Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Mishu Milan ..

১০ বছর আগে

বকুমার ঝুলি

‘কি আর কব লো বুন, মানুষির আক্কেল-পছন্দ দেকলি দুঃখে ঠোঁট কপাটি নাগার উপক্রম অয়। নতুন কর্তা আমাগের দুই জুটিরে কিনে আনে সেই রাত্তিরি থাকপার দিল মুরগীর ঘরে-একপাল মোরগ আর মুরগীর সাথে! ঘরে ঢোকা মাত্তর-ই মুরগীর করকর আর মোরগের কক্ কক্ শব্দে কানের তালা প্রায় নাগে যায় আর কি। তার ওপর মুরগীগুলোর গায়ের বিদঘুটে গন্ধ আর বিষ্ঠার গন্ধে আমার তো দম আটকে আসপার নাগলো। প্যাটের মদ্যি পাক দিয়ে বমি হবার যোগার। আর আমার সঙ্গীর শুরু হলো হাঁচি। সে কি হাঁচি রে বাবা! সহজে কি থামে! মুরগী জাতটাই নোংরা!
যাই হোক দুই চোক্ষে অন্ধকার একটু সয়ে গেলি দ্যাকলাম, ঘরের মদ্যি এই বড় বড় অনেক গুলোন মুরগী আর দামড়া দুইডা মোরগ। আমার তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগার! মনে মনে কই, ও বকমেশ্বর! একি তোমার লীলে! আগের রাতে কই ছিলাম, আর এহন কই আসলাম!’
‘ও বকুমা, বকমেশ্বর কি?’ কুবুর জিজ্ঞাসা।
‘মানুষেরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে। তারা মনে করে তাগের সৃষ্টির পিছনে একজনের হাত আছে। সেই একজনই হলো ঈশ্বর। তাই মানুষেরা এই ঈশ্বরের নামে পূজা-পার্বণ করে, প্রার্থনা করে পাপ থেকে মুক্তি পাবার নাগি। করবিনে? মানুষের মতো এই দুনিয়ায় আর কোন প্রাণী এতো পাপ করে! তা এই মানুষের কাছাকাছি থাকতি থাকতি আমাগের পায়রা সমাজেও এই সংস্কার ঢুকে পড়ছিল। মানুষেরা সৃষ্টিকর্তারে কয় ঈশ্বর, আর পায়রা সমাজে কয় বকমেশ্বর! পায়রা সমাজে এই প্রথা যিনি চালু করছিলেন, তারে কয় বকমগুরু! মানুষ বড় আজব ধরণের এক প্রভাবশালী প্রাণী লো বুন। এগের ধারে-কাছে যেসব প্রাণী যায়, তাগের ভেতরেও মানুষের আচার-আচরণের প্রভাব পড়ে। সংস্কার বড় আঠার মতো জিনিস। তাই এতো বছর বাদেও আমার মুহি প্রায়ই আসে পড়ে, বকমেশ্বর!’
‘আচ্ছা, তারপর কি হলো কও।’ কুবুর যেন তর সয় না।
‘তারপর ভয়ে ভয়ে আমরা চার পায়রা ঘরের এক কোনার দিকে সরে গেলাম। মিত্যে কতা কব না, আগের কর্তার বাড়িতে আমরা মহা আরামেই ছিলাম। তিনতলা এই বড় বাড়ি! পেত্তেক দম্পতির নাগি আলাদা ঘর। সে এক রাজার হাল আর কি! সেই বাড়িতে স্থান সঙ্কুলানের কারণে বাচ্চাগুলো একটু বড় হলি মাঝে মাঝেই হাটে নিয়ে বেচে দিতো। মাসে মাসে অনেক বাচ্চা ফুটতো যে!
পেত্তম কর্তার বাড়িতে সেদিন সকাল থেকেই আমরা দুজন ঠোঁটনা-কোটনা খেলতেছিলাম। দুপুরের দিকে কর্তার রাখাল আসে আমি, আমার সঙ্গীসহ আরো কয়েক জুটিরে ধরে পা-ডানা বাধে ঝুড়ির মধ্যে ফেলে রাখলো। তহনই বুঝলাম এ বাড়ির তে আমাগের বরাত উঠলো। আমার বাবা-মা ঘরে বাইরে আছাড়ী-পিছাড়ী করবার নাগলো। কিন্তু মানুষির ওপর কিছু করবার সাধ্যি তো তাগের নাই। একটু পর রাখাল ঝুড়ি মাতায় করে হাঁটা শুরু করলো।
