Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এএস ঔডারল্যান্ডের ৯৭তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা


বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সকল ভিনদেশী মহা মানব-মানবীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ছিলেন তাদের মাঝে উইলিয়াম এএস ঔডারল্যান্ড অন্যতম।পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে তিনি এর সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে হিটলার এর নাৎসি বাহিনীর বর্বরতার, আধা ঘণ্টায় নাৎসি বিমান বাহিনীর হামলায় নেদারল্যান্ডের রটেরডাম শহরে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন ৩০,০০০ মানুষ । ২৫শে মার্চ ও তার পরবর্তী নিরীহ বাঙ্গালীর উপর পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ঔডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী। বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালী জাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। আজ এই মহান মুক্তিযোদ্ধার ৯৭তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ডের জন্ম দিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

ঔডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড। তার পিতৃভূমি ছিল অস্ট্রেলিয়া তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। ১৭ বছর বয়সে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে জীবিকার জন্য জুতা-পালিশের কাজ নিতে হয় এবং পরে তিনি বাটা স্যু কোম্পানিতে যোগ দেন। দু'বছর পর চাকরি ছেড়ে ১৯৩৬ সালে জার্মানী কর্তৃক নেদারল্যান্ডস দখলের আগে ঔডারল্যান্ড ডাচ ন্যাশনাল সার্ভিসে নাম লেখান। পরবর্তীতে তিনি রয়্যাল সিগন্যাল কোরে সার্জেন্ট পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অংশগ্রহণ করেন। জার্মানী কর্তৃক নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করার ফলশ্রুতিতে ঔডারল্যান্ডকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং জার্মানী থেকে ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজে নিযু্ক্ত হন। ঔডারল্যান্ড জার্মান ও ডাচ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিসট্যান্স মুভমেন্টের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন।

অন্যান্য বিদেশীদের মতোই এদেশে চাকরি করতে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ড। এ দেশ তখন পাকিস্তানের পূর্বাশং-তথা পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দেলনে উত্তাল সমগ্র দেশ। দেশের পরিস্থিতি আঁচ করতে মোটেই অসুবিধা হয়নি তার। টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা কাছে থেকে দেখেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭১-এ মার্চের গণ আন্দোলন, ২৫ মার্চ এর অপারেশন সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। অন্য দশজনের মতো বিপদ-আপদে না জড়িয়ে নিরাপদে গা বাঁচিয়ে দ্বায়িত্ব পালন করতে পারতেন। কিন্তু ঔডারল্যান্ড সেই ধরণের মানুষ, যাঁরা আত্মপর বিবেচনা না করে লাঞ্চিত মানবতা, নিপীড়িত জনতার প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা নিজের অনিবার্য কর্তব্য বলে মনে করেন। বাটা স্যু কোম্পানীর মত একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার। তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী,এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাঁকে 'সম্মানিত অতিথি' হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের 'নিরাপত্তা ছাড়পত্র' সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে পাকিস্তানী হায়নাদারদের হত্যাযজ্ঞের ছবি তুলতে থাকেন এবং গোপনে সেগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতে থাকেন। এছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত। 

(জেনারেল ওসমানি ও ঔডারল্যান্ড)
টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হন ঔডারল্যান্ড। ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। তাই ঔডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধান্ত নেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ঔডারল্যান্ড বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি বাঙ্গালী যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ড তার পূর্বতন কর্মস্থল বাটা শু কোম্পানীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তাঁর নাম ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭। একমাত্র বিদেশি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে এই খেতাবে ভূষিত করেছে। 

তরুণ বয়সে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ঔডারল্যান্ড দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী এক বিরত্বগাথা রচনা করে গেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন কিন্তু তৎকালীন সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখে নি। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিরা ই-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঔডারল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য কয়েক হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এ সব স্বাক্ষর সহ তাঁরা ঔডারল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য একটি আবেদন জমা দেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই দীর্ঘদিন হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগার পর ২০০১ সালের ১৮ মে তারিখে ৮৪ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার পার্থের এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ঔডারল্যান্ড। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তার কফিন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয় সেই সাথে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। পার্থে অবস্থানরত প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধারা ঔডারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে তিনি তার নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন। আজ এই মহান মুক্তিযোদ্ধার ৯৭তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ডের জন্ম দিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
০ Likes ১ Comments ০ Share ৪৭৬ Views

Comments (1)

  • - ফাতিন আরফি

    ভালো লেগেছে বেশ। 

     

    "ডেকে ডেকে ক্লান্ত বিরহী ডাহুকি

    নল খাগড়ার বনে একা একা; পাশে কাশবনের ধবল হাওয়ায়
    উম্মাদ সাদা মেঘের প্রণয়; বিরহ যন্ত্রণায় পুড়িয়ে মরে একাকি ডাহুকি
    যদি ফিরে আসে আমুদে প্রেম আবার।"

    • - পিয়ালী দত্ত

      darun