একসময় অনলাইন সাইটের মাধ্যমে মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত।প্রথম দিকে অনলাইন দিনপঞ্জি লেখার সূত্র ধরেই আধুনিক ব্লগের জন্ম। এই লেখারপথিকৃৎ হল জাস্টিন হল্। জাস্টিন হলকে বলা হয় অন্যতম আদি ব্লগারদের একজন। অবশ্য তখনো ‘ব্লগ’ নামটা চালু হয়নি। এগুলোকে তখন বলা হত ‘ওয়েবলগ’; এই ‘ওয়েব লগ’ শব্দটির প্রবর্তক ছিলেন জোম বার্গার। ১৯৯৯ সালের দিকে পিটার মেরহোলজের একটি সাইটের সাইড বারের ‘weblog’ শব্দকে ভেঙে মজা করার উদ্দেশ্যে we Blog লেখেন তিনি। তখন তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি তার এই ‘Blog’ লেখাটিই সারাবিশ্বে এমন সাড়া ফেলবে। তৈরি করবে নতুন ইতিহাস। প্রতিটি ব্লগ সাইট গড়ে উঠেছে আলাদা আলাদা বিষয় ভাবনা দর্শন নিয়ে। এখনকার দিনে ব্লগ শুধু দিনলিপি লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং একেকটি বিষয়কে নিয়ে গড়ে উঠছে একেকটি কম্যুনিটি, বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ বাড়ছে মুক্ত চিন্তা ধারার বিকাশ।
বাংলাদেশে ব্লগিং এর সঙ্গে আমাদের সর্বপ্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যে প্লাটফর্মটি সেটি হচ্ছে সামহোয়্যার ইন ব্লগ। যাত্রার সেই দিনটি ছিল ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর শুক্রবার। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর তাই বাংলা ব্লগিং এর জন্য ঐতিহাসিক গুরুত্ববহন করে। সে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকেই সামনে রেখে সকল ব্লগার/অনলাইন ব্যবহারকারী সহ বাংলাদেশের সুধী-জনদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর সকলের সম্মিলিত মতামতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে সামহোয়্যার ইন ব্লগই সূচনা করে ব্লগ দিবসের। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ১৯শে ডিসেম্বর প্রথমবারের মত পালিত হয় বাংলা ব্লগ দিবস। ব্লগিং এর শক্তি ও সম্ভাবনাকে আরও বেশী বিস্তৃতির জন্য বিগত বছরগুলোতে দেশের বিভাগীয় শহরগুলো সহ বিশ্বের আর বেশকিছু দেশেও বাংলা ব্লগ দিবস পালিত হচ্ছে বেশ আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়েই। বিভিন্নব্লগ প্ল্যাটফর্মের সাথে পরিচয়, ব্লগারদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি ও ব্লগের সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে দিতে দিবসটি ইতিমধ্যে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।
বাংলা ব্লগের যাত্রা শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত ব্লগারদের অর্জন কি? তারা কি শুধু লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিল? লেখালেখির পাশাপাশি বাংলা ব্লগের ব্লগার-গন আরও কিছু সামাজিক মানবিক কাজে সাধারণ অসহায় দুঃস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন ভরসা হয়ে। সাহস হয়ে। শক্তিহিসেবে। জাতীয় দুর্যোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গেছেন সাধারণ মানুষদের সাথে। তারুণ্যের সকল শক্তি নিয়ে তারা মানবিক মানুষ হবার অভিপ্রায়ে সকল বাধা পেরিয়ে তারা এগিয়ে গেছেন অথচ দুঃখের বিষয় আমরা অনেকেই তা জানিনা। সম্প্রতি মাত্র দু/একজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কিছু নেতিবাচক প্রচারণা এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে ব্লগাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন, স্বীকার হয়েছেন মিথ্যা প্রচারণার যা কোনভাবেই কাম্য ছিলনা।
কয়েকবছর আগের ঘটনা, পুরনো ঢাকার নীম-তলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিলেন অনেকে। আহত নিঃস্ব হয়েছিলেন অনেক মানুষ। এই দুঃখজনক ঘটনায় ব্লগাররা এগিয়ে গিয়েছিলেন তাদের সহায়তায়। যদিও তা ছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে তবু এই এগিয়ে যাবার পেছনে কাজ করেছিল নিখাদ আন্তরিকতা, ছিল মানুষের পাশে দাঁড়াবার প্রবল ইচ্ছে। ব্লগাররা নিজ উদ্যোগে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জাতীয় দৈনিকে এই ব্লগারদের সহায়তার খবরটি প্রকাশিত হয়েছিলো।
প্রতি বছর নিয়মিতভাবে উত্তরাঞ্চল সহ অন্যান্য অঞ্চলে শীতে পর্যুদস্ত মানুষদের শীত নিবারণে সাধ্যমতো কাজ করছেন ব্লগাররা। ২০০৮ থেকে নিয়মিত প্রতি বছর প্রতিটি বাংলা ব্লগের ব্লগারদের উদ্যোগে এমন অনেক মানবিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা হচ্ছে ব্লগারদের তত্ত্বাবধানে। এতে উপকৃত হচ্ছে শত শত অসহায় দুস্থ মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে বলতে গেলে এই মানবিক কাজে জড়িয়েছেন বাংলা সকল ব্লগের ব্লগাররা। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে অসহায় দুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন। শত শত মানুষের জন্য তারা কম্বলও, গরম কাপড় নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন শীতার্তদের উষ্ণতা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে।