মা-বাবা আমাগের দিকে তাকায়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কানবার নাগলো। আমরাও একে অন্যের গলায় গলা ঘষে কানবার নাগলাম। একটু পরেই মা-বাবার চোখের আড়ালে চলে আসলাম আমরা।
রাখাল হাঁটে তো হাঁটেই, পথ আর ফুরোয় না। হাঁটা মানুষির মাতার ঝুড়িতে বসে থাকার যে কি আরাম, সেই আমি পেত্তম বুঝলাম। আরামে ঝিমুনি আসে যায়। আমার মাঝে মাঝে ঝিমুনি আসে, আবার মাঝে মাঝে আমি আকাশের দিকে তাকায়ে থাকি। অনেক উপরে মেঘ খেলা করতো। তহন মনে মনে ভাবতাম, আহারে কবে যে মেঘের দেশে উড়ে যাব! মাঝে মাঝেই মেঘ আড়াল করে দাঁড়ায় ঘন গাছপালা আর বাঁশের ঝাড়। অনেকণ আর আকাশ দ্যাহা যায় না। গাছের ডালের ওপরে চড়–ই পাখি খেলা করে, লোভী চোক্ষে আমাগের দিকে তাকায়ে থাকে কাক, আর বাঁশঝাড়ে কিচির-মিচির করে শালিক। বাঁশের ঝাড়ে জায়গা বিশেষে এমন গা ছমছমে অন্ধকার, ভয়ই করে! তারপর আবার একসময় সূর্য্যের আলোর পাই, মেঘের দ্যাহা পাই। এমনি করে করে কত পথ যে পার হই! তারপর এক তেমাতার কাছে আসে এক লোকের কতায় রাখাল ঝুড়ি নামালো। আমি গলা বাড়ায়ে দ্যাকলাম, একজন সাইকেলঅলা। ভয়ে তো আমাগের গলা শুকোয়ে আসলো। আমি মনে মনে কই, ও বকমেশ্বর! এই সাইকেলঅলার কাছে যেন আমাগের বেচে না দেয়। আমি জানি, সাইকেলে যারা হাঁস-মুরগী, পায়রা নিয়ে বাড়ি ফেরে তাড়া পোষার জন্যে কেনে না। খাওয়ার জন্যে কেনে। কর্তার বাড়িতে কতদিন আমি সাইকেলে মুরগী আনতি দেকছি। তারপর সেই মুরগী জবাই করে, রান্না করে সবাই মিলে মজা করে খাইতো। তা দামদর ঠিক করে রাখাল আমাগের দুই জুটিরে বেচে দিল ঐ সাইকেলঅলার কাছে। আমাগের পায়ে দড়ি দিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের সাথে উল্টো করে বাধলো। মাথা নিচে, পা উপরে। আমার তো বুঝা সারা যে, বাড়িতে নিশ্চয় কুটুম আইছে, তাই আমাগের নিয়ে যাতেছে জবাই করে খাওয়ানোর নাগে। বিটা কি জোরে সাইকেল চালায়! আমি ভয়ে মাতাডা গুটায়ে রাহি। ভন ভন করে সাইকেলের চাকা ঘোরে। একবার যদি চাকার মধ্যি মাতাডা যায়, তাইলে আর পরানডারে টানে হেঁছড়ে জবাই অব্দিও নিয়ে যাওয়া লাগবেন না। ঘাড়ের তে মাথাডা ছিঁড়ে এই রাস্তার মধ্যেই পরান বায়ু বাইর হয়ে যাবেনে। তা বাড়িতে আনে যহন ঘরের কাছে নিয়ে গেল, তহন ভাবলাম যাক রাত্তিরি অন্তত জবাই হবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকে মোরগ-মুরগী গুলোনরে দেখে তো ধড়ে আর পরান