Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Shahidul Islam Pramanik

১০ বছর আগে

প্রথম নানার বাড়ি ভ্রমণ


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

উনিশ শ’ আটষট্টি সাল। তখন এদেশটার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বড় মামা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। প্রায় একমাস থাকার পর মামা মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব তাড়া দিতেছিলেন। কিন্তু অগ্রাহায়ন মাস, ধান কাটা এবং মাড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাবা মাকে ছেড়ে দিতে রাজী নন। মামাও নাছোর বান্দা তার বড় বোনকে (আমার মাকে) সাথে না নিয়ে যাবেন না। যে কারণে মামা ধান কাটা-মাড়াই শেষ হওয়া পর্যন্ত একমাস থেকে মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হলেন। তখন দুরের পথে যাতায়াতের একমাত্র বাহন হলো রেল গাড়ি আর কাছের বাহন হলো গরুর গাড়ি। রেল স্টেশন আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় চার মাইল। এতোপথ মা’র পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই পাশের গ্রামে গিয়ে বাবা গরুর গাড়ি ভাড়া করে এলেন।

গরুর গাড়িওয়ালা সন্ধার সময় গড়ি নিয়ে এসে হাজির। রাতে গাড়িওয়ালা আমাদের বড়িতে ভাত খেয়ে শুয়ে থাকল। নানার বাড়ি যাওয়ার আনন্দে আমার আর রাতে ঘুম হলো না। মাও ঘুমালেন না। অধিক রাত পর্যন্ত নান-নানির জন্য পিঠা-চিড়া তৈরী করে সময় কাটালেন। মধ্য রাতে জামা কাপরের ব্যাগ আর পিঠা-চিড়ার পোটলা-পুটলিসহ গরুর গাড়িতে চড়ে রেল স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। আমি এবং মা গরুর গাড়িতে। বাবা, মামা এবং আমাদের বড়ির দুই চাকর গফুর ভাই ও এন্তাজ ভাই গরুর গাড়ির পিছনে পিছনে হেঁটে আসছেন। আমরা যখন স্টেশনে গিয়ে পৌঁছি তখনও অনেক রাত। স্টেশনে পৌছার আরও একঘন্টা পর ঢংঢং করে লোহার ডান্ডা পিটিয়ে গাড়ি আসার খবর জানানো হলো। বাবা টিকিট কেটে মামার হাতে দিলেন। রাত ঠিক চারটার সময় রেল লাইন বরাবর দক্ষিণ দিকে দুরে ছোট একটি আলো চোখে পরল। আলোটি ক্রমেই বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে একসময় পুরো স্টেশন আলোকিত করে ঝকাঝক্ ঝকাঝক্ বিকট শব্দ করতে করতে এক চোখা দৈত্যের মত কয়লার ইঞ্জিনওয়ালা রেল গাড়ি এসে স্টেশনে থেমে গেল। বাবা তাড়াতাড়ি আমাদের একটা কামড়ায় তুলে জানালার পাশের সিটে বসিয়ে দিলেন। গড়িতে তেমন একটা ভির নেই। অনেক সিট ফাঁকা পরে আছে। ছোট একটি কামড়ায় পাঁচটি ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলছে। গাড়ির মেঝেতে সুই পরলেও স্পষ্ট দেখা যায়। একটু পরেই গাড়ি হুঁ --- উঁ --- হুইসেল দিলে বাবা তাড়াতাড়ি কমড়া থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি একটা ধাক্কা দিয়েই আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে চলতে লাগল।

