Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

হাসান ইকবাল

১০ বছর আগে

প্রবাদ-প্রবচন: সমাজ মানসের একটি সমাজতাত্ত্বিক খসড়া (পর্ব-০১/০৩)

যে জাতির পুরাতত্ত্ব নেই, সে জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ নয়। যে ভাষায় প্রবাদ-প্রবচন নেই, সে ভাষারও পরিপূর্ণতা নেই। আর প্রবাদ-প্রবচন মূলত

আমাদের জাতীয় অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি। প্রবাদ যত ক্ষুদ্রই হোকনা কেন, তা পূর্ণ ভাবদ্যোতক ও অর্থবহ হয়ে থাকে। প্রবাদ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রসূত এবং মূলত বুদ্ধিপ্রধান রচনা। আবেগ নয়, মস্তিষ্ক থেকে প্রবাদের জন্ম হয়। দানা বাঁধা স্ফটিকের সঙ্গে প্রবাদের উপমা দেয়া যায়। স্ফটিক একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ফল; প্রবাদ সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ফল।

প্রবাদের নানা সংজ্ঞা নিরূপিত হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র ও অর্থবহ সংজ্ঞা হলো- A proverb is a short sentence based on long experienc. প্রবাদ হলো দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। স্প্যানিশ লোকবিদ Cervantes Saavedra এ সংজ্ঞা দেন। ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, সমাজ, জগৎ, সংসার, পরিবেশ, কাল ও কৃষ্টি সম্পর্কে মানুষ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা সংহত আকারে একটি বাক্যে বিশেষ রীতিতে প্রকাশ করলে প্রবাদ হয়। ফরাসি পন্ডিত বলেন-Provers are crystalized forms of human experience. অর্থাৎ-প্রবাদ হলো মানুষের অভিজ্ঞতা স্ফটিককৃত বাক-রূপায়ন।

এ্যারিস্টটল জাতির জ্ঞান বা বুদ্ধিমত্তার উপর জোড় দেন। তার মতে প্রবাদ হলো- Fragments of an elder wisdom. অর্থাৎ-সমাজের প্রবীণ মানুষের বুদ্ধির সার-সংক্ষেপ হলো প্রবাদ।

দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনও প্রবাদের মধ্যে একটি জাতির মেধা, বুদ্ধি ও চৈতন্যের প্রতিফলন দেখেছেন। তিনি বলেন-The genius wit and spirit of a nation are discovered in its proverbs.

টেলর সংজ্ঞাটি এভাবে নির্ণয় করেছেন- A proverb is a terse didaction statement that is current in tradition or, as an epigram says, the wisdom of many of many and the wit of one. অর্থাৎ-প্রবাদ হলো ঐতিহ্য মিশ্রিত নীতিশিক্ষামূলক নিটোল উক্তি; তিনি এও বলেন, প্রবাদে একের জ্ঞান ও বহুর বুদ্ধি নিহিত আছে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় উক্তিটি লর্ড জন রাসেলের।

ডব্লিও সি হ্যাজলিট প্রবাদকে লোকমনে ব্যাপ্ত সত্যের প্রকাশ বলেছেন-অলংকার ও দ্বন্দ্বের ভাষায় তা ব্যক্ত করা হয়। তার ভাষায়- An expression or combination of words conveying a truth to the mind by a figure, periphrasis, antithesis or hyperbole.

ডিজ রেইলীর ভাষায়- Proverbs were anterier to books and formed the wisdom of the vulgar and in the earliset ages were the unwritten lows of morality.

মার্কিন লোকবিজ্ঞানী এ্যালান ডান্ডিস বলেন- The proverbs appears to be traditional propositional statement consisting at least descriptive element, a descriptive element consisting of a topic and a comment.

এতোক্ষন বলছিলাম প্রবাদ-প্রবচনের তাত্ত্বিক সংজ্ঞার কথা। মূলত: প্রবাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- প্রচলিত কথা, প্রবচন, জনশ্রুতি, ডাকের কথা ইত্যাদি।

ডব্লিও সি হ্যাজলিট তার “A dictionar of American proverbs and proverbial phrases (1957)” গ্রন্থে প্রবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- …a short pithy sayings …popularly known and repeated, usually expressing simply and concreatly, though often methaphorrically, a truth based on common sense or the practical experience of mankind.

প্রবাদ একটি সাধারন উক্তি যা সকলে জানে এবং প্রায় উচ্চারিত হয়; যার প্রকাশ ভঙ্গি সরল, নিটোল ও রূপকধর্মী, মানুষের সাধারন চেতনা অথবা বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটি সত্যভাষণ।

মোট কথার আমরা বলতে পারি, প্রবাদ গুলোতে সাধারনত: সরলতা, সংক্ষিপ্ততা, বাস্তবতা, রসিকতা, ব্যঞ্জময়তা প্রভৃতি গুণ থাকে। দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা অন্তরের অনুভূতি হতে সমূৎপন্ন সহজ, সরস, সংক্ষিপ্ত ব্যঞ্জনময় প্রচলিত বাক্য বা বাক্যসমষ্টিই আসলে প্রবাদ।

প্রাচীন গ্রন্থাদিতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, চার/পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বেও মানব সমাজে প্রবাদের ব্যবহার ছিল। মানবজাতি গুহাবাস থেকে গৃহবাস অর্থাৎ পশু জীবনের গাঢ় অন্ধকার হতে সভ্য জীবনের ক্ষীণ আলোতে প্রথম পদক্ষেপ শুরু করেছিল তখন থেকেই তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতালব্দ সরস বাক্য বলার প্রবৃত্তি জেগেছিল। আর এরই ধারাবাহিকতায় প্রবাদ-প্রবচন ছড়িয়ে পড়ে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশে, অঞ্চলে থেকে অঞ্চলে। সেই প্রাচীনকাল থেকে লোকজ্ঞানের বহি:প্রকাশ ঘটে আসছে প্রবাদে। যে প্রবাদের স্রষ্টার সন্ধান আমরা জানিনা। বাংলা ভাষায় বহুল পরিমাণে প্রবাদ-প্রবচনের প্রচলন রয়েছে। প্রবাদ শব্দটিকে এক কথায় প্রকাশ  করার মতো কোন শব্দ অভিধানে নেই। বহুমূখী এর ভাবান্তর, ব্যবহারও বহুমূখী।