ধরে রাখপার পারিনে। আমরা চারজন সিঁটে মারে কোনার দিকে পড়ে থাকলাম। একটু পর আমি অনুভব করলাম হারামজাদা মোরগটা আমার ঘাড়ে ঠোঁট ঘষতেছে। আমি যত সরে আসি, সেও তত সরে আসে। কি আপদ! আমার তখন অল্প বয়স। ভালো মতো উড়াও শিখি নাই। উড়ে চার-পাঁচ কদমের বেশি যাবার পারিনে। কিন্তু চেহারায় একটা চেকনাই সৌন্ধর্য্য চলে আইছে। তাই দেহেই মোরগের নাচন শুরু হইছে। এরপর পাজি নচ্ছার মোরগটা আমার আরো কাছে ঘেঁষে, ঠোঁট দিয়ে আমার চুলের মদ্যি আর গলায় কেমন কেমন যেন করবার নাগলো! তাই দেহে আমার সঙ্গীর রাগ হয়ে গেল। ও চোখ গরম করে মোরগটার মুখোমুখি আগায়ে গেল। আর সাথে সাথেই মোরগটা আমার সঙ্গীর মাতায় এমন জোড়ে এক ঠোক্কর মারলো যে, সঙ্গী উমম করে বেড়ার সাথে মাথা ঠেকায়ে পড়ে থাকলো। দুঃখে আমার বুক ফাটে যাবার নাগলো।
আমি তহন খালি বকমেশ্বরের ডাকি, বকমেশ্বর, আমায় রক্ষা কর। এর পর হলো কি- হারামজাদা মোরগটার অমন মতিচ্ছন্ন কান্ড দেহে একটা মুটকী মুরগী মোরগটার দিক তেড়ে আসলো। মোরগের ঠোঁটে-গলায় ঠোক্কর দিয়ে কেমন যেন শব্দ করবার নাগলো। সে সব শব্দের একটাও আমি বুঝলাম না। আমি তো আর মুরগীদের সব ভাষা বুঝিনে। কিছু কিছু বুঝি। এরপর মুটকী মুরগীটা রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি এমন ভীরু আর মায়া মায়া চোখে তার দিকে তাকালাম যে, আমার কোন দোষ নাই। আপনি আমারে বাঁচান। ওমা! মুরগীটা এমন এক ঠোক্কর মারলো আমার মাতায়, আমার বেক্ষ্মচান্দি ঘুরে গেল। মনে হলো, আমার দুনিয়াডা বন্ বন্ করে ঘুরতেছে। আমি বেড়ার সাথে মাতা ঠেকালাম। আর সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম!
পরদিন সকালে আমার জ্ঞান ফিরলে দেহি, মুরগীগুলো ঘরের বাইরে চলে যাতেছে। পাশে বসে আমার মাতায় ঠোঁট বুলাতেছে আমার সঙ্গী। অন্য জুটিও গুটিসুটি মারে ঘরের এক কোনার দিকে বসে আছে। আর দরজায় দেহি একজন মানুষ উঁকি-ঝুকি মারতেছে। এই মানুষটাই কাল আমাগের কিনে আনছে। মানুষটা আমাগের দুই জুটিরে নিয়ে বাড়ির উঠোনে ছাড়ে দিল। নতুন জায়গা, নতুন বাড়ি। আমরা অবাক হয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকায়ে এদিক-ওদিক তাকায়ে দ্যাকপার নাগলাম। আর আমি মনে মনে কলাম, দ্যাক বাপু মানুষ, আমাগের আর মুরগীর ঘরে রাখো না। তাইলে মোরগের কাছে আমার সম্ভ্রম, আর মুরগীর কাছে আমার দুই-ই হবি বিসর্জন।
সে সকালে আমাগের খুদ খাবার দিল। আমি খুদ খাই আর এদিক-ওদিক তাকাই। মনে যে কেবলই জবাই হবার ভয়! তো দ্যাকলাম উঠোনের এক কোনায় তিনজন মানুষ একখান ঘর দাঁড় করাবার চেষ্টা করতেছে। দেহেই বুঝলাম, আমাগের ঘর। ছোট ছোট দরজা। তবে একতলা ঘর। আগের কর্তার বাড়িতে ছিলাম তিনতলা ঘরে। তা হোক, আমাগের মনে তো আনন্দ আর ধরে না! জবাইয়ের হাত থেকে তো বাঁচলাম! তো সেই একতলা ঘরে সেই দিন থেকেই শুরু হলো আমাগের নতুন জীবন। আমাগের আর মুরগীর ঘরে থাকা নাগলো না।’