হেমন্ত কাল, শীত শীত ভাব থাকায় গাড়ির সব জানালা আটকানো। গড়ি চলছে, তবে বাইরে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ পর পর হুইসেল দিয়ে স্টেশনে গাড়ি থামছে। থামার সময় হালকা একটা ঝাকি দিচ্ছে, একটু পরেই হুইসেল দিয়ে আবার একটা ধাক্কা দিয়ে আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে চলছে। প্রত্যেক স্টেশনেই গাড়ি থামছে, আর থামলেই মাঝে মাঝে গরম ডিমওয়ালা, চানাচুর ওয়ালা, পান-বিড়ি-সিগারেটওয়ালা কামরায় উঠে তার পশার অনুযায়ী চেচামেচি করে কেউ কিছু বিক্রি করছে আবার কেউ কেউ বিক্রি না করেই নেমে যাচ্ছে। হকারদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে অনেকেই কিছু কিনছে আবার কেউ কিছুই কিনছে না। প্রথমেই মামা আমাকে গরম ডিম কিনে ছাল ছাড়িয়ে দিলেন। আমি মজা করে খেলাম। পরের স্টেশনে চানাচুরওয়ালা কামরায় উঠে এলে, মামা চানাচুর চাইতেই এক খামছা চানাচুর কৌটার মধ্যে তুলে পিয়াজ, মরিচ, তেল, মশলা দিয়ে কৌটাটা ডান হাতে ধরে বাম হাতের তালুতে ঠকাঠক্ ঠকাঠক্ ঘন তালে কয়েক বার আছাড় দিয়ে ঝালিয়ে দিল। দাম খুব বেশি নয়, এক আনা। খেয়ে দেখি খুব মজা। খুশি হয়ে খেলাম। ইতিমধ্যেই বাইরে ফর্সা হয়েছে। মামা জানালা খুলে দিলে বাইরে তাকিয়ে দেখি পূর্বদিকে সূর্য লাল হয়ে উঠছে। কিন্তু গাছ গাছালি ঘর বাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। সব পিছন দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। আমি মামাকে বললাম, মামা, গাছগুলো পিছনে দৌড়ায় কেন?
মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, না মামা, গাছ দৌড়ায় না, আমাদের গাড়ি দৌড়ায়। কিন্তু মামার কথা বিশ্বাস হলো না। কারণ যতবারই আমি বাইরে তাকাই ততবারই দেখি বাইরের সবকিছু পিছনে দৌড়ায়।
এক পর্যায়ে বেলা উপরে উঠে গেলে রোদে বাইরের সব কিছু ঝলমল করে উঠল। এখন বাইরের সব কিছু পরিস্কার দেখা যায়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে দেখতেই বড় একটি স্টেশনে এসে গাড়ি থেমে গেল। আমি মামাকে প্রায় প্রত্যেক স্টেশনের নাম জিজ্ঞেস করতাম। মামা কোনটার নাম বলতেন আবার কোনটার নাম বলতে পারতেন না। এই স্টেশনের নাম জিজ্ঞেস করতেই মামা বললেন, এটা কাউনিয়া জংশন। আমি মামাকে বললাম, মামা জংশন কি?

মামা বললেন, তিন দিক থেকে রেল লাইন এসে যে স্টেশনে লাগে সেটাকে জংশন বলে। আমি মামাকে আর কোন প্রশ্ন না করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। এই স্টেশনে অনেক রেল লাইন। এতো রেল লাইন অন্য কোন স্টেশনে দেখি নাই। প্লাট ফরম দু’টি। আমাদের গাড়িটি পূর্ব পার্শ্বের প্লাট ফর্মে এসে থেমেছে। স্টেশন মাস্টারের অফিসসহ হোটেল-রেস্টুরেন্ট সব এই প্লাট ফরমে। তাকিয়ে দেখি একটি হোটেলের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে মুসলিম হোটেল, তার পাশেই অন্যটিতে লেখা আছে হিন্দু হোটেল। বুঝতে বাকি রইল না যে, হিন্দু মুসলমানের জন্য আলাদা আলাদা হোটেল। একটু পরেই দুইজন কালো কোট গায়ে টিকিট চেকার কামরায় উঠে এলো। তারা উর্দুতে কথা বলতেছিল। তারই একজন মামাকে জিজ্ঞেস করলো, টিকিট বি আছে? মামা পকেট থেকে তিনটি টিকিট বের করে দেখালেন। দু’টি বড়দের টিকিট একটি আমার জন্য হাফ টিকিট। টিকিট চেকার প্রত্যেকটি টিকিটের গায়ে পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে দিলেন। বিনা টিকিটে কোন যাত্রী ছিল না। সবার টিকেট চেক করার পর দুইজনই নেমে গেলেন।