ঈদের পূর্ব রাতে সবাই যখন ব্যস্ত থাকে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড় কেনাকাটা বা অন্যান্য আরও কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে তখন এক দল ব্লগার তরুণ/তরুণী শহরের পথ-শিশু সহ দুঃস্থ ছিন্নমূল শিশুদের জন্য কেনা নতুন জামা পাঞ্জাবী বিতরণ করেন নানা অলিগলি ঘুরে ঘুরে। ঈদের সার্বজনীন খুশী ছড়িয়ে দিতে তাদের মুখেহাসি ফুটিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার কিছুটা হলেও পালন সচেষ্ট থাকেন ব্লগাররা।
কিছুদিন আগে সাভারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভবন ধ্বসের ঘটনায় সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার কাজ থেকে শুরু করে রক্ত-প্রদান, জরুরী ঔষধ প্রদান, আহতদের পুনর্বাসন ইত্যাদি সকল কাজে একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন বাংলা ব্লগের ব্লগার-গন। দুর্ঘটনার পর প্রতিদিন ঢাকা থেকে দুর্ঘটনা স্থলে গিয়েছেন বিভিন্ন ব্লগের ব্লগার-গন। উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রায় সকল কাজে অংশ নিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালনে ব্লগার-গন ছিলেন অগ্রবর্তী দলে।
আমাদের দেশে অসহায় দুঃস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে গেলে তারা নিজেদের চিকিৎসা নিয়ে বিপদে পড়ে যায়, তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। এ মানবিক কাজেও এগিয়ে এসেছেন ব্লগার-গন, অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলা ব্লগের ব্লগার-গন। সম্প্রতিছোট্ট শিশু রুশানের চিকিৎসা সাহায্যার্থে তহবিল গঠনে ব্লগারদের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতন। প্রায় ৭ লক্ষাধিক টাকার একটি তহবিল গঠন করে শিশুটিকে সুচিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন বাংলা ব্লগাররা। আয়োজন করা হয়েছিল চিত্র প্রদর্শনীর। এ ছাড়াও আরও কয়েকজন অসহায় অসুস্থ দুস্থ মানুষদের সহায়তায়/সেবায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মানবিক এসব কাজে বাংলাব্লগ কমিউনিটির সকল ব্লগারই সাধ্যমত সহায়তা দিয়ে সচেষ্ট থাকে বছরের পুরোসময়টা জুড়েই।
গত কয়েকবছর থেকে অমর একুশে বইমেলায় ব্লগারদের লেখা গল্প/উপন্যাস/কবিতাসহ ব্লগ সংকলন প্রকাশ হচ্ছে নিয়মিত। ব্লগারদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে বেশ কিছু ছোট কাগজ/সাহিত্য-পত্রিকা। চারুকলা অনুষদে অনুষ্ঠিত হয়েছে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।
গত বৈশাখ মাসে এতিম বাচ্চাদের নিয়ে আয়োজনকরা হয়েছিল ফল উৎসবের। ব্লগারদের সম্মিলিত সহযোগিতায় বেশ কিছু জেলায় ফলবিতরণ করা হয়েছিল পথ-শিশু এবং এতিমখানায়।
চিঠি লেখার অভ্যাসকেআমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে নতুন করে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে এবংচিঠির আবেগী দিকটির কথা যেন আমরা কেউ ভুলে না সে লক্ষ্যে গত দু বছর নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয়েছে প্রিয় চিঠি লেখা আয়োজন। ১ম আয়োজনে ১১৯ জন এবং ২য়আয়োজনে ১৬৫টি চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। সেরা চিঠি লেখকদের সম্মাননা জানানো হয়েছে। জাতীয় দৈনিকে এই নিয়ে উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
নিজেদের প্রবল ইচ্ছে আগ্রহ আন্তরিকতা এবং সমাজ সংসারতথা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এমন অসংখ্য মানবিক সামাজিক স্বেচ্ছাসেবীকাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাংলা ব্লগ কমিউনিটির অনেক সদস্য। সৃজনশীল লেখালেখির পাশাপাশি মানবিক মানুষ হবার বাসনায় ব্লগাররা চেষ্টা করছেন একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় অবদান রাখতে যেখানে সুখে দুখে একে অন্যেরপাশে দাঁড়াবে সামর্থ্যবান সবাই। ব্লগাররা স্বপ্ন দেখে একদিন বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সোনালী স্বপ্নের স্বদেশ। যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন করেছিলেন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা। যে স্বপ্ন নিয়ে একুশের প্রভাতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক জব্বার বরকতেরা একদিন সেই বাংলাদেশ হবেই হবে।
ব্লগারদের এসব অসামান্য অর্জনের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়েছে ব্লগারদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি। আমরা আশাবাদী এই প্রতিবন্ধকতার অবসান হবে, ব্লগারদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষিত হবে; মানবীয় সংস্কৃতিতে প্রাণবন্ত গতিশীল থাকবে বাংলা ব্লগ। ৫ম বাংলা ব্লগদিবস এই সুদৃঢ় প্রত্যয় পূরণে সক্ষম হবে। শুভেচ্ছা সবার জন্য।
[লেখাটির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই সামহোয়্যারইন...ব্লগের শ্রদ্ধেয় সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস জানা এবং শরৎ চৌধুরীর প্রতি। মূলত উনাদের অনুপ্রেরণায় আমি লেখাটি লিখেছি।]
Comments (30)
সুন্দর অনুভূতির কবিতা
বেশ লাগল-------------
অনেক শুভেচ্ছা।
অসাধারণ...
ধন্যবাদ।
বাঃ চমৎকার
শুভেচ্ছা নিবেন।