এই পর্যন্ত বলে বকুমা আবার থামলো। তার গলা শুকিয়ে গেছে। বয়স হয়েছে বকুমার। এখন উড়ে বেশিদূর যেতে পারে না, হাঁফিয়ে ওঠে। সারাদিন বাসায় বসে ছোট দুই নাতি-নাতনিকে পাহাড়া দেয়। ক্ষিধে পেলে নিচে নেমে কিছু খুঁটে খেয়ে আবার বাসায় ফিরে আসে। কিংবা গাছের মোটা ডালে একটু হাঁটাহাটি করে, নিবিড় পাতার ফাঁক গলে ডালে আসা এক চিলতে রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকে। এখন বকুমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী জুটেছে কুবু। কুবু সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। খুবই সুন্দরী। কিন্তু ও বড় অসহায় আর নিঃসঙ্গ। অল্প কিছুদিন আগে ওর সঙ্গীটি নিখোঁজ হয়েছে। সেই যে সকাল বেলা ডানার আড় ভাঙতে কোনদিকে উড়ে গেল, আর ফিরে এলো না। তাই কুবু এখন বকুমার কাছেই থাকে। বকুমার অতীতকালের, লোকালয়ে থাকার গল্প শোনে। বকুমা শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘তুবনা পাতা নিয়ে আয় দিনি বুন। গলা যে শুকোয়ে গেল।’
কুবু ডানায় ভর করে নিচের দিকে নামলো। সামান্য দূরে গিয়ে লতা জাতীয় এক ধরণের গাছ থেকে দুটি পাতা ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে আবার বকুমার পাশে এসে বসলো। একটি পাতা বকুমাকে দিয়ে আরেকটি সে নিজে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ঠোঁট নাড়তে লাগলো। এই তুবনা পাতা স্বাদে অনেকটা পানপাতার মতো। কিছুটা ঝাঁঝালো আর পাতায় রসও থাকে খুব। খেলে তৃষ্ণা মেটে। উত্তেজনা কমে স্নায়ু শীতল হয়। আর ঝাঁঝের কারণে ঘুম ঘুম ভাব কেটে যায়।
‘তারপর কি হলো কও বকুমা।’ তাড়া দিল কুবু।
‘তারপর আমরা চারজন সেই একতলা ঘরে বাস করবার নাগলাম। তখনও উড়া শিহি নাই। ঘর-বারান্দায় খেলা করি। ঠোঁটনা-কোটনা খেলি। হঠাৎ যদি ঘর থেকে নিচে পড়ে যাই, উড়ে আর ঘরে উঠপার পারিনে। কর্তা বিংবা কর্তার বাড়ির লোকজন ধরে উঠোয়ে দেয়। একদিন হলো কি আরেক জুটির মরদটা নিচে পড়ে গেল। বারবার চেষ্টা করেও উঠপার পারলো না। আবার কর্তার বাড়ির কেউ এদিকে আসেও না যে, ধরে উঠোয়ে দিবি। একসময় কর্তার বাড়ির পাজি কুকুরটা মরদটারে মুখে নিয়ে আছাড় মারবার নাগলো। তারপর মুখে নিয়ে একদিকে হাঁটা দিল। মনে হয় কোন বনে-জঙ্গলে নিয়ে মরদটারে খাইছে হারামজাদা কুকুর। এরপর থেকে আমরা খুব সাবধানে থাকতাম। আমি আর আমার সঙ্গী খেলা করি, আরেক জুটির মাদীটা মন মরা হয়ে বসে থাকে। কর্তার বাড়ির লোকজনও বুঝলো যে জোড়ার একটা হারায়ে গেছে, এ তো আর ডিম দিবেন না। একদিন বৈকেলে কর্তার ভাই মাদীটারে জবাই করলো!
