Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

বিশ্বখ্যাত মার্কিন ছোট গল্প লেখক ও. হেনরির ১০৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি


উইলিয়াম সিডনি পোর্টার (ও.হেনরি) প্রখ্যাত মার্কিন ছোট গল্পকার। লেখক ও হেনরির নাম ছোট গল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ছোট গল্প মানেই ও.হেনরি। তিনিই সম্ভবতঃ মার্কিন ছোট গল্পকারদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এবং জনপ্রিয়। তবে আসল নামে নয় তিনি খ্যাতি লাভ করেন ও হেনরি ছদ্মনামে লিখে। ছদ্মনাম কোনো ব্যক্তি বা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো গোষ্ঠীর স্বগৃহীত ও স্বব্যবহৃত কাল্পনিক নাম। ছদ্মনাম ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখা। শুধু লেখকরাই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন না, গ্র্যাফিটি শিল্পী, প্রতিবাদী আন্দোলনকারী অথবা সন্ত্রাসবাদী, এমনকি কম্পিউটার হ্যাকাররাও ব্যবহার করেন এই জাতীয় নকল বা ছদ্মনাম। ও.হেনরি' বা অলিভার হেনরি (Olivier Henry) হলো 'উইলিয়াম সিডনি পোর্টার'-এর ছদ্মনাম। মানুষের স্বভাব-চরিত্র তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন। আর যা দেখেছেন তা তিনি তার গল্পে নিপুণভাবে পরিবেশন করেছেন। তার প্রতিটি গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে আকস্মিক চমক বা শ্লেষাত্মক পরিণতিতে। ও.হেনরি প্রায় ছয়শতাধিক গল্প লিখেছেন। তাঁর বিশ্বখ্যাত ছোটগল্পগুলোর মধ্যেঃ A Blackjack Bargainer, The Princess and the Puma, The Coming-Out of Maggie, The Ransom of Red Chief, The Gift of the Magi, The Whirligig of Life, The Last Leaf প্রভৃতি বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ। আজ প্রখ্যাত এই গল্পকারের মৃত্যুদিন। ১৯১০ সালের আজকের দিনে তিনি আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে মৃত্যুবরণ করেন। ১০৪তমমৃত্যুবার্ষিকীতে ও.হেনরীর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।

উইলিয়াম সিডনি পোর্টার ১৮৬২ সালের ১১ জুন আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার গ্রীণসবোরো শহরে (Greensboro, North Carolina) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ডাঃ এলজারনোন সিডনি পোর্টার এবং মাতার নাম মেরী জেন ভারজিনিয়া সোয়াইম পোর্টার। তার পিতা এলজারনো্ন সিডনি পোর্টার পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। ডাঃ এলজারনোন এবং মেরী জেন ভারজিনিয়া ১৮৫৮ সালের ২০ এপ্রিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন যখন উইলিয়ামের বয়স তিন বছর। তার মাতার মৃত্যুর পরে ও.হেনরি তার পিতামহী ও চাচীর কাছে পালিত হন। ১৮৮৭ সালে ও.হেনরি এথোলা ইস্টেসকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে মার্গারেট ওয়ার্থ পোর্টার নামে এক মেয়ে ছিলো। ১৮৯৭ সালে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। পরে ১৯০৭ সালে তিনি তার শৈশব প্রণয়ী সারাহ লিন্ডসে কলিমেনকে বিয়ে করেন যদিও ১৯০৮ সালে তারা পৃথক হয়ে যান।

(স্ত্রী ও কন্যার সাথে ও.হেনরি)
