আমি মানুষটা জাত ঘরকুনো- কলকাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও মন টেঁকে না, আবার অন্যদিকে পায়ের তলায় সর্ষে। আমার বাবা ই ঠিক বলেন- “তুই যে কি চাস, আর কি চাস না সেটা তুই নিজেই জানিস না”। তা এহেন সর্ষে ভূতটা আবার নিজের উপস্থিতি জানান দিল গত বছর ইউরোপ আসার পর। ইউরোপ আসার কারণ আমার স্বামীর কর্মসূত্রে, কিন্তু সেটা নামেই। আসার আগেই তালিকা ধরে ঠিক করে ফেলেছিলাম, এই এই জায়গাগুলো ঘুরে ফেলতেই হবে। সেই তালিকায় যেমন চিরকালের প্রেমের শহর হিসাবে প্যারিসের নাম ছিল, তেমনি ছিল রোম – সেই শহর যেখানে ইতিহাস ফুসমন্তর গল্প শোনায়। তালিকায় কাটছাঁট চলছে, এমন সময়ে আমার মনে হলো “আচ্ছা সেই সুন্দর ফুলের শহরটায় গেলে হয়না?”
ফুলের শহর বলতে আপনাদের মাথায় কি আসবে জানিনা তবে আজন্মকাল বলিউডি সিনেমা আর যশ চোপড়ার হাতে আঁকা রূপোলি পর্দার রূপকথা গুলো দেখে বড় হওয়া আমার মাথায় আসে “সিলসিলা” ছবির সেই গানটার কথা…ওই যে যেখানে অপ্সরা সম সাদা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা রেখা স্বর্গসম ফুলের সারি বেয়ে ছুটে আসছেন অমিতাভের দিকে, দুজনে গেয়ে উঠছেন “দেখা এক খোয়াব তো ইয়ে সিলসিলে হুয়ে”। স্বপ্ন, কল্পনা, গল্পগাছা কতকিছু অনুভূতির জন্ম দেয় সেই গানের দৃশ্য সমূহ।
ছোটবেলায় শুনেছিলাম যে গানটার শুটিং হয়েছিল নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড দেশে। সত্যি তো সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা টিউলিপ ফুল সব থেকে ভাল হয় ওই দেশেই। এওতো ভূগোলের বইতে পড়া। যাই হোক, লটবহর সমেত ইউরোপ পৌছে খোজ নিলাম জায়গাটা আসলে কোথায়। জানতে পারলাম যে আসল জায়গাটি যেটির সন্ধান যশ চোপড়ার জহুরির চোখ করেছিল সেই জায়গাটির নাম “কিউকেনহফ”। অনেকেই ভাবেন নেদারল্যান্ডসেরই “আমস্টারডাম” শহরে বোধহয় পাওয়া যাবে ওইরকম রাশি রাশি টিউলিপ ফুলের দেখা। ধারনাটা নিছক ভুল নয়। আসলে এখানকার “স্প্রিং” বা বাংলায় যাকে আমরা বলি “বসন্তকাল”- সেই সময় সারা নেদারল্যান্ডস জুড়েই রঙের উৎসব। আমাদের দোল খেলার মতোই প্রায় সব রঙ মিলে মিশে একাকার, তবে পার্থক্য এটাই যে সে রঙের প্রতিফলন সারি সারি ফুলে।
সবিস্তারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে কিউকেনহফে একটি বিশাল টিউলিপ ফুলের বাগান আছে, কিন্তু সেটি খোলা থাকে পরিমিত সময়ের জন্য। আসলে টিউলিপ ফুল শুধু মাত্র এই বসন্তকালেই হয়। আর তখনই দর্শকদের জন্য খোলা থাকে এই বাগানটি। আর বছরের বাকি সময় জুড়ে তোরজোড় চলে নানা রঙের রংমিলান্তি খেলে দর্শক মনে আনন্দদানের জন্য বিভিন্ন জাতির হরেক রকম টিউলিপ ফোটানোর প্রচেষ্টা। সাধারনত মার্চ মাসের মাঝামাঝি বাগানটি দর্শক দের জন্য খুলে দেওয়া হয় আর মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আপনি যে কোন দিন চলে জেতে পারেন এই অদ্ভূত সুন্দর ফুলের রাজত্বে। তবে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে সব থেকে সুন্দর হয়ে ওঠে ফুলের সমাহার। ইংরজীতে যাকে বলে “ফুল ব্লুম” টাইম।
আমার বর্তমান নিবাস জার্মানির বন শহর। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান হয়ে যাওয়ায় আলাদা করে ভিসা করার ঝক্কি ঝামেলা নেই। এ যেন আমাদের দেশের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাওয়া। তাই এবারের ইস্টারের ছুটিটা এপ্রিলের শেষের দিকে পড়তেই আর দ্বিধা করলাম না কোথায় যাব ঠিক করতে। বন থেকে সড়কপথে ৪ ঘন্টা মতো লাগে কিউকেনহফ পৌছতে। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে পৌছতে সময় নেয় মিনিট চল্লিশেক। সবথেকে কাছের বিমানবন্দর “শিফোল”। যে সময় বাগানটি খোলা থাকে, সেইসময় সারা দুনিয়া থেকে প্রচুর লোক আসেন কিউকেনহফে। তাই সেই সময় শিফোল বিমানবন্দর থেকে বিশেষ বাসের ব্যাবস্থা করা হয় কিউকেনহফের ফুলের বাগান অবধি।
