশা করি সেটা দিয়ে সম্পর্কের মানুষটিকে যাচাই করবে। সব মিলিয়ে গল্প ভালো লাগলো পাশা ভাই। ধন্যবাদ।     

    • - লুৎফুর রহমান পাশা

      প্রথমেই আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

      সর্বনাম ব্যবহারে তার এবং তাকে ইচ্ছাকৃত রাখা হয়েছে। আমার বেশ কিছু গল্প আছে যে গুলো সাধু কথ্য এবঙ চলিত মিশ্রন আছে। এই গুলো এভাবেই রাখা। তবে আপনার কথার সাথে একমত যে তাতে শরত বাবুর মত হয়না। আপনি জীবননান্দ পড়েছেন যেখানে ভাষার মিশ্রন লক্ষনীয়। এবঙ পরবর্তিতে মিশ্রন টাকে গ্রহন করা হয়েছে। চন্দ্র বিন্দু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আমার অজ্ঞতা।

      পরে অংশে বলার কিছু নেই। আপনার পর্যবেক্ষন অনবদ্য।

    - মাসুম বাদল

    বেশ ভালো লাগলো, পাশা ভাই !!! 

    • - লুৎফুর রহমান পাশা

      ধন্যবাদ

    Load more comments...