Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

নাসরিন ইসলাম

৯ বছর আগে

বাংলাদেশে আমের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভবনা

 

 আম আমাদের দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় ফল। এর সাথে অন্য কোন ফলের তুলনা হয় না। কারণ উৎকৃষ্ট জাতের আম স্বাদে, পুষ্টিতে, সুবাসে, তৃপ্তিতে এবং দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। আম এমন একটি ফল যা কাঁচা পাকা সর্বাবস্থায় খাওয়া যায়। ঝরে পড়া ছোট আম আমাদের বাচ্চাদের কাছে যে কত প্রিয় তা ছোটরাই ভালো জানে। ফলটি দেশে বিদেশে সবার কাছে সমানভাবে সমাদৃত। আম পছন্দ করে না এমন লোক হয়ত খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই অনেকে আমকে ফলের রাজা বলে থাকেন।

আমের বর্তমান অবস্থাঃ
আমাদের প্রায় ৫০,০০০ হেক্টর জমিতে আমের গাছ বা বাগান রয়েছে। বর্তমানে মোট আম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১,১০,০০০ টন। মাথাপিছু আম উৎপাদনের পারিমাণ দেড় কেজির মতো। যা অনেক দেশের তুলনায় আমাদের মাথাপিছু আমের উৎপাদন খুবই কম। প্রতিবেশি ভারতে মাথাপিছু উৎপাদন ১২ কেজি, পকিস্তানে ৭ কেজি এবং ফিলিপাইনে ১৩ কেজি। ষাটের দশকে এদেশে মাথাপিছু আমের উৎপাদন ছিল ৫ কেজির মতো। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, একজন সুস্থ সবল স্বাভাবিক লোকের জন্য প্রতিদিন ৮৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন অথচ এদেশে আমরা গড়ে ৪০ গ্রাম ফল খেয়ে থাকি যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সুতরাং আমাদের পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্য অন্যান্য ফলের সাথে আমের উৎপাদন বাড়াতে হবে।

আম চাষের মুনফাঃ
দানাশস্য যেমন ধান,গম ইত্যাদি চাষাবাদের চেয়ে আম চাষে ৫/৭ গুন বেশি লাভ। দানাশস্যে উৎপাদন খরচ অত্যন্ত বেশি। সে সাথে শ্রমিক সংকট সার, বালাইনাশক পেতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমের উৎপাদন খরচ একেবারেই কম  অপরদিকে নিট মুনাফার পরিমাণ অনেক বেশি। অনেক এলাকার আম বাগান মালিকগণ ৩/৪ বছরের জন্য আম বাগান বিক্রয় করে থাকেন, এসব ক্ষেত্রে মালিকের কোনো বিনিযোগ করতে হয় না এবং কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না। আমের রোগাক্রান্ত ও ছাঁটাইকৃত ডালপালা এবং ঝরে পড়া পাতা সংগ্রহ করে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা যায়। উঁচু জমিতে আম বাগান স্থাপন করলে ৮/১০ বছর পর্যন্ত আম বাগানে ধান/ গম/ শাকসবজির চাষ করা সম্ভব। তাই আম বাগান স্থাপনের প্রথমদিকেও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। উপরন্তু বাগান স্থাপনের পঞ্চম বছর থেকেই আম গাছ থেকে মুনাফা আসা শুরু হয়। একটি আম বাগান স্থাপন করলে দু‘ভাবে মুনাফা পাওয়া যায়। এক, আম ফল ও ছাঁটাইকৃত ডালপালা বিক্রয় থেকে প্রতি বছর আয়। দুই, ফলন শেষে আম গাছ বিক্রয় থেকে আয়। সুতরাং আম চাষ করলে লাভের পরিমাণ যে অনেক বেশি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

খাদ্য হিসেবে আমঃ
আম এমন একটি ফল যা কচি অবস্থা থেকে খাওয়া যায়। কাঁচা, পাকা উভয় আমই সরাসরি খাওয়া যায়। উপরন্তু আম দিয়ে নানা রকম মুখরোচক ও উৎপাদেয় খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। কাঁচা আম থেকে বহুবিধ খারার যেমন আচার, আমচুনা, চাটনি, মোরব্বা আবার পাকা আম দিয়ে জুস, জেলি, স্কোয়াশ, সিরাপ, টফি আমসত্ব ইত্যাদি খাদ্য তৈরি করা যায়। মুড়ি, খৈ ইত্যাদির সাথে পাকা আম খেতে বেশ সুস্বাদু। বেশি পরিমাণ আম খেলে হজমে অসুবিধা হয় না। কাঁচা আম দিয়ে তৈরি টক তরকারি ভাতের সাথে খেতে খুবই মজাদার। আম ছাড়া অন্য কোনো ফল থেকে এত প্রকার খাবার তৈরি করা সম্ভব নয়। আমের আঁটির ভিতরের শাঁসও গ্রাম এলাকায় অনেকে খেয়ে থাকেন। আম পাতা বা আমের খোসা গরু ছাগলের প্রিয় খাদ্য। 