কর্মময় জীবনে ও.হেনরি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। প্রথম জীবনে তিনি কিছুকাল একটি খামার বাড়িতে কাজ করেন। এ ছাড়াও একটি ওষুধের দোকান ফার্মাসিস্ট হিসেবে এবং কলাম লেখক হিসেবে কাজ করেন। তিনি একটি ব্যাংকে কেরানি হিসেবেও কাজ করেন তবে ব্যাংকের তহবিল তসরুফের কারণে তাকে অভিযুক্ত হন এবং ব্যাংকের চাকুরী থেকে বরখাস্ত হন। ব্যাংকের দায়ের করা অভিযোগে ১৮৯৬ সালে তিনি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। জামিন পাবার পরে তিনি ভবঘুরে জীবন-যাপন শুরু করেন এবং ছোট-গল্প লিখে নিজের ও তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণ চালান। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় সঙ্কলনগুলি হলোঃ 'বাঁধাকপি এবং রাজা'(Cabbages and Kings), 'নিয়তির রাস্তা' (Roads of Destiny) এবং 'ছয়-সাত'(Sixes and Sevens)।

বিখ্যাত এই ছোট গল্পকার অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় ১৯১০ সালের ৫ জুন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে মৃত্যুবরণ করেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে যকৃতের সিরোসিস তার মৃ্ত্যুর কারণ বলে ধারণা করা হয়। আজ এই জনপ্রিয় গল্পকারের মৃত্যুদিন। ১০৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ও.হেনরীর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তাঁর মৃত্যুবার্ষিকেতে ও. হেনরির লেখা আসাধারণ গল্প 'এ লিকপেনি লাভার' গল্পের অনুবাদ “তোষামোদপ্রিয় প্রেমিক” উৎসর্গ করা হলো প্রথম আলো ব্লগের পাঠকদের জন্য।

তোষামোদপ্রিয় প্রেমিক
মূল গল্পঃ এ লিকপেনি লাভার
লেখকঃ ও হেনরি
অনুবাদঃ মোবারক হোসেন খান

বিরাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। তিন হাজার সেলসগার্ল এই দোকানে চাকরি করে। ম্যাসি তাদের একজন। তার বয়স আঠারো। পুরুষের দস্তানা বিক্রি করা তার কাজ। এই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মানবচরিত্রের দুটো ব্যাপারে সে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। দুই ধরনের খরিদ্দার এখানে দস্তানা কিনতে আসে। প্রথম দলে পড়ে একধরনের পুরুষ যারা নিজেরাই দস্তানা কিনে থাকে। আরেক দলে রয়েছে মহিলা, যারা পুরুষের জন্য দস্তানা কিনতে আসে। এ ছাড়াও, ম্যাসি হাজারো ধরনের মানুষের চরিত্র সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। স্টোরে চাকরিরত দুই হাজার নয় শ নিরানব্বইটি মেয়ের কত না বিচিত্র কাহিনী ম্যাসি শুনেছে! সেগুলো সে তার মগজের চোরা কুঠরিতে চাবিবদ্ধ করে রেখেছে। একজনের কথা অন্যজনকে বলেনি। এটা তার স্বভাব। ম্যাসি বেশ চতুর। তবে তার চাতুর্য সে নিজের সৌন্দর্যের মতোই অবগুণ্ঠিত রাখত।
ম্যাসি সুন্দরী। চুলগুলো গাঢ় সোনালি। সে বেশ শান্ত, গম্ভীর আর অভিজাত। প্রতিদিন তার কাউন্টারে নিয়মিত এসে দাঁড়াত। খরিদ্দারের কাছে দস্তানা বিক্রি করত। সেই সঙ্গে খরিদ্দারকে শপগার্লের মিষ্টি হাসিতে আপ্যায়ন জানাত। তার সে হাসি যে কোনো খরিদ্দারেরই মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
একদিন আরভিং কার্টার নামে এক সম্ভ্রান্ত যুবক স্টোরে এলো। কার্টার একজন চিত্রকর, কোটিপতি, পরিব্রাজক, কবি এবং কার-বিশেষজ্ঞ। তবে আজ নিজের জন্য কিছু কিনতে আসেনি। এসেছে মায়ের সঙ্গে, কর্তব্যপালনে। স্টোরে ঢুকেই তার মা ব্রোঞ্জ আর টেরাকোটা মূর্তি পছন্দ করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়লেন।
কার্টার উদ্দেশ্যহীনভাবে স্টোরের ভেতর ঘুরতে লাগল সময় কাটানোর জন্য। ঘুরতে ঘুরতে কার্টার দস্তানার কাউন্টারে এসে হাজির হলো। অবশ্য তারও একজোড়া দস্তানা দরকার ছিল। কেননা বাসা থেকে বেরোবার সময় তার দস্তানাজোড়া ভুলে ফেলে এসেছে। তাই মায়ের মূর্তি পছন্দ করার ফাঁকে এক জোড়া দস্তানা কিনে নিতে চাইল।
কার্টার ম্যাসির কাউন্টারের কাছাকাছি এসে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। কাউন্টারে দাঁড়ানো সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রেম-দেবীর অজ্ঞাত কারসাজি যেন হঠাৎ তার চোখের দৃষ্টিতে বন্দি হয়ে পড়ল।