এই প্লাট ফরমে মানুষের সমাগমও অনেক বেশি হকারদের সমাগমও বেশি। বাইরে থেকে হকারদের কণ্ঠের বিচিত্র সুর কানে আসছে। খুব ভালো লাগছিল। এই চা গরম, এই চানাচুর, এই ঝালমুড়ি, এই পান-বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি বিচিত্র সুর শুনতে শুনতেই হঠাৎ আমাদের কামরার কাছে এসে এক জন বাঁশের তৈরী ঝাকা রশি দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে চেচিয়ে উঠল, লাগবে আরবের খুরমা খেজুর। একথা শোনার সাথে সাথেই মামাকে লক্ষ্য করে আগ্রহ নিয়ে বললাম, মামা আরবের খুরমা খেজুর। আমার বলার ভাব ভঙ্গি আর আগ্রহ দেখে মামা সাথে সাথেই খেজুরওয়ালাকে জানালা দিয়ে ডাক দিলেন, এই খেজুরওয়ালা এই দিকে আয়। খেজুরওয়ালা কাছে এলে মামা বললেন, খেজুরের দাম কত রে??
খেজুরওয়ালা বলল, দুই আনা ছটাক।
মামা সাথে সাথেই বললেন, দে এক পোয়া।
খেজুরওয়ালা ছোট একটি দাড়ি পাল্লা দিয়ে একপোয়া খেজুর মেপে দিলে আমি খেজুর হাতে নিয়ে খুব মজা করে খেতে লাগলাম। মাকে বললাম, মা খাও, খুব মজা। মা মাথা নেড়ে জানালেন খাবে না। মাথা উপর নিচে ঝাকিয়ে মামাকে বললাম, মামা খাবেন? মামা দু’তিনটি খেজুর হাতে নিয়ে আর নিলেন না।
খেজুর খেতে খেতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। হকারদের বিচিত্র সুরের ডাকাডাকি বন্ধ হলো। গড়ি আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে চলছে। কিছুদুর যাওয়ার পরই হঠাৎ কানে ঝমঝম শব্দ এলো। এরকম শব্দ আগে কখন শুনি নাই। বাইরে তাকাতেই দেখি লোহার বড় বড় পিলার একটার পর একটা পিছনে সরে যাচ্ছে। অনেক বড় ব্রিজ। নিচে বিশাল নদী। নিচে কিছু নৌকা পাল তুলে, আবার কিছু নৌকা দাড় টেনে এদিক ওদিক যাচ্ছে। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা এটা কোন নদী। মামা বললেন, এটা তিস্তা নদী। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে গেল। ট্রেন থেকে অনেক নিচে পানি। কোন কারণে ট্রেন থেকে নিচে পরে গেলে আর রক্ষা থাকবে না। খুব ভয় ভয় করতে লাগল, তাই নিচে না তাকিয়ে দুরে তাকিয়ে নদীর দৃশ্য দেখতে দেখতেই গাড়ি তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে এলো। এর পর তিস্তা স্টেশনে গাড়ি থেমে একটু পরেই ছেড়ে দিল। এরপর লালমনির হাট স্টেশনে এসে গাড়ি থামল। এটিও অনেক বড় স্টেশন। লালমনির হাটে অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল। মামা আমাকে সাথে নিয়ে নিচে নামল। গাড়ির উপর দিকে তাকিয়ে দেখি একটি লোক লম্বা একটি পাইপ নিয়ে গাড়ির উপর দিয়ে হাটছে। আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা লোকটি পাইপ দিয়ে কি করে?
মামা বলল, গাড়িতে পানি দেয়।
একটু পরেই দেখি উপরে অনেক গুলো লোহার পাইপ একটু পরপরই লাগানো আছে। লোহার পাইপগুলোর একটির মুখে রাবারের আঁকাবাঁকা নল লাগিয়ে গোল একটি চাবি ঘুরিয়ে দিল। আর সাথে সাথেই পানি চির চিরিয়ে পাইপের লিক হওয়া ছিদ্র দিয়ে চিকন ধারায় বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে চাবি বন্ধ করে দিলে পানি পরা বন্ধ হলো। লোকটি পাইপ খুলে নিয়ে গাড়ির ছাদের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে এক বগি থেকে আরেক বগিতে চলে গেল এবং সেখানেও লোহার নলের সাথে পাইপ লাগিয়ে সেই বগির টাঙ্কিতেও পানি দিল। এভাবে পুরো গাড়ির প্রত্যেকটি বগিতে পানি দিয়ে লোকটি পাইপসহ নিচে নেমে এলো। এর কিছুক্ষণ পরেই স্টেশনে ঝুলিয়ে রাখা লোহার ডান্ডায় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজালে মামা তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। গার্ড বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে ডাইনে বামে নাড়াতে থাকলে গাড়ি হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিল।
লালমনির হাট থেকে গাড়ি ছেড়ে তুষ ভান্ডার, কাকিনা, হাতি বান্ধা, বড়খাতা, পার হয়ে আমরা যখন আমাদের গন্তব্য বাবুরা স্টেশন এসে পৌছি তখন প্রায় দুপুর হয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে বাবুরা স্টেশনের পশ্চিম দিকে বাজারের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। মামার দুই হাতে ব্যাগ। মামা আগে আগে হাঁটছে আমরা মামার পিছনে পিছনে হাঁটছি। বাজারের একটি মিস্টির দোকানে নিয়ে মামা আমাকে কিছু মিস্টি খাওয়ালো। মামাও কিছু খেলেন কিন্তু অনঅভ্যাসের কারণে মা হোটেলে বসে কিছুই খেলেন না। কারণ বাড়িতেও মা অপরিচিত লোকের সামনে কখনও ঘোমটা খোলেন না সেই কারণে হোটেলে অপরিচিত মানুষ জন থাকায় লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকলেন। মামা মা’র অবস্থা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে আমাদের সাথে নিয়ে বের হয়ে এলেন।

