Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

sokal roy

৯ বছর আগে

বন্ধুত্বের সুমিষ্ট ঝরনা হতে ওরা অনেক উচুঁতে স্বপ্ন গেথেছিলো




এক.

আজকাল সকালে চোখ ছাপিয়ে ঘুম আসে। সে ঘুমকে ফাকি দেয়াও দুস্কর। হয়তো আধবোজা হয়ে আরো কিছুক্ষণ থাকা যেত। কিন্তু তা হলো না।
-রিসাত ডাকছে;
-মা তোমার চিঠি এসেছে।
চিঠি;কথাটা কানে বাজতেই চোখ ছাপানো ঘুমটা জানালায় ছুড়ে ফেলে উঠে বসে ইসরাত। কতোদিন কেউ চিঠি লিখেনা তাকে। সর্বশেষ চিঠিটা লিখেছিলো শ্রাবণ,তাও আবার কলেজ ক্যান্টিনে,হকারের হাতে করে পাঠিয়েছিলো।
ইসরাত তো ভেবেই নিয়েছিলো হয়তো এ জীবনে আর কেউ ওকে চিঠি লিখবে না। আজ চিঠি এসেছে ওর কাছে, এটা ভাবতেই কেমন লাগছে যেন।

কে লিখতে পারে চিঠি ? বইয়ের দোকান থেকে শুভেচ্ছানামা পাঠালো কি !!। নাকি ভুল করে ওর ঠিকানায় চিঠি এসে গেছে। এই দূরদেশে স্বামীর সাথে ছ’বছর ধরে পড়ে আছে ইসরাত। এখানে পাশের ষ্ট্রিটের এক বাঙলীবাবুর বইয়ের দোকানের নিয়মিত খরিদদার; এই বাঙালীবাবুটির সাথেই মিশেছে এছাড়া কারো সাথে খুব কড়া করে মেশা হয়নি ওর।
তবে কে লিখলো এই চিঠি ? ভাবনাটা ঘুড়ে ঘুড়ে মাথায় টোকা মারে ওর।
খানিক পরে রিসাত আবার এসে বললো, মা ফাদার এসেছে ?

আর বসে থাকা যায়না। ইসরাত নেমে আসে বিছানা থেকে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে বসার ঘরে আসে ও। ফাদার বসে আছে।
-আপনি এই সাত সকালে। ফাদার স্মিথ হাসে; আপনার বইয়ের রয়্যালিটির পুরো টাকাই গীর্জার ফান্ডে দিয়ে দিয়েছি। ইসরাত বলে ওহ্, তাই অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ফাদার।
কলেজ পড়ার সময় ইসরাতের বন্ধু শ্রাবণ গল্প লিখতো;কিন্তু শ্রাবণ ছিলো এক নম্বরের আলসে; লিখাগুলো কোনকালেই যে ছাপার অক্ষরে ফেলবে না সেটা বুঝে গিয়েছিলো ইসরাত। আর তাই জমিয়ে রেখেছিলো গল্পগুলো। এই দুরদেশে এসে সেই গল্পগুলো থেকেই বই করে বাজারে ছেড়েছে।
শ্রাবণ কে এ-কথা বলতে চেয়েও পারেনি;পুরোনো ঠিকানা পাল্টে সেই কবে হাওয়া হয়ে গেছে শ্রাবণ।

ঘরে ফিরে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। হাতের লেখা অচেনা। চিঠিটা খুলে মেলে ধরে সামনে। তারাহুরো করে লেখা চিঠি।

দুই.