প্রবাদ-প্রবচনে আমরা অনেক সামাজিক প্রপঞ্চ খুঁজে পাই। একটু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে তাকালে আমরা সেটা স্পষ্টই দেখতে পাই। এলাকা, সম্প্রদায়, গোষ্টী, লোকরীতি, প্রথা, কালচার, লোকাচার, পরিবার, বিবাহ, সমাজ কাঠামো, সামাজিক স্তরবিন্যাস, নরগোষ্টী, জাতি ও বর্ণ, জ্ঞাতি সম্পর্ক, ধর্ম, সামাজিক অসমতা, সমাজ পরিবর্তনসহ কোন বিষয়ই বাদ যায়নি প্রবাদ-প্রবচন থেকে। সমাজতত্ত্বের প্রাথমিক পাঠের বাইরে নয় সে বিষয়গুলো। সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস-র কথা মনে পড়ে-সমাজতত্ত্ব সামাজিক ঘটনা বা প্রপঞ্চের বিজ্ঞান। ইমেল ডুরখেইম বলেছিলেন-সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান। আর অগাস্ট কোঁতে সমাজের যে গতিশীলতার কথা বলেছিলেন-আমরা কেউই সোস্যাল ডিনামিক্সের বাইরে নই।

প্রবাদ-প্রবচনে আমরা সমাজের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত খুঁজে পাই।

সমাজবিজ্ঞানী সিমেল-র মতে সমাজ বিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের সম্পর্ক অধ্যয়ন করে। এটা খুবই সত্যি কথা যে, লোকসাহিত্যের নানান উপাদান থেকে সমাজতত্ত্বে অধ্যয়ন করার মতো বহু উপাদান লুকায়িত।

সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাক্‌স বেবার সামাজিক কার্যাবলী অধ্যয়নের কথা এবং সামাজিক কার্যাবলীর মাধ্যমে একটি কার্যকারন সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যাখ্যা দানের কথা বলেছিলেন, যা সমাজতত্ত্বে আলোচিত হবে। সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ বলেছিলেন- সমাজতত্ত্ব সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে পাঠ করে।

সমাজতত্ত্বের ব্যাখ্যায় ও সমাজ বৈজ্ঞানিক গবেষনা অনুসন্ধানে লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানগুলো টুল হিসবে ব্যবহৃত হতে পারে।

সমাজ বিজ্ঞানের নানান পরিধিতে যেমন রয়েছে ধর্মের সমাজতত্ত্ব, চিকিৎসা সমাজতত্ত্ব, সমাজচিন্তা, সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ, পরিবারের  সমাজতত্ত্ব, সামাজিক জনবিজ্ঞান, গ্রামীণ ও নগর সমাজতত্ত্ব তেমনি রয়েছে শিল্পকলা সমাজতত্ত্ব (Sociology of Art), রয়েছে লোক সমাজতত্ত্ব (Folk Sociology )।  লোক সমাজতত্ত্বে বিশদভাবে সমাজের ইতিহাস, লোক উপাদান, ঐতিহ্য নিয়ে বিভিন্ন অনুষঙ্গ আলোচিত হয়। Brain Watson Kovacs তার  “Sociological-structural constraints upon wisdom: The spatial and temporal matrix of proverbs” শীর্ষক গবেষনা নিবন্ধে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।

প্রবাদ-প্রবচনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন, সে কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গির্জাগুলোতে বাইবেল থেকে বিভিন্ন নীতিকথা আলোচিত হতো। দর্শন শাস্ত্রের তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে খন্ডিত জ্ঞান আরো শানিত হতো।

লোকমুখে প্রচলিত অভিজ্ঞতালব্দ উক্তি গুলো সমাজের বিভিন্ন নীতিনির্ধারনী কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর ধর্মীয় আচার, বিশ্বাস ও প্রথা-প্রতিষ্ঠান, সামাজিক বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা প্রবাদ-প্রবচনে পাওয়া যায়।

ক্যাথেরিন জে ডেল এর “The book of proverbs in social and theological context.” গ্রন্থে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়।

প্রবাদ-প্রবচনে সমাজের অবশ্য পালনীয় রীতি-নীতি ও লোকাচারের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

(চলবে…)

০ Likes ৬ Comments ০ Share ১৫৪৬ Views

Comments (6)

  • - মাসুম বাদল

    দারুণ চলছে...

     

    বাকিটুকুর অপেক্ষায় রইলাম

    • - ওয়াহিদ মামুন

      সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ বাদল ভাই। আমার  শ্রদ্ধা জানবেন। ভাল থাকবেন।

       

    - সুখেন্দু বিশ্বাস

    দেখি সামনে সুমাইয়ার বাবা কি জবাব দেয় আর সুমাইয়ার মনোভাবই বা কি?

     

    শুভকামনা সতত। 

    • - ওয়াহিদ মামুন

      আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার জন্যও অনেক শুভকামনা রইলো।

    - আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

    লেখা ভালো হয়েছে। ২য় পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ, ভাই ওয়াহিদ উদ্দিন।

    • - ওয়াহিদ মামুন

      গল্পটি পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য আমার কৃতজ্ঞতা ও সালাম জানবেন।

       

    Load more comments...