বাজার থেকে অল্প কিছু পশ্চিমে গিয়েই একটা ছোট নদী চোখে পড়ল। এটার নাম বুড়ি তিস্তা। বুড়ি তিস্তা পার হতে কোন নৌকা লাগল না। অল্প পানি হেঁটেই পার হলাম। নদীর ওপারে ধুধু বালুচর। বালুচরের মাঝ দিয়ে মানুষ চলাচল করায় মেঠো পথ তৈরী হয়েছে। সেই পথ দিয়ে বালুচর হাঁটতে লাগলাম। কিছুদুর গিয়ে আমি হাপিয়ে গেলাম। মা আমাকে কোলে তুলে নিল কিন্তু কোলে নিয়ে বেশিদুর হাঁটতে পারলেন না। হাপিয়ে গেলেন। অবশেষে মা আমাকে নিয়ে ঘাসের উপর বসে পরলেন, আমাদের অবস্থা দেখে মামাও ব্যাগ নামিয়ে আমাদের সাথে বসে পরলেন। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার আমরা হাঁটা শুরু করি কিন্তু কিছুদুর যাওয়ার পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব হচ্ছে না দেখে, মামা তার হাতের ব্যাগ দু’টা এক ঘাড়ে নিয়ে অন্য ঘাড়ে আমাকে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। কিছুদুর যাওয়ার পর মামা হাঁটলেও মাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। মা ঘাসের উপর বসে পরে মামাকে বকাবকি করতে লাগলেন। মা মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এতো রাস্তা হাঁটতে হয় তুই আগে কইলি না ক্যা, তাইলে তো আমি আইসি না।

মামা মার কথায় ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে বললেন, আরে বুবু বেশি রাস্তা নাই তো, আর একটু সামনে গেলেই বাড়ি পাওয়া যাইবো।

আর একটু করতে করতে মামা আমাদের অনেক রাস্তা হাঁটিয়ে নিয়ে এলেন। মা বিরক্ত হয়ে মামাকে বললেন, আর একটু সামনে আর একটু সামনে করতে করতে তো বেলা আসর ওক্ত হইল, তারপরেও তর আর একটু রাস্তা শেষ হয় না। তোরা কোন জায়গায় বাড়ি করছা রে। হাঁটতে হাঁটতে তো আমার জান থাকে না।

মামা মা’র কথায় অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলেন, বুবু আর সামান্য পথ। এই টুকু হাঁটলেই তিস্তা নদী। ওই যে দেখা যায় নদী। পশ্চিম দিকে চায়া দেখ। ্ওই যে নদী। ওই নদী পার হইলেই আমাগো বাড়ি।
মামার এ কথা বলার পরও আরো প্রায় এক মাইলের মত পথ হাঁটতে হলো। এই এক মাইল হাঁটতে গিয়ে মা মামাকে বকাবকি করতে করতে তার হাঁটার ঝাল মিটিয়ে নিলেন। আমার মা তার ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায়, এতো বকাবকির পরও মামা মা’র কোন কথার উত্তর দিলেন না এবং বিরক্তও হলেন না।