যাই হোক, কিউকেনহফ তো পৌছে যাবেন ঠিক, কিন্তু যদি ভাবেন ফুলের বাগানের ভেতরেই দেখা পাবেন সেই রাশি রাশি মাঠের পর মাঠ জুড়ে থাকা টিউলিপের…ঠিক যেমনটি “সিলসিলায়” দেখেছিলেন, তাহলে ভুল করছেন। কিউকেনহফ গেলে আপনি দেখতে পাবেন বহু ভারতীয় বা আমাদের বহু প্রতিবেশী দেশের লোক যারা বলিউডি ছবি দেখেন, তারা সেখানে এসেছেন এবং সবাই কিন্তু খুঁজে বেড়াচ্ছেন যশ চোপড়ার সেই সিনেমার দৃশ্যপঞ্জী।
কিউকেনহফের ফুলের বাগানটি অতীব সুন্দর, কিন্তু আমার চোখ জুড়িয়ে গেছিল ওই নব্য রূপকথা সম সিনেমায় দেখানো সীমাহীন ফুলের সারি দেখে। আর সেই জায়গার সন্ধান পাবেন আপনি কিউকেনহফের বাগান পৌছোনোর পথে, বা বাগান পৌছে তাকে পেছনে ফেলে আরও এক কিলোমিটার মতো এগিয়ে গেলে। এই পথ আপনি হেঁটেও অতিক্রম করতে পারবেন যদি আবহাওয়া ভালো থাকে।
ইংরেজীতে একটা কথা আছে “রায়ট অফ কালারস”, এপ্রিলের মাঝামাঝি নেদারল্যান্ডসের নেহাতই ছোট্ট একটা শহর কিউকেনহফ গেলে বোধহয় কথাটার মানে ঠিক করে বোঝা যায়। পথের দুধারে শুধু লাল, নীল বা সবুজ নয় হরেক রকম রঙের মেলা। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় স্বর্গ রাজ্যের প্রবেশদ্বার কি এরকমি হয়? তবে হঠকারিতা করে যেকোনো এরকম ফুল ভর্তি মাঠের ভেতরে ঢুকে পড়বেন না। অনেক সময়েই এই মাঠগুলিতে জনসাধারনের প্রবেশাধিকার থাকে না। ঢুকতে হলে মালিকের থেকে অনুমতি নিন। অনুমতি নিন ছবি তোলার আগেও। তবে অনেকগুলি মাঠে ঢোকার প্রবেশদ্বার অবাধ। আপনি চাইলে কিউকেনহফ বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে নদীবক্ষে নৌবিহারের মাধ্যমে বা হেলিকপ্টার পরিষেবার সুজোগও নিতে পারেন এই রংবাহারি বিস্ময়ের আনন্দ নিতে। তবে হেলিকপ্টার পরিষেবাটি খরচসাপেক্ষ।
আমার ব্যাক্তিগত ভাবে মনে হয় যে যদি কিউকেনহফ যান তাহলে অতি অবশ্যই কিউকেনহফের ফুলের বাগান এবং আশে পাশের মাঠ দুটোতেই যাবেন। দু জায়গার সৌন্দর্য দুরকম। দুটোই উপলব্ধি করা উচিত। আর তাছাড়া বাগানের ভেতর আছে বাচ্চাদের জন্য হরেকরকম বিনোদনের ব্যাবস্থা, খাওয়ার জায়গা, নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত “উইন্ডমিল” আর আপনি যদি টিউলিপ ফোটাতে চান নিজের বাগানে, তাহলে সেই বাল্ব ও কিনতে পারবেন এখান থেকে। আর অবশ্যই দেখবেন গ্রীনহাউজ এবং বাগানের বিভিন্ন আনাচে কানাচে অনেক রঙের সংমিস্রনে তৈরি, বা অদ্ভুত অচেনা রঙের ছাচে ফেলা বিভিন্ন প্রজাতির টিউলিপ। বাগানে ছবি তোলার ওপরও কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই মনের খুশিতে আপনি অচিরেই হয়ে উঠতে পারেন কল্পনার অমিতাভ বা রেখা।
আপনার হাতে যদি পুরো একদিন মতো সময় থাকে তাহলে কিউকেনহফের নির্দিষ্ট টিউলিপ ফুলের বাগানটি এবং আশে পাশের মাঠগুলিতে ফুলের মেলা দেখার জন্য তা যথেষ্ট। তবে শনি রবি এবং একদিন যেদিন ওই অঞ্চলে ফ্লাওয়ার প্যারেড নামক এক অনুষ্ঠান থাকে সেদিন বেশী ভিড় হয়। আপনি বাগানে ঢোকার টিকিট ইন্টারনেটের মাধ্যমে আগে কেটে রাখতে পারেন বা ওখানে গিয়েও কাটতে পারেন। আপামর বাঙালি যারা মেট্রো বা বাস ট্রামের লাইনে অভ্যস্ত তাদের কাছে ভিড় এমন কিছু বেশী ঠেকবে না আশা করি। কিউকেনহফ সম্পর্কে আরও জানতে দেখে নিতে পারেন এই ওয়েবসাইটটি – http://www.keukenhof.nl/en/