এরপর আমি আর আমার সঙ্গী আরেকটু বড় হলাম। উড়ে এ গাছে সে গাছে যাই, টিনের চালে যাই, আবার ফিরে আসি আমাগের একতলা ঘরে। এমনি করে একদিন আমরা ভাল মতো উড়া শিকলাম। আমরা সারা গ্রাম উড়ে বেড়াতাম, মাঠে যাতাম, ধান কাটা ক্ষ্যাতে ঝরে পড়া ধান খুঁটে খুঁটে খাতাম। দুই জনের সে কি আনন্দের দিন!
কর্তার উঠোনেও অনেক ধান রোদে দেওয়া থাকতো। বারান্দায় বসে সেই ধান পাহাড়া দিত কর্তার মা-আধকানা বুড়ি। বুড়ি একটু এদিক-সেদিক গেলেই আমরা ধান খাওয়া শুরু করতাম। মোরগ-মুরগীগুলোও এই সুযোগ নিতো। সবাই পাল্লা দিয়ে ধান খাওয়া শুরু করতাম। পাজি মোরগটা প্রায়ই আমারে বিরক্ত করতো। এহন না হয় গায়ের চুল ঝরে চামড়া বাইর হয়ে গেছে, হাড়-পাঁজড়া দ্যাহা যায়। কিন্তু বয়সকালে আমি সেইরম সুন্দরী ছিলাম! বুক-পিঠ ধবধবে সাদা। গলা হালকা আকাশী আর ডানার চুলগুলো ধূসর। পক্ষীকূলের যে কেউ একবার আমার দিকে তাকালি সহজে চোখ ফিরাবার পারতো না। কর্তার বাড়ির মোরগ তো ছিলই তা ছাড়াও মরদ হাঁস, বাঁশ ঝাড়ের মরদ বক, মরদ কাক আমার দিকে হ্যাংলার মতো কাতায়ে থাকতো। ঐ বয়সে আমিও কম দুষ্টু ছিলাম না। বিশেষ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে, ঠোঁট নাড়ে, এক জয়গায় দাঁড়ায়ে ঘুরে তাগের নাচাতাম! কিন্তু কাছে আসার সুযোগ দিতাম না কারো। এই ঢং আমি শিকছিলাম কর্তার বাড়ির টিভিতে মুডেলিং দেহে। খোলা জানলা দিয়ে দ্যাকতাম টিভি। সে এক আজব রঙের বাক্স! কয়ে বুঝাবার না। তো উঠোনে ধান খাবার সময় ঐ নচ্ছার মোরগটাই কেবল তেড়ে আসতো। আমারে দেকলিই ওর তিন ঠ্যাঙের নাচন শুরু হতো। আমিও উড়ে গিয়ে টিনের চাল কিংবা উঠোনের আরেক পাশে বসতাম। ওতো আর উড়বার পারে না, কেবল রাঙা চোখে আমার দিকে তাকায়। ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার!
কিন্তু মনের সুকে কি বেশিক্ষণ ধান খাবার জো ছিল! লাঠি হাতে তেড়ে আসতো আধকানা বুড়ি। বুড়ি এমনিতে নাকি চোকে দ্যাহে না। বাড়ির ওপর কেউ আসলি সাতবার জিজ্ঞেস করে, কিডা রে? কাছে আয়, চোক্ষে তো ভাল দ্যাকপার পারিনে।
কিন্তু আমরা ধান খালি ঠিকই দেখতো। খরখরে গলায় চিল্লাইয়ে তাড়া করতো-ধুরো কৈতোর..ধুরো কুহ্ইরো...। ধুরো ধুরো! ধুরো লক্ষ্মীছাড়ার দল!
উড়ে আসে টিনের চালে বসতাম। কিন্তু বুড়ির মুখে কৈতোর শব্দডা শুনে আমার গা জ্বলে যাতো। মুরগীগের হাজারবার কুহ্ইরো কুহ্ইরো বলে ডাকলিও ওগের গায়ে লাগতো না। মুরগী জাতটাই কেমন বেজাত টাইপের। না পাখি, না পশু! আত্মসম্মান বোধ বলে কিছু নাই!
