আলতাব আলী একটি লাশ, একটি ইতিহাস। সত্তরের দশক, বিলেতে তখন বাঙালিরা সংখ্যা লঘিষ্ঠ নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত তখনও ছিল নিষিদ্ধ! বাসার জানালায় ছুড়ে মারা হত পচা ডিম। ময়লা আবর্জনা ফেলে যাওয়া হত ঘরের দরজায়। বাঙালিদের ঘরের দরজায় পেস্রাব করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাঙালিরা এড়িয়ে চলতেন যতটা পারা যায়। কেউই ঝামেলায় যেতেন না খুব সহজে। মানে শত নির্যাতন সহ্য করেই চলত জীবন। এমনটা যে শুধু বাঙালিদের ক্ষেত্রেই ঘটত টা কিন্তু নয়। কালো আর এশিয়ানদের ক্ষেত্রেই ছিল ব্যাপারটা। বর্ণবাদ!!
১৯৭৮ সালের ৪ মে, স্থানীয় নির্বাচনের ঠিক আগের রাত, মার্গারেট থেচার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগের বছর। আলতাব আলী, ২৪-২৫ বছরের এক টগবগে যুবক, ইস্ট লন্ডনের হ্যানবেরি স্ট্রিট থেকে রাতে কাজ শেষ করে যাচ্ছিলেন ক্যানন স্ট্রিটের দিকে। বাসায় ফিরবেন। তার আর বাসায় ফেরা হয়নি। তিনি আর কোনদিন ফিরবেন না। তিনি ফিরেবেন না ঠিকই তবে লন্ডনের রাজপথ অলি গলি নিরাপদ করে গেলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে নিজের জীবনের বিনিময়ে। তিনজন বর্ণবাদী সাদা ছেলে তার পিছু নিয়েছিল। কোন দুষ ছিলনা তার। কোন ক্ষতি করেননি তাদের। ছিলনা কোন ব্যাক্তিগত দন্দ! তবুও তিনি সেদিন লাশ হলেন। রক্তে ভাসিয়ে দিলেন সেন্ট মেরী পার্কের সামনের আল্ডার স্ট্রিটের প্রতিটি ইঞ্চি। ঘতকদের ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল তার সারা শরীর। তার ঘাড়ে ছুরির আঘাত ছিল মারাত্মক। নিতর দেহ পড়ে থাকল রাজপথে। কিন্তু এটাই একমাত্র ঘটনা ছিলনা। এর প্রায় এক সাপ্তাহ আগে প্লাস্টো এলাকায় খুন হয়েছিলেন মাত্র ১০ বছর বয়সের এক ভারতীয় বালক, কেন্নিত সিং (kennith singh). প্রতিবাদ হয়েছে, একসময় আওয়াজ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু বাঙালিরা সংগ্রামী জাতি তা আরেকবার প্রমান হল। দেয়ালে পিট ঠেকে গেছে। গর্জে উঠল পুরা বাঙ্গালী কমিউনিটি। এই লাশ যেন প্রতিটি ঘরের লাশ। রাস্তায় পড়ে থাকা রক্ত যেন সকলের রক্ত। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাঙালিরা। শুরু হল আন্দোলন। এই আন্দোলন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এই আন্দোলন আধিকার আদায়ের আন্দোলন, এই আন্দোলন নেলসন মেন্ডেলার আন্দোলন। একে একে জড়ো হতে থাকল প্রতিবাদী জনতা। এখনকার মত তখন হাতে হাতে ফোন ছিলনা। ছিলনা ইন্টারনেট, কমিউনিটি টি ভি কিংবা পত্রিকা। তবুও কোন কিছুই যেন প্রতিবন্ধকতা ছিলনা। সে এক অন্যরকম আন্দোলন। একজন আরেকজনকে বলেন। খবর যায় এই মুখ থেকে সেই মুখে। কোথায় যেতে হবে? আলতাব আলীকে