এই অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে তিস্তা নদীর পারে যখন এসে পৌছলাম তখন পশ্চিম দিকে বেলা ঢলে পরেছে। খেয়া নৌকা ওপারে ছিল। আমাদের দেখে দু’জন যাত্রী নিয়ে তাড়াতাড়ি এপার চলে এলো। খেয়া নৌকায় যখন নদী পার হয়ে এলাম তখন সুর্য ডুবে ডুবে অবস্থা। আরো প্রায় দুই মাইলের মত রাস্তা হেঁটে নানার বাড়ি যখন পৌছলাম তখন সন্ধা পার হয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। মামা আমাদের বাইরে রেখেই আগে আগে বাড়ি ঢুকে হাঁক ছাড়লেন, সব বাইরে বারাও রে, দেখো কেডা আইছে। মামার ডাক শোনার সাথে সাথে নানী দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা নানীর গলা ধরে কেঁদে দিলেন। নানীও কান্না শুরু করে দিলেন। কান্না অবস্থায় নানী মাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। এরমধ্যে নানা বাইরে কোথায় ছিল। খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে মা’র কান্নার আগেই নানা কেঁদে দিলেন। কান্না করতে করতে মাকে বলতে লাগলেন, মা তুই আইছস। আমি প্রতি দিনই তর লাইগা পথের দিকে চায়া থাকি। বহুদিন পরে কাছে পাওয়ায় মেয়ের প্রতি বাবার হৃদয় নিংরানো ভালবাসার সে কি দৃশ্য, সে কথা বলে বুঝানো যাবে না!

এবার নানা মাকে ছেড়ে দিয়ে নানীকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার নাতিডা কই গো? নানি আমাকে ধরে নিয়ে নানার কাছে দিলে নানা আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে নানিকে ধমক দিয়ে বললেন, এই ব্যাক্কল, কলাগাছের মত খারায়া রইছো ক্যা? হাঁটতে হাঁটতে নাতির পাও দুইডা ফুইলা গ্যাছে। দুইডা বড় বড় চোখ থাকতেও কেউ দেহ নাই, তাড়াতাড়ি পানি গরম করো। গরম পানি দিয়া ওগো দুই মাও বেটার পাও ধুইয়া দাও। বলেই নানা আমাকে নিয়ে উঠানে পাতা জলচৌকিতে বসে পরল। একটু পরে নানী গরম পানি নিয়ে এসে নিজের হাতে আমার দুই ঠ্যাংগ পানি ঢেলে ঢেলে ধুয়ে দিলেন। নানা-নানীর এই আদর আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না।

নানার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে আড়াই মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে ছিল। যমুনা নদীর করাল গ্রাসে সব জমিজমা হারিয়ে নানা দিশেহারা হয়ে পরেন। নানার বড় ভাই অনেক আগেই নদী এলাকা ছেড়ে এই এলাকায় এসে বাড়ি করেছিলেন। নানার দুরাবস্থার কথা শুনে নিজে গিয়ে তিনি নানাকে সপরিবারে নিয়ে এসে এই এলাকায় বসবাসের ব্যাবস্থা করে দেন। অনেক দুরুত্বের কারণে নানা বাড়ির সাথে আমাদের যাতায়াত ছিল না। নানা নানী আমাকে জন্মের পরে দেখলেও যাতায়াত না থাকায় আর দেখতে পায় নাই। কাজেই আমিও যেমন জন্মের পরে নানার বাড়ি প্রথম এসেছি। মা’ও এই এলাকায় প্রথম এসেছে।

এই প্রথম আমার নানার বাড়ি বেড়াতে আসা। নানার বাড়ি নীলফামারী জেলার ডিমলা থানার খগাখড়িবাড়ি গ্রাম। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পায়ে হেঁটেই চলাচল করতে হয়। যানবাহনের মধ্যে মহিষ বা গরুর গাড়ি ছাড়া অন্য কোন যানবাহন তখন ঐ এলাকায় ছিল না। রাস্তাঘাটের অবস্থাও উন্নত নয়। জমিনের মাঝ দিয়ে প্রশস্ত মেঠো পথই ছিল একমাত্র রাস্তা। তখন এই এলাকায় গ্রামের কোন রাস্তাই মাটি কেটে উঁচু করা হয় নাই।

ক্ষেতের আইল, ঝোপঝাড় বা মেঠো পথের দুই পার্শ্বে হলুদ গছের মত আগাছা ষটি গাছে ভরপুর। এই ষটি গাছের মধ্যে চিনা জোকের বাস। চিনা জোক দেখে যাতে আমি ভয় না পাই তার জন্য নানা মামারা আমাকে সবসময় পাহারা দিয়ে রাখত। কখনও ষটি গাছের ঝোপের মাঝে যেতে দিত না। আমার ছোট দুইভাই মারা যাওয়ায় আমার বাবা মার কাছেও যেমন আদরের তেমনি নানা মামাদের কাছেও আদরের। বড় মামা আমাকে দুরে কোথাও নিয়ে গেলে বেশির ভাগ রাস্তা ঘারে করে নিয়ে যেতেন।