কয়েকজন সস্তা ধরনের লোক বিভিন্ন কাউন্টারে হুমড়ি খেয়ে জিনিসপত্র দেখছিল। আর সেলস্গার্লরা তাদের কীর্তিকা- দেখে উচ্ছ্বসিত হাসিতে ভেঙে পড়ছিল। এসব কা-কারখানা দেখে কার্টার পিছিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু তখন আর উপায় ছিল না। সে মুহূর্তে ম্যাসি জিজ্ঞাসুনেত্রে তার দিকে তাকাল। ওর সে দৃষ্টি স্থির, উষ্ণ ও মন কেড়ে নেয়ার মতো। শরতের অফুরন্ত নীল যেন সেই দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছিল।
আর ঠিক সে মুহূর্তে আরভিং কার্টার নামের চিত্রকর, কোটিপতি ইত্যাদি ইত্যাদি অভিজাত যুবক তার পা-ুর মুখম-লে একঝলক উষ্ণ রক্ত উঠে এসেছে অনুভব করল। না, এতে লজ্জার লেশমাত্র ছিল না। বরং জ্ঞানার্জনের একটা চমক ছিল। সেই মুহূর্তে যুবক যে অন্যান্য কাউন্টারে তরুণরা সেলস্গার্লদের সঙ্গে যে ধরনের উচ্ছ্বসিত ব্যবহার করছিল তেমনি একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছে বলে তার মনে হলো। দস্তানার কাউন্টারের ওপাশে দ-ায়মান ম্যাসির প্রতি তার হৃদয়ে যেন একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করল। সে বুঝতে পারল যে বিল, জ্যাক বা মিকি এবং তার মধ্যে আর কোনো ব্যবধান রইল না। তাদের প্রতি, সে মুহূর্তে, সহানুভূতিতে তার হৃদয় ভরে উঠল। সে দ্বিধাজড়িত পদে ম্যাসির দিকে এগিয়ে গেল।
কার্টার এক জোড়া দস্তানা কিনল। দাম পরিশোধ করে দিল। একটা কাগজে জড়িয়ে মেয়েটি দস্তানা-জোড়া তার হাতে তুলে দিল। কার্টার কাউন্টার ছড়ে যেতে গিয়েও যেতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাসির রক্তিম গালের টোলটা আরো একটু গভীর হলো। সে জানত, খরিদ্দাররা দস্তানা কেনা শেষ হলেও এমনিভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ম্যাসি ধীরে ধীরে ডান হাতটা ভাঁজ করে কনুইটা কাউন্টারের ওপর রাখল। তার চোখের দৃষ্টি কার্টারের মুখের ওপর নিবদ্ধ।
কার্টার জীবনে এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কোনো দিন পড়েনি। যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সে ওস্তাদ। কিন্তু এ মুহূর্তে বিল বা জ্যাক বা মিকির চেয়েও নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। এই সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে তার আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যে অভিজাত সমাজে তার বসবাস সে সমাজ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। অথচ মেয়েটির সঙ্গে আরেকবার দেখা করার জন্য তার হৃদয় উথাল-পাথাল করতে লাগল। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো সুন্দরী কুমারী মেয়েটির কাছে আবার দেখা করার অস্বাভাবিক প্রস্তাব করার চিন্তা তাকে ঘামিয়ে তুলল। তার হৃৎপি-ের গতি ভীষণরূপে বেড়ে গেল এবং হৃদয়ের প্রচ- আবেগই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো।
কিছুক্ষণ এ কথা-সে কথার পর কার্টার নিজের নামের একখানা কার্ড কাউন্টারের মেয়েটির হাতের কাছে রেখে বলল,
'আমার ধৃষ্টতার জন্য মাফ চাইছি। অনেক সাহস সঞ্চয় করে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। আচ্ছা, আপনার সঙ্গে কি আমার আর দেখা হতে পারে না? আপনার কাছে এই অনুগ্রহটুকু প্রার্থনা করছি। আমার নাম কার্ডে লেখা আছে। বিশ্বাস করুন, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব_ না, মানে পরিচয় লাভের সুযোগ পেলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করব। আপনার কাছ থেকে এই কৃপাটুকু আশা করতে পারি কি?'