যেখানে খুন করা হয়েছে সেখানেই আসুন! ১৪ই মে ডাকা হলো প্রতিবাদ মিছিল। আলতাব আলীর লাশের কফিন নিয়ে মিছিল! কাদে প্রিয় ভাইয়ের লাশ। মুষ্টি বদ্ধ হাত। সেদিন শুধু বাঙালিরা মিছিল করেনি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এসে যুগ দিয়েছিল। কি এশিয়ান কি আফ্রিকান? এ লাশ যেন সকলের। এই দুঃখ যেন সবার! মিছিল চলল হোয়াইট চ্যাপল থেকে হাইড পার্কে। সেদিনের প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়ে ছিল প্রায় সাত হাজার বাঙ্গালী। শ্লোগান আর মুহুর্মুহুর ধ্বনিতে প্রকম্পিত হল লন্ডনের রাজপত। এর আগে কেউ এমন প্রতিবাদ দেখেনি। আন্দোলন চলল নিয়মিত ভাবে। সবাই কাজ শেষ করেই চলে আসেন আলতাব আলীকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে। পার্কটির নাম ছিল সেন্ট মেরী পার্ক কিন্তু মুখে মুখে তখন আলতাব আলী পার্ক। নামটি তখনও অফিসিয়ালি স্বীকৃতি পায়নি।
মানুষের গন জোয়ারে টনক নড়ল শাসকদের। গ্রেফতার করা হল ঘাতক তিন কিশোরকে। আনা হল বিচারের আওতায়। বিচারের পরে আদালত ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে এদের একজনকে ছুরিকাঘাতের জন্যে সাত বছরের জেল এবং বাকি দুইজনকে সাহায্য করার জন্যে তিন বছর করে জেল দেয়। পরে ১৯৯৮ সালে আলতাব আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেন্ট মেরী পার্ক যেখানে আলতাব আলীকে খুন করা হয়েছিল তাকে অফিসিয়ালি আলতাব আলী পার্ক ঘোষণা করা হয়।
আজ পেরিয়ে গেছে কয়েকটি দশক। সেই অচেনা জায়গাটি পরিচিত হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে। এখানেই নির্মাণ করা হয়েছে ইউরুপের মাটিতে বাঙ্গালীর প্রথম শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনারের গায়ে লেগে আছে আলতাব আলীদের রক্ত। আজ এখানকার মেয়র একজন বাঙ্গালী। এখানকার এম পি একজন বাঙ্গালী। আজ এই এলাকাটিকে বলা হয় বাংলা টাউন, যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ। আজ এখানকার স্কুল গুলোতে বাংলা শিখানু হয়। আজ এখানকার যেকোন ধরনের অফিসে কিংবা ব্যাংক, হাসপাতালে আপনি বাংলায় কথা বলে সাহায্য চাইতে পারবেন। আজ আপনি এখানে আসলে একবারের জন্যেও মনে হবেনা আপনি বাংলাদেশের বাহিরে কোথাও। আমাদের পূর্ব পুরুষদের দেয়া রক্তেই আজ আমরা নিরাপদ। মাথা উঁচু করে চলি।
আলতাব আলী পার্কে ব্লগারদের আড্ডার একটি ছবি। (বা’থেকে ব্লগার রেহা হাবীব, আমি এবং ব্লগার মাটির ময়না ভাই)
Comments (14)
পড়ে ভাল লাগল।
ধন্যবাদ
খুব সুন্দর গল্প লিখেছেন দাদা।
ধন্যবাদ দাদা। আপনার বাড়ি কি কলকাতা?
শিশুসাহিত্য হিসেবে সত্যিই গল্পটি আগ্রহ জন্মায়। ভাল লাগল। চলতে থাকুক আমার শুভেচ্ছা সাথে নিয়ে।
ধন্যবাদ আপু। ভাল থাকবেন।