প্রিয় ইসরাত কেমন আছিস তুই ?
চিঠি পেয়ে তোর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে কি ? ভয় পাসনে আবার।
ঠিকানা পেয়েছি সিস্টার ডি-মারিয়ার কাছ থেকে। বলতো,কতোদিন দেখিনা তোকে !! কতো কথা যে জমে আছে; হয়তো সেগুলো আর কখনই বলা হবেনা।
তোর সংসার কেমন চলছে ? তোর বাবুটা কেমন আছে ? তোর কি এখনও খুব মন খারাপ হয় ? এখনও কি ঈদে মেহেদী নিয়ে বসে থাকিস।
এই,রে কতো প্রশ্ন করে ফেললাম একসাথে। একটু থামি!!
জানিস ইসরাত,মিনা বাজারের বই মেলায় তোকে দারুন মিস করি। প্রতিবছর মেলায় তুই সুনীল,সমরেশ কতো বই কিনতি,আমরা সবাই সে,সব বই বছর জুড়ে পরতাম।
এ্যাই তোর মনে আছে, ঘুগনিওয়ালা কথা, তোকে খুব আদর করতো। কচুরী তোর খুব প্রিয় ছিল। শালপাতায় ঝালমুড়ি। জানিস আমার মনে হলে এখনও জিবে জাল আসে।
ইসরাত,
পিৎজা, পেটিসের ভীড়ে কুচুরী স্বাদ তোর মুখে থেকে হারিয়ে গেছে তাই না,রে ?
তোর বরের রাগ কমেছে এখন ?
আচ্ছা তুই কি এখনো জোস্নারাতে খোলা গলায় গান করিস ? গান না করলে দোষের কিছু নেই কিন্তু তোর প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতটা আমি মাঝে মাঝে গুনগুন করে গাই।
তুই শুনলে হাসবি পূজোর নাটকে তুই তো দেবীসুলতানার পার্টটা নিতি,কিন্তু এবার যে মেয়েটা সেই চরিত্রটা নিয়েছিলো একটুও জমাতে পারেনি। সে,কি বিচ্ছিরি ব্যাপার।
জানিস তোর কথা মনে হলে সেই পুকুর পাড়ে গিয়ে আজও বসি। তোর হাতের লাগানো শেফালী গাছটায় এখন ফুলের সমাহার। সেই ফুলের সুভাসে মাতোয়ারা হই যতখানি তারচেয়ে কষ্ট পাই ততখানি যখন তোর কথা মনে পড়ে।

আমি জানি বড় চিঠি পড়তে তোর অস্বস্থি হয়; তাই আর কিছু লিখছি না। আমি ভালো আছি। তোর বরকে আমার সালাম দিস। বাবুটার জন্য অনেক আদর।
এ,চিঠির উত্তর হয়তো পাবোনা,ব্যাস্ততার মেশিনে পড়ে হয়তো ভুলে গেছিস এই শ্রাবণকে।


শেষান্তে
সুতো ছিড়ে হারিয়ে যাওয়া ঘুড্ডি (শ্রাবণ)।


চিঠিটা আবার খামে পুড়ে উঠে বসে ইসরাত। একসময় বড়চিঠিতে অস্বস্থি হতো ওর। কি›তু আজ আক্ষেপটা বড় জ্বালা দিচ্ছে ইস্ চিঠিটা কেন আরেকটু বড় হলোনা ? আরেকটু বড় হলে কি এমন ক্ষতি হতো।
ইসরাতের বুক ফেটে কান্না আসে।
শ্রাবণ!!
কতোদিন পর শ্রাবনের লেখা। শ্রাবনের একটা কথা খুব ভাবায় ওকে “সত্যিকারের বন্ধুত্ব কখনো মরেনা সেটা বেছে থাকে চন্দ্র সুর্যের মতো”। শ্রাবনের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো কিন্তু এখন কি আর তা আছে;সেটাই ভাবে ইসরাত। ইচ্ছে করে ওয়েলসের টাইম মেশিনটায় চড়ে চলে যেতে নয় বছর আগেকার সেই দিনে।



তিন.

কলেজে নতুন তখন।
কো-এডুকেশন কলেজ হলেও;ছেলেমেয়েতে জটলা প্রিন্সিপালের অপছন্দ। পঙ্গপালের দল কি তা বুঝে। মাঠের আশেপাশে জটলা আছেই।
খোলামাঠে গিটার হাতে গান গাইছে এক তরুন;কন্ঠটা মিষ্টি।
ইসরাত বই পছন্দ করে লাইব্রেরী থেকে বেরুতে যাবে পিছু থেকে ডাক আসে,এই যে মিস শুনুন; আপনি যে বইটা নিয়েছেন সেটা রেখে অন্য আরেকটা নিন;আমি এটা নেব; দুইমাস ধরে ঘুরছি বইটার জন্য।
ইসরাত জানে এই বই আজ ছাড়লে পরে কবে পাওয়া যায় তার ঠিক নেই।
ছেলেটি সামনে এসে দাড়াল, বলে আপনি তো প্রথমবর্ষে তাই না !! কথা দিচ্ছি আমি পড়ার পর ওটা পড়ার সুযোগ আপনিই পাবেন। ইসরাত কিছুই বলতে পারেনি অপু-দূর্গার পথের প্যাচালী সেদিন দিয়ে দিয়েছে।
পরে ছেলেটির পরিচয় পেয়েছিলো ওর নাম শ্রাবণ।
সায়েন্স নিয়ে পড়তো ইসরাত। ল্যাবরেটরীতে প্রায়ই দেখা হতো;তারচেয়ে বেশি লাইব্রেরীতে। এভাবেই চলতে ফিরতে আকাশ তারায় একসময় বন্ধুত্ব হয়ে যায় ওদের মাঝে। শুধু ওরাই না, ওদের দলে আরো পাচঁজন এসে ভীড় করে। সবচেয়ে মজার বিষয় ওদের এই বন্ধুত্ব কারো কাছে কারো চাইতে হয়নি হয়েছে এমনিতেই।