বুড়ির মুখে কৈতোর শব্দডা শুনলিই আমার মনে হতো উড়ে যায়ে মাতায় কয়ডা ঠোক্কর মারে দেই, নয়তো নখ দিয়ে মুখ আঁচড়ে দেই। মুখ্যু বুড়ি! ক্যান বাপু, কৈতোর কতি হবি কি জন্যে! পায়রা কয়ে ডাক, নয়তো কবুতর কয়ে ডাক। তা না কৈতোর, কৈতোর! মানুষ জাতটাই অমন, কোন প্রাণীরে সম্মান দিবার জানে না। এমনকি নিজেগেরও না। কেউ যদি কোন একটা ভুল করতো বা খারাপ কাম করতো, তারে বকা ঝকা করার সময় মানুষেরা কইতো-তুই একটা মুনিষ্যি না, মুনিষ্যি হলি কি এমন কাম করিস! আবার কোন কোন এলাকায় মানুষ মানুষরে মনু কয়ে ডাকে। এই কি কোন ডাকার শ্রী! হায় বকমেশ্বর! কি এক আজব প্রাণীরে জন্ম দিছ, দুনিয়াডা জ্বালায়ে দিল।
তারপর একদিন আমি ডিম পাড়লাম। আমার আর আমার সঙ্গীর সে কি আনন্দ! কর্তার বাড়ির লোকজনও খুব খুশি হলো। আমি বাচ্চার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দিনের পর দিন ডিমে তা দিবার নাগলাম। এক সময় ডিম ফুটে এক জোড়া ফুটফুটে বাচ্চা হলো। আমি তো আনন্দে কান্দেই ফ্যাললাম! মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে বাচ্চার নাগি খাবার নিয়ে আসি। বাচ্চারা আমার ঠোঁটের তে কাড়কাড়ি করে খাবার খায়। সে কি অনুভূতি রে বুন, তা কয়ে বুঝাবার পারবো না!
সেই শুরু, তারপর আরো ডিম পাড়লাম, আরো বাচ্চা ফুটলো। ক্রমেই বংশ বাড়বার নাগলো। কিন্তু বংশ তো বাড়বার নাগলো, সেই সাথে শুরু হলো আরেক কষ্টের কাল। কর্তার ছিল তিন মিয়া। জামাইগের অবস্থাও খুব একটা ভাল না। তার ওপর মেয়েগুলো বছর বিয়েনো। একটা বাইর হয়, আরেকটা প্যাটে আসে। আর কয় দিন পর পরই বগলে একটা, হাতে একটা, আঁচল ধরে আরেকটা, বাক্স-পেটরা মাতায় আরেকটা, হাড়-হাভাতের দল নিয়ে জামাই-মিয়া আসে হাজির হয়। যে দিন আসে তার পরদিনই শুরু করে, দাদু কবুতর খাব, কবুতর খাব।
আর কর্তাও নাতি-নাতনিগের আবদার মিটেতো আমার জোড়া জোড়া বাচ্চা জবাই করে। বুনরে, কলজেডা আমার ফাটে যাতো। চোখের সামনে নিজের সন্তানের রক্ত দ্যাহা যে কি কষ্টের!
যেদিন ওরা আমার বাচ্চা জবাই করতো, সেদিন আমি আর ঘরে থাকপার পারতাম না। একলা একলা আকাশে উড়ে বেড়াতাম। কোন জায়গায় বসতামও না। খালি উড়তাম। কতক্ষণ যে উড়তাম তা আমি নিজেও বুঝতাম না।’
