Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

পুরনো সেই দিনের কথা

গুদিঘাটা স্কুলে মাত্র মাস ছয়েক ক্লাস ফোরে পড়েছিলাম। এর মধ্যে বাবা আবারও মঠবাড়িয়ার থানা সদরে কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি নিলেন। একদিন সন্ধ্যায় বাবা মঠবাড়িয়া থেকে বাড়িতে এসে এ কথা জানালে বড়রা আনন্দের সাগরে ভাসলেন। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম উজ্জ্বল কিছু চোখের দিকে। কিছু বুঝলাম না। না বোঝার মধ্যেও এটুকু শুধু বুঝলাম গ্রাম ছেড়ে আমাদের ‘শহরে’ যেতে হবে। ওখানে দালান-কোঠা আছে, পাকা পায়খানা, ইট বিছানো রাস্তা, রিকশাও নাকি আছে! এতোসব নতুন নতুন জিনিসের কিছুই আমি জানি না, চিনি না! পাকা রাস্তা কি, রিকশা দেখতে কেমন- এসব ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেলাম। রাতে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। তবে মঠবাড়িয়া এর আগেও গিয়েছিলাম একবার। শুধু একদিনের জন্য। আন্তস্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় মেঝো বোন দোদুল অংশ নিয়েছিল গুদিঘাটা স্কুল থেকে। ও তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। নাচসহ আরো দু’টি গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল ও। বাবা দোদুলকে নাচের জন্য সুন্দর একটি ফ্রক তৈরি করে দিয়েছিলেন। সবুজের নীচে তিনটি সাদা দাগ আড়াআাড়িভাবে। চল্লিশ বছর আগের সে জামাটি এখনও আমার স্মৃতিতে অমলিন। প্রতিযোগিতা হয়েছিল মঠবাড়িয়া কমিউনিটি সেন্টারের সামনে, উন্মুক্ত জায়গায়। তখনও পিরোজপুর জেলা হয়নি। বরিশাল জেলার মধ্যে মঠবাড়িয়া থানা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিতে এখনও অদ্বিতীয়। সেদিন মঠবাড়িয়ার সেই অনুষ্ঠানে আমার বোনটি নেচেছিল, গেয়েছিল গুণী গুণী লোকজন আর ওখানকার ওস্তাদের কাছে শেখা অন্য শিল্পীদেও সামনে। অথচ আমার এই বোনটি তিনটি বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। পুরস্কার পেয়েছিল। আমাদের পরিবারে সেই প্রথম প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ। সেদিন দোদুলের জন্য বাবা-মায়ের সেকি আনন্দ, সেকি উল্লাস, সেকি অহংকার! অথচ তার চার বছরের মাথায় দোদুল যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র, তখন আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো। সে ১৯৭৩ সালের কথা! ছেলেবেলায় আমি বাবার সাথে ঘুমাতাম আমাদের বারান্দায় একটি চৌকির ওপর। এ কারণে অন্যান্য ভাইবোনদেন তুলনায় বাবার সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। তখনকার দিনে অনেক ছেলেমেয়েরা বাবাকে ভয় করতো বলেই জানতাম। কিন্তু আমি বাবাকে ছেলেবেলা থেকে কখনোই ভয়ের দৃষ্টিতে দেখিনি। মাঝে মধ্যে স্কুল কামাই করে বাবার হাতে প্রচন্ড মার খেয়েছি বটে। তবে সে জন্য বাবার প্রতি আমার কোন অভিমান বা রাগ ছিল না। যে বিছানায় বাবার সাথে ঘুমাতাম তার দক্ষিণ পাশে একটি জানালা ছিল। তার ওপাশে ছোট্ট একখানি ভিটে, সবজি ফলতো সেখানে। তার পাশেই ছিল গোয়াল ঘর। আমাদের দু’টি বলদ ও একটি গাভি থাকতে সে ঘরে। ছাগলও ছিল কয়েকটি। ওদের জন্য নির্দিষ্ট কোন ঘর থাকতো না। এখানে-সেখানে থাকতো ওরা। মাঝে-মধ্যে খাটাস ওদের ধরে নিয়ে যেতো। গ্রামে থাকতে আমাদের প্রচুর মোরগ-মুরগি আর হাঁস ছিল। চিনে হাঁসও ছিল । ওরা উড়তে পারতো। মাঝেমধ্যে উড়ে চলে যেতো বাড়ির পাশে ধান ক্ষেতে শামুক খাওয়ার জন্য। হাঁসের ছানা দেখতে খুব সুন্দর। ওদের তুলতুলে শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করতে খুব ভালো লাগতো। বর্ষার সময় যখন ধানক্ষেতে অল্প কিছু পানি থাকতো, তখন প্রচুর শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যেতো। আমি সেগুলো নিয়ে আসতাম হাঁসের জন্য। মায়ের বারণ উপেক্ষা করে কেটে দিতাম। শামুকের ছোট ছোট টুকরোগুলো মা হাঁসটি ঠোঁট দিয়ে বাচ্চার সামনে এনে দিতো, নিজে না খেয়ে! আমাদের মুরগীর খোঁয়ারে (বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় ‘খোপ’ বলা হয়) কত যে মুরগী ছিল সে আমার জানা ছিল না। প্রতিদিন সকালে খোপের দরজা খুলে দিলে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসতো হাঁস-মুগরী। ওরা বেরিয়ে গেলে এবার ডিম সংগ্রহের পালা। আমার বড় বোন আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, বলতো ক’টা ডিম আজ পাওয়া যাবে?’ আমি যদি আটটি বলতাম তো দেখা যেতো একটি বেশি। আবার পরের দিন যদি ৯টি বলতাম দেখতাম যে দু’টি কম। হিসাব মেলাতে পারতাম না। কোন কোন মুগরী ডিম দেয়নি, আবার কোন কোনটি নতুন করে ডিম দিতে শুরু করেছে বলে এমন হতো। তাছাড়া ছেলেবেলা থেকেই আমি বেহিসেবী। এখনও আমার মানিব্যাগ থেকে কেউ যদি এক বা পাঁচশ’ টাকার একটি নোট সরিয়ে নিলে আমি ধরতে পারবো না। ফজরের আযান হতো আমাদের দরজার জামে মসজিদে। আমার দাদার চাচাতো ভাই, আমরা যাকে ছোট দাদু বলে ডাকতাম, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত আযান দিতেন মসজিদে। প্রতিদিন ভোর রাতে আযানের সময় আমার ঘুম ভেঙে গেলে বাবার সাথে আমার গল্প জমতো বেশ। এটা কি, ওটা কি- কত প্রশ্ন যে করতাম বাবাকে তার ইয়ত্বা ছিল না। আর প্রতিদিন নতুন একটা কিছু বাবাকে শোনাতে না পারলে স্বস্তি পেতাম না। কী কী শোনতাম তাকে তার দু’একটি কথা আজো মনে আছে। ‘আজ আমাদের বাছুরটা আমার গলা চেটে দিয়েছে,’ ‘একটি ছাগলের বাচ্চাকে বোতলে করে ফ্যান খাইয়েছি,’ ‘বাগানের একটি ঘুঘু পাখির বাসা দেখিছি আজ, নারকেল গাছের কোঠরে টিয়ার বাচ্চা হয়েছে’- ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা কখনো রাগ করতেন না। বাবাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হতো। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন আমি তার সাথে সাথে থাকতাম। মঠবাড়িয়া ব্যাংকে চাকরি নেয়ার পর সকালে উঠে তিনি মঠবাড়িয়া চলে যেতেন, আসতেন সন্ধ্যায়। আমি অপেক্ষা করতাম কখন সন্ধ্যা হবে। তাকিয়ে থাকতাম বাবার পথের দিকে। কোন কিছুই আমার চাওয়ার ছিল না বাবার কাছে। বছরে শুধু একটি আধুলি হলেই চলতো, যখন পৌষ সংক্রান্তিতে আমার গ্রামে মেলা বসতো। বিকালে মেলায় যাওয়ার জন্য সকাল থেকে কি দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটাতাম সে আমিই জানি। মেলার দিন আট আনা পয়সা আমি চাইতে পারতাম না। মায়ের পিছু পিছু থাকতাম, বলতাম, কখন যাবো মেলায়। মা বুঝতেন আমার উত্তেজনার কথা। বলতেন, বিকালে তোর বাবা আট আনা দিলে মেলায় যাবি। খুব খুশি হতাম। বিকালে আমার বড় ভাই মেজবাহ উদ্দিন বাবুল ও আমার ইমিডিয়েট বড় বোন দোদুলের সাথে মেলায় যেতাম। সাথে থাকতো চাচাতো ভাইবোনেরা। গুদিঘাটা আমাদের স্কুলের পাশে মেলা বসতো। মেলায় হাতপাখা থেকে শুরু কওে মাটির পুতুল, বেলুন, বাঁশের বাঁশি উঠতো। মিষ্টি-মন্ডাও ছিল। কোন খাবার কেনায় আমার আগ্রহ ছিল না। প্রথমেই কিনতাম একটি মাটির ঘোড়া, মাটির পাখি, একটি বাঁশের বাঁশি। পয়সায় কুলাতো না বলে হারমোনিয়াম বাঁশি কিনতে পারতাম না। কিছু বলতেও পারতাম না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। বুঝি কষ্টও পেতাম মনে মনে। চলবে

১ Likes ২ Comments ০ Share ৫১৫ Views

Comments (2)

  • - ‍মোঃ মোসাদ্দেক হোসেন

    এই ‍ছড়াটা কোন পত্রিকায় দেখলাম মনে হয়...

    শুভকামনা রইল অবিরাম..

    • - বাসুদেব খাস্তগীর

      কোথায় দেখলেন  জানালে খুশী হবো।কযেকটি পত্রিকায় দিয়েছিলাম।