ম্যাসি পুরুষের চরিত্র ভালো করেই জানে। বিশেষ করে কাউন্টারে যারা দস্তানা কিনতে আসে তাদের চরিত্র তার নখদর্পণে। সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে চোখ তুলে কার্টারের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে সারল্য আর চাপা উল্লাস খেলা করছিল। সে মৃদু হেসে বলল,
'বেশ তো! আমার তো আপনাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে। তবে আমি সাধারণত অচেনা আগন্তুকের সঙ্গে বাইরে যাই না। ওটা ঠিক ভদ্রমহিলাসুলভ নয়। কিন্তু আপনার কথা আলাদা। তা, আপনি আবার কখন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান বলুন তো?'
কার্টার বলল,
'যত শিগগির সম্ভব। বলুন তো আপনার বাড়িতে আমি যেতে প্রস্তুত। আপনার ওখানে যেতে আমার_।'
ম্যাসি সশব্দে হেসে উঠল। সঙ্গীতের সুর যেন সে হাসিতে ঝঙ্কৃত হলো। সে বেশ জোর দিয়ে বলল,
'না, না, অসম্ভব। উহ্, একবার যদি আপনি ফ্ল্যাট দেখেন! তিনটে ঘরে আমরা পাঁচজন বাস করি। কোনো ভদ্রলোক বন্ধুকে আমাদের বাসায় নিতে গেলে, মাইরি বলছি, আমার মায়ের মুখটা দেখতে যা হবে না!'
'তাহলে, আপনি যেখানে বলুন সেখানেই আমি যাব। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।' কার্টার আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল।
ম্যাসির মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল। তার চোখে-মুখে তা স্পষ্ট ধরা পড়ল। সে চপল কণ্ঠে বলল,
'বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেবেলা আমার কোনো কাজ নেই। আপনি সেদিন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় সাত নম্বর অ্যাভেন্যুর আটচলি্লশ নম্বর সড়কের কোণে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আমি সেখান থেকে খুব কাছেই থাকি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, রাত এগারোটার বেশি কিন্তু থাকতে পারব না। মা কিছুতেই রাত এগারোটার পর আমাকে বাইরে থাকতে দিতে নারাজ।'
কার্টার আগামী বৃহস্পতিবার আসবে বলে ম্যাসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের খোঁজে গেল। তার হৃদয়ে তখন প্রেম রুদ্র ছন্দে উন্মত্ত তালে নৃত্য করছিল।
কার্টার চলে যেতেই একজন সেলস্গার্ল ম্যাসির কাছে এসে হাসতে হাসতে বলল,
'বড়শিতে আটকাতে পেরেছিস্ তো, ম্যাসি?' ম্যাসি কাউন্টার থেকে কার্টারের নামের কার্ডখানা তুলে বুকের ভাঁজে রাখতে রাখতে বনেদি ভঙ্গিতে বলল,
'আবার দেখা করার অনুমতি চাইছিল।'
'দেখা করার অনুমতি? কী বলছিস্? ওয়াল্ডর্ফ হোটেলে ডিনারে ডাকল না? কিংবা মোটরে খানিক মুক্ত হাওয়া খেতে বলল না?'