বন্ধু হলো আত্নার আত্না। চোখ বুঝলেই অনুভব।
শ্রাবনের সাথে চলতে ফিরতে সে অনুভব গুলো রাঙ্গিয়ে নিয়েছিলো ইসরাত। শেয়ার করার হাজারও কথা যখন মাথায় ঘুরপাক খেতো ওর সে,সব হালকা হতো শ্রাবনের অনুভবের আঙ্গিনায়।
দূর পাহাড়ের পটভূমিতে বন্ধুত্বের সুমিষ্টি ঝরনা হতে ওরা অনেক উচুঁতে স্বপ্ন গেথেছিলো। ওরা রোদের সাথে পাল্লা দিতে পড়ন্ত বিকেলে বালিতে হেটেছিলো। ইসরাত বুঝেছিলো জমে থাকা ক্লেশ ঢেলে দিতে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই সেরা।
মিনা বাজারের বইমেলা আর ওদের বই কেনা প্রতিবছর নিয়মকরা হয়ে গিয়েছিলো। ইসরাত বিজ্ঞানের পটে বসে নাটকের অভিনেত্রীও হয়ে গিয়েছিলো এই শ্রাবনের হাত ধরে।
ইসরাত প্রেম ভালোবাসাকে এক সাইডের ঝুপরিতে ফেলে বন্ধুত্বের অবগাহনে ভেসে চলেছিলো।

যখন কলেজ বন্ধের দিনে ওরা সবাই বাসায় থাকতো নিয়মিত চিঠি চলতো ওদের মাঝে।
এভাবেই কাটছিলো দিনগুলি।
হয়তো এভাবেই কাটতো। কিন্তু পাকা ধানে মই না দিলে বিধাতা পুরুষটারটার বোধহয় ভালো লাগেনা। এই দহরম-মহরম ভালো লাগেনি বোধহয় তার। আর এই জন্যই এক বিকেলে ভুলের অবতারনা শুরু করলেন তিনি।
সার্কসের মাঠে শ্রাবণের সাথে এক রমনীর খুব হাস্যরস মনে বাধলো ইসরাতের। ভেতরে দহন হতে থাকলো। শ্রাবনের উপর একটা অদৃশ্য অধিকার পেয়ে গিয়েছিলো ইসরাত;সেটা আর কারো কাছে যাচ্ছে ভেবে ভাঙ্গনের নদীতে ডুব দিচ্ছিলো ওর মন।
কিন্তু সেটাই ছিলো মস্ত ভুল।
মনেপ্রানে একাত্না হয়ে গিয়েছিলো শ্রাবন। রং মেশাচ্ছিলো মনের আকাশে ইসরাত কে নিয়ে।
এক সকালে কলেজ ক্যান্টিনে হকার এসে শ্রাবনের লেখা একটা চিঠি দিয়েছিলো ইসরাত কে, তাতে লেখা ছিলো, আমরা ভালো বন্ধু থেকে ভালো জীবনসঙ্গি হতে পারি। কিন্তু ইসরাত পাল্টা জবাবে বলেছিলো বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে গলাটিপে হত্যা করে আমি প্রেমে যেতে চাইনা।
তাছাড়া আজকাল শ্রাবণের চারপাশে অনেক প্রেম ঘুড়ছে তাতে ইসরাতের দূয়ারে না এলেও চলবে। কি এক অজানা অভিমানে ইসরাত এড়িয়ে গেছে শ্রাবণকে।
শ্রাবন অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হয়নি।
বিয়ে করে স্বামী নিয়ে দেশ ছেড়ে দিয়ে এই বিদেশ বিভূয়ে পড়ে আছে সাত বছর। বিয়ের পর ইসরাত ভাবনার পুকুরে জাল ফেলে দেখেছিলো,সেদিন শ্রাবণকে ও ভাবে না ফেরালেই ভালো হতো;হয়তো ভালো বন্ধু থেকে ভালো জীবনসঙ্গি হতে পারতো ওরা।


চার.


কতোক্ষণ যে এভাবে বসেছিলো ইসরাত তা খেয়াল নেই। টাইম মেশিনের জগৎ থেকে ফিরে আসে।
রিসাত এসে আবার ডাকলো মা খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে তুমি আসবেনা।
এখন খাবো না বলে চিঠির প্যাড হাতে নিয়ে চিঠি লিখতে বসে যায় ইসরাত।

প্রিয় শ্রাবন,
কেমন আছিস তুই ?


________________সমাপ্ত____________________
১ Likes ০ Comments ০ Share ১০৫৬ Views