আমের ওষুধি গুণঃ
আম একটি ফল হলেও এর অনেক ওষুধি গুন রয়েছে। আয়ুবেদীয় ও ইউনানী পদ্ধতির চিকিৎসায় পাকা আমকে হজমকারক এবং বলকারক খাদ্যরূপে অভিহিত করা হয়। কাঁচা ও পাকা উভয় প্রকার আমে ভিটামিন‘এ’ থাকায় চোখের জন্য বেশ উপকারি। আম খেলে যকৃত ভালো থাকে। আম পাতা পোড়ানো ধোঁয়া হিক্কা রোগ ও গলার প্রদাহকে উপশম করে। আমের কচি পাতা চিবিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত ও মাড়ি শক্ত হয়। আম পাতা গোড়া ছাই আগুনে পোড়া ক্ষতে প্রয়োগ করলে তা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। আম গাছের বাকলের রস বা কচি পাতার রস সাধারণ আমাশায় বা রক্ত আমশয়ে বেশ উপকারি। আম বীজের শাঁসের ক্লথ আদা সহকারে সেবন করলে উদরাময়ে উপকার পাওয়া যায়। 

আম চাষের সম্ভবনাঃ
আমাদের দেশে মাথাপ্রতি চাষাযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম। নতুন নতুন ঘর বাড়ি ও রাস্তা ঘাট তৈরি, কলকারখানা স্থাপন এবং নদী ভাংগনে অনেক চাষযোগ্য জমি প্রতি বছর কমে যাচ্ছে। তাই ফসলী জমিতে আম বাগান স্থাপনের সুযোগ কমে যাচ্ছে। চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম, সিলেটের পাহাড়ের ঢালে আম বাগান স্থাপনের এাখনও সুযোগ রয়েছে। রাজশাহী বিভাগের বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের সুবদ্যবস্থা না থাকায় চাষাবাদে বিঘœ ঘটে। সেখানকার আম বাগান সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

শহরাঞ্চলে বাড়ির আশেপাশে আম গাছ লাগানোর মত খোলা জায়গা নেই। তবে বাড়ির ছাদে ২/৪টি আম গাছ লাগানো তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়।এতে পরিবারের আমের চাহিদার অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। ড্রাম, সিমেন্টের তৈরি টব বা ইটের তৈরি বড় টব বানিয়ে গাছ লাগানো সম্ভব। যে সমস্ত জাতের বৃদ্ধি কম যেমন বারি আম-৩, বারমাসি, লতা বোম্বাই ইত্যাদির চাষ করা যায়। আম গাছ লাগানোর ইচ্ছা থাকা সত্বেও ভালো চারার অভাবে অনেকে আম গাছ লাগাতে পারে না। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় উন্নত জাতের আমের চারা সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য আম গাছ আঁটি থেকে উৎপন্ন। এদের ফলনও অত্যন্ত কম। উপরন্তু আম চাষে আমাদের অনভিজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে হেক্টরপ্রতি ফলন তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আঁটির গাছগুলোকে টপওয়াকিং-এর মাধ্যমে উন্নতজাতে পরিবর্তনের ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে ভালো জাতের আমের উৎপাদন বাড়াতে হবে। জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। উন্নত পদ্ধতিতে আম চাষে সরকার ও জনগণ উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা এবং সুচিন্তিত কর্মপদ্ধতি নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে অবশ্যই দেশে আম উৎপাদন বাড়বে এবং অতিরিক্ত আম বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

আমের গবেষণাঃ
আমাদের দেশে আমের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় সরকার ১৯৮৫ সনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন। আম একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল হওয়ায় গবেষণার ফলাফল পেতে দীর্ঘ সমায়ের প্রয়োজন পড়ে। আম গবেষাণা কেন্দ্রে বিভিন্ন রকম সমস্যা থাকলেও বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত চারটি আমের জাত (বারি আম-১, বারি আম-২, বারিআম-৩ এবং বারি আম-৪) মুক্তায়ন করা সম্ভব রয়েছে। জাতগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো সুমিস্ট এবং প্রতি বছর নিয়মিত ফল দেয়। এদের মধ্যে দু‘টি জাত পাকার সময় উজ্জ্বল হলুদ রঙ ধারণ করে। এ ছাড়াও এ কেন্দ্র থেকে রোগ ও পোকা দমন, জাত উন্নযন, সার ও সেচ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ কাজের ফলে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আম চাষি ভাইয়েরা এখন অনেক- বেশি সজাগ। দেশের অন্যান্য এলাকার আম চাষি ভাইয়েরা আম চাষে যত্নশীল হলে শুধুমাত্র সাধারণ পরিচর্যা গ্রহণের মাধ্যমে আমের উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। আম গবেষণা থেকে পরিপূর্ণ ফলাফল পেতে হলে গবেষণা কেন্দ্রটির উন্নয়ন তথা আরো বিজ্ঞানী নিয়োগ, গবেষণাগার উন্নয়ন, বিজ্ঞানীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও আরো বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

০ Likes ১ Comments ০ Share ৪৬৯ Views