'দূর ছাই! তুই খালি আজেবাজে স্বপ্ন দেখিস্! একটা ছেলেবন্ধু পেয়ে দেখছি তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে! না, লোকটা ওয়াল্ডর্ফের কথা মুখেও আনেনি। তবে তার কার্ডে ফিফথ্ অ্যাভেন্যুর ঠিকানা লেখা রয়েছে দেখছি।'
মায়ের সঙ্গে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় কার্টারের হৃদয় যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কেমন যেন এক ব্যথা অনুভব করল। ঠোঁটে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করল। সে বুঝতে পারল, তার ঊনত্রিশ বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মতো প্রেমের পরশ লেগেছে। কিন্তু একবার বলতেই মেয়েটা তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়ে গেল কেন? মনে কেমন যেন একটা খট্কা লাগছিল। তবে সঙ্গে সঙ্গে ভাবল, না, মেয়েটির কোনো দোষ নেই। ওর অনুরোধ ঠেলতে পারেনি বলেই তো মেয়েটি রাজি হয়েছে। কার্টারের মনের ভেতর টানাপড়েনের খেলা চলতে লাগল। মেয়েটির সম্পর্কে কিছু না জেনেও কার্টার তার প্রেমে মত্ত হয়ে গেল!
একদিন সন্ধ্যেবেলা। তাদের প্রথম সাক্ষাতের পর দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে। কার্টার আর ম্যাসি পরস্পরের হাত ধরাধরি করে মৃদু আলোকোজ্জ্বল একটি ছোট উদ্যানে হাঁটছিল। সামনে একটা বেঞ্চ দেখে দুজন তাতে বসে পড়ল। কার্টার ম্যাসির পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল। ম্যাসির সোনালি মাথাটা আবেশে কার্টারের কাঁধে আলতোভাবে রাখল। ম্যাসি আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলল,
'তুমি এত দিন দেরি করলে কেন? আরো আগেই তো এভাবে আদর করতে পারতে।'
কার্টার আন্তরিকতার সুরে বলল,
'ম্যাসি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। বিশ্বাস কর ম্যাসি, আমার কথায় কোনো খাদ নেই। আমি তোমাকে চাই। তোমাকে আমার চাই, ম্যাসি। তোমার আর আমার জীবনে যত ব্যবধানই থাকুক না কেন, আমি মোটেই তা মানি না।'
'কীসের ব্যবধান?' কৌতূহলভরা কণ্ঠে ম্যাসি জিজ্ঞাসা করল।
'না, ও কিছু নয়। আসলে কোনো তফাত নেই। বোকা মানুষরাই ওসব খুঁজে বেড়ায়। তবে এ কথা ঠিক, আমি তোমাকে বিলাসবহুল জীবনের স্বাদ দিতে পারি। ওটা দেয়ার সামর্থ্য আমার আছে। আমার সামাজিক প্রতিষ্ঠা আছে। আর আছে প্রচুর অর্থ এবং প্রাচুর্য।'
'এ ধরনের কথা সবাই বলে থাকে।' ম্যাসি মন্তব্য করল, 'ওরা সবাই আকাশের চাঁদ এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকে। যা হোক, তুমি নিশ্চয়ই কোনো ভালো চাকরি কর, নাকি রেসের মাঠে যাও? একটা কথা বলছি, আমাকে যত কচি দেখছ, আসলে কিন্তু আমি তত খুকি নই।'
'তুমি চাইলে আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রমাণ হাজির করতে পারি।' কার্টার নম্রভাবে কথাগুলো বলল, 'তোমাকে ছাড়া আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে, ম্যাসি। প্রথম দর্শনেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।'
'সবাই এ কথা বলে।' ম্যাসির কণ্ঠে কৌতুক। বলল, 'কোনো লোক কখনো তিনবার আমার কাছে প্রেমনিবেদন করছে বলে মনে করতে পারছি না।'