দু’দিন পরের ঘটনা। সকাল বেলা নানার সাথে গাঁয়ের পথে হাঁটতে গিয়ে এক দৃশ্য দেখে থ হয়ে গেলাম। পঞ্চাশ ষাট বছরের এক বুড়ি তামাক ক্ষেতের আইলে বসে বিশাল মোটা কালো রঙের বিড়ি টানছে। নানা তামাক ক্ষেতের আইল দিয়ে আমাকে বুড়ির কাছে নিয়ে গেলেন। মহিলার পরনে দু’টি লুঙ্গি। একটি লুঙ্গি পরেছে আরেকটি লুঙ্গি গায়ে জড়ানো।  আমরা কাছে যাওয়ার পরও বুড়ি ভক্ ভক্ করে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে। বিড়ির গন্ধ নাকে এলো। তখন আমাদের এলাকায় টেন্ডু পাতার বিড়ি আর হুক্কা তামাক খাওয়ার প্রচলন ছিল। কাজেই টেন্ডু পাতার বিড়ির গন্ধটা আমার কাছে পরিচিত ছিল কিন্তু বুড়ির মুখ থেকে যে বিড়ির গন্ধটা বের হচ্ছে সেটা টে›ডু পাতার বিড়ির মত নয়, আরো কড়া কেমন যেন উৎকট গন্ধ মনে হলো। আমাদের এলাকায় টেন্ডু পাতার বিড়ি খায় তবে সেটা পুরুষে, মহিলারা যে বিড়ি খায় এটা আগে কখনও দেখি নাই। এই প্রথম দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার তাকনো দেখে বুড়ি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, এ বাউ কি দ্যাখোছেন?
বুড়ির কথা বুঝতে না পেরে আমি নানার মুখের দিকে তাকালে নানা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বুড়ির সাথে কি কি যেন কথা বললেন, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
পরে নানাকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম এরা এই এলাকার স্থানীয় মহিলা। এই এলাকার স্থানীয় মহিলারা তখনও শাড়ি না পরে দু’টি করে লুঙ্গি পরিধান করে। বয়স্ক মহিলারা মাঠে মাঠে কাজ করে আর বিড়ি নাসা খায়।
এই এলাকায় এসে প্রচুর তামাক ক্ষেত দেখেছি। প্রত্যেকটা তামাক ক্ষেতের মাঝখানে কুয়া খনন করা আছে। মাত্র চার পাঁচ হাত মাটি খুঁড়লেই পানি পাওয়া যায়। কুয়া থেকে সহজেই পানি উঠানোর জন্য একটি বাঁশ পুতে আরেকটি বাঁশ আর বানিয়ে ঠিক মাঝখানটায় বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে দাড়ি পাল্লার মত ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আর বানানো বাঁশের এক মাথায় ভারি কিছু বেঁধে দিয়ে অন্য মাথায় রসি দিয়ে বালতি বেঁধে সহজেই পানি উঠিয়ে তামাক ক্ষেতে সেচের কাজ করা হয়।
আরেক দিন এক স্থানীয় বাড়িতে মামার সাথে বেড়াতে গিয়েছি। ঔ বাড়ির গিন্নি আমাকে দেখে মামাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলেন। মামা তার কথার উত্তর দিলে আমাকে লক্ষ্য করে মহিলা বললেন, এ বাউ বগাইলা খাবু ক্যানে?
আমি বগাই কথা বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম না না বগাই খাই না। আমার মাথা নাড়ানো দেখে মামা হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আরে মামা বগাই হলো বড়ই। সকাল বেলা বড়ইয়ের জন্য চেঁচামেচি করলা এখন বড়ই দিতে চাইলো আর তুমি না করলা।
এ কথা শুনে আমি মামার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। মহিলা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি অনেকগুলা বড়ই বেতের টালায় করে এনে আমাকে দিলেন। আমি কিছু বড়ই খেয়ে বাকি সব নিয়ে চলে এলাম।

১ Likes ২৮ Comments ০ Share ৮৬০ Views