বকুমার গলা ধরে আসে। একখন্ড মেঘ ওদের ছুঁয়ে চলে যায়। ডানায় চোখ মুছে বকুমা আবার শুরু করে-‘মানুষেরা বড় হিংস্র প্রাণীরে বুন, ওরা খালি অন্য প্রাণী মারে না। নিজেরাও নিজেগের মারে। একবার কর্তার পাশের বাড়ির এক ছাওয়াল বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনলো। দেখি কি, কয়দিন পর পরই নিরীহ বউডারে খালি মারে। এরপর একদিন স্বামী আর শাশুড়ি মিলে বউডার গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরায়ে পোড়ায়ে মারলো। আর সবার কাছে কইলো, বউ নিজে নিজেই গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করছে। বউডার অপরাধ ছিল তার গরিব বাবা যৌতুকের টাকা শোধ করে নাই। যৌতুকপ্রথা, মানুষ জাতির সৃষ্টি এ এক আজব প্রথা! মিয়ার বাপ-মা কষ্ট করে মিয়া বড় করে বিয়ে দেয়। সাথে সোনা-দানা, কাগুজে টাকা দিতি হয়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমাগের সমাজে এসব আমরা ভাববারও পারিনে! চলতে ফিরতে মানুষের সোনা-হীরের গহনা লাগে। আরে বাপু, মন সুন্দর থাকলি অলঙ্কারের দরকার হয়! সুন্দর মনই তো যে কোন প্রাণীর অলঙ্কার। গর্বের বিষয়। মানুষেরাই কেবল আলাদা। ওগের মনঅলঙ্কার যে বড়ই কুৎসিত, বিভৎস!
খালি কি তাই, মানুষেরা ভাইয়ে ভাইয়ে নাড়াই করে, এক ভাই আর এক ভাইরে জবাইও করে! কর্তার ছোট ভাই আর মেজো ভাইয়ের মইদ্যে জমিজমা নিয়ে নাড়াই নাগলো। ছোট ভাই মেজো ভাইরে দা দিয়ে গলায় কোপ দিল। মেজো ভাই মরে গেল। ও বকমেশ্বর, সে কি বিভৎস দৃশ্য!
এদিক আমার বাচ্চা ফুটে বাইর হতি যতক্ষণ, ধরে নিয়ে জবাই করে খায়। আমার বড় মিয়ার বাচ্চা হয়, তাও জবাই করে খায়। মানুষির ওপর আমি এহেবারে তিতি বিরক্ত হয়ে গেলাম।
তাজ্জব ব্যাপার কি জানিস বুন, মানুষ কয়-পায়রা হলো শান্তির প্রতীক। কোন অনুষ্ঠান হলি পায়রা উড়োয়। আরে বাপু, এতোই যদি শান্তির দূত ভাবিস তয় পায়রা জবাই করে খাস ক্যান!মানুষির চরিত্র দ্বিচারিতায় ভরা রে বুন।
এরপর একদিন আউশের ধান কাটা ক্ষ্যাতে আমরা খুুঁটে খুঁটে ধান খাতেছি। শ্যাষ বিকেলের সেই আলোয় আমাগের সবার মনে দারুণ ফুর্তি! ক্ষ্যাতে অনেক ধান। সেই আনন্দের বিকেলেই আমার সর্বনাশ হলো। মানুষির পাতা ফাঁদে আটকা পড়লো তোর বড় বকুম। মানে আমার সঙ্গী। ছাড়া পাবার নাগি সে কতো ছুটো ছুটি করলো, কিন্তু কিছুতেই ছুটপার পারলো না। আমরা ঠোঁট দিয়ে সুতো কাটপার হাজার চেষ্টা করেই পারলাম না। তারপর সন্ধ্যের সময় সেই ফাঁদঅলা হারামজাদা মানুষটা আসলো। ফাঁদে আটকা পড়া আমার সঙ্গীরে দেহে কি খুশি! ফাঁদের কাছে আসে তোর বকুমরে ধরে গালায় ছুঁড়ি চালায়ে মাতাডা একটুখানি ঝুলোয়ে রাখলো। উহ্ বকমেশ্বর! সে কি মর্মান্তিক দৃশ্য! আমি আর সহ্য করবার পারলাম না। বাড়ি ফিরে আসেই ঘরে ঢুকলাম। আমার ছাওয়াল-মিয়ারা ডাকলো কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না। চোখ বুজে পড়ে থাকলাম। মনে একটাই পিতিজ্ঞে-মানুষির সংসারে আর থাকপো