'অমন কথা বলো না, লক্ষ্মীটি। আমার কথা শোনো, যেদিন প্রথম তোমার চোখের দিকে তাকালাম, বুঝতে পারলাম পৃথিবীতে তুমি হলে আমার জীবনের প্রথম নারী।'
'আচ্ছা, বলো তো, এ ধরনের মিষ্টিকথা আর কজন মেয়েকে বলেছ।'
কিন্তু কার্টার বার বার একই কথা বলতে লাগল। ম্যাসিই যে তার জীবনের প্রথম নারী এ কথা বিশ্বাস করানোর জন্য অবিরত চেষ্টা করতে লাগল।
'আমাকে বিয়ে কর ম্যাসি।' ম্যাসির কানে ফিসফিস করে কার্টার বলল, 'বিয়ের পর দিনই আমরা এই নোংরা শহর ছেড়ে সুন্দর কোনো শহরে চলে যাব। আমরা কাজ ভুলে যাব। জীবনকে উপভোগই হবে আমার ছুটির দিনগুলোর একমাত্র ধ্যান। আমি তোমাকে অমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তুমি জীবনকে জীবনের মতোই উপভোগ করতে পারবে। ভাব তো, এমন একটি সমুদ্রের উপকূলের কথা যেখানে সারা বছরই সামার, যে সমুদ্রের ঢেউ উপকূলে এসে সঙ্গীতের নির্ঝরের মতো ভেঙে পড়ে, যেখানে মানুষ শিশুর মতোই মুক্ত। আমরা সেই সমুদ্র উপকূলে যাব, তোমার যত দিন খুশি তুমি থাকতে পারবে। কিংবা এমন কোনো চমৎকার শহরে তোমাকে নিয়ে যাব যেখানে তুমি সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ আর দুর্গ দেখতে পাবে। আর সেসব প্রাসাদ আর দুর্গে সাজানো মনোরম ছবি ও ভাস্কর্য মূর্তি তোমাকে বিমুগ্ধ করবে। সে শহরের সড়কগুলো মনে হবে পানির ভেতর নিমজ্জিত। সেখানে মানুষ ঘুরে বেড়ায়_'
'এবং গন্ডোলায় চড়ে। আমি জানি, তাই না?' ম্যাসি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল।
'হ্যাঁ, ঠিক তাই।' কার্টার হেসে বলল।
'আমি তোমার কাছে এমনি ধরনের কথাই আশা করেছিলাম।' ম্যাসি জবাব দিল।
'তারপর আমরা পৃথিবী ভ্রমণে বের হব। আমাদের যা খুশি দেখে বেড়াব। ইউরোপ, পারস্য আর ভারতের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো দেখে চোখ সার্থক করব। কী বল, তোমার ভালো লাগবে না, ম্যাসি?'
'ম্যাসি উঠে দাঁড়াল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
'দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওঠ, চল, বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।'
কার্টার ম্যাসির মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাইল। সে ম্যাসির মন জয় করতে পেরেছে মনে করে মনে মনে আত্মপ্রসাদবোধ করতে লাগল। আলতোভাবে ম্যাসিকে ক্ষণিকের জন্য নিজের আলিঙ্গনে ধরে রাখল। তার মনের ভেতর প্রেমের আশাটা যেন আরো শক্ত করে খুঁটি গেড়ে বসল।
পর দিন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকতেই লুলুর সঙ্গে ম্যাসির দেখা হয়ে গেল। লুলুও ম্যাসির মতো সেখানে চাকরি করে। লুলু দোকানের এক কোণে ম্যাসিকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
'নতুন বন্ধুর সঙ্গে তোর সময় কেমন কাটছে ম্যাসি? বল না ভাই, সত্যি করে!'
'ও, ওই লোকটার কথা বলছিস?'_ জুলফির কোঁকড়ানো চুলগুলো সমান করতে করতে ম্যাসি বলল, 'লোকটা আমাকে কী করতে বলে জানিস লুলু?'
'অভিনয় করতে?' শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে লুলু জিজ্ঞাসা করল।
'উঁহু, না! সে কি না তাকে বিয়ে করতে বলে। আর বলে, বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমার জন্য আমাকে কনি দ্বীপে নিয়ে যাবে।'
০ Likes ০ Comments ০ Share ৬২৭ Views