না। এমন জাগা যাব যাতে মানুষির মুখ আর দেকতি না হয়। পরদিন কাকভোরে কর্তা ঘরের দরজা খোলা মাত্তরই কাউরে কিছু না জানায়ে আমি উড়াল দিলাম। উড়তি উড়তি কত পথ যে পাড়ি দিলাম, তার ঠিক নাই। লোকালয় আর শ্যাষই অয় না। গাছের ডালে বসে একটুখানি জিড়োই, তারপর আবার উড়ি। এক সময় এই পাহাড়ে আসে পৌঁছালাম। জনশূন্য ঘন জঙ্গলে ভরা এই পাহাড় দেহে আমি যেন আমি বাঁচার স্বাদ ফিরে পালাম। আমার কেবলই মনে হবার নাগলো, মানুষিরা যারে স্বর্গ কয় এই কি তাই!
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে একটা ঝর্ণার ধারে যায়ে জল খাতেছি, দেখি এক মরদ বুনো পায়রা আমার দিকে কেমন কেমন করে যেন চায়। আমার আর ভয় কি, সবই তো হারায়ছি! আস্তে আস্তে মরদটা আমার কাছে আসলো। আমার সাথে কথা কওয়া শুরু করলো। আমি তার বুনো ভাষা সব বুঝিনে, কিছু কিছু বুঝি। আমার ভাষাও সে কিছু কিছু বোঝে। সে তার পরিচয় আমারে জানালো। আমিও আমার বেত্তান্ত তারে খুলে কলাম। দ্যাকলাম মরদের মনে আমার নাগি দরদ হলো। আমারে জানালো, সে নাকি কোনদিন আমার মতো সুন্দরী পায়রা দ্যাহে নাই। তার কতা শুনে আমি নজ্জাই পালাম! সে আমার চোকের দিকে তাকায়ে কইলো, তোমারও কেউ নাই। আমার সঙ্গীও মারা গেছে অসুখে। আমরা কি এই ঝর্ণার ধারে চালতা গাছে ঐ উঁচু ডালে নতুন করে বাসা বাধবার পারিনে!
মরদটা বুনো। দেকতেও আলাদা। কিন্তু আমি বুঝলাম তার মনডা অনেক বড়। জাত-পাত, গায়ের রঙে কি আসে যায়! আমি মরদটার চোহের দিকে তাকায়ে কান্দে ফ্যাললাম আবেগে। সে বুঝলো, কাছে আসে তার ঠোঁট দিয়ে আমার চোহের জল মুছায়ে দিল। আর ঠোঁটে গলায় ছড়ায়ে দিল তার বুনো চুম্বন। আমি বুনো মরদের মনদরদে বাঁধা পড়লাম। সেই বৈকেলের মিষ্টি আলোয় আমরা দুজন মেঘের গায়ে গায়ে মনের আনন্দে উড়লাম। ঐ মরদই তোর বকুম!’
কুবু তাকিয়ে আছে বকুমার ঘোলা দুটো চোখের দিকে। ও চোখে এখনও যেন উড়ছে একটি ঘর ছাড়া পোষা পায়রা, আরেকটি বুনো পায়রা!


ঢাকা।
ডিসেম্বর, ২০১৩।



১ Likes ৭ Comments ০ Share ৫৩৭ Views

Comments (7)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    স্বাধীনতা মানে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়া আমার বাংলাদেশে
     স্বাধীনতা মানে মৃত্যন্জয়ী হওয়া বিজয়ের হাসি হেসে।

     

    দারুন হয়েছে সকাল। শুভ কামনা।

    - নীল সাধু

    শুভেচ্ছা সকাল। স্বাধীনতার মানে খুজে চলেছি আমরা ৪৩ বছর ধরে।

    - সুমন আহমেদ

    স্বাধীনতার মানে খুঁজতে এসে এ সময়ে দ্বিধান্বিত আমরা!

    ‘উদ্বাত্ব’ সম্ভবত ‘উদাত্ত’ হবে

    শুভকামনা।

    Load more comments...